বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১৩

মুজিবনগরের বাখানি


কম্যুনিস্টদের কাছে ইসলাম হলো একটা প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মবিশ্বাস। কেবল ইসলাম নয়, এদের চিন্তাগুরু লেনিন বলেছেন, ধর্ম হলো আফিমের নেশার মতো। যা ইহকাল ছেড়ে মানুষকে করে তুলতে চায় পরকালবাদী। করে তোলে বিপ্লববিরোধী। কিন্তু এখন খোদ লেনিনের দেশে ধর্ম চেতনা পুনঃআবির্ভাব ঘটতে দেখা যাচ্ছে। কম্যুনিস্টরা পারছে না এর ব্যাখ্যা দিতে। ১৯১৭ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্ষন্ত রাশিয়ায় কম্যুনিস্টরা ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু তারা বস্তুবাদী (Materialism) না হয়ে কেন আবার ধর্মীয় আবেগকে আঁকড়ে ধরতে চাচ্ছে, সেটার ব্যাখ্যা দিতে পারছে না বিশ্বজুড়ে কম্যুনিস্টরা।
আশ্চর্যজনক হলেও এই কম্যুনিস্টরা দিচ্ছে এখন আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব। আওয়ামী লীগের পুরনো নেতারা এখন আর কেউ ক্ষমতায় নেই। তোফায়েল আহমেদের মতো নেতাকে আওয়ামী লীগ এখন আর যেন চাচ্ছে না কোনো প্রকার স্বীকৃতি দিতে। অথচ ১৯৬০-এর দশকে শেখ মুজিবের নামের সাথে ‘বঙ্গবন্ধু’ বিশেষণটি যোগ করে দিয়েছিলেন তোফায়েল আহমেদ। তিনি রাজনীতি করা নেতা। যেমন ছিলেন মরহুম রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। তোফায়েল আহমেদকে যদি আওয়ামী লীগ জিল্লুর রহমানের মতোই মূল্যায়ন করত, তবে সেটা মনে হয় খুবই সমীচীন হতো। আমরা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট নই। রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ কী করবে সেটা তারই বিবেচ্য। মানুষ চাচ্ছে কর্মসংস্থান। মানুষ চাচ্ছে থাকার জন্য বাসস্থান। মানুষ চাচ্ছে আবর্জনামুক্ত পরিবেশে বাস করতে। কিন্তু আওয়ামী লীগ যেন চাচ্ছে কেবলই ১৯৭১-এর কথা বলে রাজনীতি করতে। ১৯৭১-এর যুদ্ধের ছিল দু’টি রূপ। বাংলাদেশের মানুষের কাছে সাধারণভাবে যা প্রতিভাত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে। ভারতের কাছে তা ছিল সাবেক পাকিস্তান ভেঙে দেয়ার এবং তাকে ভেঙে দিয়ে শেষ পর্যন্ত অখণ্ড ভারত প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ হিসেবে। আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, একাত্তরের যুদ্ধে এ দেশের মানুষ জয়ী হয়েছে। কিন্তু তারা বলছেন না, ভারত এ দেশে সৈন্য পাঠিয়েছিল আর তাই যুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল পাক-ভারত যুদ্ধ।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আমাদের মুক্তিবাহিনীর সেনানায়ক আতাউল গনি ওসমানীর কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। করেছিল ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় সেনাপ্রধান জগজিৎ সিং অরোরার কাছে। বন্দী পাক সেনাদের নিয়ে যাওয়া হয় ভারতে। শেষে তাদের সবাইকে ছেড়ে দেয়া হয় সিমলা চুক্তি অনুসারে। সিমলা চুক্তি হয়েছিল ১৯৭২ সালের ৩ জুলাই পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে। এতে বাংলাদেশের কোনো প্রতিনিধি ছিল না। বাংলাদেশকে দেয়া হয়নি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম শরিক হিসেবে কোনো মর্যাদা। বাংলাদেশ সরকার করেনি সিমলা চুক্তির কোনো প্রতিবাদ। পাক বাহিনীর যে ১৯৫ জনকে বাংলাদেশ সরকার চেয়েছিল যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচার করতে, যায়নি তাদের বিচার করা। আজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে তাতে কেবল বিচার করা হচ্ছে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের। যারা চাননি সাবেক পাকিস্তান ভেঙে যাক। আর তাই সহযোগিতা করেছিলেন তদানীন্তন পাকিস্তান সরকারের সাথে। যারা খুন করে তারা খুনি। খুনিদের যারা সহযোগিতা করে, তাদেরও বিচার হতে পারে। কিন্তু মূল খুনিদের ছেড়ে দিয়ে তাদের সহযোগীদের বিচার আইনসম্মত হয় না। অথচ পাক সেনাবাহিনীর যুদ্বধাপরাধীদের ছেড়ে দিয়ে এখন কেবলই করা হচ্ছে জামায়াতে ইসলামী দলের নেতাদের বিচার।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৯৭১ সালে চীনপন্থী কম্যুনিস্টরাও চায়নি সাবেক পাকিস্তান ভেঙে যাক। তারাও করেছিল সাবেক পাকিস্তানের সামরিক জান্তার সহযোগিতা। জামায়াতের চেয়ে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে চীনপন্থী কম্যুনিস্টদের ক্ষমতা ছিল অনেক বেশি। কিন্তু এদের কারো বিচারের প্রশ্ন তোলা হচ্ছে না। তোলা হচ্ছে না আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। কেবলই করা হচ্ছে জামায়াত নেতাদের বিচার। কিন্তু জামায়াতে ইসলামীকে আওয়ামী লীগ যতটা শিকড়বিহীন মনে করেছিল, বাস্তবে দলটি তা নয়। জামায়াতের বিচার করতে যেয়ে আওয়ামী লীগ দেশকে এনে ফেলেছে আর একটি গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে। আওয়ামী লীগ ইসলাম ও তথাকথিত সাম্প্রদায়িকতাকে ভাবছে সমার্থক। কিন্তু এ দেশে ইসলাম অনেকের কাছে প্রতিভাত হচ্ছে রাজনৈতিক আদর্শবাদ হিসেবে। ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম হওয়া মানেই দেশ পিছিয়ে দেয়া নয়। আমাদের বাড়ির কাছে মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রধর্ম হলো ইসলাম। কিন্তু মালয়েশিয়া হয়ে উঠেছে একটি খুবই উন্নতগামী দেশ। বাংলাদেশে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হলেই দেশটি পিছিয়ে পড়বে এ রকম কল্পনা যুক্তিযুক্ত নয়। ইউরোপে বহু দেশ আছে, যাদের আছে রাষ্ট্রধার্ম। যেমন ইংল্যান্ডের রাষ্ট্রধর্ম হলো অ্যাংলিকান খ্রিষ্টধর্ম। সুইডেনের রাষ্ট্রধর্ম হলো লুথেরান খ্রিষ্টধর্ম। কিন্তু এই দু’টি দেশ তা বলে ধর্মান্ধ হয়ে পড়েছে এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে হয়ে পড়েছে অনগ্রসর, এ রকম সিদ্ধান্ত করা চলে না। ইসলাম না থাকলে আজকের বাংলাদেশ হতো না। আজকের বাংলাদেশ হতো ভারতেরই অংশ। বাংলা ভাষা হতো না কোনো রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা। এটাকে ধরে নেয়া যায় স্বতঃসিদ্ধভাবে।
আমরা আলোচনা করছিলাম, মুজিবনগরের ঘোষণাপত্র নিয়ে। সেখানে বলা হয়নি কোনো ইসলামবিরোধী কথা। আসলে ওই ঘোষণাপত্রে ধর্ম সম্পর্কে বলা হয়নি কিছুই। অথচ আমাদের ঘাদানিকের বুদ্ধিজীবীরা বলছেন, বাংলাদেশের মানুষ ১৯৭১-এ যুদ্ধ করেছিল ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্যে। আমরা মুজিবনগরের ঘোষণাপত্রের দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিয়েছি। পাঠক এই উদ্ধৃতি থেকে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। এই ঘোষণা পত্রের মর্মবাণী কী ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কোনো বাড়িঘর ছিল না মুজিবনগরে। মুজিবনগর সরকারের অবস্থান ছিল কলকাতা শহরে। যদিও মুজিবনগর বথাটা উল্লেখ করা হতো রাজনৈতিক কারণে। মুজিবনগর সরকারকে কোনো দেশই স্বীকৃতি দিয়েছিল না। যত দূর মনে পড়ে, একমাত্র ভুটান প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। ভুটান জাতিসঙ্ঘের সদস্য হলেও তার তেমন কোনো রাষ্ট্রিক মর্যাদা ছিল না।
প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিতে চেয়েছিল ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল। ইসরাইল অস্ত্র ও অর্থ দিতে চেয়েছিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে সাহায্য করতে। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী করেছিলেন এর ঘোর বিরোধিতা। তাজউদ্দীন সরকারের পক্ষে তাই সেভাবে গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি ইহুদি সহায়তা। অনেকেই এ ঘটনা সম্পর্কে অবগত নন। মুজিবনগরের ঘোষণাপত্রে শেখ মুজিবকে প্রেসিডেন্ট বলে ঘোষণা করা হয়। ইন্দিরা গান্ধী তাজউদ্দীনকে বলেন, শেখ মুজিবকে নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি না করতে। কারণ শেখ মুজিব ভারতে আসেননি, তিনি আছেন পাকিস্তানে। তিনি শেষ পর্যন্ত কী নীতি গ্রহণ করবেন তা অনুমান করা সম্ভব হচ্ছে না। এ ছাড়া পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবকে মেরে ফেলে তার সব দায় দায়িত্ব চাপিয়ে দিতে পারে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারেরই ওপর। কারণ, মুজিবনগরের ঘোষণপত্র পড়ে মনে হতে পারে শেখ মুজিব আছেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারেরই সাথে। যেটা ঘটনা নয়। ইন্দিরা গান্ধী নানাভাবেই নির্ধারিত করেছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কাজকর্ম। যেটা এখন বলা হচ্ছে না।
আমি ১৯৭১ সালে কলকাতায় ঢাকা থেকে আগত এক সাংবাদিকের কাছে শুনেছিলাম, শেখ মুজিব ২৫ মার্চ রাত ১০টা নাগাদ কারো কাছ থেকে একটি টেলিফোন পান। তিনি এই টেলিফোন পাওয়ার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন স্বেচ্ছায় পাক বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের। আত্মসমর্পণের পর রাত ১১টা ৪৫ মিনিট নাগাদ পাক বাহিনী ঢাকার রাজপথে নেমে শুরু করে গুলি ছোড়া। তার আগে নয়। আমি অবশ্য পাক বাহিনীর ঢাকার রাস্তায় নামার কথা শুনেছিলাম বেশ কিছুটা আগে। রাজশাহীর খ্যাতনামা ন্যাপ নেতা (মোজাফ্ফর) আতাউর রহমান আমাকে বিকেল ৩টার সময় ডেকে বলেন, পাক সেনা রাস্তায় নামতে যাচ্ছে। সাবধানে চলাফেরা করবে। আমি ঢাকার পরিস্থিতি জানার জন্য আমার ভাইকে টেলিফোন করতে যাই। কিন্তু তা করতে পারি না। ঢাকার সব টেলিযোগাযোগ করে দেয়া হয়েছিল বিচ্ছিন্ন।
সন্ধ্যা নাগাদ যথারীতি রাজশাহী ভুবনমোহন পার্কে বসেছিল গণসঙ্গীতের আসর। আমি সেখানে যেয়ে পাক বাহিনী নামার কথা বলি। কিন্তু গণসঙ্গীতের দল আমার কথা হেসে উড়িয়ে দেয়। আমি বাসায় ফিরে কলকাতায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকি। আমি কলকাতায় ছিলাম ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাস থেকে ১৯৭২ সালের মার্চ মাসের প্রারম্ভ পর্যন্ত। শেখ মুজিব ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তান থেকে যান লন্ডনে। তিনি পাকিস্তান থেকে সরাসরি ভারতে না এসে লন্ডনে যাওয়ার জন্য ভারতের পত্রপত্রিকায় ওঠে সমালোচনার ঝড়। কলকাতায় গুজব ওঠে শেখ মুজিব নাকি পাকিস্তানের সাথে এমন একটি বিশেষ চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছেন, যা ভারতের স্বার্থের অনুকূল নয়। শেখ মুজিব পাকিস্তানের সাথে রাখতে চাচ্ছেন যৌথ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। শেখ মুজিব লন্ডন থেকে দিল্লি হয়ে ঢাকায় ফেরেন ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। তিনি ১২ জানুয়ারি তাজউদ্দীনের কাছ থেকে গ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রিত্বের ভার। শুরু হয়, মুজিব ও তাজউদ্দীনের মধ্যে নীতিগত ও ব্যক্তিত্বের বিরোধ। ১৯৭৪ সালে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েন তাজউদ্দীন। ছেদ পড়ে, মুজিবনগর তথা কলকাতা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বাখানি আবৃত্তির।  (সমাপ্ত)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন