সোমবার, ১১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

মেঘ কাঁদে, কাঁদে মুক্তিযুদ্ধ

১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি কাল। ভাষা আন্দোলন এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার মহান মাস ফেব্রুয়ারি। গত বছর এই ফেব্রুয়ারি মাসের ১১ তারিখ সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনী খুন হয় নিজ বাসায়। পশ্চিম রাজা বাজারের ৫৮/এ/২, শাহজালাল লজ নামের অ্যাপার্টমেন্টিকে ১১ ফেব্রুয়ারি বেছে নেন তাদের খুনিরা। নিহতদের উভয়েই পেশায় ছিলেন সাংবাদিক, তাদের ঘরে ছিল একমাত্র পুত্র সন্তান মাহির সরওয়ার মেঘ। গত এক বছরে শত কষ্টের মাঝেও মেঘ অনেকটা বেড়ে উঠেছে। গেল শনিবার ৯ ফেব্রুয়ারি নানী-দাদীকে নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করে মেঘ। ১০ ফেব্রুয়ারি পরিবারের সকলকে নিয়ে শাহবাগ স্কয়ার পরিদর্শন এবং কিছুক্ষণ সময় দাঁড়িয়ে থাকেন হাসপাতালের পাশে।

২০১২ সালটা বৈশ্বিক মন্দার বছর। বাংলাদেশের পালেও হাওয়া লেগেছে। ব্যাংক লুটপাটের কারণে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ বন্ধ। নাগরিক হিসাবে মন্দার একটা ইম্পেক্ট মেঘের উপরও পড়েছে। দাদী-নানীর পরিবার দুটি আতংকে বসবাস আয় প্রবাহ কমে যায়। ২০১৩ সালে পরিবার দুটিতে অর্থনৈতিক টানাপোড়ন আরো বাড়তে থাকে। তাছাড়াও সামনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সুষুম নির্বাচনের দাবিতে রাজনৈতিক অঙ্গন ও রাজপথ থাকবে উত্তপ্ত। মেঘসহ দেশের অন্য কিশোর-কিশোরীরাও সমাজ ব্যবস্থাপনায় হবে ক্ষতিগ্রস্ত।

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির হলরুমে সে দিনের সাংবাদিক সম্মেলনে আরোও উপস্থিত ছিলেন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক এবং উভয় পরিবারের অন্যান্য সদস্যবৃন্দ। এক বছর গড়িয়ে গেল সাগর-রুনির হত্যাকারীর মূল আসামির সন্ধান মিলেনি। র্যাব পুলিশ ডিবি মিলে এ পর্যন্ত ১২৭ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। দেশে-বিদেশে অনেকের ডি এন এ পরীক্ষা করা হয়েছে। তদন্ত কাজে ব্যয়ও হয়েছে প্রচুর। হত্যাকাণ্ডে জড়িত খুনিদের সম্পর্কে প্রমাণযোগ্য কোন তথ্য খুঁজে পায়নি তদন্ত দল। হত্যার মোটিভও রয়ে গেছে অনুমান নির্ভর। সরকারের পুরস্কার ঘোষিত গার্ড এনামুল ধরা পড়েও কোন তথ্য দিতে পারেনি তাদের কাছে। অন্য সাংবাদিকরা জজ মিয়া সাজানোর নাটক না করার পরামর্শও দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট মহলকে।

উপস্থিত সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে কেঁদে ফেললেন মেঘের দাদীমা ছালেহা মনির। বার বার চোখ মুছলেন নানীমা নুরুন নাহার মির্জা। হলে উপস্থিত সদস্যরাও আবেগ-আপ্লুত হয়ে গেলেন। পুরো হলরুম নিশ্চুপ, কোন পিন-পতন শব্দ নেই, কয়েক মিনিট। এবার দাদী সাংবাদিকদের উদ্দেশে প্রশ্ন করলেন-'মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মেঘের সমস্ত দায়িত্ব কেন নিতে গেলেন? এজন্য প্রায়ই পাড়া প্রতিবেশীদের প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। মেঘ অতিরিক্ত একটি খেলনা চেয়ে যখন পায় না- তখন কেউ কেউ প্রশ্ন করেন প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে মাসে মাসে যে টাকা দেয়া হয় সে টাকা দিয়ে আপনারা কি করেন? সে সময় উত্তর দেয়ার কোন ভাষা থাকে না'। কেননা প্রধানমন্ত্রীকে তিনি খাটো করে বলতে পারেন না যে, প্রধানমন্ত্রী একটি মিথ্যা আশ্বাস দিয়েছিলেন। অনেক সময় মেঘ নানুকে প্রধানমন্ত্রীর নিকট যাওয়ার জন্যও বলে, কিন্তু নানু নিশ্চুপ থাকেন। নাতীর এমন প্রশ্নের জবাবে নানীও কাঁদেন, দাদীও কাঁদেন। বাসায় রেডিও শুনে, টেলিভিশন ও পত্রিকা দেখে বাবা-মায়ের হত্যাকারীদের প্রতিশোধ নিতে মুক্তিযুদ্ধ করার অঙ্গীকার করে সে। বার বার চিত্কার করে বলে ওঠে আমি মুক্তিযুদ্ধ চাই। সে বলে উঠে সাভার স্মৃতি সৌধ, মিরপুর বদ্ধভূমি এবং শহীদ মিনারে যাওয়ার। শেষতক গতকাল গিয়েছিল শাহবাগ স্কয়ারে।

মেঘ বুঝে উঠতে পারেনি যে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও কেঁদে বেড়ায়। পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের থাকার ব্যবস্থা সামান্য থাকলেও ভাতার পরিমাণ খুবই অপ্রতুল, চিকিত্সার সুব্যবস্থা নেই বল্লেই চলে। রাজাকার আল-বদররা মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট নিয়ে করছে বাণিজ্য। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকের সার্টিফিকেটও নেই, মাহির সরওয়ার মেঘ শাহবাগ হোটেলের নীচে দাঁড়িয়ে ছিল অনেকক্ষণ। তার সাথে ছিল সাগর সরওয়ারের মা ছালেহা মনির এবং পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন নানী নুরুন নাহার মির্জা। হঠাত্ নানী বলে উঠলেন এ হোটেলটাতেই ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাহিনী, আল-বদর ও রাজাকাররা তাদের একটি ক্যাম্প বানিয়েছিল। ভিতরে ছিল টর্চার সেল ও নারী নির্যাতনের রম্যশালা। যারা নির্যাতন ও অত্যাচারে মারা যেতো তাদেরকে হাতিরঝিলে ফেলে দেয়া হতো অথবা লাশ গুম করে দেয়া হতো। কিন্তু মেঘ একটি বছর পার করলো সরকারের মিথ্যা কমিটমেন্টের উপর। সরকার শুধু সাগর রুনির হত্যাকারীদের ধরতে পারছেন না এমন নয়, তারা যে কোন খুন বা ধর্ষণের বিচারও করতে পারছেন না। সরকার শুধু ব্যস্ত পদ্মাসেতুর মত ডেড হর্স বিষয় নিয়ে।

মুক্তিযোদ্ধাদের ভাবনা সুখী সমৃদ্ধি বাংলাদেশ গড়া। সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা। আমরা সাগর-রুনির হত্যাকারীদের যেমন বিচার চাই তেমন বিচার প্রার্থনা করি রাজাকার আল-বদরদের।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন