রবিবার, ১০ মার্চ, ২০১৩

শেখ হাসিনার নাম হবে ‘কারজাই’


দৈনিক সমকাল ঘোর আওয়ামীপন্থী পত্রিকা হিশাবে পরিচিত। গত আটই মার্চে দেখলাম তারা আট কলামে বড় লাল অরে প্রথম পাতায় শিরোনাম করেছে ‘মহাসংকটে দেশ’। বোঝা যাচ্ছে এটা আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের কোন একটি অংশের উপলব্ধি। ঘটনা ঘটছে দ্রুত। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী ও শক্তি এই পরিবর্তনশীল ঘটনার মধ্যে কখন কী উদ্দেশ্যে কী অবস্থান গ্রহণ করছে, সেটা এই ধরণের খবর দেখে আন্দাজ করা যায়। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর যে অংশ চতুর্দিকে পরিস্থিতি দেখে আতংকিত হয়ে পড়েছে এবং অশান্তি, সহিংসতা, বল প্রয়োগ ইত্যাদিকে নৈতিক জায়গা থেকে নিন্দা করে ভেবেছিল প্রলয় বন্ধ থাকবে, তারা এখন প্রকাশ্যে তাদের আতংক ব্যক্ত করছে। ইন্টারেস্টিং।
এই আতংকিত মধ্যবিত্তের পে সম্ভাব্য রাজনৈতিক পদপে কী হতে পারে তারও প্রস্তাব আছে পত্রিকাটিতে। সেটা হচ্ছে, বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপ। প্রস্তাবটি আসছে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের প থেকে। খবরের দিক থেকে দেখলে খুবই গুরুত্বপূর্ণ খবর। বলা বাহুল্য, সমকালও একে যথাযোগ্য গুরুত্ব দিয়েছে। তিন কলামে পত্রিকার ডান দিকে ছেপেছে। তবে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আতংক আরো সঠিক ভাবে ধারণ করেছে ইংরেজি পত্রিকা নিউ এইজ। তারা সৈয়দ আশরাফের এই খবরকে প্রধান সংবাদ বানিয়ে চার কলামে পরিবেশন করেছে : Ashraf offers talk with BNP |  ‘আশরাফ বিএনপির সঙ্গে কথা বলার প্রস্তাব দিয়েছেন’। এর আগে তিনি বলেছিলেন, ‘দেশে গৃহযুদ্ধ ও এক-এগারো সৃষ্টি করতে দেবে না আওয়ামী লীগ’ (দেখুন প্রথম আলো ৭ মার্চ ২০১৩)। সৈয়দ আশরাফ ধরে নিয়েছেন দেশে বিএনপি ও জামায়াত-শিবির গৃহযুদ্ধ লাগাবার চেষ্টা করছে সেনাবাহিনীকে মতায় আনার জন্য। দেশে যে আসলে গৃহযুদ্ধ লেগে গিয়েছে এবং তার জন্য মতাসীন আওয়ামী লীগই মূলত দায়ী, এই উপলব্ধি তিনি করলেও প্রকাশ্যে তাঁর পে সেটা বলা কঠিন।
গৃহযুদ্ধের সমস্ত লণ যতই স্পষ্ট হচ্ছে এবং এর কারণ অনুসন্ধান চলছে, ততই দেশের ভেতরে ও
আন্তর্জাতিক ভাবে এই সংঘাতে দুই পরে ভূমিকাও ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আওয়ামী লীগ একতরফা তার রাজনৈতিক প্রতিপরে বিরুদ্ধে যে প্রচার চালাচ্ছিল, তা গ্রহণযোগ্য হয় নি। জামায়াত শিবির যুদ্ধাপরাধী ও একাত্তরে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করলেও ঘটনার জন্য একতরফা তাদের কেউ নিন্দা করে নি। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন মার্চের ২ তারিখে যে বক্তব্য দিয়েছে সেখানে রাজনৈতিক সহিংসতার নিন্দা করা হয়েছে কিন্তু কোন প নেওয়া হয় নি। বলা হয়েছে, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায়ের ব্যাপারে দুই পইে ‘গণসংবেদনার তীব্রতা’ (strength of public sentiment) রয়েছে তারা সে সম্পর্কে অবহিত। তার পরেও সব পকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন অবিলম্বে সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শন ও রাজনৈতিক সহিংসতা বন্ধের তাগিদ দিয়েছে। তাদের বক্তব্যের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক হচ্ছে তারা মনে করে বাংলাদেশ আসলে দুটো সমাজে ভাগ হয়ে আছে। যে বিভাজন সাম্প্রতিক ঘটনার মধ্য দিয়ে সবার সামনে উদোম হয়ে দুষ্ট তের মতো বেরিয়ে পড়েছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন চাইছে যেন এই ত আর না বাড়ে এবং তার জন্য সব প তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করুক। (দেখুন, http://www.consilium.europa.eu/ uedocs/cms_data/docs/pressdata/EN/ foraff/135786.pdf)।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বক্তব্যে কূটনৈতিক সংযম থাকলেও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো দুই পকে সমান ভাবে নিন্দা করছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মার্চের ১ তারিখে বলেছে, অধিকাংশ মৃত্যু হয়েছে পুলিশের গুলিতে (…security forces using live ammunition against Jamaat protesters). এই প্রসঙ্গে তারা আন্তর্জাতিক বিধিবিধানের প্রসঙ্গ এনেছে এবং দাবি করেছে পুলিশ যেন আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের েেত্র জাতিসংঘের বিধিবিধান মেনে চলে। সেটা হচ্ছে,আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার ও বলপ্রয়োগের েেত্র জাতিসংঘের মৌলিক নীতিমালা (United Nations Basic Principles on the Use of Force and Firearms)। কারণ পুলিশ ইতোমধ্যেই সেই বিধান লংঘন করেছে।
এখন যারা বক্তব্য দিচ্ছেন তাদের অবস্থান আরো স্পষ্ট। এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কাউন্সিল মার্চের ৭ তারিখে দেওয়া তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশের গৃহযুদ্ধের জন্য মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালই দায়ী (Shoddy Tribunal has pushed the country to the verge of a civil war)। ইংরাজি ‘শডি’ কথাটার নানান বাংলা হতে পারে। যেমন, অগোছালো, বেপরোয়া, নির্দয়, অবিবেচক, নিম্ন মানসম্পন্ন, খেলো এমনকি পচা। তারা দেখিয়েছে, ফৌজদারি অপরাধ বিচারের ন্যূনতম মানদণ্ডকেও এই আদালত অস্বীকার করেছে। সাীদের আদালতে হাজির না করেও তাদের কথিত স্টেটমেন্ট স্যা হিশাবে আমলে নিয়ে এমন এক নজিরবিহীন বিচারের নমুনা দেখিয়েছে, যাকে বলা যায় ‘ফেইসলেস’ ব্যাপার। চেহারাহীন বিচার।
মানবাধিকার সংগঠনটি বলছে, “ ট্রাইব্যুনাল হচ্ছে মতাসীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন চৌদ্দদলীয় জোটের রাজনৈতিক হাতিয়ার। যেসব লোকজন আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ তাদের বিরুদ্ধে (যুদ্ধ ও মানবতার বিরুদ্ধে) অপরাধের শক্ত প্রমাণ থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে কোন তদন্ত হয় নি। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত, প্রসিকিউশান, বিচারপ্রক্রিয়া বিপুল ভাবে প্রশ্নবিদ্ধ’… ইত্যাদি।
সাতই মার্চে আরেকটি ইউরোপীয় মানবাধিকার সংস্থা এফআইডিএইচ বলেছে, ট্রাইব্যুনালের বিচারে সরকার হস্তপে করেছে এবং যে রায় দেওয়া হয়েছে তা সুস্পষ্ট ভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। শাহবাগে ফাঁসির দাবি মেনে নিয়ে বিচারে খালাস দেবার পর একজন ব্যক্তিকে আবার বিচার ও শাস্তি দেবার জন্য আন্তর্জাতিক আইনের বিধানে সংশোধনী আনাকে মানবাধিকার সংগঠন বিচারব্যবস্থার মারাত্মক অন্যায় হিশাবে দেখছে। তারা বলছে, বাংলাদেশকে অবশ্যই অভিযুক্তের ন্যায়বিচার পাবার অধিকারকে সম্মান করতে হবে। ইনসাফের যে মারাত্মক লংঘন হয়েছে, তাকে বিবেচনায় নিতে হবে। এ ছাড়া মানবাধিকার কোন অবস্থাতেই প্রাণদণ্ড সমর্থন করে না। সেই বিবেচনা আমলে নিতে হবে। ইত্যাদি।
আসলে বিচারের নামে কী ঘটেছে আন্তর্জাতিক মহল সে ব্যাপারে ক্রমশ সচেতন হয়ে উঠছে ও ট্রাইব্যুনালের বেইনসাফির সমালোচনা করছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের কূটনৈতিক মহলের সঙ্গে সরকারের যে সভা হয়েছে, সেখানে সরকার গণহত্যার দায় চাপার অভিযোগ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারে নি। যেহেতু মতাসীনদের চরিত্রের কারণে তারা কূটনৈতিক মহলের সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল, অতএব তাদের উৎকণ্ঠা যেন আর না বাড়ে, তা ঠাণ্ডা করার জন্যও সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে আলোচনার প্রস্তাব দিতে হয়েছে।
তবে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আতংক আসলে যতটা না গৃহযুদ্ধ, তার চেয়েও ইসলামি রাজনীতির উত্থান। তা ছাড়া বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মধ্যবিত্ত শ্রেণির যে শক্ত মত আছে, তারও প্রতিনিধিত্ব করছেন সৈয়দ আশরাফ। এই শ্রেণীর উদ্বিগ্নতাই ধারণ করছে দৈনিক সমকাল। তবে বাংলাদেশের বর্তমান ফ্যাসিস্ট ও গণবিরোধী সংবিধানের মধ্যে থেকে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির কোন অবশেষ রা করা যায় কি না, তার একটা চেষ্টা আছে ৮ মার্চের ইংরাজি দৈনিক নিউ এইজ পত্রিকার। এক/এগারোর মতো বাংলাদেশ আবার সেনাশাসনের অধীনস্থ হোক, এটা অনেকেই চান না। মধ্যবিত্ত শ্রেণির একাংশের মধ্যে এই আতংক থাকা অন্যায় কিছু নয়।
এই সব চাপের কথা যদি আমরা মনে রাখি তাহলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংলাপে সৈয়দ আশরাফের আগ্রহকে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া উচিত নয়। যদিও তিনি বলছেন, “সংকট নিরসনে আমরা যেকোন বিষয়ে যেকোন স্থানে বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা করতে রাজি”। বলেছেন, আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল তাই তিনি কথা বলতে রাজি হয়েছেন। সেনাবাহিনীকে মতা থেকে দূরে রাখার জন্য আরেকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলা যায়। এই ইঙ্গিত দিয়ে তিনি কথা বলার পরিবেশ তৈরি করতে চেয়েছেন।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে সময় সময়ে ফুঁসে উঠতে দেখা যায়, মনে হয় তিনি বোধ হয় মধ্যবিত্ত শ্রেণির সেই অংশের প্রতিনিধি, যারা নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন। অন্তত অন্যান্য আওয়ামী নেতার তুলনায় তার কথাবার্তায় এই ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কিন্তু প্রহসন হচ্ছে বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে, বিশেষত পঞ্চদশ সংশোধনীর পর এই রাজনীতির আর কোন সম্ভাবনা বাংলাদেশে নাই। অন্য দিকে তিনি আলাপ-আলোচনার কথা বললেও তার দল সুস্পষ্ট ভাবে ফ্যাসিস্ট নীতি অনুসরণ করে চলেছে এবং রাষ্ট্রব্যবস্থাকে আরো হিংস্র ও প্রতিহিংসাপরায়ণ করে তুলে গৃহযুদ্ধকে আরো কার্যকর ও সম্প্রসারিত করবার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। আর সেটা করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং। সন্ত্রাস প্রতিরোধ কমিটি ও সিটিজেন সিকিউরিটি সেন্টার গঠন যার প্রমাণ। এর আগের লেখায় (রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের নতুন সাংগঠনিক রূপ) আমরা এ বিষয়ে আলোচনা করেছি। তবুও সৈয়দ আশরাফুলের এই প্রস্তাব মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটা অংশকে আশ্বস্ত করতে পারে।
গণমাধ্যমগুলোর মধ্যেও পরিষ্কার দুটো ধারা শনাক্ত করা যায়। অনেক পত্রিকা সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের এই খবর ছাপেনি, কিম্বা ছাপলেও চোখে পড়ার মতো নয়। আর কিছু পত্রিকা যারা মূলত প্রধানমন্ত্রীর প্রতিহিংসাপরায়ণ নীতির সমর্থক এবং জামায়াত-শিবিরকে নির্মূল করবার রাজনীতিকেই সঠিক গণ্য করছে তারা প্রথমে প্রধানমন্ত্রীর সন্ত্রাস প্রতিরোধ কমিটির খবর দিয়েছে এবং তার ভেতরে সৈয়দ আশরাফের আলোচনার প্রস্তাব ছেপেছে। মনে হচ্ছে, নির্মূলের রাজনীতি থেকে এরা এখনো নিজেদের দূরত্ব বজার রাখা জরুরি মনে করছে না। এদের সংবাদ পরিবেশনের ধরণ ও মিথ্যাচার দেখে স্পষ্ট হয় যে দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে এদের এখনো হুঁশ হয় নি।
বিএনপির মধ্যে এর প্রতিক্রিয়া ইন্টারেস্টিং। বাংলাদেশের সমাজ, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক নয়, ফলে এখানে গণতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চা উচ্চাশা মাত্র। কিন্তু তবুও সব পরে কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনীপ্রক্রিয়া মেনে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মতা হস্তান্তরের একটা বিধান গড়ে উঠেছিল। শেখ হাসিনা আদালতের রায়ের পরিপ্রেেিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিধান লুপ্ত করে দেওয়ায় নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির সম্ভাবনাও সুদূরপরাহত হয়ে গিয়েছে। এখন আওয়ামী লীগকে মতায় রেখে বিএনপির পে আবার মতায় আসা কঠিন।
যদিও উগ্র জাতীয়তাবাদ ও প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনীতির বিপরীতে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের সমর্থকের সংখ্যা কম নয়, তবুও বিএনপির সাংগঠনিক মতা দুর্বল। নির্বাচনের ভোটের সংখ্যার মধ্যে তা প্রতিফলিত হয়। কিন্তু দল হিশাবে আওয়ামী রাজনীতির প্রতিক্রিয়া হিশাবেই বিএনপি গড়ে উঠেছে। এর অধিক সুনির্দিষ্ট কোন রাজনৈতিক মতাদর্শ এই দলটি দাঁড় করাতে পারে নি। এর ফলে চরম দুর্নীতিবাজ আর দুর্বৃত্তদের আধিপত্য এই দলে বেড়েছে। এ কারণে বেগম খালেদা জিয়া গত নির্বাচনে হেরে যাবার পর আওয়ামী লীগের শক্ত কোন প্রতিপ হিশাবে দলটি দাঁড়ায় নি। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে জনগণের ােভকে পুঁজি করে বিএনপি সে কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন ছাড়া আর কিছু চাইতে পারে না। বেগম খালেদা জিয়ার এই হুঁশটুকু থাকা উচিত যে নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপির দুর্নীতিবাজ ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের মতায় বসানোর বিশেষ আগ্রহ জনগণের নাই। যে কারণে বিএনপি ক্রমশ জাতীয় রাজনীতিতে গৌণ হয়ে পড়ছে। এই দুর্বলতা ও রাজনৈতিক দেউলিয়াপনার পরেও খুনি সরকারের পদত্যাগের দাবি দেবার সঙ্গে সঙ্গেই বিএনপির প্রতি জনগণ আবার আগ্রহী হয়ে উঠেছে। কিন্তু তার দলের ভেতর থেকে তার এই দাবিকে নস্যাৎ করবার জন্য বারবারই আবার ভাঙা রেকর্ডের মতো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি তোলা হচ্ছে। বাংলাদেশে এত বড় গণহত্যার পরে তত্ত্বাবধায়কের দাবি বিএনপির য় ত্বরান্বিত করবে মাত্র। এই স্ববিরোধিতার মধ্যে বিএনপি যতই বিভ্রান্তি ছড়াবে ততই বর্তমান পরিস্থিতিতে দলটির জনপ্রিয়তা দ্রুত হ্রাস পেতে থাকবে।
গণহত্যার প্রতিবাদে বেগম খালেদা জিয়ার খুনি শাসকের পদত্যাগ দাবি দলের অভ্যন্তরের বড় একটি অংশ পছন্দ করে নি। এরাই শাহবাগের প্রতি শুরুতে সমর্থন জানিয়েছিল। কারণ তারা মনে করেছে, সমর্থন না দিলে আগামী নির্বাচনে তারা যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে ভোট হারাবে। শাহবাগ যখন ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেওয়া শুরু করল এবং ছাত্রলীগ-যুবলীগের দখলে চলে গেল, তখন একে সমর্থন দেওয়া কঠিন হয়ে গেল। অন্য দিকে জামায়াত-শিবির যখন সহিংস রাজনীতির পথে পা বাড়াল, ভোট হারাবার ভয়ে বিএনপি দ্রুত জামায়াত-শিবিরের কাছ থেকে নিজেদের ফারাক প্রমাণের জন্য অস্থির হয়ে পড়ল। তাদের আঠারোদলীয় জোট কার্যত ভেঙে দিলো। জনগণের চোখে এটা দুর্নীতিবাজ ও দুর্বৃত্ত-প্রভাবিত বিএনপির রাজনৈতিক সুবিধাবাদিতা হিশাবেই হাজির হোল। বিএনপিও জাতীয় রাজনীতিতে দ্রুত গৌণ হয়ে উঠল।
বেগম খালেদা জিয়ার পে কঠোর অবস্থান নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নাই। শেখ হাসিনার গণহত্যা, ক্রমাগত দমন-পীড়ন ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশে গুলি চালিয়ে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথ রুদ্ধ করা এবং ঘটনা যেভাবে গড়াচ্ছে তাতে আওয়ামী লীগের প্রতিপ হিশাবে জামায়াত-শিবিরের আবির্ভাব বিএনপিকে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে। কঠোর অবস্থান নেবার মধ্য দিয়ে তিনি এক হিশাবে তার দলকে বিপর্যয় থেকে রা করেছেন। তবে তিনি তার দলের দুর্নীতিবাজ ও দুর্বৃত্তদের যদি শায়েস্তা না করেন তাহলে এই ফল হবে সাময়িক। বক্তৃতা দিয়ে জনগণের মন জয় করা যাবে না। তিনি জনগণকে মাঠে নেমে আসবার কথা বলেছেন, তার দলকে মাঠেই থাকতে হবে। কারণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেখানে চলে গিয়েছে আওয়ামী লীগের পে তা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা কঠিন। অন্য দিকে খুনি শাসকের পদত্যাগের দাবি ত্যাগ করে তিনি এখন আগের জায়গায় ফিরে যেতে পারেন না। তার দলের পে যারা সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের আলোচনার
প্রস্তাবে আলোচনার শর্ত হিশাবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির কথা বলছেন, তারা কার্যত সংবাদ সম্মেলনে তার অবস্থান ঘোষণাকে তামাশায় পর্যবসিত করছেন। তাদের ধারণা, বর্তমান পরিস্থিতিতে একটি স্বাভাবিক নির্বাচন সম্ভব। তা ছাড়া জনগণের কাছে এই মুহূর্তে বিএনপিকে মতায় বসানোর কোন বাসনা নাই। বিএনপি যতই এই কথা বলবে ততই জনগণের কাছে খেলো ও তামাশার বস্তু হয়ে উঠবে। তা ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করে বিএনপিকে মতায় বসানোর কোন পরিকল্পনা যে শেখ হাসিনার নাই সেটা তো খুবই স্পষ্ট। এই পরিপ্রেেিত বিএনপির সামনে আন্দোলন-সংগ্রাম ছাড়া কোন বিকল্প নাই। কী করবে তা এখন বিএনপিকেই বেছে নিতে হবে।
এই পরিস্থিতিতে নাগরিকদের দিক থেকে সব পরে কাছে কিছু দাবি তোলা খুবই জরুরি, যাতে কয়েকটি আশু ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিষয়ে জাতীয় সম্মতি তৈরির পরিবেশ সৃষ্টি হয়। তার মধ্যে প্রথমেই থাকবেÑ ০১. যেসব নাগরিকের বাড়িঘরে হামলা হয়েছে, জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং উপাসনালয় ভেঙে দেওয়া হয়েছে, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। অনেকেই বাড়িঘর হারিয়ে সর্বহারা হয়ে পথে বসেছে, তাদের সর্বপ্রকার আর্থিক সহযোগিতা দেওয়া। এরপর, ০২. যারা পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন তারা যে পরেই হোক তাদের পরিবারের জন্য তিপূরণের ব্যবস্থা করা; (৩) গণহত্যার নিরপে তদন্ত করা এবং এই ধরণের পরিস্থিতি এড়ানোর নীতিমালা গ্রহণ করা এবং (৪) পুলিশকে জাতিসংঘের বিধান (United Nations Basic Principles on the Use of Force and Firearms)   মেনে চলতে বাধ্য করা এবং সরাসরি বন্দুক ঠেকিয়ে হত্যা করবার যেসব ভিডিও রয়েছে, সেই সব পরীা করে ট্রিগারহ্যাপি পুলিশদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
আমাদের সবাইকে এবং বিবদমান সব পকেই বুঝতে হবে, বাংলাদেশের লড়াইকে যদি আমরা বাঙালি জাতীয়তাবাদ বনাম জামায়াত-শিবির ও তাদের পাবলম্বনকারীর মধ্যে গৃহযুদ্ধে পরিণত করি, তাহলে উভয় পই শুধু ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে না, বাংলাদেশও ধ্বংস হয়ে যাবে। সে দিকে বাংলাদেশকে ঠেলে দেবার জন্য নানান শক্তি কাজ করছে। যদি বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপরীতে ইসলামি ঝাণ্ডা নিয়ে আমরা লড়াই করতে নামি তাহলে বাংলাদেশ আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া প্রভৃতি দেশের মতো রক্তাক্ত পথে খাবি খাবে। আমরা ইসলামও হারাবো, আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিও ধ্বংস হবে। আর তখন শেখ হাসিনার নাম হবে ‘কারজাই’। আর যদি বুঝি সমাজে আমার যে আত্মপরিচয়ই থাকুক আমি রাষ্ট্রের চোখে ‘নাগরিক’ হিশাবে স্বীকৃতি পাবার অধিকারের জন্য লড়ছি। যে অধিকারের বলে আমি অপরাধী হতে পারি, কিন্তু আদালতে ন্যায়বিচার পাবার অধিকারী। তাহলে এই লড়াইয়ের আসল মর্ম আমরা ধরতে পারব, এর পে সমর্থনও দ্রুত বাড়বে।
ওপরে আন্তর্জাতিক মহল ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অবস্থান যদি আমরা ল করি তাহলে দেখব, তারাও ট্রাইব্যুনালের ভূমিকা পর্যালোচনা করছেন ইনসাফ বা ন্যায়বিচার পাবার অধিকারের দিক থেকে। ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার অর্থ হচ্ছেÑ আমরা এমন এক সমাজে ও রাষ্ট্রে বাস করছি, যে সমাজ থেকে ইনসাফ শুধু আদালত থেকে নয় আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক পরিমণ্ডলসহ সব ত্রে থেকেই উধাও হয়ে গিয়েছে। এই লড়াই ইনসাফ কায়েমের লড়াই। যারা এই ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন, যদি তারা লড়াইয়ের সারবত্তা বুঝতে পারেন, তাহলে এই লড়াইয়ে গণমানুষের সমর্থন পেতে তাদের দেরি হবে না। যে বিপজ্জনক রাজনীতির ছক সাজানো হয়েছে, সেই ছকের ফাঁদে যেন বাংলাদেশ না পড়ে সেটাই আমাদের কামনা।
৯ মার্চ ২০১৩। ২৫ ফাল্গুন ১৪১৯। শ্যামলী।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন