বুধবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

'বাংলা-বসন্ত' :উদ্দেশ্য ও উপায়


বিগত কয়েক হাজার বছর ধরে কর্তৃত্বপরায়ণ শাসক শ্রেণীর হাতে তৈরি যে বস্তু 'মানবসভ্যতা' নামে অভিহিত হয়ে আসছে তার মধ্যে ভালো ভালো কথার কোনো অভাব নেই: কি বিদ্যমান শাসকদের তরফে, কি তাঁদের বিরুদ্ধে 'প্রতিরোধ' গড়ে তোলা ভাবি শাসকদের তরফে। উভয় পক্ষই দুনিয়ার সমস্ত মহত্ উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্যে তাঁদের আকাঙ্ক্ষার কথা লাগাতারভাবে বলে আসছেন শত মুখে। এ নিয়ে রাজ-বুদ্ধিজীবীদের সৃজিত ও প্রচারিত শাস্ত্রীয় শিক্ষা-দীক্ষা-প্রকৌশলের শত শত রূপ, অজস্র চেহারা। মহত্ এইসব উদ্দেশ্যকে নিজেদের উদ্দেশ্য হিসেবে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে কেউ কারো চেয়ে পিছিয়ে নেই; কারো সাথে কারো মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। তারপরও আজ সারা পৃথিবী জুড়ে বৈষম্য-বঞ্চনা-বল প্রয়োগের কোনো অন্ত নেই। একদিকে, গুটিকয় বিশেষাধিকারপ্রাপ্ত মানুষের সম্পদ-বিলাস-জৌলুষের অশেষ নেই। অন্যদিকে, কয়েক শ' কোটি মানুষের অভাব-অসমতা-অভিযোগও অন্তহীন। সমস্যাটা তাহলে কোথায়? অনেকে হয়ত ভাববেন আমাদের পক্ষ থেকে যাঁরা যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের এবং শাসন করার অধিকারী নেতা তাঁরা যথেষ্ট সত্-আন্তরিক-ঈমানদার নন বলেই দুনিয়ার আজও এই অবস্থা।

কিন্তু আমার মনে হয় সমস্যাটা মূলত সততা-নিষ্ঠা-আন্তরিকতা-আস্থা-উদ্দেশ্য-ঈমানের নয়। সমস্যাটা উপায়ের। এক কথায়, সকলেই আমরা নিজের নিজের মতো করে মানব জাতির মঙ্গল-শুভ-উন্নতির কথা বলি কিন্তু কী পদ্ধতিতে কী উপায়ে কী প্রণালীতে তথাকথিত মহত্ উদ্দেশ্য পূরণ করার কথা ভাবা হচ্ছে এবং শুধু কথায় নয়, খোদ বাস্তবেও কী উপায়ে সেইসব উদ্দেশ্য পূরণের পথে 'এগিয়ে' যাচ্ছি আমরা: সমস্যাটা সেখানেই। অন্ধ মতাদর্শের রঙিন চশমা-পরা চোখে নয়, শাদা চোখে বাস্তবের দিকে তাকাতে পারলে পলকেই দেখা যাবে যে, আমাদের আদর্শ-মতাদর্শ-উদ্দেশ্যের মধ্যে শত পার্থক্য থাকলেও (থাকাটা স্বাভাবিকও বটে) উপায়-পদ্ধতি-প্রণালীর প্রশ্নে কারও সাথে কারও মৌলিক কোনো পার্থক্য নাই। যেকোনো উদ্দেশ্য পূরণের, এমনকি উদ্দেশ্যের পক্ষে প্রচার চালানোরও, প্রথম সামষ্টিক উপায় হচ্ছে কোনো-না-কোনো প্রকারের সংগঠন-কাঠামো গড়ে তোলা। আর সংগঠনের প্রশ্নে পরস্পরবিরোধী-মতাদর্শওয়ালাদের মধ্যে সত্যিকারের কোনো পরস্পরবিরোধিতা নেই বললেই চলে। সকলেই (আস্তিক-নাস্তিক-গণতন্ত্রী-সমাজতন্ত্রী-পুঁজিতন্ত্রী-ইত্যাদি-প্রভৃতি সকল মতাদর্শের লোকই) বাস্তবে একই ধাঁচের, একই ছাঁচের সংগঠন-কাঠামোর অনুসারী। যাবতীয় রাজনৈতিক ধারার অনুসারীদের অনুসৃত সংগঠন-কাঠামোটি একই রকমের: উচ্চনিচ-ক্রমতান্ত্রিক ও কর্তৃত্ব-পরায়ণ, এবং হর্তাকর্তা-আমির-আমলা-জেনারেল-বিচারক-উপাচার্য-গুরু-পণ্ডিত-পুরোহিত- মোল্লা-পাদ্রী-সেক্রেটারি-সম্পাদক-মহাসচিব-নির্ভর।

সাদা চোখে তাকালে দেখা যাবে: সংগঠন-কাঠামোর প্রশ্নে বলশেভিক-বামপন্থি ইসলামী-ডানপন্থি তথা উত্তরপন্থি-দক্ষিণপন্থিদের সকলেরই সাংগঠনিক কেন্দ্র রাজধানীতে; সকল সংগঠনেরই রাষ্ট্রপতি-সভাপতি-মহাসচিব-প্রধানমন্ত্রী-আমির একজন মাত্র ব্যক্তি। সংগঠনের মধ্যে সবচাইতে বেশি ক্ষমতার মালিক এই ব্যক্তিটি। সংগঠনের কাঠামোয় ইনি সবার ওপরে। তারপরেই আছে সভাপতিমণ্ডলী বা প্রেসিডিয়াম বা সম্পাদকমণ্ডলী বা মন্ত্রীপরিষদ বা মজলিশে শুরা টাইপের একটি সাংগঠনিক স্তর। তারপর জাতীয়-বিভাগীয়-আঞ্চলিক-জেলা-উপজেলা-কেন্দ্রিক বিভিন্ন পর্যায়ের সাংগঠনিক প্রণালী। আর, বিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত এই যাবতীয় সংগঠন-কাঠামোর ক্ষেত্রেই সকলের নিচে আছেন সংগঠনের সাধারণ সদস্যবৃন্দ তথা আপামর জনতা। সংখ্যাগরিষ্ঠ এই সাধারণ সদস্যবৃন্দের বা আমজনতার হাতে তেমন কোনো ক্ষমতাই নেই। এঁদের কাজ শুধু ভোট দেওয়া আর নেতাদেরকে অনুমোদন দেওয়া। মুখে মুখে এঁদেরকেই সকল ক্ষমতার মালিক বলা হলেও বাস্তবে সকল ক্ষমতার মালিক একেবারে ওপরের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ। যাবতীয় সংগঠনে সিদ্ধান্ত-নির্দেশনা-অর্থ-ক্ষমতার প্রবাহ উপর থেকে নিচের দিকে। নিচের দিকে ক্রমবিন্যস্ত সদস্যদের কাজ হলো উপরের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা। নিচের আপামর সদস্যবৃন্দের বা আমজনতার কোনো স্বাধীনতাও নেই। এঁদের কাজ শুধু উপরের প্রতি আনুগত্যের, অন্ধত্বের ও বিশ্বস্ততার নিরঙ্কুশ প্রমাণ দিতে থাকা, প্রশ্নাতীতভাবে উপরের আদেশ-নিষেধ-হুকুম তামিল করা এবং প্রয়োজনে নিজেদের জীবন উত্সর্গ করে দেওয়ার জন্য সদাপ্রস্তুত থাকা। বিদ্যমান সর্বগোষ্ঠী কর্তৃক অনুসৃত এই সংগঠন-কাঠামোটির সাথে এবার যদি আপনি আমাদের সমাজের প্রচলিত বাস্তব সংগঠন-সংস্থা-প্রতিষ্ঠানসমূহকে মিলিয়ে দেখেন, তাহলে দেখা যাবে পাড়ার ক্লাব ও পাঠাগার থেকে শুরু করে এনজিও, ছাত্রসংগঠন, রাজনৈতিক দল, সেনাবাহিনী, বিচারবিভাগ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মিডিয়া, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, সচিবালয় এবং খোদ রাষ্ট্র আসলে একই ধারার সংগঠন। মুখে যে যা-ই বলুক না কেন, এই যাবতীয় সংগঠনই বৈষম্য ও ব্যক্তিমালিকানায় বিশ্বাসী, বঞ্চনা ও বিলাসে বিশ্বাসী এবং জবরদস্তি ও বলপ্রয়োগে বিশ্বাসী। কেউ আইনের নামে, কেউ গণতন্ত্রের নামে, কেউ বিপ্লবের নামে, কেউ ধর্মের নামে, কেউ অবিশ্বাসের নামে আসলে যা চান তা হলো বিদ্যমান কেন্দ্রীভূত ও জবরদস্তিমূলক রাষ্ট্রক্ষমতাকে দখল করা এবং যত বেশি দিন সম্ভব ছলে-বলে-কৌশলে নিজেদের হাতে তা কুক্ষিগত করে রাখা। এঁরা কেউই চান না সংগঠনের সাধারণ সদস্যরা নিজেরা নিজেদের বিবেক-বুদ্ধি-বিবেচনা অনুসারে গৃহীত স্বাধীন সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে নিজেদের মতো করে সংগঠন পরিচালনা করুক, কিংবা অন্য কথায় বললে, এঁরা চান না দেশের জনসাধারণও একইভাবে নিজেরা নিজেদেরকে পরিচালনা করুক।

এই যে কর্তৃত্বপরায়ণ সাংগঠনিক উপায়, এর সাথে ঘোষিত উদ্দেশ্যের সম্পর্ক কী? আজকে যাঁরা নিজেদের সংগঠন নিজেরা পরিচালনা করতে শিখছেন না, হর্তাকর্তা-হুজুরের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হচ্ছেন, তাঁরা কালকে সত্যিকারের গণতন্ত্র গড়ে তুলতে সক্ষম হবেন? আজকে যাঁরা নিজের সংগঠনের ভেতরেই নিজেরা মুক্তবুদ্ধির, স্বাধীনতার ও ভিন্নমতের চর্চা করতে পারছেন না, তাঁরাই কালকে মুক্ত মানুষের মুক্ত সমাজ (তথা সমাজতন্ত্র) প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন? আজকে যাঁরা নিজেদের জীবন উত্সর্গ করার সিদ্ধান্তটুকু পর্যন্ত নিজেদের স্বাধীনতার ভিত্তিতে গ্রহণ করতে সক্ষম নন, কাল তাঁরাই হাশরের মাঠে মহান আল্লাহ পাকের দরবারে নিজের সারা জীবনের কর্মকাণ্ডের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে দাঁড়ানোর মতো হিম্মত অর্জন করে ফেলবেন? ভাবলেই বোঝা যায়: এ সব প্রশ্নের উত্তর ইতিবাচক হওয়া সম্ভব নয়।

দুই. আজকে যাঁরা যুদ্ধাপরাধীদের ন্যায্য বিচারের দাবিতে, সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে, শাহবাগে এবং সারা দেশে সমবেত হয়েছেন তাঁরা কিন্তু বিদ্যমান জবরদস্তিমূলক থানা-পুলিশ-আইন-আদালত-কারাগার ও সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সমন্বয়ে গড়ে রাষ্ট্র-সংগঠনটিকেই ধরপাকড়-জেল-জুলুম-গুলি-ফাঁসির পদ্ধতিতে পরিচালিত হতে প্ররোচিত করছেন। তাঁরা নিজেরা অত্যন্ত সঠিকভাবে অহিংস উপায়ের কথা বলছেন বটে, কিন্তু অন্য দিকে খোদ রাষ্ট্রকেই তাঁরা সহিংস পদ্ধতিতে যাওয়ার বৈধতা দিচ্ছেন। এখানেই তৈরি হচ্ছে উদ্দেশ্য ও উপায়ের অসঙ্গতি। আজকেও আমাকে নির্ভয়ে বলতে পারতে হবে যে, ফাঁসি-জবাই-মার-কাটের প্রতিশোধপরায়ণ হিংসানীতিকে শাহবাগের সংকীর্ণ শ্লোগানগুলো অতিক্রম করতে পারছে না। ফাঁসি-জবাই-মার-কাট কিন্তু একাত্তরে আমাদের শ্লোগান ছিল না। একাত্তরে আমাদের শ্লোগান ছিল ইতিবাচক ও সৃজনধর্মী। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেও নতুন একটি সুন্দর রাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষাই ছিল আমাদের সকল শ্লোগানের প্রাণ। আজকে কেন তাহলে আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে চলমান আন্দোলনের মধ্যেই আমাদের নতুন সমাজের রূপকল্পের প্রশ্নটিকে সামনে আনতে পারছি না? অনেকেই বলছেন, এক যুদ্ধাপরাধী ইস্যুতে হাজারটা আগাম ইস্যু, পরিকল্পনা ও ভিশন নিয়ে কনফিউশন তৈরি করা যাবে না; এতে করে ফোকাস নষ্ট হয়ে যাবে। কথাটা যে খুব মিথ্যা তা নয়। শাহবাগ-সমাবেশ এখন এসব কথা শোনার মুডেও নাই। ঠিক আছে, আপাতত শুধু এই একটা ইস্যুতেই আন্দোলন গড়ে তুলি চলেন। যুদ্ধাপরাধ প্রশ্নেই কাজ হোক। কিন্তু তার জন্য তো সংগঠন লাগবে। কাজটা তো মূলত অর্গানাইজ করারই কাজ, তাই না? বর্তমান মুহূর্তের এই কাজটাই কী উপায়ে কোন সাংগঠনিক কাঠামো-প্রণালীতে সম্পাদিত হচ্ছে তা নিয়ে কিন্তু কথা বলতেই হবে। কেননা উপায়ই উদ্দেশ্য। উপায় যদি উদ্দেশ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ না হয়, খোদ উদ্দেশ্যই তাহলে ব্যর্থ হয়। প্রচুর শ্রম-ঘাম-রক্তেও আমাদের উদ্দেশ্য পূরণ হয় না। উদ্দেশ্য দিয়ে উপায়কে জাস্টিফাই করার সুযোগ নাই। উদ্দেশ্য দিয়ে উপায়কে জায়েজ করার নামই হলো সুবিধাবাদ। আমি জানি, সাধারণভাবে আমরা কিছু লোক যাবতীয় রাষ্ট্রীয় বল প্রয়োগের বিরোধী হলেও, চাইলেই কিন্তু এক পলকের মধ্যে বিদ্যমান বল প্রয়োগমূলক রাষ্ট্রকাঠামো এবং এর আইন-আদালত-কারাগার-নিবর্তন ইত্যাদি উবে যাবে না। চাইলেই আজ আইন-আদালত-কর্তৃত্ব-রাষ্ট্র-সচিবালয়-সেনাবাহিনী সম্পর্কিত বিদ্যমান ধ্যানধারণাগুলো চোখের নিমেষে গায়েব হয়ে যাবে না। আমি চাইলেই হাজার বছরের ইতিহাস-পরিক্রমায় গড়ে ওঠা অপরাধ, ফৌজদারি দণ্ডবিধি, বিচার-প্রণালী এবং জেল-জরিমানা-শাস্তি সংক্রান্ত শিক্ষণ-প্রশিক্ষণ-দীক্ষায়নজনিত বিশ্বাসগুলো তাত্ক্ষণিকভাবে বাতিল হয়ে যাবে না। সুতরাং, সর্বপক্ষের আমজনতা যাকে এতদিন ধরে ন্যায্য বিচার বলে শিখে এসেছেন, সেই মানদণ্ড মোতাবেকই আজকে যুদ্ধাপরাধীদের এবং অন্য সব অপরাধীর উপযুক্ত শাস্তি হওয়ার দাবিকে কোনো যুক্তিতেই অবজ্ঞা করা সম্ভব না। এ কথা ঠিক যে, খুনের বদলা খুনের প্রতিশোধপরায়ণ চিন্তনই আমাদের আদালত-প্রথার ভিত্তি। খুন করা যদি সত্যি সত্যি অপরাধ হয়ে থাকে তাহলে অপরাধী ব্যক্তিকে আইনত খুন করে ফেলার যুক্তি টেকে কীসের ভিত্তিতে? খোদ খুন করাটাই যদি অপরাধ হয়ে থাকে তাহলে মৃত্যুদণ্ড প্রদানকারী বিচারক-কারাগার-জল্লাদও তো খুনের দায়েই অপরাধী হন। কিন্তু এতদিন এ কথা না বলে আজ হঠাত্ করে যুদ্ধাপরাধের বিচারের সময় এ কথা তোলাটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে তো হবেই। কাজেই, উপযুক্ত সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি আজ আর অবজ্ঞা করার কোনো অবকাশ থাকতে পারে না। তবে আজ আমাদেরকে ঠাণ্ডা মাথায় বিচারবুদ্ধি বর্জন না করে ভাবতেই হবে যে, শান্তিপূর্ণভাবে এই বিচারপ্রণালী সমাপ্ত করতে না পারলে, সারা দেশের সকল পক্ষের মানুষের শান্তি-স্থিতি-স্বস্তির বিনিময়ে গুটিকয় ভয়াবহ রকমের গণবিরোধী ঐতিহাসিক দুষ্কৃতকারীর উপযুক্ত শাস্তি দিতে গিয়ে আমাদের এই দুঃখিনী বাংলা আসলেই কি আরো এগুবে, নাকি আরও পিছিয়ে পড়বে? স্বাভাবিক-সামাজিক জীবনযাত্রা দিনে দিনে অচল হয়ে পড়তে থাকলে অভাব-অনটন দেখা দেবে। আমাদের ক্রমোন্নতিশীল সমাজ আবার পিছিয়ে পড়বে। এ ধরনের একটা পিছিয়ে পড়া সমাজই কিন্তু অন্ধ-বিশ্বাস আর অন্ধ-অবিশ্বাস বিস্তারের জন্য আদর্শ সমাজ। দেশে যখন রবীন্দ্রনাথের ভাষায় "খুনোখুনির দুর্বিপাক" শুরু হয়ে যায়, তখন সবচেয়ে লাভ হয় সকল পক্ষের অস্ত্রধারীদের; লাভ হয় জোর-জুলুম-জবরদস্তিওয়ালাদের; আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে রাষ্ট্রের বলপ্রয়োগের সংস্থাসমূহের সক্ষমতা। আজকে আমরা রাষ্ট্রকে হাতে ধরে প্রতিপক্ষের ওপর জুলুমের বৈধতা দিচ্ছি, প্রতিপক্ষের সম্পাদক-সংবাদপত্র-ব্লগ-ওয়েবসাইট নিষিদ্ধ করার পাইকারি অনুমোদন দিচ্ছি, কিন্তু কাল যখন আমার-আমাদের যাবতীয় ভিন্নমতের ওপরও রাষ্ট্রের একই ধরনের জুলুম নেমে আসবে তখন আমরা সেটা ঠেকানোর কোনো নৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারব না। অথচ ভিন্নমতের স্বাধীনতা ছাড়া 'স্বাধীনতা' কথাটাই অর্থহীন, অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়ে। অন্তঃসারশূন্য স্বাধীনতা অর্জন করার জন্যই কি একাত্তর এসেছিল এই দেশে? আজকে যারা বিচারের এক পাল্লায় মুক্তিযুদ্ধকে, আর অন্য পাল্লায় রাজাকার-আলবদরদেরকে রেখে ইতিহাস মাপছেন, মুক্তিযুদ্ধের সাগর-গভীর-মহত্ত্ব আর আকাশ-সমান-বিশালত্ব অনুভব করার মতো সময় তাঁদের হাতে নাই। তাঁরা বুঝবেন কী করে যে একাত্তর শুধু দুই পক্ষের বন্দুকধারীদের যুদ্ধ ছিল না। বারো বছরের এক বালকের সদ্য-ফোটা হাঁসের ছানাদেরকে বুকে আগলে নিয়ে নিজের আবাল্য গ্রাম-স্মৃতি-সংসর্গ ছেড়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াতে থাকার নামও একাত্তর।

তিন. আমার প্রিয়তম শিক্ষকদের এক জন হযরত মুহম্মদের কথা ভাবি (তাঁর ওপর অপার করুণা ও শান্তি বর্ষিত হোক)। উনি নিশ্চয়ই দেখছেন কীভাবে তাঁর নামে দুই পক্ষ অশান্তির আবাহনী গান গাইতে লেগেছেন। এক পক্ষ টাক-মাথায় নতুন গজানো চুলের আয়না-দৃশ্যে এতই বিমোহিত যে, হযরত মুহম্মদকে নিয়ে গালাগালি-কুত্সা-পর্ণো রচনা না করলে তাঁদের নিজের কাছেই নিজের যুক্তিবুদ্ধির শিঙের ধার পরীক্ষা করা চলে না। এঁরা এতটাই যুক্তিবাদী যে, পৃথিবীর সবচাইতে নোংরা কল্পনায় আর নোংরা ভাষায় তাঁরা তাঁদের আত্মার ওপর জমে ওঠা পুঁজের আবর্জনার প্রকাশ ঘটানোর যুক্তি খুঁজে পান। এঁরা জানেন না যে, যুক্তি জিনিসটা জনাব হিটলারেরও ছিল; জিনিসটা ফ্যাসিবাদের পক্ষেও লাগে। আসলে যুক্তি বলতে এঁরা বোঝেন নিজের অবিশ্বাসের সপক্ষে অন্ধ প্রমাণ হাজির করার গোঁয়ার্তুমি। হযরত মুহম্মদের (স.) বাস্তব আর্থ-সামাজিক-ঐতিহাসিক সূর্যকরোজ্জ্বল ভূমিকা সম্পর্কে সামান্য উপলব্ধিও যাঁর জন্মায়নি তাঁর জন্য তবু আমার মায়াই হয়। আহা মনুষ্যসন্তান, মতাদর্শের নামে এঁরা কতখানি ছোট করতে পারে নিজের আত্মাকে। 'আল্লাহ নাই' প্রমাণ করার জন্য এইসব নাস্তিকেরা এতটাই যুক্তিবাদী যে 'যা' নাই তারও যে একটা নাম আছে, আর যার নাম আছে সেটাও যে 'একটা কিছু' সেটুকু বোঝার মতো যুক্তি-সঙ্গতি তাঁদের নাই। বঙ্গের মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য কিন্তু সেটা বুঝিয়ে বলেছিলেন: দেহ মাত্রেরই যেমন 'দেহী' থাকেন, তেমন নাম মাত্রেরই 'নামী' থাকেন। কিন্তু এই বঙ্গের সন্তান হয়েও চোরা কভু নাহি শোনে ধর্মের কাহিনী। আল্লাহ আর মুহম্মদের নাম কলুষিত করতে পারলেই এঁরা খুশি, যেন এই নামগুলো এতই পলকা যে, দুই পাতা পর্নো লিখলেই হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। অন্যদিকে, আরেক পক্ষ হযরত মুহম্মদের 'মান-সম্মান'কে এতই পলকা ভাবেন যেন তাঁর মান-সম্মান বাঁচানোর জন্য অকথ্য ভাষায় 'নাস্তিক'দেরকে গালাগালি না-করলে, অন্ধকারে চাপাতি দিয়ে প্রতিপক্ষকে না-কোপালে হযরত মুহম্মদের সম্মান বাঁচে না। ফেসবুক আর ব্লগের পাতায় চোখ বুলালেই এই উভয় পক্ষের সম্পর্কে বলা আমার কথাগুলোর সত্যতা পাওয়া যাবে। আসলে উভয় পক্ষের উপায়-পদ্ধতি-প্রণালী একই: গালাগালি, নোংরা কথা, আর হিংসা। হিংসা মানে কিন্তু হননেচ্ছা: হনন করিবার ইচ্ছা। এক পক্ষ বাড়ি-ফেরতা নিরস্ত্র মানুষের গলায় চাপাতির কোপ বসানোকে পূণ্যকর্ম মনে করেন; অন্য পক্ষ যাবতীয় সহিংসতার দায়িত্ব রাষ্ট্রের বন্দুকধারী বাহিনীর ওপর ন্যস্ত করে পরোক্ষভাবে মানুষ খুন করাকে যুক্তিপরায়ণ কম্মো বলে ভাবেন। এক পক্ষ ফাঁসি চান যুদ্ধাপরাধীদের; আরেক পক্ষ ফাঁসি চান নাস্তিকদের। এক পক্ষ রাষ্ট্রকে দিয়ে নিষিদ্ধ করাতে চান যুদ্ধাপরাধী দলগুলোকে, তাঁদের পত্রিকা-ব্লগ-সম্পাদকদেরকে; আরেক পক্ষ ঐ একই রাষ্ট্রকে দিয়ে নিষিদ্ধ করাতে চান 'নাস্তিক বামপন্থি'দের দলগুলোকে, আর তাঁদের পত্রিকাগুলোকে। উভয় পক্ষই বল প্রয়োগমূলক ও প্রতিশোধপরায়ণ আইন-আদালতের ওপর অগাধ আস্থা রাখেন। আমাদেরকে তাই বুঝতে হবে: আজকে যে-রাষ্ট্র যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে, কালকে জামায়াত ক্ষমতায় গেলে সেই রাষ্ট্রই প্রতিপক্ষের রক্তপান করার জন্য আন্তরিকভাবে তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠবে। আমাদেরকে খেয়াল করতে হবে: রাষ্ট্রের একটা দিক হলো তার লালন-পালন-সৃজনের আর্থসামাজিক সত্তা; আর রাষ্ট্রের অপর দিক হলো হত্যা-বলপ্রয়োগ-লুটপাটের রাক্ষস-রাজনৈতিক-শাসনমূলক সত্তা। রাষ্ট্র-রাক্ষসের নখদন্ত-থাবা যদি ক্রমাগতভাবে মুড়িয়ে দেওয়া না যায়, তার বদলে যদি রাষ্ট্রের রক্ততৃষ্ণাকে আরো আস্কারা দেওয়া হয়, তাহলে সেই যূপকাষ্ঠে দল-মত-মতাদর্শ নির্বিশেষে আমরা সবাই কখনো-না-কখনো বলি হবো। আমরা কি ভুলে যাব, এই সরকারই বন্ধ করেছিল ফেসবুক, বন্ধ করেছিল ইউটিউব? একবার খুলে দেওয়ার পরেও এখন আবার বন্ধ ইউটিউব। মানুষের বিবেক-বুদ্ধি আর বিচার-বিবেচনার প্রকৃতি-দত্ত, আল্লাহ-প্রদত্ত সক্ষমতার ওপর কেউই দেখছি ভরসা রাখেন না। সকলেই ভুলে যান, কোনো 'মহত্' উদ্দেশ্যেই সরকার ও রাষ্ট্রের বলপ্রয়োগের সংস্থাগুলোকে আরো শক্তিশালী, আরো আক্রমণাত্মক, আরো সহিংস করে তোলাটা গোটা কওমের জন্য, পুরো কমিউনিটির জন্য মারাত্মক বিপজ্জনক একটি কাজ। হিংসা আরো হিংসাকেই ডেকে আনে। রাষ্ট্রের বিপরীতে শক্তিশালী করে তোলা দরকার বরং আমাদের সমাজ-সত্তাকে, সামজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে। রাষ্ট্র ও আইন-আদালতের জবরদস্তি দিয়ে একটা ভাবধারাকে নিশ্চিহ্ন করা যায় না। নুরেমবার্গ ট্রায়াল দিয়ে নাজিবাদ নিশ্চিহ্ন করা যায়নি। সমাজই পারে উদারতা, স্বাধীনতা, বহুমত, অহিংসা, বোঝাপড়া, সংহতি, সহযোগিতা এবং সৃজনশীলতার ক্রমবিকাশ ঘটানোর মধ্য দিয়ে মতাদর্শের অন্ধত্বকে অগ্রহণযোগ্য করে তুলতে।

বিশেষ কোনো একটি আদালতের দেওয়া রায়ে কোনোদিন 'ইতিহাসের মীমাংসা' হতে পারে না। 'ইতিহাসের দায়' মেটানো কোনো ফৌজদারি মামলার বিষয় হতে পারে না। রাষ্ট্রীয় আইন-কানুন আর বল প্রয়োগের জোরে কোনো একটি রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করে ইতিহাসের মীমাংসা করা যায় না। তাতে করে খোদ রাজনীতি টিকে যায়, চিরন্তন মর্যাদা লাভ করে। ইতিহাসের দায় মেটানো যায় বরং আত্মত্যাগের রক্ত আর মমত্ববোধের কান্না দিয়ে নতুন ইতিহাস রচনা করার মধ্য দিয়ে। ইতিহাসের দায় মেটাতে হবে রাষ্ট্র-সমাজের পুনর্জাগরণ-পুনর্গঠনমূলক রূপান্তর ঘটানোর মধ্য দিয়ে: রাজনৈতিক-মতাদর্শিক-সহিংস-সামরিক রাষ্ট্রসত্তা থেকে আর্থ-সামাজিক-অহিংস-বেসামরিক রাষ্ট্রসত্তার দিকে এগোনোর মধ্য দিয়ে।

চার. অ্যানার্কিস্টদের ঐতিহাসিক ভুল থেকে জামায়াত চাইলে শিখতে পারে। উনবিংশ শতকের শ্রমিক-জনতার মুক্তিপরায়ণ আন্দোলনগুলির প্রধান একটি স্রোতোধারা ছিল নৈরাজ্যবাদ। তাকে কোনোভাবে আটকাতে না পেরে শেষে চরম জুলুমের পথ গ্রহণ করেছিল ইউরোপের রাষ্ট্রগুলো। আইনী পন্থায় চলার সুযোগ সম্পূর্ণভাবে নিঃশেষিত হওয়ায় ১৮৮০-১৮৯০ দশকে চরম পন্থার দিকে ঝুঁকে পড়ে নৈরাজপন্থিরা। একাধিক রাষ্ট্রপ্রধান-কারখানামালিক খুন হন তাঁদের হাতে। অবশেষে ১৯০৭ সালের আমস্টার্ডাম-কংগ্রেসে ক্রমবর্ধমান গণবিচ্ছিন্নতার ভুল সন্ত্রাসবাদী পথের কথা প্রকাশ্যে স্বীকার করে নিজেদেরকে গণশ্রমিক আন্দোলনের পথে ফিরিয়ে আনেন নৈরাজ্যবাদীরা। আজকে চাইলে অ্যানার্কিস্টদের সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিতে পারে জামায়াত। তাঁরাও একটা ঐতিহাসিক ঢাকা-কংগ্রেস ডেকে স্বীকার করতে পারে একাত্তরের ঐতিহাসিক ভুলের কথা। পাক হানাদার-বাহিনীর গণহত্যা-গণলুণ্ঠন-ধর্ষণে সহায়তা করার অপরাধ কবুল করে নিঃশর্তভাবে ক্ষমা চাইতে পারেন তাঁরা বাংলাদেশের আপামর মানুষের কাছে। এবং তাঁরা ফিরে আসতে পারেন সন্ত্রাসবাদ থেকে জনসাধারণের কাতারে। তাঁদের মধ্যে যাঁরা এখনও পরিপূর্ণভাবে বিবেক-বঞ্চিত হননি, কতিপয় যুদ্ধাপরাধী নরঘাতকদেরকে উপযুক্ত শাস্তির হাত থেকে বাঁচানোর গণবিরোধী প্রচেষ্টা অব্যাহত না রেখে তাঁরা ফিরে আসতে পারেন শান্তির পথে, আল্লাহর পথে। ইসলাম বা যেকোনো বিশ্বাস মোতাবেক সমাজকে গড়ে তোলার চিন্তা করা কোনো অপরাধ নয়। কিন্তু জবরদস্তির পথ ইসলামের পথ নয়। আল্লাহ চাইলে জবরদস্তির ডিক্রি জারি করে ইসলাম কায়েম করতে পারতেন, তাঁর পেয়ারা হাবিব হযরত মুহম্মদকে সত্য প্রচারের দায়ে এত অপমান-অসম্মান-অবিচার-অত্যাচারের মুখোমুখি হতে হতো না। কিন্তু জবরদস্তি দিয়ে আপাতভাবে মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করা যায়, কিন্তু সত্ বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করা যায় না।

ইসলাম মানে ঈমান, ফেইথ, বিশ্বাস। বিশ্বাস জিনিসটাই যুক্তিপূর্ণ, বিচারবুদ্ধিপূর্ণ। বিশ্বাস-সংশয়-ভয় এবং যুক্তিবোধ সহজাত মানবিক বৈশিষ্ট্য। জন্মসূত্রে আল্লাহর কাছ থেকে মানুষ এগুলো পেয়ে থাকে। এগুলো মানুষের অন্তর্জাত গুণ। বিশ্বাসী মানুষ মাত্রেই তাই যুক্তিবাদী। সে যুক্তি খোঁজে নিজ বিশ্বাসের সপক্ষে, প্রমাণও খোঁজে, বাস্তব ইশারা খোঁজে। না পেলে সংশয় ভর করে, বিশ্বাস বদলায়। আর, যে-বিশ্বাস নিজের জন্য বদলানোর কোনো অবকাশ রাখে না, সে বিশ্বাস অন্তর্দৃষ্টিতে অন্ধ। অন্ধ-বিশ্বাস ডেকে আনে অন্ধকার। অন্ধকারের প্রধানতম আধেয় ভয়-বিভীষিকা-আতঙ্ক-আশঙ্কা। এদেরই বাহন জবরদস্তি। অন্যদিকে যে-বিশ্বাস অন্ধ নয়, ওপেন: সে বিশ্বাস মানবিক, ধার্মিক। মানুষের স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক গুণাবলী বা মনুষ্যধর্মকে তা ধারণ করে। তাই বলে বিশ্বাস পরিবর্তনের সুযোগ থাকা মানে কিন্তু সুবিধাবাদ নয়, উঠতে-বসতে (জান বাঁচাতে বা লোভে-মোহে) বিশ্বাস বদলানো নয়। বিশ্বাস বদলানোর সুযোগ থাকা মানে আসলে আন্তরিক বোঝাপড়ার সুযোগ থাকা: নিজের সাথে নিজের, নিজের সাথে আল্লাহর, এবং আল্লাহর অভিপ্রকাশসমূহের সাথে (মানে তাঁর সৃষ্টিকুলের সাথে) নিজের ত্রিমাত্রিক বোঝাপড়ার সুযোগ। এই সার্বিক বোঝাপড়ার পথেই ব্যক্তি-মানুষ তার পরিবার-সম্প্রদায়-সমাজ-আত্মদায়ের পথ বেয়ে অনন্তের দিকে বিকশিত, প্রসারিত, পরিব্যাপ্ত হয়ে উঠতে থাকে।

এ জন্যই বিশ্বাস মানে বিবেকও বটে। বিবেক হচ্ছে সংশয়-যুক্তি-বিচারবুদ্ধির পথে বিশ্বাসকে শুদ্ধতর করে তুলতে থাকা। বিবেক তাই মূলবোধ। অন্যের কাছে নিজের মূল্য এবং নিজের কাছে অন্যের মূল্যের মধ্যে তুল্যমূল্য বিচারের বোধই মূল্যবোধ। অন্যের জায়গায় আমি হলে কী করতাম, আর আমার জায়গায় সে হলে কী করত, সেই বিচারবোধের নামই মূল্যবোধ। নীতিনৈতিকতা-মূল্যবোধ হলো: অন্যের স্থানে আমি হলে যে আচরণ প্রত্যাশা করতাম, আমার দিক থেকে অন্যদের সাথে সেই আচার-ব্যবহার-আদব-কায়দার অনুশীলন করা। বিশ্বাস-বিবেক-মূল্যবোধ মানে তাই সমবেদনাও বটে। অন্যের স্থানে আমি থাকলে যে বেদনা বোধ করতাম, অন্যের সেই বেদনাকে সুষমভাবে উপলব্ধি করার নামই সমবেদনা। বিশ্বাসী মানুষ মানেই তাই বিবেকবান, যুক্তিশীল, নীতিবোধ-মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ। অন্যদিকে, অন্ধ বিশ্বাস মানে জুলুমপন্থা। তার মধ্যে অভাব বোঝাপড়ার, বিচার-বিবেচনার, যুক্তিবুদ্ধির এবং বিবেকের। বিশ্বাসী মানুষ মাত্রেই আবার স্বাধীন মানুষও বটে। কেননা আন্তরিক বোঝাপড়ার পথে সে নিজেকে খোলা রাখে যেকোনো পরিণাম মোকাবেলা করার জন্য। বিশ্বাসীরা পথিক: সহজ পথের, সিরাতুল মুস্তাকিমের। পথ কখনো আগে থাকতে মুখস্ত থাকে না, জানা থাকে না। পথ মানেই অচেনা-অজানা পথ। পথ খোলা না থাকলে পথিক এগুতে পারে না। পথ বন্ধ তো পথিক অন্ধ। আর, মুখস্ত পথ মানে রাজার পথ, হুকুম তামিল করার পথ। অন্ধ বিশ্বাসী এই জন্যই পরাধীন। নিজেরই বদ্ধ বিশ্বাসের হাতে সে নিজে বন্দী। খোয়া গেছে মনুষ্যসন্তান হিসেবে তাঁর স্বভাবদত্ত-প্রকৃতিদত্ত-আল্লাহপ্রদত্ত স্বাধীনতার স্বাদ এবং সাধ। এবং নাস্তিকতাও এক প্রকার বিশ্বাস: আল্লাহর অস্তিত্বের প্রশ্নে অন্ধ-অবিশ্বাস। যা নাই তা না-থাকার পক্ষে তথাকথিত 'প্রমাণ' হাজির করা। কিন্তু যা নাই তার না-থাকা প্রমাণসাপেক্ষ হয় কোন যুক্তিতে তা ভাবার মতো সময় নাস্তিকের হাতে নাই। যুক্তির দিক থেকে দেখলে নাস্তিকতা তাই স্রেফ একটা 'ফ্যালাসি' (মিথ্যা যুক্তি, মিথ্যা বিশ্বাস বা হেত্বাভাস)।

পাঁচ. শাহবাগ-সমাবেশকে এগুতে হবে বিশ্বাস-যুক্তি-স্বাধীনতার পথে। আমাদেরকে বুঝতে হবে: এই তিনের মধ্যকার বহুল প্রচারিত আপাতবিরোধ আসলে যথাযথ উপলব্ধির অভাব মাত্র। অ্যানার্কিস্টদেরকে জবরদস্তিমূলকভাবে নিষিদ্ধ করতে যাওয়ার রাষ্ট্রীয় ভুল থেকে আজকের রাষ্ট্রপক্ষ এবং শাহবাগ-সমাবেশও চাইলে শিখতে পারে। নৈরাজ্যবাদকে নিষিদ্ধ করতে গিয়ে ইউরোপের রাজ রাষ্ট্রগুলো ডেকে এনেছিল দুই দশকের সহিংসতার হুল্লোড়। আজকের রাষ্ট্রপক্ষও কি সেই দিকেই নিয়ে যেতে চায় সমাজকে? যাঁদেরকে নিষিদ্ধ করার দাবি তুলছে তাঁদের রাষ্ট্র-সংগঠনপ্রণালী আর যাঁদের কাছে দাবি পেশ করছে শাহবাগ, তাঁদের রাষ্ট্র-সংগঠনপ্রণালী মূলত একই রকমের। এতকাল ধরে রাষ্ট্রকে যাঁরা খুন-গুম-নির্যাতন-কারাদণ্ড-মৃত্যুদণ্ড আর যুদ্ধের একটা অপ্রতিরোধ্য মেশিনে পরিণত করেছেন, সেই সব রাষ্ট্রাপরাধীদের গড়ে তোলা সংগঠন-কাঠামো দিয়েই কি যুদ্ধাপরাধীদের ন্যায্য বিচার সম্ভব? শাহবাগ-সমাবেশ কি রাষ্ট্রের বৈষম্য-বলপ্রয়োগ-ব্যক্তিমালিকানা-নির্ভর নখদন্ত-থাবাগুলোকেই আরো শানিয়ে তুলতে চায়? একবার বলেছি, সমাজ-সংগঠন-রাষ্ট্র যদি হুকুমতান্ত্রিক এবং যান্ত্রিকই থেকে যায় তাহলে নাগরিকেরা ব্যক্তিগতভাবে ও সামাজিকভাবে নিজেকে-পরিবারকে-সমাজসংস্থাগুলোকে পরিচালনা করতে পারেন না; কারণ সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণের মালিকানা থাকে হুকুমতন্ত্রের একেবারে ওপরে গুটিকয় লোকের হাতে। যা বলি নি তা হলো: এই ধরনের সমাজ-সংগঠনই শেখায় আনুগত্য, অন্ধ-বিশ্বাস, অন্ধ-অবিশ্বাস এবং বল প্রয়োগের বৈধতা। সুতরাং, ব্যক্তি-সামাজিক-রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড থেকে এই সাংগঠনিক উপায়-প্রণালী-কাঠামোকে বিদায় করতে না পারলে মতাদর্শিক অন্ধত্ব থেকে আমরা মুক্তি পাব না। সমাজে খুনোখুনি লেগেই থাকবে।

সেলিম রেজা নিউটন
লেখক : কবি-প্রাবন্ধিক-শিক্ষক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন