বৃহস্পতিবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১২

ওরা ‘ভেড়ার পোশাকে নেকড়ে’!

‘সব কিছুকে নিষেধ করার অর্থ হলো অন্ধ করে দেয়া, আর সব কিছু করতে দেয়ার অর্থ হলো কাউকে হারিয়ে ফেলা।’ এই সহজ-সরল উক্তিটি বিশ্বজোড়া খ্যাতিমান আরব বংশোদ্ভূত ইউরোপীয় পণ্ডিত তারিক রামাদানের। তার ভাষায়, ইউরোপীয় মুসলমানদের এখন ‘ভেড়ার পোশাকে নেকড়ে’ ভাবা হয়। নয়তো ভাবা হয় ‘ট্রোজানের ঘোড়া’। এমন প্রেক্ষাপটে তারিক রামাদান মুসলমানদের ইউরোপীয় ধারায় লাগসই এবং আনুগত্যবাদী হতে পরামর্শ দিয়েছেন। এ লাগসই ও আনুগত্যবাদী হওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তি একটাই, অভিবাসী হোক আর ভূমিপুত্রই হোক প্রত্যেকে নাগরিকত্ব ও সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে রাষ্ট্রের আনুগত্য করতে বাধ্য। এটা চুক্তি মানার মতো যুক্তির দায়।
বাংলাদেশ ইউরোপও নয়, মধ্যপ্রাচ্যও নয়। তার পরও কিছু মিল-অমিল অবশ্যই আছে। তা ছাড়া সরকার ও আদর্শের বিরোধীদের স্বরূপ বিশ্বজোড়া প্রায় অভিন্ন। শ্রেণিচরিত্রও কাছাকাছি। বাংলাদেশেও মেরুকরণটাকে ইসলামের ও ইসলামপন্থীদের বিরোধিতার ক্ষেত্রে একই সমতলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তার ওপর বাংলাদেশে আছে ইগো ও দলবাজ রাজনীতির নানা নোকতা। একাত্তর প্রসঙ্গ তো আছেই। তা ছাড়া ক্ষমার রাজনীতিতে বাংলাদেশের ডান-বাম আদর্শবাদীরা বড়ই অনুদার ও কৃপণ। বাম ও ইসলামপন্থীরা অতীত ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করে, কিন্তু জনগণের কাছে স্বচ্ছ ও জবাবদিহির ভাষায় ক্ষমা চায় না। অথচ বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ভুলের জন্য ক্ষমা চাওয়ার নজির অসংখ্য। অবশ্য বাংলাদেশে তওবার রাজনীতির কথা বলে হাফেজ্জী হুজুর প্রকারান্তরে আলেম-ওলামা ও শাসকদের যুগপৎ ভুলের ক্ষমাই চেয়েছিলেন। শেখ হাসিনা অতীত ভুলভ্রান্তি ভুলে গিয়ে আরেকবার সুযোগ দেয়ার আবেদনের ভেতর অতীত ভুলের স্বীকৃতিও ছিল, ক্ষমা চাওয়ার মতো মিনতিও ছিল। ইন্দিরা গান্ধী, রাজিব গান্ধী, ভুট্টো, জিয়াউল হক, বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক ভুলের মাশুল গুনেছিলেন বলে অনেকের মূল্যায়ন। যদিও ইন্দিরা গান্ধী জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য জোরজবরদস্তি ও জরুরি অবস্থা জারির জন্য একবার জনগণের কাছে ক্ষমাও চেয়েছিলেন। জনগণ তাকে ক্ষমাও করেছিল। আবার ক্ষমতায় বসিয়েছিল। খালেদা জিয়া অতীত রাজনৈতিক ভুলের জন্য দু’বার জনগণের কাছে কৈফিয়ত দিয়ে ক্ষমাই চেয়েছেন। আরেকবার সুযোগ দেয়ার মিনতির ভেতর সেই ক্ষমা চাওয়ার সুর অনুরণিত হয়েছে। রাজনৈতিক ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেনি কিংবা জনগণের কাছে ক্ষমা চায়নি এমন নজির রাজনীতির ইতিহাসে কম, যারা খোদার কাছে তওবা করতে কিংবা জনগণের কাছে রাজনৈতিক ভুলের জন্য ক্ষমা চাইতে কাপর্ণ্য প্রদর্শন করে, তাদেরকে ট্রোজানোর ঘোড়া কিংবা ভেড়ার পোশাকে নেকড়ে ভাবলে কিংবা ভাবার সুযোগ করে দিলে সংশ্লিষ্ট কারো দায়দায়িত্ব কম হওয়ার কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না।
আঠারো শতকের গোড়ার দিকে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের শাহওয়ালিউল্লাহ দেহলবি পরামর্শ দিয়েছিলেন ঠিক উল্টো। তিনি আগ্রাসী ইংরেজ বেনিয়া সরকারকে বয়কট করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ইংরেজদের ভাষা, সংস্কৃতি, পোশাক ও শাসন প্রত্যাখ্যান করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এই আহ্বান ছিল সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে জরুরি। এই পরামর্শের কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকলেও উপমহাদেশের আজাদির জন্য এই মূলমন্ত্রের বিকল্প ছিল না। গান্ধীর অসহযোগ, বয়কট আন্দোলন এবং বর্জননীতি সেই সত্য বিলম্বে হলেও প্রমাণ করেছে।
এই মুহূর্তে বাংলাদেশের ইসলামপন্থীদেরও যেমনি ভেড়ার পোশাকে নেকড়ে বানানো হয়েছে, তেমনি নেকড়ের পোশাকে ভেড়াও ভাবা হচ্ছে। কারো কারো কাছে এরা মানুষ নয়, ভয়ঙ্কর প্রাণী। কারো কারো কাছে তার চেয়েও বিপজ্জনক কিছু। তাই দমন-পীড়ন ও উৎখাতের হুঙ্কার প্রতিনিয়ত শোনা যাচ্ছে। তাদেরকে চিমটি কেটে অনেকেই সুখ পাচ্ছে। কাজটা করা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দোহাই দিয়ে, যা শুধু দুর্বোধ্যই নয়, অযৌক্তিকও।
ইসলাম বাংলাদেশের নিরঙ্কুশ মানুষের ধর্মবিশ্বাসের নাম। বলা হচ্ছে, এখানে ইসলামের নামে রাজনীতি করা যাবে না। তবে ধর্ম নিয়ে ব্যবসায় কারো কোনো আপত্তি নেই। রাজনৈতিক ইসলামকে এতই ভীতি যে বলা হচ্ছে, ইসলামি ধারণা সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। কিন্তু কমিউনিজম ও সেকুলার ইজমকে সাংঘর্ষিক ভাবা হচ্ছে না। এ জন্যও দোহাই দেয়া হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার। অথচ অভিযুক্তকে সরকার রাষ্ট্রের পক্ষে স্বচ্ছ বিচারের মুখোমুখি করতে পারে কিন্তু গণতান্ত্রিক মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার হরণ করে রাষ্ট্র কিভাবে তার সন্তানতুল্য নাগরিকদের ন্যায়বিচারের আশ্রয় নেয়ার সুযোগবঞ্চিত করে তা বোধগম্য নয়। ইউরোপের সাথে এই মৌলিক পার্থক্য বিবেচনায় রাখার মতো।
দোষটা কোনোভাবেই ইসলামের নয়, ইসলামপন্থীদের। এ দেশের ইসলামপন্থীরা ইসলামকে প্রতিনিধিত্ব করার ক্ষেত্রে নিশ্চয় ভুল করেছেন। নয়তো রাজনৈতিক ইসলামকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন। এটা ঠিক কমিউনিজম অবৈধ ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে, ইসলাম ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব দুটোকেই চ্যালেঞ্জ করে। এখানে বিতর্কটা ইসলামপন্থী ও সরকারের, আমার নয়। আমাদের কাছে প্রায়ই মনে হয় এ দেশে ইসলামকে আরবীয় কিংবা পারসীয় করার একটা মনোস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ আছে। অথচ ইসলাম এই তল্লাটে এসেছে একেবারে লোকজ ঐতিহ্যের সাথে লেপ্টে থেকে। যারা আরবীয়করণের পক্ষে তারা বুঝতে চান নাÑ আল্লাহ-রাসূল ও পরিশীলিত আরবীয় সংস্কৃতি ইসলাম হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। যেমনি বিবেচিত হয়েছে আল্লাহ রাসূল ও পরিশীলিত পারস্য লোকজ সংস্কৃতি। এই মেলবন্ধন ঐতিহাসিক এবং তাৎপর্যপূর্ণ। আরবেরা গ্রহণ-বর্জনের মাধ্যমে ইসলামের সাথে লাগসই হয়েছে। পারস্যবাসীও গ্রহণ-বর্জনের পথ ধরে আড়াই হাজার বছরের ঐতিহ্য ও ইসলাম আত্মস্থ করে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। গাঙ্গেয় বদ্বীপে ইসলাম লোকজ ধর্ম। গণমানুষের ধর্ম। ধর্মকে বাদ দিয়ে কোনো শাসক ক্ষমতায় আসতে পারে না। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করে ক্ষমতায় টিকেও থাকতে পারে না। অথচ যত ভয় এর আদর্শিক ও রাজনৈতিক দর্শনকে। খানকা কিংবা দরবারি ইসলামকে নয়। একাত্তর এখানকার অনিবার্য বাস্তবতা, যা মুসলিম বিশ্বের অন্য কোনো দেশের সাথে তুলনীয় নয়। এ বিষয়টি অনেকে মাথায় রাখতে চান না। কোনো জাতি তার স্বাধীনতার প্রতিপক্ষকে আত্মস্থ করতে চায় না। ইসলাম কখনো স্বাধীনতার প্রতিপক্ষ ছিল না। এখনো নেই। ইসলামপন্থীদের মুক্তিযুদ্ধের প্রতিপক্ষে পেয়েছিল বলেই এর আদর্শিক প্রতিপক্ষ ইসলাম ও ইসলামপন্থীদের এক পাল্লায় তুলে ঠেঙানোর সুযোগ পেয়েছে। এটা আড়ালে রাখার কোনো বিষয় নয়। বাংলাদেশে ইসলামপন্থীদের অদূরদর্শিতা অনেকের মতো আমাকেও ভাবায়। যদিও বারবার যৌবনের বামপন্থী চিন্তার প্রভাব প্রায় আচ্ছন্ন করে। ভাবতে চেষ্টা করি যে মিসর ফেরাউনের দেশ হিসেবে পরিচিত, যে দেশের সেকুলার শাসকেরা এ জন্য গর্বও করত, সেই দেশে ইসলামের কথা বলে, মুসা নবীর উত্তরাধিকার বলে শাসকদের কাছে যারা নিন্দিত হলো, প্রহসনের বিচারে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলতে হলো, তাদের উত্তর-পুরুষেরা মাত্র পাঁচ দশকের মাথায় বাঁক ঘুরে দাঁড়াল কিভাবে? এর সরল ব্যাখ্যা হতে পারে শাসকদের কাছে নিন্দিতরা জনগণের চোখে নন্দিত হলে ‘সময়’ তাদের বিজয় মালা পরিয়ে দেয়। সম্ভবত এ কারণেই ব্রাদারহুড এখন ভিন্ন নামে ক্ষমতায়। ড. মুরসি এখনো মুসলিমপ্রধান সেকুলার মিসরের প্রেসিডেন্ট। যেমনটি ঘটেছে তুরস্কে। আরবাকান-এরদোগান সেকুলার তুরস্কের নন্দিত নেতা হলেন। নিজ নিজ দলের নাম পাল্টানোর ব্যাপারে সামান্যতমও হোঁচট খেলেন না। শুধু দলের গঠনতন্ত্র নয়, নাম পর্যন্ত পাল্টিয়ে সামনে বাড়ানোর পথ রচনা করলেন। তিউনিসিয়াও এ ক্ষেত্রে আরেক ব্যতিক্রমধর্মী উপমা। এ উপমা বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই প্রযোজ্য, যদিও ওসব জায়গায় স্বাধীনতা আন্দোলনে বিতর্কিত অবস্থানের মতো বিব্রতকর ইস্যু নেই। তবে আদর্শ হিসেবে ইসলাম একই ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে।
বাংলাদেশে যেমন মরমিবাদ, সুফিবাদ, পীরবাদ চ্যালেঞ্জ হয় না, হয় ইসলামের রাজনৈতিক দর্শন। তেমনি ঘটেছে ইরান, তুরস্ক, মিসর, তিউনিসিয়াসহ অন্য অনেক স্থানে। ইসলামের রাজনৈতিক দর্শন প্রচার করা হবে অথচ সেকুলারিজম ও কমিউনিজম ক্ষেপে উঠবে না, তেড়ে আসবে নাÑ এমনটি শুধু আহাম্মকই ভাবতে পারে। কারণ ইসলাম কমিউনিজম সেকুলারিজম শুধু সাংঘর্ষিকই নয়, পরস্পর বিশ্বাস ও বস্তুবাদী দর্শনের কারণে প্রতিপক্ষও। এই ঋজু মন্তব্য বোঝার জন্য বোধকরি অনেক বড় পণ্ডিত হওয়ার প্রয়োজন হয় না। তা ছাড়া আধুনিক যুগে ‘ন্যাশন স্টেট’ কনসেপ্ট উপড়ে ফেলা সম্ভব নয়, প্রয়োজনও নেই। তাই বিশ্বজোড়া খেলাফত প্রতিষ্ঠার দাবিটি জামালউদ্দিন আফগানি কিংবা তকিউদ্দিন নাবানি, মুহাম্মদ আলী-শওকত আলীর মতো করে বলা সম্ভব নয়। তবে সময়ের দাবিতে সেই সঙ্গত দাবি যে অন্য ধারায় ভিন্ন অবয়বে উঠবে তা নিশ্চিত। তখন সেই দাবিকে অসঙ্গত বলা সম্ভব হবে না। ঠেকানোও কঠিন হবে। সেটা সময়ের অপেক্ষার ব্যাপার।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের দাবি কিংবা জেদের কারণে চরমপন্থী সেজে যাওয়া কোনোটিই সমর্থনযোগ্য নয়। বরং যৌক্তিক ও প্রায়োগিক আদর্শিক কারণে লাগসই হওয়ার দাবিটি মুখ্য। এ জন্য যেকোনো ইসলামপন্থীর উচিত মৌলিক প্রশ্নে ছাড় না দিয়ে লাগসই হতে চেষ্টা করা। এখানে প্রশ্ন দাঁড়ায় কোনটি মৌলিক বিষয় কোনটি নয় সেই প্রশ্ন গৌণ নয়। তবে এতটুকু চিন্তা নেতৃত্বের মগজে ঠাঁই পাওয়া উচিত। এ যুগে সার্বভৌমত্ব কনসেপ্টটিকে ‘ন্যাশন স্টেট’ ধারণায় একটি রাষ্ট্রিক ধারণার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়, যা আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ও কূটনৈতিকভাবেও স্বীকৃত ও অনুশীলিত। জনগণের সার্বভৌমত্ব ও রাষ্ট্রাচারের সাথে সম্পৃক্ত। এর সাথে খোদায়ি উলুহিয়াত ও রুবুবিয়াত কনসেপ্টকে গুলিয়ে অথবা মিশিয়ে ফেলা হয় না। যেমন সিটি করপোরেশনের আইন, দেশের প্রচলিত অনেক আইনই নির্দোষ। কয়েকটি ছাড়া এর সাথে আদর্শ হিসেবে ইসলামের তেমন কোনো মৌলিক সঙ্ঘাত থাকার কথা নয়। যা পরিবর্তন করার দাবি আদর্শবাদীরা তোলেন, সেটি আন্দোলন প্রক্রিয়ারই অংশ। সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাষ্ট্র যা অনুমোদন করে, আইনের শাসন উপেক্ষা না করে ন্যায়-ইনসাফ না এড়িয়ে সরকার যা বাস্তবায়ন করতে চায় তার সাথে আদর্শিক আশা-আকাক্সার দূরত্ব নেই বললেই চলে। যতটুকু দূরত্ব সেটা কমানোর জন্যই তো রাজনৈতিক অঙ্গীকার পূরণের দায় নেয়ার প্রশ্ন ওঠে। এখানেই দলীয় প্রচেষ্টার যুক্তি দাঁড়ায়। এ ব্যাপারে একটা উপমা দেয়া যায়, ইসি একটি ইসলামপন্থী দলকে তার গঠনতন্ত্র পরিবর্তন না করলে নিবন্ধন বাতিলের কথা বলেছে। প্রচলিত সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক বলেই ইসি এ ধরনের দায়বোধ করছে বলে তাদের দাবি। তবে ইসি দলটির সাথে বিতর্কিত ও একচোখা রাজনৈতিক আচরণ করছে কি না সেটাও দেখার আছে। ইসির বক্তব্যে আইনি ভিত্তি থাকলে দলটির উচিত গঠনতন্ত্র পাল্টিয়ে নেয়া। এটি কোনো আপস নয়, সময়ের সাথে লাগসই হওয়া মাত্র। ইসি যদি একচোখা কিংবা বৈরী আচরণ করেও তার পরও কোনো রাজনৈতিক দলেরই উচিত নয় মিথ্যা প্রচারের সুযোগ দেয়া। জনশক্তিকেও নিয়মতান্ত্রিক পথ থেকে সরিয়ে দেয়ার সুযোগ নেয়াও উচিত নয়। রাজনৈতিক দলমাত্রই তার আদর্শের জন্য লড়াই করে। তার আদর্শের সাথে অসঙ্গতিগুলো দূর করার দাবি জানায়। এ জন্যই আন্দোলন ও সংগ্রাম। তা হবে কখনো নিয়মতান্ত্রিক, কখনো ভিন্ন কায়দায় আবেদন-নিবেদনের ভাষায়। এরই চূড়ান্তপর্যায়ে কঠোর অবস্থানের সুযোগ আসে। একটি সরকার প্রতিষ্ঠিত আছে। আছে একটি সংবিধান। সব কিছু যদি দলের কিংবা দলবিশেষের আদর্শের অনুকূলেই তবে শুধু শাসন করার জন্য একটি আদর্শিক দলের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়।
ক’দিন আগে নিজের নামে কলাম না লিখে একটি ভিন্ন ধারার লেখা লিখেছিলাম, শিরোনাম ছিল ‘ভালো কাজ খারাপ পদ্ধতিতে হয় না’। প্রচুর পাঠক ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন, দেশ-বিদেশে লেখাটি ব্যাপক আলোচিত হয়েছে। ইন্টারনেটে অনেক মন্তব্য পেয়েছি। একজন পাঠক মন্তব্য করেছেন ‘লেখক যুক্তিবাদী কিন্তু আপসকামী’। হ্যাঁ, এ ক্ষেত্রে লেখক আপসকামী তো বটেই, একই সাথে সময় বিবেচনায় দূরদর্শী হওয়ার দায়ও বোধ করেন। কারণ কোনো দল নিষিদ্ধের দাবি যেমন উসকানিমূলক ও হঠকারিতা, তেমনি চরমপন্থী ও রাষ্ট্রশান্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাও হঠকারিতা। কোনো দল প্রচলিত আইন পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন করতে পারে। সংবিধান পরিবর্তনের দাবিও গ্রহণযোগ্য, কিন্তু প্রতিষ্ঠিত কোনো কিছুকে উপড়ে ফেলে দিতে হলে, একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জন্য জনগণকে প্রস্তুত করতে হয়। যেমনটি ঘটেছে তিউনিসিয়া ও মিসরে। অংশত নেবাননে। নিয়মতান্ত্রিক সংস্কারপ্রক্রিয়ায় যেমনটি তুরস্কে প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে, জনগণকে বাদ দিয়ে তেমনটি বাংলাদেশে কেন কোথাও কোনো পরিবর্তন হওয়ার সুযোগ নেই?
একটি আদর্শবাদী দল সরকারি জুলুম-নিপীড়ন ও নির্যাতন-নিষ্পেষণে কোনো দিন নিঃশেষ হয়ে যায় না। নিষিদ্ধ করেও কোনো আদর্শ ঠেকানো যায় না। বরং কোনো দল নিঃশেষ হয়ে যায় নিজস্ব আদর্শের প্রাণশক্তি হারিয়ে ফেললে। নেতা ও কর্মীরা নীতিভ্রষ্ট হলে অথবা কায়েমি স্বার্থবাদী বড় হয়ে গেলে। দলবিশেষকে নিষিদ্ধ করার হুঙ্কার মানুষকে বরং সেই দলের দিকে প্রলুব্ধ করে। সম্ভবত সরকার তেমন কোনো হঠকারিতা কিংবা ক্ষমতার জোরে বাড়াবাড়ি করতে যাবে না। পাকিস্তান আমলে বামপন্থী রাজনীতিকে শাসকেরা শুধু আড়চোখে দেখেনি, উসকানিও দিয়েছিল। সেই ফলাফল সবার জানা। অন্য দিকে সরকার ইসলামপন্থীদের রাজনৈতিক ভোট ব্যাংকের কারণেই বনসাইয়ের মতো করে রাখতে আগ্রহী। এতে তারা ভাবছে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হবে। কার্যত এতে শাপে বর হবে বিরোধী দলের। কারণ ইতিহাস যুক্তি এবং তথ্য কোনোটিই সরকারি হঠকারী ভাবনার পক্ষে সমর্থন জোগায় না। সরকারের জন্য এ লাভ সাময়িক ও তাৎক্ষণিক। অপর দিকে একটি গণবিচ্ছিন্ন দলও এমন পরিস্থিতিতে জনগণের সিমপ্যাথি পেয়ে যায়। কিংবা সহমর্মিতা আদায় করে নেয়ার মতো সুযোগ পেয়ে যায়। যেসব দল কর্মিবহুল  সেগুলোর কথা তো আলাদা। একজন তাত্ত্বিক বামপন্থী মনে করেন, বাংলাদেশের ইসলামপন্থীরা ‘নাইদার ইসলামিস্ট, নর পলিটিক্যাল পার্টি’; আরেকজন মনে করেন ইসলামপন্থীরা আনপ্রেডিক্টেবলÑ বিষয়টি উড়িয়ে দেয়ার মতো নয়। সংশ্লিষ্টদের ভেবে দেখার মতো বিষয়। বাম চিন্তা পড়ে বুঝেছি প্রতিকূল পরিবেশে আদর্শের চারা দ্রুত গজায়। হাল আমলের আন্তর্জাতিক বলয়ের ইসলামপন্থী প্রজ্ঞাবানদের দর্শন ঘেঁটেও এটাই সবক পেয়েছি। মনে হয় একটি আদর্শবাদী দল নিজেকে স্বচ্ছতার সাথে যুক্তিগ্রাহ্য ভাষায় তুলে ধরতে বা মেলে ধরতে না পারলেই দলটি আবেদন হারায়। প্রতিপক্ষের সামান্য উসকানি ও আঘাতে হোঁচট খায়। একটু ঝড়ে উপড়ে পড়ে, খানিটা উসকানিতে অদূরদর্শী হয়ে যায়। অধিকন্তু সংযম হারায়। আদর্শকে রাজনৈতিক অনাচারের সাথে গুলিয়ে ফেলে।
বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে বাঙালি মুসলমানের মন-মনন বুঝতে হবে। যেমনটি বলেছেন মরহুম আহমদ ছফা। মরহুম আবুল মনসুর আহমদ বাংলাদেশের আত্মা আবিষ্কার করেছেন তার বাংলাদেশের সংস্কৃতি গ্রন্থে। কেন যেন মনে হয় যারা আদর্শের কথা বেশি বলেন, তারা লোকজ ভাবনা থেকে দূরে সরে যান; অথচ আরব-পারস্য আমাদের ভিন্ন শিক্ষা দেয়Ñ সেটাকে ঠুনকো জাতীয়তাবাদী চিন্তা বলে অবজ্ঞা করার মধ্যে কোনো গভীরতা নেই। যারা বাংলাদেশে রাজনীতি করবেন তারা বাংলাদেশের বাস্তবতা বুঝবেন না কিংবা লোকজ ঐতিহ্যকে গ্রহণ-বর্জনের বড় ক্যানভাসে রেখে আত্মস্থ করবেন না তাদের শিক্ষা ইতিহাসের কাছে, জনগণের কাছে নয়।
আজকের প্রেক্ষাপটে ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে কারা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবেন, সেটাই বিবেচ্য বিষয়। সিমপ্যাথি পেতে মার খেতে হবে। কারণ, ‘ওরা মরে ও মারে’Ñ এই তত্ত্ব এই মুহূর্তে প্রয়োজনীয় নয়। অন্যায়-অত্যাচার সহ্য করে কারা জনগণের সিমপ্যাথি আদায় করে নেবেন, সেটাই আগামী দিনের রাজনীতির জন্য পুঁজি হবে। খলের যেমন ছলের অভাব হয় না, তেমনি সরকার, মতান্ধ ও দলান্ধরা নিজেদের দুর্বল অবস্থানকে যৌক্তিক প্রমাণ করতে সচেষ্ট থাকে। যদিও ক্ষমতার জোরের চেয়ে বিশ্বাসের জোর সব সময় বিজয় পায়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন