বৃহস্পতিবার, ২৫ অক্টোবর, ২০১২

গাদ্দাফির শেষ যুদ্ধ


মুয়াম্মার গাদ্দাফি বিদ্রোহীদের হাতে আটক হয়ে নিহত হওয়ার এক বছর পূর্তি হলো ২০ অক্টোবর। এর তিন দিন আগে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ‘ডেথ অব এ ডিক্টেটর: ব্লাডি ভেনেগান্স ইন সির্তে’ নামের প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এখানে তারই আলোকে গাদ্দাফির অন্তিম মুহূর্ত এবং লিবিয়ার মানবাধিকার পরিস্থিতির ভয়াবহতা নিয়েই এই প্রতিবেদন।

২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে গাদ্দাফির বিরোধীরা লিবিয়াজুড়ে সরব হওয়া শুরু করে। কিন্তু লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ সেই প্রতিবাদ শুনল না, উল্টো শোনাল সিংহের হুঙ্কার। পরিণাম—বিদ্রোহ। লিবিয়ার মরুসিংহ বিদ্রোহীদের তাড়িয়ে বেড়ালেন। কিন্তু মরুসিংহকে তাঁর সুরক্ষিত গুহা থেকে বের করে আনার ব্যবস্থা করল ন্যাটো। ভূমিতে বিদ্রোহীদের মর্টার আক্রমণ, আকাশ থেকে ন্যাটোর ড্রোন আর মিসাইল বর্ষণ; হার মানতে হলো গাদ্দাফিকে। দিনের শেষে দেখা গেল গাড়িবহর নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। গৃহযুদ্ধের ডামাডোলে জনশূন্য শহরের ভুতুড়ে বাড়ি থেকে বাড়িতে লুকিয়ে দিন কাটতে থাকল তাঁর। দুনিয়ার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। খাবার, পানি, এমনকি ওষুধ পর্যন্ত নেই। তাঁর খোঁজে চারদিক দাবড়ে বেড়াচ্ছে বিদ্রোহী মিলিশিয়ারা। আকাশে চক্কর দিচ্ছে ড্রোন। মার্কিন স্যাটেলাইটের সর্বদর্শী চোখ তাঁর জন্মস্থান লিবিয়ার ইঞ্চি ইঞ্চি মাটি তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
মুয়াম্মার গাদ্দাফি ৪২ বছর ধরে ছিলেন লিবিয়ার পরম ক্ষমতাধর। বলা হয়, পরম ক্ষমতা চরম দুর্নীতিবাজ। এটা বলা হয় না, ক্ষমতার খুঁটিগুলো সরে গেলে পরম ক্ষমতাই চরম অসহায় হয়ে পড়ে। বিরাট বাহিনী, বিপুল শানশওকত, অজস্র বিমান আর ট্যাংক ছিল তাঁর। কিন্তু তাঁকে কিনা মরতে হলো প্রায় খালি হাতে পালাতে পালাতে ধরা পড়া অবস্থায়। বেআইনি হত্যা নিজে করেছেন, তাঁকেও হত্যা করা হয়েছে বেআইনিভাবে। যুদ্ধবন্দী হওয়া সত্ত্বেও হয়েছেন নৃশংস প্রতিহিংসার শিকার।
বিদ্রোহীদের হাতে ধরা পড়ার সেই কালো দিনের এক বছর পূর্তি হলো ২০ অক্টোবর। এর তিন দিন আগে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ‘ডেথ অব এ ডিক্টেটর: ব্লাডি ভেনেগান্স ইন সির্তে’ তথা ‘এক স্বৈরশাসকের মৃত্যু: সির্তে শহরে রক্তপিপাসু প্রতিহিংসা’ নামের প্রতিবেদন প্রকাশ করে। গাদ্দাফির মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রসঙ্গ থাকলেও মূলত মুয়াম্মার গাদ্দাফি ও তাঁর পরিবার এবং ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের হত্যার অমানবিকতার বিষয়টিই এই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এখানে ভয়ংকর সেই দিনের কথাই আপনাদের শোনাব।

ধুলার ঘূর্ণি থেকে মরুঝড়
২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গাদ্দাফিবিরোধী প্রথম বিক্ষোভ দেখা যায়। মাত্র অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই অসম্ভব দ্রুততার সঙ্গে বেনগাজি শহরে ঘাঁটি গেড়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এনটিসি প্রতিষ্ঠা করে। ১৭ মার্চ সরকারি বাহিনী বেনগাজি ঘিরে ফেললে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ লিবিয়ার ওপর ‘উড়ালনিষিদ্ধ’ সিদ্ধান্ত পাস করে। তারা একই সঙ্গে দখলদার বাহিনী পাঠানো ছাড়া বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষায় প্রয়োজনীয় যেকোনো ব্যবস্থা (সামরিকও অন্তর্ভুক্ত) নেওয়ার সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলে। এই সিদ্ধান্তের ফলেই চালু হয় ‘অপারেশন ইউনিফায়েড প্রটেক্টর’ সম্মিলিত রক্ষা অভিযান। বিমান উড়াল নিষিদ্ধ হওয়ায় বেনগাজি দখলে ব্যর্থ হয় সরকার। ফ্রান্স, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে পশ্চিমা কয়েকটি সরকার বিদ্রোহীদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দেয়। কাতার পরে স্বীকার করে, কয়েক হাজার কাতারি সৈন্যও গাদ্দাফির বিরুদ্ধে লড়াই করে।

বর্বরতার জবাবে বর্বরতা
বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ামাত্রই গাদ্দাফির অনুগত বাহিনীগুলো কঠোর হাতে দমনে নেমে পড়ে। ইতিহাস সাক্ষী, পরদেশি শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের চেয়ে কোনো অংশে কম নৃশংস হয় না স্বদেশিদের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধ। এই যুদ্ধে গাদ্দাফি ছিলেন একা এবং তাঁর বিরুদ্ধে ন্যাটোসহ আরবের যুক্তরাষ্ট্রপন্থী রাষ্ট্রগুলো। উভয় পক্ষই মরিয়া হয়ে সংক্ষিপ্ততম সময়ে জয়ের জন্য চরম নৃংশস পদ্ধতি অবলম্বন করে। সরকারি বাহিনী হাজারো লোককে আটক করে। তাদের অনেকে বন্দী অবস্থায় নিহত ও নির্যাতিত হয়। বেসামরিক এলাকায় মর্টার হামলা, বোমাবর্ষণ ও গ্র্যাড রকেট নিক্ষিপ্ত হয়। ত্রিপোলির পতনের ঠিক আগে আগেই কমপক্ষে ৪৫ জনকে হত্যা করে। ২০টির মতো গণধর্ষণের ঘটনাও জানা যায়। এসবই ছিল যুদ্ধের আইনের লঙ্ঘন। বিদ্রোহীরাও কাউকেই ছাড় দেয়নি। অজস্র বিচারবহির্ভূত হত্যা, বন্দী অবস্থায় নির্যাতন, ধর্ষণ, গাদ্দাফির অনুগত শহরে নির্বিচার হামলা চলে। সাব-সাহারান আফ্রিকার অভিবাসী শ্রমিকদের ওপরও লাগামছাড়া আক্রমণ হয়।
এইচআরসি গৃহযুদ্ধকালীন মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিবিড় বিবরণটি তুলে ধরে মিসরাতা শহরের ব্যাপারে। গাদ্দাফি বাহিনী প্রায় দুই মাস শহরটি অবরোধ করে ছিল। এ দুই মাসে নিয়মিতভাবে তারা শহরটিতে বোমাবর্ষণ করে গেছে। মিসরাতার বিদ্রোহীদের এ জন্য গাদ্দাফির প্রতি বিশেষ প্রতিহিংসা তৈরি হয়েছিল। আবার মিসরাতা দখলে রাখা বিদ্রোহীরা শহরটি ধরে রাখায় সাফল্যের পরপরই ৩০ হাজার মানুষকে ঘরবাড়িতে ফিরতে বাধা দেয়। এদের অনেককেই আটক করে নির্যাতন কিংবা হত্যা করা হয়। পরিণামে মিসরাতার এই বেয়াড়া বাহিনীর ঠিক মাঝখানে গিয়ে পড়েন গাদ্দাফি ও তাঁর গাড়িবহর। গাদ্দাফিকে মর্মান্তিক মৃত্যু ও অবমাননার জন্য মিসরাতার বিদ্রোহীদেরই দায়ী করা হয়।

জন্মশহরই ধ্বংসশহর
বেনগাজি ছাড়াও বিদ্রোহীদের বড় ঘাঁটি ছিল গাদ্দাফির আপন শহর মিসরাতা। রাজধানী ত্রিপোলি হাতছাড়া হওয়ার পর গাদ্দাফি তাঁর ঘনিষ্ঠজন এবং দুই ছেলেসহ পরিবারের লোকদের নিয়ে এ শহরের দিকেই পালিয়ে আসেন। ঠিক এভাবেই ইরাকের পতিত শাসক সাদ্দাম হোসেন বাগদাদ থেকে পালিয়ে জন্মস্থান তিকরিতে এসে আত্মগোপন করেন এবং ধরা পড়েন। এফবিআইয়ের জেরা থেকে সাদ্দামের শেষ দিনগুলো সম্পর্কে জানা গেলেও গাদ্দাফির সেই ভাগ্য বা দুর্ভাগ্য ঘটেনি। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের জন্যও গাদ্দাফির শেষ দিনগুলোর চিত্র হাজির করা তাই কঠিন ছিল। প্রথমত, তাঁর সঙ্গীদের বেশির ভাগই বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হন। ভাগ্যের জোরে বেঁচে যাওয়া গাদ্দাফির ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি পিপলস গার্ড বাহিনীর প্রধান মনসুর ধাও একজন সাক্ষী। গাদ্দাফির মৃত্যুর দুদিন পরে নিউইয়র্ক টাইমস ও এইচআরসি মিসরাতার এক জেলে তাঁকে পায় এবং বিস্তারিত সাক্ষাৎকার নেয়। তবে ঘটনাস্থলের আশপাশে থাকা অন্য জীবিত ব্যক্তিদের কাছ থেকেও ধাওয়ের বিবরণের সত্যতা নিশ্চিত করা হয়।
বিদ্রোহীদের হাতে ত্রিপোলির পতন হয় ২৮ আগস্ট। তখন কয়েকটি গাড়িবহরে বিভক্ত হয়ে গাদ্দাফি ঘনিষ্ঠজনদের নিয়ে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়েন। পরদিনই এ রকমই এক গাড়িবহরে থাকা অবস্থায় গাদ্দাফির পুত্র খামিস গাদ্দাফি, তিনি ছিলেন এলিট খামিস ব্রিগেডের অধিনায়ক—ন্যাটোর বিমান হামলায় নিহত হন। আরেক পুত্র সাইফ আল ইসলামের গাড়িবহরেও একইভাবে বিমান হামলা হলেও আহত অবস্থায় তিনি পালাতে পারেন। পরে লিবিয়ার দক্ষিণ সীমান্তে তিনি বিদ্রোহীদের হাতে ধরা পড়েন। তৃতীয় পুত্র মুতাসিম পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা রক্ষার দায়িত্বে সির্তে শহরেই অবস্থান করছিলেন।

গাদ্দাফির শেষযাত্রা
গাদ্দাফি সির্তের দিকেই রওনা হন। সেখানে তাঁর সঙ্গে মিলিত হন মনসুর ধাওসহ বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। সামরিক প্রতিরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত মুতাসিম বাবার সঙ্গে একত্রে না থাকলেও নিয়মিতভাবে এসে দেখা করতেন। গাদ্দাফির অবস্থান ছিল শহরের কেন্দ্রস্থলের একটি ভবনে। কিন্তু সেখানে নিয়মিতভাবে আক্রমণ ও বোমা হামলা হতে থাকায় অনবরত তাঁদের আশ্রয় বদলাতে হয় এই ভবন থেকে সেই ভবনে। এদিকে বিদ্রোহীদের ঘেরাও ক্রমে কাছে চলে আসছিল। এই বেপরোয়া পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়েছেন ধাও এভাবে:
‘বেশির ভাগ সময় গাদ্দাফি কোরআন পাঠ আর নামাজ পড়ে কাটাতেন। দুনিয়ার সঙ্গে তাঁর সব যোগাযোগ ছিল বিচ্ছিন্ন। খাবার নেই, পানি নেই, ওষুধ নেই। বিভিন্নজনকে ফোন করে আল-রাই, রাশিয়া টুডে, বিবিসি অথবা ফ্রান্স ২৪-এর সংবাদ শুনে নিতাম। কারোরই কোনো কাজ ছিল না। ঘুমাতাম আর জেগে থাকতাম।’
চার-পাঁচ দিন পরপর তাঁরা জায়গা বদলাতেন। ‘ফাঁকা জনহীন বাড়িতে থাকতাম। কোনো এলাকা ফাঁকা হয়ে গেলেই সেখানে গিয়ে আশ্রয় নিতাম। এক বা দুটি গাড়িতে করে দফায় দফায় লোক আনা-নেওয়া করা হতো। প্রায়ই আমাদের থাকার জায়গায় হামলা হতো।...গাদ্দাফি দিনকে দিন রগচটা হতে থাকলেন। মূলত বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারা তাঁকে ক্ষিপ্ত করে তুলত।’

অন্তিম সময়ে আত্মীয়-বন্ধু-পরিজন
সির্তে শহরের দ্বিতীয় অংশে সে সময় বেশ কিছু বেসামরিক মানুষও ছিল। অনেকে বাড়িঘর ছেড়ে যেতে চায়নি। অনেকে গাদ্দাফির প্রতি অনুগত। আহত অনেককেও হাসপাতাল থেকে সরিয়ে সেখানে রাখা হয়েছিল। অল্প কয়েকজন নারী ও শিশুও তাঁদের সঙ্গে ছিলেন। বাইরে তুমুল লড়াই চলছে। ভুতুড়ে ভবনগুলোয় লুকিয়ে প্রাণ বাঁচাতে চাওয়া মানুষগুলো তখনো জানে না, কী ঘটবে একটু পর। একটু পর গাদ্দাফি প্রায় সশস্ত্র গাড়িবহর নিয়ে বের হবেন নিয়তির রাজপথের শেষ মঞ্জিলের উদ্দেশে। সকালে আহত, নিহত ও জীবিত ব্যক্তিদের সংখ্যা গুনে জানা যাবে,
সেখানে ছিল আড়াই শ জন, যাদের এক শ জনই নিহত হবে।
২০ অক্টোবর রাত এল গোলাবর্ষণের মধ্যেই। মুতাসিম ভাবছেন, দলবল নিয়ে অবরোধ ভেঙে বেরিয়ে যাবেন ভোরের দিকে। ওদিকে বিদ্রোহী মিলিশিয়ারাও হামলার জন্য প্রস্তুত। ন্যাটোর স্যাটেলাইটও ইগলচক্ষু মেলে রেখেছে গাদ্দাফির অবস্থানের দিকে। ভূমধ্যসাগরের কিনারে তখন ওত পেতে আছে মার্কিন যুদ্ধজাহাজ। প্রস্তুত আছে ব্রিটিশ যুদ্ধবিমান টর্নেডো, মার্কিন ড্রোন প্রিডেটর এবং ফরাসি রাফালে জেট। গাদ্দাফির কনিষ্ঠ পুত্র মুতাসিম এ সময়টাকেই পিতাকে নিয়ে ব্যূহ ভেঙে বেরিয়ে যাওয়ার এবং বাঁচার ক্ষণ হিসেবে বেছে নিলেন।

 

লিবিয়া-২

‘তোমাকে বাঁচাবার চেষ্টা করছি বাবা’

নিয়তির সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় আলো নেই জেনেও আশা ছাড়েননি গাদ্দাফি। বড় ছেলে আহত ও পলাতক, মেজো ছেলে ন্যাটোর বিমান হামলায় নিহত, ছোট ছেলে মুতাসিম কেবল বাবার সঙ্গী। ত্রিপোলি থেকে বিভিন্ন পথে সরকারের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিরা অক্টোবরের মাঝামাঝি সির্তে শহরে জড়ো হন। ইতিমধ্যে মুতাসিমকে পূর্বাঞ্চলীয় এলাকার প্রতিরক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় সির্তে শহর ঘিরে কৌশলগত পরিকল্পনা থাকাই স্বাভাবিক। হয়তো এখান থেকে প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল তাঁর। কিন্তু একদিকে সমস্ত যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়া, অন্যদিকে ন্যাটোর বিমান অবরোধ ও হামলার কারণে প্রতিরোধ ক্রমশ আশাহীন হয়ে আসছিল। এ অবস্থায় ১৯-২০ অক্টোবর ভোররাত সাড়ে তিনটা থেকে চারটার মধ্যে গাড়িবহর নিয়ে সির্তে থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত আগেই নেওয়া ছিল। কিন্তু আহত আর বেসামরিক লোকজনদের গাড়িতে তোলার বন্দোবস্ত করতেই সকাল আটটা হয়ে গেল। রাতভর গোলাবর্ষণ চলেছে। ভোরের দিকে মিলিশিয়ারাও ফিরে এসেছে যুদ্ধ অবস্থানে। তাদের ব্যূহ ভেদ করা ছাড়া উপায়ই বা কী?

পথের খোঁজে
সকাল আটটায় রওনা হলো ৫০টি গাড়ির বহর। কিছু গাড়িতে মেশিনগান ও বিমানবিধ্বংসী বন্দুক বসানো। মিলিশিয়ারা জানত যে একটা বহর আসছে। কিন্তু তারা জানত না, গাদ্দাফি ও তাঁর ছেলের এই গাড়িবহরই ছিল সেই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ টার্গেট। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন আর ফ্রান্সের যুদ্ধবিমান পাক খাচ্ছে আকাশে, মাটিতে মিলিশিয়ারা তক্কে তক্কে আছে। এরই মধ্যে সন্তর্পণে বহরটি পশ্চিমে সমুদ্রের দিকে চলল। শিগগিরই মিলিশিয়ারা হামলা শুরু করল। সেটা সামলে বাঁক নিয়ে চলল শহরের দক্ষিণ দিকে। কিন্তু খোলা রাস্তায় পড়ামাত্রই আকাশ থেকে একটা মিসাইল গাদ্দাফির সামনের গাড়িকে বিধ্বস্ত করে দিল। যুদ্ধবিমান আর ড্রোন থেকে বাঁচতে গলিপথে ঢুকল বহর। তাঁদের জানা ছিল না, নাক বরাবর রাস্তার ওপর বিদ্রোহীদের ঘাঁটি। তখন আর থামার বা পিছু হটার উপায়ও ছিল না। ততক্ষণে মরুসিংহ ফাঁদে আটকে গেছেন। ব্যারিকেড ভেঙে বেরিয়ে যাওয়াই তখন একমাত্র কাজ। সেই ঘাঁটির কমান্ডার খালিদ আহমেদ রিয়াদ বলছেন, ‘গাড়িবহর সোজা আমাদের ব্রিগেড ভবনের দিকে এসে রকেটচালিত গ্রেনেড ছুড়ল। আমরাও গোলাগুলি শুরু করলাম। ওরা চেয়েছিল আমাদের ভেতর দিয়ে পথ তৈরি করে নিতে...।’
বহরের যোদ্ধারা তখন মিলিশিয়াদের সঙ্গে লড়ছেন, সেই ফাঁকে ন্যাটোর বিমানগুলো সহজেই ৫০০ পাউন্ডের দুটি শক্তিশালী বোমা ফেলতে পারল। আরোহীদের বেশির ভাগই সেখানেই মারা গেল। পরদিন, ২১ অক্টোবর এইচআরসি সেখানে ৫৩টি লাশ পায়, ২৮ জনের দেহ চেনার উপায় ছিল না। সেই ঘটনায় মোট ১০৩ জনেরও বেশি নিহত হয়।

নিরুপায় চেষ্টা
হামলার পর যারা যেভাবে পারল আশপাশের ভবনে আশ্রয় নিল। গাদ্দাফি তাঁর ঘনিষ্ঠ চক্রসহ পাশের একটা ভিলায় ঢুকে পড়লেন। এদিকে মিলিশিয়াদের গোলাবর্ষণের তোড়, ওদিকে আকাশ থেকে বিমান হামলা। লিবিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইউনিস আবু বকর ইউনিস ও তাঁর ছেলেও সেখানে ছিলেন। অজ্ঞাতনামা সেই ছেলে এইচআরসিকে জানায়: ‘দেখলাম, মুতাসিম আহত। তাঁর গাড়িটাই ছিল বহরের একদম সামনে। গাদ্দাফিকে পেলাম ভিলার প্রহরীকক্ষের ভেতরে। গায়ে বুলেটপ্রুফ ভেস্ট, মাথায় হেলমেট। পকেটে একটা হ্যান্ডগান আর হাতে অটোমেটিক অস্ত্র। মনসুর ধাও এসে বাবাকে আর মুয়াম্মারকে আরেকটি বাড়িতে নিয়ে গেলেন। সবগুলো গাড়িই বিধ্বস্ত। ভিলার ভেতরেও বোমার আক্রমণে টেকা যাচ্ছিল না। সেখানে বিস্তর সিমেন্টের কাঠামো থাকায় তার আড়ালে পরিবার-পরিজন ও রক্ষীরা মিলে আশ্রয় নিলাম।’

‘তোমাকে বের করার চেষ্টা করছি, বাবা’
মুতাসিমই হাল ধরলেন। ৮ থেকে ১২ জন যোদ্ধা নিয়ে বের হওয়ার পথ তৈরির সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। যাওয়ার আগে বাবাকে বললেন, ‘আমি তোমাকে এখান থেকে বের করে বাঁচাবার চেষ্টা করছি।’ ওখান থেকে বেরিয়ে তাঁরা সড়কের তলা দিয়ে যাওয়া চওড়া পাইপের দিকে দৌড়ে গেলেন। খোলা মাঠের মধ্য দিয়ে গাদ্দাফিসহ ১০-১২ জন হামাগুড়ি দিয়ে সেখানে পৌঁছালেন। পাইপের অপর প্রান্ত দিয়ে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মিলিশিয়ারা তাঁদের দেখতে পায়। মিলিশিয়ারাও দৌড়ে গাদ্দাফিদের লুকিয়ে থাকা পাইপের ওপরের রাস্তায় চলে আসে। ইউনিস আবু বকর ইউনিসের জবানিতে: ‘দেখামাত্রই গাদ্দাফির দেহরক্ষীরা তাদের দিকে কয়েকটি গ্রেনেড ছোড়ে। কিন্তু তৃতীয় গ্রেনেডটি দেয়ালে বাড়ি খেয়ে আমাদের দিকেই পড়ল। একজন রক্ষী সেটা হাতে নিয়ে আবার ছোড়ার চেষ্টা করতে না-করতেই বিস্ফোরিত হলো। বাবা আহত হলেন, গাদ্দাফির গায়েও গ্রেনেডের শার্পনেল বিঁধল। দেখলাম, রক্ষীটি মারা গেছে, বাবার শরীর নিস্তব্ধ, গাদ্দাফির গা থেকে রক্ত ঝরছে, মনসুর ধাও-ও মাটিতে পড়ে আছেন!’

আহত ও বন্দী
মিলিশিয়ারা লাফিয়ে নামল সেখানে। তাদের ধারণাই ছিল না যে গাদ্দাফিকে তারা হাতে পেয়ে যাবে। তাদের উদ্যত বন্দুকের সামনে গাদ্দাফি কেবল বলতে পেরেছিলেন, ‘গুলি কোরো না, গুলি কোরো না।’ আনাড়ি হাতের তিন মিনিট ৩৮ সেকেন্ড দীর্ঘ একটি ভিডিওচিত্রের বরাত দিয়ে এইচআরসি বলছে, ‘আটক হওয়ামাত্রই তারা গাদ্দাফিকে মারধর করা শুরু করল। আগেই তিনি মাথায় বোমার আঘাত পেয়েছিলেন। রাস্তা দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় একজন তাঁর পেছনটায় বেয়নেট চালাল। সেই ক্ষত থেকেও রক্ত ঝরা শুরু হলো। গাদ্দাফিকে ঘিরে ‘আল্লাহু আকবর’ আর ‘মিসরাতা’ বলতে বলতে মারছিল তারা। মারতেই থাকল। মিসরাতায় সেই বিদ্রোহী কমান্ডারের সাক্ষ্য:
‘গাদ্দাফিকে আটকের সময় অবস্থা ছিল চরম গোলমেলে। চারপাশে অনেক যোদ্ধা। আমি যখন তাঁকে দেখি, তখনো তিনি জীবিত ছিলেন। তার মানে, তাঁকে গুলি করা হয় আরও পরে। তাঁকে একটা পিকআপ ট্রাকে রাখা হলো, কিন্তু তিনি পড়ে গেলেন। যোদ্ধারা তাঁর চুল ধরে টানছিল, মারছিল। পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল।’
অবশেষে তারা গাদ্দাফিকে একটা অ্যাম্বুলেন্সে তুলে নিয়ে রওনা হলো, পেছনে অজস্র গাড়ির বহর। ফোনে তোলা ভিডিওচিত্রে দেখা যাচ্ছে, প্রায় নগ্ন গাদ্দাফি একটা অ্যাম্বুলেন্সে নিথর হয়ে শুয়ে আছেন। এ থেকে বোঝা যায় যে ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। দুই ঘণ্টা পরে অ্যাম্বুলেন্সটি মিসরাতায় পৌঁছায়। সেখানে তাঁর মৃতদেহ প্রকাশ্যে রাখা হয়। লিবীয় বিপ্লবের নেতা, একটা গোত্রীয় যাযাবর সমাজকে সমৃদ্ধ সেবামূলক দেশে পরিণত করার নায়ক, ৪২ বছরের একচেটিয়া শাসনের ক্ষমতা উপভোগকারী মুয়াম্মার গাদ্দাফি ইতিহাস হলেন। জীবনে অজস্র নাটকীয় ঘটনার জন্ম দিতে দিতে নিজেও হয়ে গেলেন এক মর্মান্তিক ট্র্যাজেডির প্রধান চরিত্র।

কার হত্যা কে করে?
ঠিক কীভাবে তাঁর মৃত্যু হয়, সেটা এখনো পরিষ্কার নয়। বেনগাজির কিছু মিলিশিয়া কৃতিত্ব দাবি করে বলেছে, তাঁকে কোথায় নেওয়া হবে, তা নিয়ে মিসরাতার যোদ্ধাদের সঙ্গে বিবাদের একপর্যায়ে তারা গাদ্দাফিকে গুলি করে। কিন্তু এই দাবিও প্রমাণিত হয়নি। ঘটনার ধারা অনুসরণ করলে দেখা যায়, ন্যাটোর নামে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন আর ফ্রান্সের তিনটি বিমান থেকে প্রথম গাদ্দাফির বহরে বোমা হামলা চালানো হয়। সম্ভবত গাদ্দাফির অবস্থান তারা আগেভাগেই জেনে গিয়েছিল এবং সে অনুযায়ীই হামলার পরিকল্পনা এঁটেছিল। মুতাসিমের নেতৃত্বে বহরটি গেরিলাদের এড়িয়ে মূল সড়কে উঠে পড়ার সময়ই হামলাটি হয়। বিমান হামলা না হলে গাদ্দাফির বেঁচে যাওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ২০১১ সালের ২০ অক্টোবর মিসরাতায় গণহত্যার শুরু এই হামলা থেকেই। ন্যাটো বিমানের দুটি মিসাইলেই গাড়িবহর ধ্বংস হয়। তারপর আসে মিলিশিয়ারা এবং তাদের হাতেই মুয়াম্মার গাদ্দাফি, মুতাসিম গাদ্দাফি ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইউনিস নিহত হন। বিনাবিচারে যুদ্ধবন্দী হত্যার দায় তাই ন্যাটো এবং তাদের দেওয়া অস্ত্রসজ্জিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মিলিশিয়ারা এড়াতে পারে না। লিবিয়ার মরুভূমির অজ্ঞাত কোনো স্থানে গোপনে এই তিনজনের কবর দেওয়া হয়। গাদ্দাফির অনুগতরা কবরগুলোকে প্রতিরোধের প্রেরণা হিসেবে যাতে নিতে না পারে, তা ঠেকাতেই এই ব্যবস্থা।
এই লিবিয়ার মরুভূমিতেই ১৯১১ সালে আরেকটি যুদ্ধের শুরু হয়েছিল। আগ্রাসী ইতালি বাহিনী লিবিয়া দখল করে নিলে মক্তবের শিক্ষক ওমর আল মুখতারের নেতৃত্বে ২২ বছরব্যাপী স্বাধীনতাযুদ্ধ চলে। অবশেষে ১৯৩৪ সালে মুখতার যুদ্ধরত অবস্থায় আটক হন। দখলদারেরা তিন দিনের মাথায় বন্দীদের শ্রমশিবিরে অনুসারীদের সামনে তাঁকে ফাঁসি দেয়। ইতিহাসের কী মর্মান্তিক মিল, মুখতার আর গাদ্দাফি বিনাবিচারে নিহত হন; মৃত্যুর সময় উভয়েরই বয়স হয়েছিল ৭০ বছর।

লিবিয়া-৩

গাদ্দাফির অন্তিম প্রশ্নের উত্তর দেবে কে?

মুয়াম্মার গাদ্দাফি বিদ্রোহীদের হাতে আটক হয়ে নিহত হওয়ার এক বছর পূর্তি হলো ২০ অক্টোবর। এর তিন দিন আগে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ‘ডেথ অব এ ডিক্টেটর: ব্লাডি ভেনেগান্স ইন সির্তে’ নামের প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এখানে তারই আলোকে গাদ্দাফির অন্তিম মুহূর্ত এবং লিবিয়ার মানবাধিকার পরিস্থিতির ভয়াবহতা নিয়েই এই প্রতিবেদন।

মৃত্যুর আগের মুহূর্তে গাদ্দাফি বলে উঠেছিলেন, ‘ডোন্ট শ্যুট, ডোন্ট শ্যুট’। তখন তিনি নিরস্ত্র, আহত ও বন্দী। যুদ্ধবন্দী হত্যা যুদ্ধাপরাধ ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন। কিন্তু ন্যাটো-সমর্থিত বিদ্রোহীদের জবাবদিহি চাইবার কেউ ছিলনা। খোদ ন্যাটোই যেখানে আহত ও বেসামরিক নাগরিক বহনকারী গাড়িবহরে হামলা করেছে, সেখানে বিদ্রোহীরা তাদের দোসর হয়ে গাদ্দাফিকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। তারা তখন হত্যার লাইসেন্সপ্রাপ্ত।
লিবিয়ায় ক্ষমতা পরিবর্তনকালে মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে এইচআরসির প্রতিবেদন মনে করিয়ে দেয় ইরাক দখল-পরবর্তী পরিস্থিতির কথা; আফগানিস্তান, বসনিয়া, কসোভো, সোমালিয়াসহ এ রকম অজস্র দেশের গণহত্যার কথা। সবখানেই মানবাধিকার, শান্তি ও গণতন্ত্রের জন্য আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর তত্ত্বাবধানে যুদ্ধ হয়েছে। সেসব যুদ্ধের বলি হয়েছে লাখ লাখ সাধারণ মানুষ। পরাজিত পক্ষের মানবাধিকারের কথা এসব শান্তিবাদী ভাবেননি। মৃত্যুর আগে আরেকটি কথা গাদ্দাফি বলেছিলেন, কথাটি ভোলা কঠিন। তিনি বলেছিলেন, ‘তোমরা কি সত্য আর মিথ্যার পার্থক্য করতে পারো?’

মুতাসিম গাদ্দাফির অন্তিম সময়
মুয়াম্মার গাদ্দাফির কনিষ্ঠ পুত্র মুতাসিম গাদ্দাফির হত্যাকাণ্ড এই দ্বিচারিতারই আরেক নজির। তাঁকে বাঁচানোর যথেষ্ট সময় পাওয়া গেলেও কোনো সাড়াশব্দ করেনি ন্যাটোর মদদপুষ্ট লিবিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এনটিসি। ‘বাবা, তোমাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি’ বলে দলবল নিয়ে লড়াইয়ে যাওয়ার পর পিতা-পুত্রের আর দেখা হয়নি। সির্তের গাদ্দাফিপন্থী যোদ্ধাদের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। বিদ্রোহীদের সশস্ত্র ঘেরাও ভেঙে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টার সময় তিনিও বাবার মতো আটক হন। ফোনে ধারণকৃত কয়েকটি ভিডিওতে তাঁর অন্তিম মুহূর্তের সাক্ষ্য পাওয়া যায়। বন্দী হওয়ার কিছুক্ষণ পরের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, একটি পিকআপ ট্রাকে হেলান দিয়ে বসে আছেন। বিমূঢ় ও আহত। বুকের ডান দিকটা রক্তাক্ত। উঠে দাঁড়িয়ে টলমল পায়ে হাঁটতেও দেখা গেল। তাঁকে ঘিরে আছে এক দঙ্গল বন্দুকধারী।
দ্বিতীয় ভিডিওতে দেখা গেল সাদা পিকআপে হেলান দিয়ে আছেন, চোখ বন্ধ, শরীর থেকে রক্ত ঝরছে। তৃতীয় ভিডিওতে তিনি একটা ঘরের ভেতর, বিছানায় শোয়া। বুকের ক্ষত দেখিয়ে বলছেন, ‘এগুলো আমার পদক।’ গালিগালাজের জবাবে বললেন, ‘বাচ্চাদের মতো আচরণ করা বন্ধ করো!’ এক বন্দুকধারী পাল্টা বলে, ‘সে চায় ভিডিওতে তাকে বীরের মতো দেখাক, চায় মানুষ বলুক মৃত্যুর মুখেও কত নির্ভীক ছিল সে।’ এর কিছুক্ষণ পরই গাদ্দাফি পরিবারের শেষ পুরুষ মুতাসিম গাদ্দাফিকে হত্যা করা হয়। বড় ছেলে সাইফ আগেই বন্দী অবস্থায়নিহত হন।

মাহারি হোটেলের গণহত্যা
সির্তে শহরে ন্যাটোর বিমান হামলা আর স্থানীয় মিলিশিয়াদের হাত থেকে যাঁরা বেঁচে যান, তাঁদের আনা হয় পাশেরই মাহারি হোটেলে। পরের দৃশ্য: সমুদ্রের দিকে মুখ করা সেই হোটেলের সবুজ চত্বরে ছড়ানো-ছিটানো লাশের স্তূপ। অনেকেরই হাত বাঁধা, অনেকেরই নিথর চোখ খোলা সমুদ্রের দিকে মেলে ধরা। গত বছরের অক্টোবর মাসের ২০ তারিখে গাদ্দাফি নিহত হওয়ার পরের কয়েক দিন যেখানেই তাঁর জন্মশহর সির্তের মানুষদের পাওয়া গেছে, কিংবা আটক হয়েছে গাদ্দাফির গাদ্দাফা গোত্রের কেউ—সবাই নির্বিচারে হত্যার শিকার হয়েছে। গাদ্দাফির শেষ যুদ্ধের জায়গায় পাওয়া গিয়েছিল ১০০ জনের লাশ, মাহারি হোটেলে মিলল ৫৩ জনের দেহ। বাকি আরও ১০০ জনের কতজন বেঁচে ছিলেন আর কতজন নিহত, তার হিসাব নেই। পাশের পানি সরবরাহকেন্দ্রেও অনেক লাশ পড়ে থাকে।

গাদ্দাফির অষ্টম আশ্চর্যের পাশেই মৃত্যু
ইতিহাসের নিষ্ঠুর পরিহাস। গাদ্দাফির যে অবদান অবিস্মরণীয় তা হলো, পৃথিবীর বৃহত্তম বিশুদ্ধ পানি সরবরাহব্যবস্থা নির্মাণ করে নব্বই ভাগ মরুময় দেশে পানির অভাব দূর করা। পৃথিবীর বৃহত্তম খনিজ পানির আধার নুবিয়ান ভূগর্ভস্থ জলাধার থেকে মরুভূমির ভেতর দিয়ে হাজার হাজার মাইল দীর্ঘ পাইপ টেনে দেশবাসীর জলকষ্ট দূর করেছিলেন তিনি। সাহারা মরুতে নদী থাকার কথা নয়, গাদ্দাফির মহা মানব-নির্মিত নদীব্যবস্থা (গ্রেট ম্যান মেড রিভার সিস্টেম) হলো সেই কৃত্রিম নদী। এটা ছিল বিশ্বের অষ্টম আশ্চর্য। অথচ তাঁর মৃত্যু হয় সেই পানি সরবরাহব্যবস্থার একটি কেন্দ্রেরই পাশে। লিবিয়ায় শান্তি কায়েমের অভিযানে সেই পানি সরবরাহব্যবস্থাকেও বোমা মেরে বিপর্যস্ত করে দেওয়া হয়।
২৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নির্মিত এই পানি সরবরাহব্যবস্থার জন্য গাদ্দাফিকে একটি পয়সাও আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ করতে হয়নি। মরুভূমির অনেক গভীরে চার হাজার মাইল দীর্ঘ এলাকাজুড়ে এই অ্যাকইফায়ার বা পাতাল জলাধারে পানির পরিমাণ ২০০ বছর ধরে নীল নদ দিয়ে প্রবাহিত পানির থেকেও বেশি। খনিজ পানি হওয়ায় এর মূল্য সাধারণ পানির থেকে বেশি। তেলের যুদ্ধের পাশাপাশি লিবিয়া হলো পানির যুদ্ধেরও শিকার। এখন এই পানির নিয়ন্ত্রণ পেতে যাচ্ছে ফ্রান্সের ভিওলিয়া (সাবেক ভিভেন্দি) কোম্পানি। এরাই গোটা দুনিয়ার পানি-বাণিজ্যের ৪০ শতাংশের মালিক। এবং এই ফ্রান্সের রাফালে বিমান থেকেই গাদ্দাফির বহরে বোমা হামলা হয়। সঙ্গে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রিডেটর ড্রোন এবং ব্রিটেনের টর্নেডো বিমান তাঁর অবস্থান চিহ্নিত করে।

সবই শান্তি ও গণতন্ত্রের জন্য
২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবরে গাদ্দাফি হত্যা হয়ে এ পর্যন্ত লিবিয়ায় যা কিছু হয়েছে সবই হয়েছে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের নামে। মানবিক হস্তক্ষেপের (হিউম্যানেটারিয়ান ইন্টারভেনশন) রুপালি ঝালর উড়িয়েই পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর মাধ্যমে সামরিক অভিযান, জাতিসংঘের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবরোধ, পাশ্চাত্যকেন্দ্রিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিদেশে লিবিয়ার সম্পদ বাজেয়াপ্ত এবং সৌদি আরব, কাতার প্রভৃতি রাষ্ট্রের মাধ্যমে বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রসজ্জিত করা হয়। আরব গণজাগরণের প্রেরণাও ব্যবহূত হয় বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করার জন্য।
দিনের শেষে দেখা গেল, আরব বসন্ত লিবিয় মরুঝড়ে বুমেরাং হয়ে লিবীয়দের গণহত্যা ও অশেষ দুর্ভাগ্য বয়ে আনল। পশ্চিমা অস্ত্রসজ্জিত জিহাদি আল-কায়েদা, গাদ্দাফিবিরোধী মিলিশিয়া এবং হরেক রকমের বন্দুকধারীদের অবাধ রাজত্ব কায়েম হলো লিবিয়ায়। যত্রতত্র প্রাইভেট নির্যাতনখানা, অজস্র নারী ধর্ষিত। বধ্যভূমি আর বোমা-বারুদে অনেক প্রাণ গেল। উত্তর আফ্রিকার মধ্যে জীবনমান ও সম্পদে এগিয়ে থাকা রাষ্ট্রটি পরিণত হলো মগের মুল্লুকে। লিবিয়ার তেল ও গ্যাসক্ষেত্রগুলো এবং বিশ্বের বিস্ময় গ্রেট ম্যান মেড রিভার সিস্টেমও তছনছ হলো। এই ক্ষতি পূরণ করতে অনেক দশক চলে যাবে, তাও যদি লিবিয়ায় স্বাধীন দেশপ্রেমিক সরকার প্রতিষ্ঠিত থাকে। কিন্তু লক্ষ প্রাণের অপচয় কি আর ফেরানো যাবে? কে দায় নেবে এই গণহত্যার? হিউম্যান রাইটস ওয়াচ লিবিয়ার সরকারকে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণহত্যার তদন্ত করার দায় বর্তিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এই পরিস্থিতি যাদের সৃষ্টি, গাদ্দাফির হত্যাকাণ্ডে যারা সরাসরি জড়িত, তাদের বিচার হবে কোন আদালতে?
গাদ্দাফি অগণতান্ত্রিক শাসক ছিলেন, তাঁর কৃতকর্মের অনেক কিছুই মানবতার লঙ্ঘন করেই ঘটেছে। আবার তিনি যেখানে শেষ করেছিলেন, সেই লিবিয়া ছিল সমৃদ্ধ দেশ। এবং তিনি মোটেই ধর্মপন্থী শাসক ছিলেন না, যেমন ছিলেন না ইরাকের সাদ্দাম হোসেনও। কিন্তু উভয়ের বিলয়ের পর উভয় দেশই সাম্প্রদায়িক আর ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের খপ্পরে পতিত হয়েছে। হয়তো সিরিয়া ও লেবাননের জন্যও একই পরিণতি অপেক্ষা করছে। শেষ বিচারে মানবিকতার জন্য যুদ্ধ যেমন প্রতারণা, তেমনি দেশপ্রেমিক স্বৈরশাসনও বিপদের কারণ। সাদ্দাম ও গাদ্দাফি যতই দেশপ্রেমিক হোন, অগণতান্ত্রিক শাসক যে সার্বভৌমত্ব বাঁচাতে পারেন না; জীবন দিয়ে তাঁরা সেই শিক্ষাই দিয়ে গেলেন।
লিবিয়া এখন রাষ্ট্রীয় হত্যাপুরী। এই মুহূর্তে গাদ্দাফিপন্থী শেষ মুক্ত শহর বানি ওয়ালিদের ওপর চতুর্দিক থেকে হামলা চলছে। গাদ্দাফির পক্ষ নেওয়ার জন্য গণশাস্তি পাচ্ছে সমগ্র শহরবাসী। অথচ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম গাদ্দাফির দুরাচার নিয়ে যতটা সোচ্চার, পশ্চিমা-সমর্থিত এনটিসির হত্যাযজ্ঞ নিয়ে ততটাই নীরব। তারা আফগানিস্তানের তালেবানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, আবার তালেবানদের কাতারে অফিস খুলতে দিয়ে যুদ্ধখেলার আলোচনা করে। একদিকে চলছে আল-কায়েদা ধ্বংসের কার্যকলাপ, অন্যদিকে সিরিয়া ও লিবিয়ায় আল-কায়েদা দিয়ে অস্থিতিশীলতা জারি রাখার কায়কারবার। এ অবস্থায় শান্তির ডাকনাম হয়েছে যুদ্ধ, গণতন্ত্রের জন্য দরকার হচ্ছে আগ্রাসন আর মানবাধিকারের নামে মানবের প্রাণ ও সভ্যতার অবাধ ধ্বংস। গাদ্দাফির অন্তিম প্রশ্নটির উত্তর তাই খুঁজতে হচ্ছে আমাদের, ‘তোমরা কি সত্য আর মিথ্যার পার্থক্য করতে পারো?’ (সমাপ্ত)
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
farukwasif@yahoo.com


 

 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন