সোমবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০১৩

বাংলাদেশে লেনিনবাদ


লেনিন উদার গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন না।  উদার গণতন্ত্র তার কাছে মনে হয়েছিল বুজোয়া বখামি। মার্কসবাদ ও লেনিনবাদ সমার্থক নয়। মার্কস তার জীবনের একপর্যায়ে ছিলেন বেশ কিছুটা গণতন্ত্রী। মার্কস তাই সমর্থন করেছিলেন বিলাতের চার্টিস্ট (Chartist) আন্দোলনকে। বিলাতে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে  চার্টিস্টরা দাবি করেন, প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের সার্বজনীন ভোটাধিকার, গোপনভাবে ভোট প্রদানের ব্যবস্থা ও পার্লামেন্টে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের (এমপি) বেতন প্রদান আর বছরে কম করে একবার পার্লামেন্টের অধিবেশন।  চার্টিস্টরা মনে করেছিলেন, পুরুষের সার্বজনীন ভোটাধিকারের মাধ্যমে বাড়বে সর্বসাধারণের রাজনৈতিক ক্ষমতা। আর এই ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আইন করে সম্ভব হবে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন। মার্কস মনে করেছিলেন, অন্য দেশের তুলনায়  ব্রিটেন আছে এগিয়ে। ব্রিটেনে গণতান্ত্রিক উপায়ে শ্রেণিবিহীন সমাজব্যবস্থা, তাই সম্ভব হতে পারবে।  কিন্তু তিনি এর পাশাপাশি ভেবেছিলেন, সারা ইউরোপে বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে গড়তে হবে শ্রেণিবিহীন সমাজ। ১৮৪৮ সালে মার্কস ও তার সহযোগী এঙ্গেলস রচনা করেন তাদের বিখ্যাত কম্যুনিস্ট ম্যানুফেস্টোÑ যাতে তারা বলেন, দুনিয়ার সর্বহারা এক হও, বিপ্লব করে ক্ষমতা দখল করো। তা না হলে তোমাদের মুক্তি আসবে না। মার্কস ও এঙ্গেলস সর্বহারা বলতে  বুঝিয়েছেন সেই সব মানুষকে, যাদের জীবিকার একমাত্র উপায় হলো শারীরিক শ্রম করে কিছু উপার্জন করে কোনো মতে বেঁচে থাকতে পারা।
যারা শ্রেণিহীন সমাজ গড়তে চান, তাদের সাধারণভাবে বলা যায় সমাজতন্ত্রী। সমাজতন্ত্রীদের দুই ভাগে ভাগ করা চলে। এক ভাগের মতে, পার্লামেন্টের মাধ্যমে ধাপে ধাপে আইন প্রণয়ন করে সম্ভব হবে শ্রেণিবিহীন সমাজ গঠন করা। আর একদল মনে করে, বিপ্লব ছাড়া শ্রেণিবিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। বিপ্লব ছাড়া শ্রেণিবিহীন সমাজ গড়ে তোলা যাবে না বলে যারা মনে করেন তাদের উল্লেখ করা হয় কম্যুনিস্ট হিসেবে। আর যারা মনে করেন, পার্লামেন্ট বা আইনসভার মাধ্যমে আইন করে ধাপে ধাপে শ্রেণিবিহীন সমাজ গড়া সম্ভব হবে, তাদের বলা  হয় গণতান্ত্রিক সমাজবাদী (Social Democrat) । লেনিন ছিলেন কম্যুনিস্ট। তিনি বলেন, বিপ্লব করে ক্ষমতা দখল করতে হলে গড়তে হবে শক্তিশালী কম্যুনিস্ট দল। তিনি কম্যুনিস্ট দল গড়ে তুলতে চান পেশাদার বিপ্লবীদের মাধ্যমে। পেশাদার বিপ্লবী (Professional Revolutionaries) বলতে বোঝান, এমন রাজনৈতিক কর্মীদের, যাদের ধ্যানজ্ঞান হবে বিপ্লব করা। বিপ্লবের পর যারা নিবেদিতপ্রাণ হয়ে কাজ করে যাবেন, শ্রেণিহীন সমাজ গঠনের লক্ষ্যে। এসব কর্মীর বেতন দিতে হবে পার্টির পক্ষ থেকে, যাতে করে তাদের সময় নষ্ট না করতে হয় জীবিকার অন্বেষণে। লেনিন এসব কথা বলেন তার একটি বইতে। বইটির ইংরেজি অনুবাদের নাম হলো `What is to be Done’। বইটি তিনি লিখেছিলেন ১৯০২ সালে। এই বইটিতে পাওয়া যায় বিপ্লবী লেনিনের চিন্তাচেতনার সারমর্ম। লেনিন উদার গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি চেয়েছেন, এক দলের রাজত্ব। যারা বিপ্লব করে ক্ষমতা দখল করবে। আর এগিয়ে চলবে শ্রেণিহীন সমাজ গঠনের কাজে। সব দেশেই লেনিনবাদীরা গণতন্ত্রের বিরোধী। তারা চান এক দলের রাজত্ব।  বাংলাদেশের লেনিনবাদীদের চিন্তাচেতনা একই সূত্রে গাঁথা। তবে এখানে তারা অনুপ্রবিষ্ট হয়ে পড়েছেন আওয়ামী লীগের মধ্যে। আর  আওয়ামী লীগের নামে চেয়েছেন ও চাচ্ছেন এক দলের রাজত্ব। যে দল চলবে বেনামিতে তাদের নেতৃত্বে। তাদের এই চেষ্টা শুরু হয়েছে অনেক দিন আগে থেকে।
আমার মনে পড়ে ১৯৭১ সালের কথা। তাজউদ্দীন ছিলেন একজন লেনিনবাদী। তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে গঠিত হয় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের দফতর ছিল কলকাতায়। ইন্দিরা গান্ধী ঠিক লেনিনবাদী ছিলেন না। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীর সাথে গড়ে উঠেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের বিশেষ সম্পর্ক। আর সেই সুবাদে ইন্দিরা কংগ্রেসের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের  সমর্থক ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টির (CPI) সৃষ্টি হতে পেরেছিল নিকট সম্পর্ক। ইন্দিরা গান্ধী বলতেনÑ তার লক্ষ্য ভারতীয় জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। বাস্তবে ভারতে কার্যত চলেছিল ইন্দিরা কংগ্রেসের নেতৃত্বে এক দলের সরকার। ইন্দিরা গান্ধী যদিও দাবি করতেন যে, তার আদর্শ হলো ধর্মনিরপেক্ষতা। কিন্তু ভোট পাওয়ার জন্য তিনি প্রতীক হিসেবে  গ্রহণ করতেন গরু ও বাছুর। গোমাতা হিন্দুদের কাছে পূজনীয়। কংগ্রেসের এই প্রতীকটি ছিল আসলে বিশেষভাবে হিন্দুঘেঁষা। পশ্চিমবঙ্গে কম্যুনিস্টরা দুই ভাগে বিভক্ত ছিলেন। এক ভাগ সমর্থন করতেন সোভিয়েত ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতিকে। আর চাইতেন ইন্দিরা কংগ্রেস থাক সোভিয়েত প্রভাবে। অন্য দিকে জ্যোতি বসু ছিলেন বেশ কিছুটা চৈনিক কম্যুনিস্ট পার্টি। জ্যোতি বসুর কম্যুনিস্ট পার্টির নাম ছিল মার্কসবাদী কম্যুনিস্ট পার্টি (CPIM)। জ্যোতি বসুর অনুসারীরা গরু-বাছুর প্রতীক সম্পর্কে বলতেনÑ দেশে এলো ইন্দিরা গাই, সঙ্গে বাছুর সিপিআই।
১৯৭১ সালে আমি ছিলাম কলকাতায়। ভারতের রাজনীতির অনেক কিছু জানার সুযোগ ঘটেছিল। ভারতে CPI চাচ্ছিল সাবেক পাকিস্তান ভেঙে পড়–ক। অন্য দিকে CPIM চাচ্ছিল সাবেক পাকিস্তান টিকে থাকুক। কারণ তারা  মনে করতেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন চাচ্ছে না বিশ্ববিপ্লব। কিন্তু চীন চাচ্ছে বিশ্ববিপ্লব। পাকিস্তান চীনের বন্ধু। পাকিস্তান তাই শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠবে বিশ্ববিপ্লবের সহায়ক শক্তি। আমি রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ছিলাম না। কলকাতায় আমার এক ভাই চাকরি করতেন। আমি ১৯৭১ সালে তার কাছে গিয়ে আশ্রয় নিই। কলকাতায় আমার সাথে সাক্ষাৎ ঘটে আমার ছেলেবেলার অনেক হিন্দু বন্ধুদের সাথে। এদের মধ্যে একজন ছিলেন CPI -এর গোঁড়া সমর্থক ও সার্বক্ষণিক কর্মী। তার মুখে শুনতে পেতাম পশ্চিমবঙ্গের ও ভারতের রাজনৈতিক অনেক কথা। তার মাধ্যমেই প্রথম জানতে পারি, ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে হতে যাচ্ছে ২৫ বছরের মৈত্রী চুক্তি। মৈত্রী চুক্তি হওয়ার পর ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় সেনাকে নির্দেশ দিলেন পাকিস্তান আক্রমণের জন্য। আমার চোখে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে, আমারা যাকে বলছি মুক্তিযুদ্ধ, তা আসলে হয়ে উঠতে যাচ্ছে ভারতের পাকিস্তানকে ভেঙে দেয়ার যুদ্ধ। আর তাজউদ্দীন সরকার করছেন সেই একই লক্ষ্যে কাজ। হঠাৎ একদিন আমার সাথে পরিচয় ঘটে ঢাকা থেকে যাওয়া এক সাংবাদিকের সাথে।  তার সাথে আমার জমে ওঠে গল্প।  তিনি আমাকে বলেনÑ তিনি যাচ্ছেন খন্দকার মোশতাক আহমদের সাথে দেখা করতে। আমি যদি চাই, তবে যেতে পারি তার সাথে। আমার পক্ষে সম্ভব হবে রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহকে অনেক  সহজভাবে উপলব্ধি করতে পারা। কৌতূহলবশে আমি গিয়েছিলাম তার সাথে। মোশতাক আহমেদ বললেনÑ তাজউদ্দীনের লক্ষ্য সফল হবে না।  তিনি জোর দিয়েই বললেনÑ আমি (মোশতাক) বেঁচে থাকতে নয়। মোশতাককে আরো বলতে শুনলাম, ভারতের হাতে সব তাস নেই।  অন্য পক্ষের হাতেও আছে তাস। তারা তুরুপ করবে। আমি খুব অবাক হলাম তার একটি কথা শুনে। তিনি বললেনÑ  শেখ মুজিব নন, কথা হচ্ছিল আমাকেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করবার। বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাকে দিচ্ছিল সমর্থন। আমার কাছে বিষয়টা বেশ কিছুটা জটিল মনে হয়েছিল। আমি ভাবছিলাম, তবে কেন তিনি আসতে গেলেন ঢাকা থেকে কলকাতায়। যা হোক, আমি কোনো আলোচনার মধ্যে না যেয়ে কথাগুলো শুনে গিয়েছিলাম। যার সাথে গিয়েছিলাম তার সাথেই এসেছিলাম ফিরে।
ঢাকা থেকে ১৯৭১ সালে অনেক বুদ্ধিজীবী গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন কলকাতায়। এদের মধ্যে একজন ছিলেন কবি সিকানদার আবু  জাফর। জাফর সাহেবের সাথে (যাকে আমি ডাকতাম জাফর ভাই বলে) ছিল আমার ঘনিষ্ঠ পরিচয়। যখন ঢাকায় চাকরি করতাম, তখন তার মাসিক সমকাল পত্রিকায় কিছু কিছু  লিখতাম। জাফর সাহেব আমাকে বলেন, তিনি কলকাতা থেকে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করতে যাচ্ছেন। যার  নাম হবে অভিযান। আমাকে লিখতে হবে এতে। আমি বলি, যদি সময় পাই লিখব। কলকাতায় ব্যস্ত আছি নানা বিষয়ে পড়াশোনা নিয়ে। কলকাতায় আসতে পেরে আমি ব্যক্তিগতভাবে  উপকৃত হয়েছি। এই পড়াশোনার সুযোগ আমার কাছে এসেছে যথেষ্ট অপ্রত্যাশিতভাবে। হঠাৎ আমার মনে একটা প্রশ্ন জাগল। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করে বসি, কলকাতায় খালি হাতে এসে পত্রিকা প্রকাশের মতো টাকা কিভাবে জোগাড় করতে পারলেন? তিনি আমাকে কিছুটা বিস্মিত করে বললেন, টাকা দিয়েছেন খন্দকার মোশতাক আহমদ। আমি বলি, আপনি কি মোস্তাকপন্থী। জাফর ভাই বলেন, ঠিক তা নয়। তবে তাজউদ্দীন হয়ে পড়েছেন খুবই ভারতঘেঁষা। কিন্তু মোশতাক তা নন। তাই কিছুটা আছি মোশতাকের সাথে। এর আগে একদিন দেখা হয়েছিল খান সারওয়ার মুর্শিদের সাথে। তার সাথে আমার ছিল মুখচেনা পরিচয়। কোনো ঘনিষ্ঠ পরিচয় তার সাথে আমার ছিল না। কিন্তু তিনি আমার সাথে অনেকক্ষণ কথা বলেন। জিজ্ঞাসা করেন, ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি সম্বন্ধে। আমি তার কথার উত্তরে বলিÑ  রাজনীতির ভেতরের ব্যাপার আমি জানি না। তবে ভারতের সামরিক শক্তি পাকিস্তানের তুলনায় খুব একটা উন্নত মনে হচ্ছে না আমার কাছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক সহায়তা ছাড়া ভারতের পক্ষে সম্ভব হবে না পাকিস্তানের সাথে লড়াই করে জিততে পারা। খান সারওয়ার মুর্শিদ এ সময় ছিলেন তাজউদ্দীন সরকারের একজন উপদেষ্টা। সারোয়ার মুর্শিদ সাহেব আমার সাথে সহমত পোষণ করলেন না। বললেন, এই চুক্তির ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতবৈরী হয়ে উঠবে, এবং ভারতকে এর জন্য বিপাকে পড়তে হবে। এ রকম অনেকের কাছ থেকে অনেক টুকরো কথা শুনেছিলাম।
ভারত পশ্চিম পাকিস্তান আক্রমণ করেছিল ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ শুরু করেছিল এর অনেক আগে থেকেই। পূর্ব পাকিস্তানে যখন ঢুকত ভারতের কমান্ড বাহিনী, তখন সাথে নিত বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাকে। এভাবে তারা করে চলেছিল ৩ ডিসেম্বরের অনেক আগে থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ। ৩ ডিসেম্বরে তারা সরাসরি সৈন্য ঢোকায় পূর্ব পাকিস্তানে। এই যুদ্ধ ভারতের সেনা বাহিনীর উপদেষ্টা হিসেবে এসেছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের কয়েকজন সমরবিশারদ। কার্যত তারাই রচনা করেন ১৯৭১-এর ডিসেম্বরের পরিকল্পনা। যুদ্ধটা দাঁড়িয়ে গিয়েছিল শেষ  পর্যন্ত পাকিস্তান ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে। যুদ্ধে জিতেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। কিন্তু জেতা পুরোপুরি বলা যায় বলেও মনে হয় না।  পাকিস্তানের পক্ষে শেষ পর্যন্ত এসে দাঁড়িয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। নেপথ্যে মার্কিন চাপে বন্ধ হয়েছিল যুদ্ধ। এসব কথা জেনেছিলাম নানা লোকের কাছ থেকে অনেক টুকরো খবর শুনে এবং তাদের  একত্র করে।
শেখ মুজিব পাকিস্তান  থেকে ভারত হয়ে বাংলাদেশে আসেন না। তিনি ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি যান লন্ডন। সেখান থেকে ১০ জানুয়ারি দিল্লি হয়ে আসেন ঢাকায়, ১২ জানুয়ারি তিনি ভার নেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। প্রথমে তার সাথে তাজউদ্দীনের বিরোধ শুরু হয়। বিরোধটা মোটামুটি ছিল ব্যক্তিত্বের সঙ্ঘাতের। এর সাথে কিছুটা মতবাদিক দ্বন্দ্বও ছিল। শেখ মুজিব ভারতের সাথে তাজউদ্দীনের মতো অতটা মাখামাখি করা পছন্দ করেননি। পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়ায় যে, তাজউদ্দীন শেষ পর্যন্ত মন্ত্রিসভা পরিত্যাগ করতে বাধ্য হন। কিন্তু একই সাথে আবার সৃষ্টি হলো নতুন সমস্যা। সমস্যার সৃষ্টি হলো খন্দকার মোশতাককে নিয়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারকে চাপ প্রয়োগ করতে শুরু করল খন্দকার মোশতাককে প্রধানমন্ত্রী করার জন্য। এ সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন এগিয়ে এলো শেখ মুজিবের পক্ষে। আর এ দেশের লেনিনবাদী কম্যুনিস্টরা পক্ষ নিল শেখ মুজিবের। শেখ মুজিব ১৯৭৪ সালে চিকিৎসার নাম করে যান মস্কোতে। সেখানে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের সুপ্রিম সোভিয়েতের প্রেসিডেন্ট এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের কম্যুনিস্ট পার্টির ফার্স্ট সেক্রেটারি লিওনিদ ব্রেজেনেভের সাথে দেখা করেন। ৯ এপ্রিল ব্রেজেনেভের সাথে তার হয় বিস্তারিত আলোচনা। মস্কো থেকে তিনি যান দিল্লি। দিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে আলোচনা করেন। দিল্লি থেকে আবার যান মস্কো। তার পরে ফেরেন ঢাকায়। ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি শেখ মুজিব গঠন করেন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ। সংক্ষেপে বাকশাল। আর বাকশাল ছাড়া সব রাজনৈতিক দলকে করেন বিলুপ্ত। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের অনুসরণে এক দলের সরকার। তিনি (শেখ মুজিব) চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের সংবিধানে পরিবর্তন আনেন। ২৫ জানুয়ারি তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এবং সেই সাথে নিযুক্ত হন বাকশালের সেক্রেটারির পদে। বেশ কিছুটা ব্রেজেনেভেরই মতো। বাকশালে  এসে যোগ দেয় মণি সিংহের নেতৃতাধীন কম্যুনিস্ট পার্টি ও অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ। কিন্তু এসব করে শেখ মুজিব ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘটে সামরিক অভ্যুত্থান। নিহত হন শেখ মুজিব।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আমি ছিলাম ঢাকায় আমার এক ভাইয়ের বাসায়। আমি ঢাকায় গিয়েছিলাম একান্ত ব্যক্তিগত কাজে। খুব ভোরে আমার এক ভাতিজার যাওয়ার কথা  ছিল ধানন্ডিতে তার এক বন্ধুর বাসায়। সেখান থেকে তার যাওয়ার কথা ছিল বনভোজনে। খুব ভোরে টেলিফোন বেজে ওঠে। আমার ভাতিজাকে তার বন্ধু বলে, ধানমন্ডিতে আসিস না। এ দিকে খুব গোলাগুলি চলছে। মনে হচ্ছে শেখ মুজিব আর বেঁচে নেই। আমার ভাতিজার বন্ধু থকত শেখ মুজিবের বাড়ির বেশ কাছেই। কিছুক্ষণ পর রেডিওতে শুনলাম, মেজর (অব:) ডালিম বলছেন, শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন খন্দকার মোশতাক আহমদ। দেশে জারি করা হয়েছে মার্শল ল। আমি আমার ভাইয়ের বাড়ির ছাদে উঠে বাইনোকুলার দিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে থাকি। ঢাকা শহরের পথঘাট হয়ে পড়েছিল একেবারেই জনশূন্য। এ রকম জনশূন্য পথঘাট এর আগে আমি দেখিনি।
বর্তমানে শুনছি, সাবেক মস্কোপন্থীরা আওয়ামী লীগের নামে চালাচ্ছে সরকার। শেখ হাসিনা হলেন তাদের শিখণ্ডী মাত্র। বাংলাদেশে সাবেক লেনিনপন্থীদের ক্ষমতায় এনেছে ভারতের কংগ্রেস সরকার। ২০০৮-এর নির্বাচনে ভারত এ দেশে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছিল। নির্বাচনে ঘটাতে পেরেছিল বড় রকমের কারচুপি। কারচুপির ব্যাপারটা তখন যথেষ্ট স্পষ্ট ছিল না। কিন্তু বিভিন্ন সূত্র এখন বলছে কারচুপির কথা। বিএনপি গত নির্বাচনে হেরেছে। কেবল কারচুপির কারণেই যে হেরেছে, তা বলা যথাযথ নয়। তবে, কারচুপি না হলে সে অত করুণভাবে পরাজিত হতে পারত না।
আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা তোফায়েল আহমেদ সম্প্রতি বলেছেন (বাংলাদেশ প্রতিদিন; ৫ জানুয়ারি-২০১৩)Ñ আমাদের চলতে হবে লেনিনের নেতৃত্বে। ছাত্র ইউনিয়ন, কম্যুনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ থেকে যারা এসেছেন, তারা হয়তো খুবই আদর্শ মানের। আমরা হয়তো নিকৃষ্ট। নিকৃষ্টদের চলতে হয় উৎকৃষ্টদের কথা শুনে। তিনি বলেন- মতিয়া চৌধুরী ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন। নুহউল আলম লেনিনও ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি। তারা আজীবন আদর্শের জন্য সংগ্রাম করেছেন। আমরা হয়তো সুবিধাবাদী। তাই এ পর্যায়ে এসে আজকে লেনিনের নেতৃত্বে আমাদের কাজ করতে হবে। তোফায়েলের এই বক্তব্য হলো একজন বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতার ক্ষেদ উক্তি মাত্র। মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগ গুরুতরভাবেই বিভক্ত হয়ে পড়ছে। হয়তো ঠিক ১৯৭৫-এর মতো নয়। কিন্তু শেখ হাসিনা পড়তে পারেন মহা বিপর্যয়েরই মধ্যে। ১৯৭৫ আর আজকের পৃথিবী এক নয়। ১৯৭৫-এ কেউ ভাবতে পারেনি বিপুল সামরিক শক্তির অধিকারী সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়বে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল ১৫টি রিপাবলিকে বিভক্ত। এর মধ্যে রাশিয়া ছিল সবচেয়ে বড়। রাশিয়ায় মানুষ এখন চাচ্ছে বহুদলীয় গণতন্ত্র। কম্যুনিস্ট পার্টি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কোনো রিপাবলিকই ক্ষমতায় নেই। বাংলাদেশে লেনিনবাদীরা ক’দিন ক্ষমতায় থাকতে পারবেন তা অনুমান করা যাচ্ছে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত এখন এক অক্ষে থাকলেও বাংলদেশের ব্যাপারে মার্কিন-ভারত মতানৈক্য খুব স্পষ্ট হয় উঠেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে না, বাংলাদেশে জঙ্গি ইসলামের উত্থান ঘটা সম্ভব হিসেবে। কিন্তু ভারত প্রচার করে চলেছে, বাংলাদেশ হয়ে উঠছে জঙ্গি ইসলামের ঘাঁটি। বাংলাদেশের লেনিনবাদীরা জঙ্গি ইসলামের উত্থান সম্পর্কে মুখর হয়ে উঠেছেন। তাদের বক্তব্য আর ভারত সরকারের বক্তব্য হয়ে উঠেছে একই। বংলাদেশের মানুষ উদার গণতন্ত্রের পক্ষে। তারা মনে করছে না, বাংলাদেশ হতে যাচ্ছে একটি জঙ্গি ইসলামি রাষ্ট্র। লেনিনবাদীরা ক্রমশই এ দেশে হয়ে পড়ছেন জনবিচ্ছিন্ন। ১৯১৭ সালে লেনিন সামরিক  ক্যুদেতার মাধ্যমে রাশিয়ায় ক্ষমতায় আসেন। লেনিনের ক্ষমতা লাভ সারা বিশ্বে জাগিয়েছিল বিশেষ সাড়া। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর লেনিনবাদ হয়ে উঠেছে একটি রদ্দি মতবাদ। এখনো অনেক মানুষ চান সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। কিন্তু তারা এটা চান গণতান্ত্রিক উপায়ে। এক দলের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে নয়।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন