সোমবার, ১২ আগস্ট, ২০১৩

ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন : গণধোলাইয়ের ভয়ে এলাকায় যান না আ.লীগের এমপিরা


নির্বাচনী আসনকে টাকা গচ্ছিত রাখার বাক্সে পরিণত করায় (দুর্নীতি করায়) গণধোলাইয়ের ভয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সংসদ সদস্য নির্বাচনী এলাকায় যেতে সাহস করেন না বলে মন্তব্য করেছে ব্রিটেনের প্রভাবশালী সংবাদপত্র ‘দ্য ইকোনমিস্ট’।
পত্রিকাটির চলতি সংখ্যায় ‘দ্য ব্যাটলিং বেগমস’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে একথা বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ঈদুল ফিতরের আগে বাংলাদেশের প্রধান দুই কলহমুখর নেত্রী শুভেচ্ছাসূচক ঈদকার্ড বিনিময় করেছেন। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দল বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়ার মধ্যে শান্তির ন্যূনতম আভাস দৃশ্যত নেই বললেই চলে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, একজন ইউরোপীয় কূটনীতিক বলেছেন, তিনি তার (দেশের) রাজধানীতে দুটি তারবার্তা পাঠিয়েছেন। প্রথমটিতে রয়েছে আগামী জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের ক্রমবর্ধমান আশঙ্কার কথা। দ্বিতীয়টিতে রাজত্বের উত্তরাধিকার নির্ধারণ নিয়ে লড়াইরত দুই বেগমের পরিকল্পনার কথা আলোচনা হয়েছে। ইকোনমিস্টের মতে, একটি রাজনৈতিক দল আসন্ন সংসদ নির্বাচনে খুব সম্ভবত অংশ নিতে পারছে না। গঠনতন্ত্রে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপর আল্লাহকে স্থান দেয়ায় গত ১ আগস্ট দেশের বৃহত্তম ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীকে আদালত নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করে।’ প্রতিবেদনে বলা হয়, তবে এরপরও বাংলাদেশের অনেক মানুষের মধ্যে আওয়ামী লীগের পুনর্নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। এ সন্দেহ শুধু এ কারণে নয় যে, বাংলাদেশে একই দলের পরপর দুবার ক্ষমতা গ্রহণের নজির নেই। বরং যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে গিয়ে দলটি বিরোধীদের দারুণ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের প্রতিক্রিয়ায় সেক্যুলারদের সঙ্গে ইসলামপন্থীদের বিরোধ দেখা দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় হেফাজতে ইসলাম দ্বিতীয়বার ঢাকায় সমাবেশ করার সময় তাদের অন্তত ৫০ জন সমর্থক নিরাপত্তাকর্মীদের হাতে নিহত হন।
হেফাজতের তরুণ সদস্যরা গ্রামে ফিরে গিয়ে প্রচার চালান, ঢাকায় তাদের হাজার হাজার কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। সারাদেশে সরকারের জনপ্রিয়তার ওপর এর ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়ে। এর সুফল যায় বিএনপির ঘরে। গত জুন ও জুলাইয়ে অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হয়। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে সুরক্ষিত নির্বাচনী এলাকা গাজীপুরেও আওয়ামী লীগ হেরে যায়।
এতে বলা হয়, জনপ্রিয়তা উদ্ধারে শেষ রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে ফেরত যাওয়ার আগে জুলাইয়ে তিন সপ্তাহের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদকে ‘প্রদর্শন’ করে আওয়ামী লীগ।
জয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানকে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, যদিও তারেক এখন দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের জন্য বিচারাধীন, তবু সজীবকে মোকাবিলায় তিনি যে কোনো সময় লন্ডন থেকে বাংলাদেশে উড়ে আসতে পারেন। দুর্বল স্বাস্থ্যের কারণে খালেদা জিয়া তার হাতে দায়িত্ব তুলে দিতে আগ্রহী।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আওয়ামী লীগ সরকার যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে একমত না হয় এবং এরপরও তারেক যদি বাংলাদেশে ফিরে আসেন, তবে হয়তো তাকে সরাসরি কারাগারে যেতে হবে। ইকোনমিস্ট বলছে, সামনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মরিয়া হয়ে লড়বে।
এতে বলা হয়, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে হেরে গেলে বিএনপি তার ‘নিগৃহীত’ উত্তরাধিকার ও মিত্র জামায়াতকে পুনর্বাসিত করবে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘বাংলাদেশে এটা এক অপরিবর্তনীয় ঐতিহ্য যে, যখন কোনো দল ক্ষমতায় যায় সে বিরোধীদের যে কোনো দাবি-দাওয়াকে ভিত্তিহীন প্রতিপন্ন করে।’
জামায়াতের নিবন্ধন নিয়ে সুপ্রিমকোর্টের ভিন্ন রায়ের সম্ভাবনা কম : অপর এক প্রতিবেদনে ইকোনমিস্ট বলেছে, জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছে, সুপ্রিমকোর্টও সেই রায়ই বহাল রাখতে পারে।
বুধবার অনলাইন সংস্করণে ‘বাংলাদেশ’স পলিটিক্স : ডিসপেনস্যাবল অ্যালাইস’ শিরোনামে প্রকাশিত নিবন্ধে আরো বলা হয়, আওয়ামী লীগ জামায়াত নিষিদ্ধের কথা বলে যে শোরগোল তুলছে তা অন্তঃসারশূন্য। যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এলেও শেখ হাসিনা চাইবেন ফাঁসির রায় যতটা কম কার্যকর করা যায়।
ইকোনমিস্টের নিবন্ধে বলা হয়, ২০১১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের পরে যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থী বুদ্ধিজীবীরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, এখন ছোট দল হলেও জামায়াত একদিন বাংলাদেশের সেক্যুলার ট্রেডিশন ধ্বংস করে দিয়ে ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে। তবে বিপ্লবের মাধ্যমে নয়, সেটা তারা করবে ব্যালটের মাধ্যমে।
আগে এটাকে কিছুটা অদ্ভূত মনে হলেও গত সপ্তাহে এটাকে একেবারেই অর্থহীন মনে হয়েছে। ঢাকার হাইকোর্ট বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল এবং বৃহত্তম ইসলামপন্থী দল জামায়াতে ইসলামীকে আগামী নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করেছে। রায়টি স্থগিত চেয়ে সুপ্রিমকোর্টে করা আবেদন ৫ আগস্ট খারিজ করে দেয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশন বলছে, জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করা হবে।
এই আইনি লড়াইয়ের পরিণতি হলো সুপ্রিমকোর্ট ভিন্ন কোনো অবস্থান না নিলে বাংলাদেশে তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দলটি আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। তবে সুপ্রিমকোর্টের ভিন্ন অবস্থান নেয়ার সম্ভাবনা কম। অন্য একটি উপায় হচ্ছে জামায়াতের গঠনতন্ত্রের মৌলিক পরিবর্তন, সেটাও প্রায় অসম্ভব।
রায়টি যদি বহাল থাকে তবে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি তার দীর্ঘদিনের মিত্রকে হারাল। বিএনপির জন্য এটা বড় ইস্যু। গত কয়েক বছরে ধরে এমন ধারণা তৈরি হয়েছে যে, বিএনপি-জামায়াতের ঐক্য অপরিহার্য।
তবে বিএনপি জানে এখন সময় তাদের। পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তাদের প্রার্থীরা চরমভাবে ভালো করেছে। বাংলাদেশে কোনো দলই পরপর দুই মেয়াদে সরকার গঠন করতে পারেনি। এ অবস্থায় জামায়াতের সঙ্গে জোট তাদের আরো বাড়তি সুবিধা দেবে।
নিবন্ধে বলা হয়, ২০১১ সালে সংবিধান সংশোধনের পর থেকেই আওয়ামী লীগ জামায়াত নিষিদ্ধের কথা বলে শোরগোল তুলছে। তবে এই হুমকি অন্তঃসারশূন্য। সহিংস প্রতিরোধের আশঙ্কা রয়েছে সরকারের। তাছাড়া সরকার ভালো করেই জানে যে সৌদি আরবের সমর্থনপুষ্ট তার রাজনৈতিক শত্রুকে আন্ডারগ্রাউন্ডে পাঠানো যাবে না।
এদিকে জনঅসন্তোষ দমন করতে হিমশিম খাচ্ছে আওয়ামী লীগ। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, শুধু গত ফেব্রুয়ারি থেকেই অন্তত ১৫০ জন বিক্ষোভকারীকে হত্যা এবং ২ হাজার জনকে আহত করেছে নিরাপত্তা বাহিনী।
গত সপ্তাহান্তে আওয়ামী লীগ কূটনীতিক এবং দাতাদের আশ্বস্ত করতে চেষ্টা করেছে যে তারা কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করতে চায় না।
নিবন্ধে বলা হয়, যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় এবং আপিল নিয়ে সামনের মাসগুলোতে লড়াই আরো তীব্র হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠজনরা বলছেন, যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এলেও এখন তিনি চাইবেন ফাঁসির রায় যতটা কম কার্যকর করা যায়।
১৯৯১ সালের পর থেকে আগামী নির্বাচনে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া ষষ্ঠবারের মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। এই প্রথম এই নির্বাচনে খ্যাতনামা ইসলামপন্থী রাজনীতিকদের কোনো ভূমিকা থাকবে না। নির্বাচনের আগে বড় বড় রাজনীতিকরা মহান সুফি সাধক হজরত শাহজালালের (রা.) মাজার জিয়ারত করবেন, যে কাজটি জামায়াত করত না।
ভারত চাইবে শেখ হাসিনা আগেকার নজির (পরপর দুবার ক্ষমতায় না আসা) উপেক্ষা করে পুনর্নির্বাচিত হোক। নির্বাচিত হলে তিনি হবেন এশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘকালীন প্রধানমন্ত্রী। হাসিনা হেরে গেলে এই রেকর্ডটি অর্জন করবেন খালেদা জিয়া।
আশার কথা হলো, শেখ হাসিনা যদি পরাজিত হন তাহলে পেন্ডুলাম ঘুরে যাবে। ক্ষমতায় গিয়ে বিএনপি তার অপদস্থ মিত্রকে পুনর্বাসিত করবে এবং যুদ্ধাপরাধের রায় বাতিল করবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন