বুধবার, ১২ জুন, ২০১৩

শাপলা অভিযানে নিহত ২০২


রাজধানীর শাপলা চত্বরে যৌথবাহিনীর অভিযানে হেফাজতে ইসলামের ২০২ কর্মী নিহত হয়েছেন। এখনও নিখোঁজ রয়েছেন ২৫০০ জন। গতকাল মানবাধিকার সংগঠন অধিকার-এর এক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। অধিকার জানায়, সরকার প্রথমে কেউই হতাহত হয়নি বলে দাবি করেছিল। কিন্তু সোস্যাল মিডিয়ায় সেদিন রাতের অভিযানের ছবি ও নির্বিচারে মানুষ হত্যার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ায় সরকার সে দাবি থেকে সরে আসে। সারা দিন বিভিন্ন পর্যায়ের সংঘাতে তিন পথচারী, একজন পুলিশ সদস্যসহ মোট ১১ জন নিহত হওয়ার কথা জানায়। তবে হেফাজতে ইসলামী বাংলাদেশের এক নেতা অধিকারকে জানান, এ পর্যন্ত ২০২ জনের মৃত্যুর খবর তাঁরা পেয়েছেন এবং প্রায় ২৫০০ জন নিখোঁজ রয়েছেন। তবে এ ব্যাপারে চলমান অনুসন্ধানের একটি প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে অধিকার নিহত ৬১ জনের নাম সংগ্রহ করেছে। আল-জাজিরা টেলিভিশন চ্যানেল ৫০ জন নিহত হওয়ার কথা জানিয়েছে। অধিকার-এর তথ্যমতে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে যৌথবাহিনীর হামলায় আহত অনেকে ঢাকার হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আবার অনেকে ঢাকায় শুধুমাত্র প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে তাঁদের নিজ নিজ এলাকায় চলে গেছেন। তাঁদের মধ্যে এখন পর্যন্ত গুরুতর আহত ৫ জন বিভিন্ন হাসপাতালে মারা গেছেন বলেও জানা গেছে। হেফাজতে ইসলামের এই সমাবেশে যোগ দিয়েছিল অনেক শিশু-কিশোর। প্রায় প্রত্যেক শিশুই ছিল কওমি মাদ্রাসার ছাত্র। তারা সাধারণত খেটে খাওয়া গ্রামবাংলার অসহায় দরিদ্র মানুষের সন্তান। এই শিশুদের মধ্যে অনেকেই এতিম। যারা রাষ্ট্রের কাছ থেকে প্রাপ্য সুযোগ সুবিধা থেকেও বঞ্চিত। গত ৬ই মে অন্ধকারে যৌথবাহিনীর হামলা থেকে বাদ পড়েনি ওই শিশুরাও। বিশেষ করে এতিম শিশুদের মধ্যে থেকে যারা নিখোঁজ রয়েছে, কেউ তাদের সন্ধান না করায় তাদের নিখোঁজ কিংবা হতাহতের সংখ্যা অন্ধকারেই থেকে যাচ্ছে। সেই রাতে কত লাশ কিভাবে কোথায় সরানো হয়েছে এবং নিহতদের সঠিক সংখ্যা কত তা এই মুহূর্তে যাচাই করা কঠিন হলেও মানবাধিকারের দিক থেকে এই কাজটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অধিকার আরও জানায়, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ-এর সর্বশেষ কর্মসূচি ছিল গত ৫ই মে রাজধানী ঢাকা ঘেরাও বা অবরোধ। কর্মসূচি মোতাবেক ৪ঠা মে  থেকেই দেশের বিভিন্ন কর্মীরা ঢাকায় চলে আসতে শুরু করেন। ঘোষণা অনুযায়ী ৫ই মে  ভোর থেকে তারা ঢাকায় প্রবেশ করার ৬টি রুটে অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন। দুপুরের পর হেফাজতে ইসলাম এর কর্মীরা তাঁদের অবরোধ কর্মসূচি গুটিয়ে রাজধানী ঢাকায় বায়তুল মোকাররমে আল্লামা আহমদ শফীর নেতৃত্বে ‘দোয়া কর্মসূচি’ পালন করার জন্য ঢাকায় প্রবেশ করতে শুরু করেন। তাঁদেরকে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)-এর পক্ষ থেকে দুপুর আনুমানিক ৩টায় মতিঝিলের শাপলা চত্বরে দুপুর ৩টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সমাবেশ করার অনুমতি দেয়া হয়। মতিঝিলের শাপলা চত্বরে আসার পথে পথে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের সশস্ত্র সমর্থকদের হাতে হেফাজত কর্মীরা আক্রান্ত হন। বিশেষ করে গুলিস্তান হয়ে আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে দিয়ে শাপলা চত্বরে আসার সময় আওয়ামী কর্মী ও সমর্থকরা হেফাজত কর্মীদের ওপর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে সশস্ত্র হামলা চালায়। এই সময় পুলিশ সরকারী দল সমর্থক সশস্ত্র ব্যক্তিদের সহায়তা করে। সেদিন পুলিশের গুলি ও সরকার সমর্থকদের হামলায় কয়েক শ’ হেফাজত কর্মী আহত এবং ৩ ব্যক্তি নিহত হন। হেফাজত কর্মীরা ইট-পাটকেল ছুড়ে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেন। এরপর দুপুর আনুমানিক ৩টা থেকে তারা সমাবেশ শুরু করেন এবং পর্যায়ক্রমে সেখানে অবস্থানকারী নেতারা সরকারের কাছে তাঁদের দাবি-দাওয়া এবং সেই সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে বক্তব্য দিতে থাকেন। এইভাবে চলতে থাকে তাঁদের এই সমাবেশ। বাংলাদেশসহ আর্ন্তজাতিক মিডিয়াগুলোতে কয়েক লাখ লোকের এই সমাবেশের খবর প্রচারিত হয়। কিন্তু এর মধ্যে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সাধারণ সমপাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম একটি সাংবাদিক সম্মেলন করে হেফাজতে ইসলামকে সমাবেশ ভেঙে ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য হুমকি দেন। এই সময়, বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি জানানোর নাগরিক অধিকারের প্রতি সমর্থন জানায়। হেফাজতের শান্তিপূর্ণ অবরোধ ও ঢাকা প্রবেশের সময় পথে পথে তাঁদের নেতা কর্মীদের ওপর আওয়ামী লীগের সশস্ত্র সমর্থকদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর হামলা ও অনেক মানুষ আহত ও ৩ জন নিহত হওয়ার পর হেফাজত আরও অনড় অবস্থানে চলে যায়। হেফাজতের নেতা কর্মীরা বলতে থাকেন তাঁদের নেতা আল্লামা শফী মতিঝিল শাপলা চত্বরে এসে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত তাঁরা সেখানে অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাবেন। সন্ধ্যার পরও হেফাজতের নেতারা সমাবেশে বক্তৃতা করছিলেন। তবে রাত আনুমানিক ৮ টায় এশার নামাযের আগে এই বক্তৃতা থেমে যায়। এরপর রাত আনুমানিক সাড়ে  ৮টায় পুলিশের সঙ্গে হেফাজত কর্মীদের মতিঝিল থানা ও এর আশপাশে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়। একপর্যায়ে পুলিশ হেফাজত কর্মীদের
লক্ষ্য করে গুলি চালায়। একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা মতে তখন পুলিশের গুলিতে ৭ জন হেফাজত কর্মী নিহত হন। হেফাজতের নেতারা তখন মাইকে পুলিশকে গুলি না করার জন্য অনুরোধ করতে থাকেন। রাত আনুমানিক ১১.০০ টায় শাপলা চত্বরের পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসে। রাতের গভীরতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হেফাজতের কর্মীরা যে যেখানে ছিলেন সেখানেই রাস্তার মাঝে বসে পড়েন, অনেক হেফাজত কর্মী গায়ের পাঞ্জাবি খুলে অথবা সঙ্গে থাকা ব্যাগ কিংবা জুতা কাপড়ে পেঁচিয়ে মাথার নিচে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। আবার অনেকেই সেখানে বসে জিকির করতে থাকেন।
এদিকে পুলিশ, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব), আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনীর সদস্যরা ৩টি দলে বিভক্ত হয়ে সেখানে হামলার পরিকল্পনা করে। যৌথবাহিনীর সদস্যরা পরিকল্পিতভাবে রামকৃষ্ণ মিশন (আর কে মিশন) রোডটি বাদ দিয়ে দৈনিক বাংলা মোড় থেকে ১টি, ফকিরাপুল মোড় থেকে ১টি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতর থেকে বের হয়ে মূল মঞ্চের দিকে ১টি- এই মোট ৩টি দলে ভাগ হয়ে একযোগে শাপলা চত্বরে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এরপরই শুরু করে টিয়ারগ্যাস, গুলি, সাউন্ডগ্রেনেডসহ বিরতিহীন আক্রমণ। আর কে মিশন রোডটি দিয়ে অভিযান না চালানোর উদ্দেশ্য ছিল, যাতে আহত বা বেঁচে যাওয়া হেফাজত কর্মীরা ওই পথ দিয়ে পালিয়ে রাজধানীর বাইরে চলে যেতে পারে। ৬ই মে রাত আনুমানিক ১২.৩০ টায় মতিঝিলের প্রতিটি রাস্তার বৈদ্যুতিক সংযোগ বন্ধ করে দিয়ে চারদিক অন্ধকার করে দেয়া হয় এবং এই সময় সমাবেশ করার জন্য ব্যবহৃত মাইকের সংযোগও কেটে দেয়া হয়। যৌথবাহিনীর প্রায় ১০ হাজার সদস্য সশস্ত্র অবস্থায় রাত আনুমানিক ২.১৫টায় হেফাজত কর্মীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং শাপলা চত্বর ও এর আশে পাশে থাকা নিরস্ত্র ও ঘুমন্ত হেফাজত কর্মীদের ওপর নির্বিচারে গরম পানি, টিয়ারসেল, কাঁদানে গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড এবং গুলি ছুড়তে থাকে। যৌথবাহিনী রাতের এই অপারেশনের তিনটি সাংকেতিক নাম দেয়। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয় ‘অপারেশন শাপলা’, র‌্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয় ‘অপারেশন ফ্ল্যাশ আউট’ এবং বিজিবির পক্ষ থেকে বলা হয় ‘অপারেশন ক্যাপচার শাপলা’।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন