শুক্রবার, ১১ জানুয়ারী, ২০১৩

কেন ব্যর্থরাষ্ট্র হতে যাবে বাংলাদেশ


বাংলাদেশ কেন অকার্যকর একটি দেশ হতে যাবেÑ এ প্রশ্ন এখন অনেকের মধ্যে। ব্যর্থরাষ্ট্র হওয়ার আশঙ্কা যেসব দেশের রয়েছে তার শীর্ষ বিশের মধ্যে বারবার বাংলাদেশের নাম এসে যাওয়ায় আলোচিত হচ্ছে এ প্রশ্ন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফান্ড ফর পিচ ও ফরেন পলিসি সাময়িকী যৌথভাবে প্রতি বছর বিভিন্ন সূচককে বিবেচনায় এনে রাষ্ট্রগুলোর একটি তালিকা প্রকাশ করে। সূচকে ব্যবহারের মতো তথ্য বিশ্বের যেসব দেশের পাওয়া যায় সেগুলোকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয় এ তালিকায়।
এ তালিকার শীর্ষ দেশগুলো হলো ব্যর্থরাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে রেড অ্যালার্টভুক্ত রাষ্ট্র। এর পরে রয়েছে সতর্কসঙ্কেতের দেশগুলোÑ যেসব রাষ্ট্র সাবধান না হলে লাল সঙ্কেত বেজে উঠতে পারে। এরপর রয়েছে মধ্য অবস্থানের দেশÑ যেগুলোর ঝুঁকি তেমন একটা নেই। তার পরের দেশগুলো হলো টেকসই রাষ্ট্র। এসব দেশের সব সূচকের অবস্থা সন্তোষজনক। অদূরভবিষ্যতে শঙ্কিত হওয়ার মতো কোনো কারণ এসব দেশের নেই।
রেল অ্যালার্টে বাংলাদেশ
ফান্ড ফর পিচ ২০১২ সালে বিশ্বের ১৭৭টি দেশের একটি তালিকা প্রকাশ করে। এ তালিকার ৩৩টি দেশের জন্য রয়েছে রেড অ্যালার্ট। যথারীতি এসব দেশের শীর্ষে রয়েছে সোমালিয়া। তারপরে কঙ্গো, সুদান, ইথিওপিয়া, ভুরুন্ডির মতো দেশের অবস্থান। এ তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ২৯ নম্বরে। ২০১১ সালের তুলনায় বাংলাদেশের ক্রম অবস্থান চার ধাপ নিচে নেমেছে। আর ব্যর্থরাষ্ট্র হওয়ার ঝুঁকির যে নম্বর তা ২ দশমিক ১ কমে দাঁড়িয়েছে ৯২.২। তালিকার শীর্ষ দেশ সোমালিয়ার চেয়ে ১২.৭ পয়েন্ট কম আর সর্বনিম্নে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ ফিনল্যান্ডের চেয়ে ৭২.২ পয়েন্ট বেশি বাংলাদেশের নম্বর। ব্যর্থ হওয়ার প্রশ্নটি আলোচনায় আসার আরেকটি কারণ হলো যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স কাউন্সিলের (এনআইসি) কয়েক দিন আগে প্রকাশ করা একটি প্রতিবেদন। ‘ওয়ার্ল্ড ট্রেডস ২০৩০ : অলটারনেটিভ ওয়ার্ল্ড’ শীর্ষক এ প্রতিবেদনে যে সব দেশের ব্যর্থরাষ্ট্র হওয়ার উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে তার তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ২০৩০ সালে ১৫ নম্বরে থাকবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ তালিকায় ২০০৮ সালে ব্যর্থরাষ্ট্রের ঝুঁকি তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান দেখানো হয়েছিল ১১ নম্বরে।
কেন সৃষ্টি হয় ব্যর্থরাষ্ট্রের ঝুঁকি?
রাষ্ট্র হিসেবে একটি দেশ কেন ব্যর্থ চিহ্নিত হবে তা নির্ধারণ করা হয় কতগুলো সূচকের ভিত্তিতে। রাষ্ট্রকে ব্যর্থ বিবেচনা করা হতে পারে এমন একটি পর্যায়ে গেলে যখন দেশটির সার্বভৌম সরকার কতগুলো মৌলিক শর্ত ও দায়িত্ব পালন করতে আর সমর্থ হয় না। থিংকট্যাংক ফান্ড ফর পিচ ও ফরেন পলিসি  ১২টি সূচক ব্যবহার করে প্রতিটি সূচকের জন্য রাষ্ট্রের ব্যর্থতার মাত্রা বিবেচনায় শূন্য থেকে ১০ পর্যন্ত নম্বর দিয়েছে। এতে মোট নম্বর দাঁড়ায় ১২০। জাতিসঙ্ঘের সদস্যদেশগুলোর অবস্থানই শুধু বিবেচনায় আনা হয়েছে এখানে। যেসব দেশ ৭৫ শতাংশ বা তার বেশি নম্বর পেয়েছে সেগুলোর প্রতি ব্যর্থরাষ্ট্রের লাল সঙ্কেত দেখানো হয়েছে। ২০১২ সালে এ ধরনের দেশ রয়েছে ৩৩টি। ৫০ শতাংশ বা তার বেশি নম্বর পেয়েছে এমন দেশকে দেখানো হয়েছে কমলা সঙ্কেত। এ ধরনের দেশ রয়েছে ৯২টি। তালিকায় হলুদ সঙ্কেতের দেশ রয়েছে ৩৯টি। ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ নম্বর পেয়েছে এমন দেশগুলো। ২৫ শতাংশের নিচে যেসব দেশের নম্বর তাদের প্রতি রয়েছে সবুজ সঙ্কেত।
ব্যর্থরাষ্ট্রের সর্বসম্মত সংজ্ঞা নিরূপণ না হলেও ঝুঁকি তালিকা যারা তৈরি করে সেই ফান্ড ফর পিচ ব্যর্থরাষ্ট্রের কতগুলো বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেছে। এসব রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য এমন হবে সেসব দেশের সরকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবে নিজস্ব ভূখণ্ডের ওপর অথবা আইনানুগ শক্তি প্রয়োগের একক ক্ষমতা সরকারের আর থাকবে না। রাষ্ট্রে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের আইনানুগ যে কর্তৃপক্ষ তাতে ভাঙন সৃষ্টি হবে। জনগণকে প্রয়োজনীয় সেবা প্রদানে অসমর্থ হয়ে পড়বে রাষ্ট্র। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পূর্ণাঙ্গ সদস্য হিসেবে অন্য দেশের সাথে আদান-প্রদান বা আলোচনায় সামর্থ্যও হারিয়ে ফেলব রাষ্ট্র। সার কথা হলো একটি ব্যর্থরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকার এতটা দুর্বল ও অকার্যকর হয় যে দেশের ওপর কার্যকর নিয়ন্ত্রণ সরকারের থাকে না, জনগণকে সেবা দেয়া যায় না, দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ন হয় সর্বগ্রাসী। দেশের মানুষ ইচ্ছার বাইরে বাস্তুচ্যুত শরণার্থী হয়ে পড়ে অথবা স্থান পরিবর্তনে বাধ্য হয় আর অর্থনৈতিক অবস্থার ঘটে দ্রুত অবনতি। কোনো দেশকে ‘ব্যর্থরাষ্ট্র’ ঘোষণা করাটা সাধারণভাবে হয় বিতর্কিত। আর একতরফাভাবে এটি করা হলে তার ভূ-রাজনৈতিক নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াও দেখা দেয়।
ব্যর্থতার সামাজিক কারণ
রাষ্ট্রের ব্যর্থতা বিবেচনায় সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক তিন ধরনের সূচক ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে সামাজিক চার সূচকের প্রথমটি হলো জনসংখ্যাগত চাপ। খাদ্যপ্রাপ্তি এবং জীবনধারণের অন্যান্য সম্পদের তুলনায় অধিক জনসংখ্যাঘনত্ব বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করে রাষ্ট্রে। এই চাপ আসে জনসংখ্যার বিন্যাসের ধরন, সীমান্তবিরোধ, জমির মালিকানা ও দখল, বাইরে যাওয়ার পরিবহন সুবিধা, ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক স্থানগুলোর নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশগত বিপত্তির নৈকট্য থেকে।
ব্যর্থতা নিরূপণের দ্বিতীয় সামাজিক সূচক হলো ব্যাপক শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত জনসংখ্যা। সাধারণ বা টার্গেট করা করা মানুষের ওপর সহিংসতা বা দমন-পীড়ন চলে এ ধরনের দেশে। খাদ্যসঙ্কট, রোগ-ব্যাধি, বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট, ভূমি নিয়ে প্রতিযোগিতা, অভাব ও অস্থিরতা ব্যাপক মানবিক ও নিরাপত্তা সমস্যা সৃষ্টি করে। এটি দেশের অভ্যন্তরে বা দু’টি দেশের মধ্যেও হতে পারে এ সমস্যা।
ব্যর্থরাষ্ট্রের তৃতীয় সামাজিক সূচকটি হলো প্রতিহিংসাপরায়ণদের প্রতিশোধ নেয়ার উত্তরাধিকার। সাম্প্রতিক বা অতীতের অবিচারের প্রতিশোধ গ্রহণের প্রবণতা চলতে থাকেÑ এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেটি শতাব্দীর পুরনোও হতে পারে। বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক জনগোষ্ঠী বা রাষ্ট্রযন্ত্রকর্তৃক বঞ্চিত বা দমনের শিকার বিশেষ কোনো গ্রুপের প্রতিহিংসাপরায়ণতা বা ক্ষোভের প্রকাশ থেকেও ঘটে থাকতে পারে এটি।
দেশ থেকে অব্যাহত ও স্থায়ী বহির্গমন হলো ব্যর্থরাষ্ট্রের চতুর্থ সামাজিক সূচক। পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক ভিন্নমতালম্বী ও মধ্যবিত্তদের স্বেচ্ছা অভিবাসনের মাধ্যমে মেধা বাইরে চলে যাওয়ার ঘটনা ঘটে এ ধরনের দেশে। কোনো দেশের প্রবাসী ও অভিবাসী সম্প্রদায় ক্রমাগতভাবে বাড়তে থাকাও সূচকের একটি অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যর্থতা
ব্যর্থরাষ্ট্র নিরূপণে অর্থনৈতিক সূচকের গুরুত্বও অপরিসীম। এ ধরনের দু’টি সূচকের প্রথমটি হলো অসম অর্থনৈতিক উন্নয়ন। গোষ্ঠিভিত্তিক অসাম্য অথবা শিক্ষা, চাকরি ও অর্থনৈতিক মর্যাদার ক্ষেত্রে ধারণাগত বৈষম্য থাকে দেশে। গোষ্ঠিভিত্তিক দারিদ্র্য, শিশু মৃত্যুর হার, সাক্ষরতার হারও এ ক্ষেত্রে বিবেচিত হয়।
অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অতি দ্রুত ও মারাত্মক অবনতি হলো ব্যর্থরাষ্ট্রের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক সূচক। মাথাপিছু আয়, স্থূল জাতীয় আয়, ঋণ, শিশুমৃত্যুর হার, দারিদ্র্য হার, ব্যবসায় বিপর্যয় ইত্যাদি সূচক ব্যবহার করা হয় সমাজের অর্থনৈতিক অগ্রগতির পরিমাপে। এ ক্ষেত্রে পণ্যমূল্য, কর, রাজস্ব, বিদেশী বিনিয়োগ, দায় শোধ ইত্যাদির হঠাৎ পতন গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়। এ ছাড়া জাতীয় মুদ্রামানের বিপর্যয় বা বড় রকমের অবমূল্যায়ন আর কালো অর্থনীতির আকস্মিক স্ফীতি ও পুঁজির পলায়নও গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি কর্মচারী, সেনাবাহিনী অথবা অন্য কোনো নাগরিকের বেতনভাতা পেনশন বা অন্য আর্থিক দায় পূরণে ব্যর্থতাও দেখা হয় এ প্রসঙ্গে।
বেশি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সূচক
ব্যর্থরাষ্ট্রের রাজনৈতিক সূচককে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। এ ক্ষেত্রে বিবেচনায় আনা ছয়টি বিষয়ের প্রথমটি হলো রাষ্ট্রের দুর্বৃত্তায়ন এবং কর্তৃপক্ষের আইনগত বৈধতা না থাকা। শাসক শ্রেণীর ব্যাপক দুর্নীতি বা অর্থুধা আর স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের ধার না ধারা থেকে এর সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়ায় ব্যাপক জনগোষ্ঠীর অংশ না থাকাও এ ক্ষেত্রে হয় গুরুত্বপূর্ণ।
ব্যর্থরাষ্ট্রের দ্বিতীয় রাজনৈতিক সূচক হলো জনগণকে দেয়া সেবার ব্যাপক অবনতি। সন্ত্রাস ও সহিংসতা থেকে নাগরিকদের রক্ষা পাওয়া আর স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পয়নিষ্কাশন, জনপরিবহনের মতো জনগণের মৌলিক প্রয়োজন পূরণের সেবা প্রদানে ব্যর্থতা থেকে সঙ্কটের সৃষ্টি হয়। নিরাপত্তা বাহিনী, প্রেসিডেন্সিয়াল স্টাফ, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, কূটনৈতিক সার্ভিস, রাজস্ব সংস্থার মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে শাসক শ্রেণীর জন্য ব্যবহার করার কারণে জনগণকে তার কাক্সিত সেবা দেয়া যায় না।
ব্যর্থরাষ্ট্রের তৃতীয় রাজনৈতিক সূচক হলো মানবাধিকারের ব্যাপকভিত্তিক লঙ্ঘনপ্রবণতা। শাসনতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া স্থগিত বা নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারের মতো সর্বাত্মকবাদী, একনায়কতান্ত্রিক বা সামরিক শাসনের উদ্ভব হলে এটি দেখা যায়। নিরীহ বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আনুকূল্যেও সহিংসতা হয়। রাজনৈতিক বন্দী ও ভিন্ন মতাবলম্বীর সংখ্যা ক্রমাগতভাবে বাড়তে থাকে। তাদের সাথে আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ও প্রক্রিয়া অনুযায়ী আইনানুগ ব্যবহার করা হয় না। সংবাদপত্র ও বিচার বিভাগকে রাজনীতিকীকরণ করা হয়। রাজনৈতিক কারণে সেনাবাহিনীকে অভ্যন্তরীণ কাজে ব্যবহার এবং রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক প্রতিপক্ষকে দলন ও নিপীড়ন থেকেও সৃষ্টি হয় সঙ্কটের।
চতুর্থ রাজনৈতিক সূচক হলো নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ‘রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্রের’ অবস্থা সৃষ্টি আর এলিট বাহিনীগুলোকে দায়মুক্তি দিয়ে পরিচালিত করা। রাষ্ট্রের আনুকূল্যে বেসরকারি বাহিনী সৃষ্টি করা যারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, সন্দেহভাজন শত্রু ও বিরোধীপক্ষের প্রতি সহানুভূতিশীল সাধারণ নাগরিকদের সন্ত্রস্ত করে রাখে। সেনাবাহিনীর মধ্যে সেনাবাহিনীর চক্র সৃষ্টি করে এই চক্রকে প্রতাপশালী সেনানায়ক বা রাজনৈতিক স্বার্থ আদায়ে ব্যবহার করা হয়। প্রতিদ্বন্দ্বী মিলিশিয়া, গেরিলা বাহিনী বা প্রাইভেট সেনাবাহিনীর উত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে সহিংস প্রতিরোধের ঘটনাও ঘটে।
ব্যর্থতার পঞ্চম রাজনৈতিক সূচকটি হলো রাষ্ট্রে পরস্পর প্রতিপক্ষ এলিট শ্রেণীর সৃষ্টি হওয়া। শাসক শ্রেণীর আগ্রাসী জাতীয়তাবাদী বক্তব্য বিশেষত নৃতাত্ত্বিক নির্মূল বা বিশ্বাস চাপিয়ে দেয়ার মতো বিষয় সাম্প্রদায়িক ভ্রাতৃত্ব বিনষ্ট করে। শাসক শ্রেণী ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে গ্রুপভিত্তিক বিভাজন সৃষ্টি হয়।
ব্যর্থরাষ্ট্রের ষষ্ঠ রাজনৈতিক সূচক হলো বাইরের শক্তির হস্তক্ষেপ। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সামরিক বা আধা সামরিক বাহিনীকে সম্পৃক্ত করলে বাইরের রাষ্ট্র, সেনাবাহিনী বা অন্য কোনো গ্রুপের সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকে। বিদেশী সাহায্য বা শান্তিরক্ষী মিশনের ওপর অতি মাত্রায় নির্ভরশীলতাও বিদেশী দাতাগোষ্ঠীর হস্তক্ষেপের পরিস্থিতি সৃষ্টি করে।
আফ্রিকান সিনড্রম!
একটি রাষ্ট্র অকার্যকর বা ব্যর্থ দেশে পরিণত হওয়ার আলোচিত বৈশিষ্ট্যের বেশির ভাগই রেড অ্যালার্ট তালিকার শীর্ষ দেশগুলোতে রয়েছে। লাইবেরিয়া, সিওরালিওন আইভরি কোস্ট ও কঙ্গোর মতো আফ্রিকান দেশগুলোতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থাকে অকার্যকর করে ফেলেছিল। সরকারি বাহিনী ও বিদ্রোহী বাহিনীতে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে রক্তপাত এমনপর্যায়ে পৌঁছে যে এসব দেশে জাতিসঙ্ঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী দীর্ঘ সময়ের জন্য মোতায়েন রাখতে হয়। ২০০৫ সালে আইভরি কোস্টের উত্তর ও দক্ষিণ উভয় অংশ ভ্রমণের সময় একটি রাষ্ট্র গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতে সশস্ত্রভাবে বিভাজিত হয়ে গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়লে কী অবস্থার সৃষ্টি হয় তা স্বচক্ষে দেখার সুযোগ হয়। সেখানে নির্বাচিত সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনী কাজ করেছে। সেখানে কর্তৃত্বের ভিত্তিতে দুই অঞ্চলে বিভক্ত দেশে সশস্ত্র প্রাইভেট বাহিনীগুলোর নিয়ন্ত্রণ ছিল দীর্ঘ সময় ধরে। দশক কাল ধরে লাখ লাখ মানুষ দেশটিতে প্রাণ হারিয়েছে। এসব দেশের মধ্যে কঙ্গো ছাড়া বাকিগুলোতে শান্তি ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে নতুন করে এসব দেশের কাতারে যুক্ত হয়েছে মালে ও মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রের মতো দেশ। সোমালিয়ার অবস্থা অবনতির চরম স্তরে। সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নির্মম শিকারে পরিণত হয়েছে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান। ধাক্কা সামলানোর অপরিসীম ক্ষমতার জন্য পারমাণবিক শক্তিধর পাকিস্তান রাষ্ট্র হিসেবে এখনো জোরালোভাবে টিকে রয়েছে যদিও প্রতিদিনই দেশটি থেকে সঙ্ঘাত ও অস্বাভাবিক মৃত্যুর খবর আসছে।  ভারতের ৩০ ভাগ এলাকা এখন মাওবাদী বিদ্রোহী কবলিত। এ লেখার এক দিন আগেও সেখানে ৩০ জন পুলিশ ও মাওবাদীর মৃত্যুর খবর এসেছে। আরব বসন্তের জের ধরে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশেই দীর্ঘ সময় ধরে বিরাজ করেছে অস্থিরতা। এখন আগ্নেয়গিরির উত্তপ্ত অবস্থা সিরিয়ায়। ৬০ হাজার লোক নিহত হয়েছে সেখানে। কিন্তু এ রকম কিছু ছাড়াই দুর্ভাগ্যজনকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যর্থরাষ্ট্রের তালিকায় আসতে শুরু করেছে বাংলাদেশের নাম। স্বাধীনতা-পরবর্তী ৪০ বছর সময়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বা সামাজিক উন্নয়নের কাক্সিত পর্যায়ে হয়তো পৌঁছতে পারেনি। কিন্তু যে অগ্রগতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্জিত হয়েছে সে দৃষ্টান্ত অনেক দেশের জন্য অনুসরণীয়। সামাজিক সূচকগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে দারিদ্র্যহার ক্রমাগতভাবে হ্রাস পেয়েছে। শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে উল্লেখযোগ্যভাবে। সাক্ষরতা, সুপেয় পানিপ্রাপ্তি, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহার, প্রত্যাশিত গড় আয়ু, জন্ম ও মৃত্যুহার সব ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মাথাপিছু জাতীয় আয় বিনিময় হার বিবেচনায় ৮৪৮ ডলার এবং ক্রয়ক্ষমতার সমানুপাত বা পিপিপি হিসাবে দুই হাজার ২৩৩ ডলারে পৌঁছেছে। দুই দশক ধরে গড় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের ওপরে। রফতানি আয় আড়াই হাজার কোটি ডলারের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। রেমিট্যান্স পৌঁছেছে ১৩০০ কোটি ডলারে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও ছাড়িয়ে গেছে ১৩০০ কোটি ডলার। এসব ইতিবাচক দিকের পাশাপাশি ব্যর্থরাষ্ট্রের যেসব অর্থনৈতিক সূচক ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে তার কিছু বৈশিষ্ট্যও বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া যায়। বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ও বিকাশ হার অব্যাহতভাবে বাড়লেও বর্ধিত সম্পদের অংশ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে সেভাবে পৌঁছাচ্ছে না। রাষ্ট্রের সর্বাপেক্ষা ধনী ৫ শতাংশের সম্পদ ও আয় ক্রমাগতভাবে বাড়ছে আর ৯৫ শতাংশ মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র মানুষের আয় ও সম্পদ কমছে। সরকারি চাকরিতে সরকারের পক্ষ-বিপক্ষ রেখা তৈরি করে একটি গোষ্ঠীকে আনুকূল্য দেয়া হচ্ছে, অন্য শ্রেণীকে করা হচ্ছে বঞ্চিত। এর পাশাপাশি দুর্নীতি চাঁদাবাজি ইত্যাদি ক্রমাগতভাবে বেড়ে গিয়ে কালো অর্থনীতির আকারও স্ফীত হচ্ছে।
তবু কেন ঝুঁকির নম্বর ৭৭ ভাগ
এত কিছুর পরও অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচক বিবেচনায় বাংলাদেশের ব্যর্থরাষ্ট্র হওয়ার ঝুঁকির নম্বর ৭৭ শতাংশে পৌঁছার কথা নয়। বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় শতকরা যত নম্বর পেয়ে সর্বোচ্চ গ্রেড এ প্লাস পায় আর মাত্র তিনটি নম্বর হলে তা আমরা পেয়ে যাবো ব্যর্থরাষ্ট্রের শর্ত পূরণে। ব্যর্থরাষ্ট্রের সূচকগুলোর আলোকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মূল জায়গা হিসেবে খুঁজে পাওয়া যায় রাজনীতি। ব্যর্থরাষ্ট্রের যে ছয়টি রাজনৈতিক সূচক রয়েছে তার প্রতিটাতেই বাংলাদেশের বিপজ্জনক অগ্রযাত্রা রয়েছে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় দুর্বৃত্তায়নের দাপট প্রতিদিনই যেন বাড়ছে। শাসক শ্রেণীর ব্যাপক দুর্নীতি আর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ধার না ধারার প্রবণতা উদ্বেগজনক। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ব্যাপক জনগোষ্ঠীর আস্থায় ধরা চিড় ক্রমেই বড় হচ্ছে। সন্ত্রাস, সহিংসতা ও মানবাধিকার হরণের ঘটনা বাড়ছে। আর আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার। গণতান্ত্রিক স্বৈরাচার নামে নতুন কোনো বিভাগ রাষ্ট্রবিজ্ঞানে চালু করা হলে তার বাস্তব উদাহরণ হতে পারে বাংলাদেশ। কাউকে গ্রেফতার, হয়রানি, পুলিশ রিমান্ড বা নির্যাতনের জন্য তার একটি পরিচয়ই যথেষ্ট, সেটি হলো তিনি ক্ষমতাসীন দলের প্রতিপক্ষ শিবিরের ব্যক্তি। গণমাধ্যম ও বিচার বিভাগকে রাজনীতিকীকরণ এখন সর্বোচ্চ এক স্তরে। নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানকে গুম খুনে ব্যবহার আন্তর্জাতিক উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ জন্য দায়মুক্তি সংস্কৃতিকে লালন করা হচ্ছে। জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত এবং রাষ্ট্রযন্ত্রকে প্রতিপক্ষ নিপীড়ক যন্ত্রে পরিণত করা হচ্ছে ক্রমাগতভাবে। প্রশাসন, পেশাজীবী, সাধারণ মানুষÑ সব ক্ষেত্রে বিভাজনের আওয়াজ ও প্রচারাভিযান জোরদার হচ্ছে। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে বাইরের কোনো কোনো শক্তিকে নিবিড়ভাবে সংশ্লিষ্ট করা হচ্ছে যা অন্য পক্ষের বিদেশী হস্তক্ষেপের আশঙ্কাকে প্রবল করছে।
ব্লু হেলমেটের পদধ্বনি!
সার্বিক বিবেচনায় গত ৪০ বছরে যে অগ্রগতি অর্থনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অর্জন করেছেÑ এমনকি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার যে দৃষ্টান্ত দুই দশকে স্থাপিত হয়েছিল তাকে এগিয়ে নেয়া গেলে অকার্যকর বা ব্যর্থরাষ্ট্র হওয়ার আশঙ্কা কোনোভাবেই দেখা দিত না। এখন ব্যর্থরাষ্ট্রের ঝুঁকিপূর্ণ দেশ বিবেচনায় ৭৭ শতাংশ নম্বরই শুধু বাংলাদেশ পায়নি একই সাথে নির্বাচন নিরপেক্ষ করতে জাতিসঙ্ঘের সহায়তার কথাও আলোচনা হচ্ছে। শোনা যাচ্ছে ব্লু হেলমেটের পদধ্বনি। শাসক শ্রেণীর রাজনৈতিক শুভবুদ্ধিই কেবল পারে সে ধরনের বিপর্যয় থেকে উন্নয়ন ও অগ্রগতির রাজপথে বাংলাদেশ ট্রেনটির গতি ফেরাতে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন