মুয়াম্মার গাদ্দাফি বিদ্রোহীদের হাতে আটক হয়ে নিহত হওয়ার এক বছর পূর্তি হলো
২০ অক্টোবর। এর তিন দিন আগে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ‘ডেথ অব এ ডিক্টেটর: ব্লাডি ভেনেগান্স ইন সির্তে’
নামের প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এখানে তারই আলোকে গাদ্দাফির অন্তিম মুহূর্ত
এবং লিবিয়ার মানবাধিকার পরিস্থিতির ভয়াবহতা নিয়েই এই প্রতিবেদন।
২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে গাদ্দাফির বিরোধীরা লিবিয়াজুড়ে সরব হওয়া শুরু করে। কিন্তু লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ সেই প্রতিবাদ শুনল না, উল্টো শোনাল সিংহের হুঙ্কার। পরিণাম—বিদ্রোহ। লিবিয়ার মরুসিংহ বিদ্রোহীদের তাড়িয়ে বেড়ালেন। কিন্তু মরুসিংহকে তাঁর সুরক্ষিত গুহা থেকে বের করে আনার ব্যবস্থা করল ন্যাটো। ভূমিতে বিদ্রোহীদের মর্টার আক্রমণ, আকাশ থেকে ন্যাটোর ড্রোন আর মিসাইল বর্ষণ; হার মানতে হলো গাদ্দাফিকে। দিনের শেষে দেখা গেল গাড়িবহর নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। গৃহযুদ্ধের ডামাডোলে জনশূন্য শহরের ভুতুড়ে বাড়ি থেকে বাড়িতে লুকিয়ে দিন কাটতে থাকল তাঁর। দুনিয়ার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। খাবার, পানি, এমনকি ওষুধ পর্যন্ত নেই। তাঁর খোঁজে চারদিক দাবড়ে বেড়াচ্ছে বিদ্রোহী মিলিশিয়ারা। আকাশে চক্কর দিচ্ছে ড্রোন। মার্কিন স্যাটেলাইটের সর্বদর্শী চোখ তাঁর জন্মস্থান লিবিয়ার ইঞ্চি ইঞ্চি মাটি তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
মুয়াম্মার গাদ্দাফি ৪২ বছর ধরে ছিলেন লিবিয়ার পরম ক্ষমতাধর। বলা হয়, পরম ক্ষমতা চরম দুর্নীতিবাজ। এটা বলা হয় না, ক্ষমতার খুঁটিগুলো সরে গেলে পরম ক্ষমতাই চরম অসহায় হয়ে পড়ে। বিরাট বাহিনী, বিপুল শানশওকত, অজস্র বিমান আর ট্যাংক ছিল তাঁর। কিন্তু তাঁকে কিনা মরতে হলো প্রায় খালি হাতে পালাতে পালাতে ধরা পড়া অবস্থায়। বেআইনি হত্যা নিজে করেছেন, তাঁকেও হত্যা করা হয়েছে বেআইনিভাবে। যুদ্ধবন্দী হওয়া সত্ত্বেও হয়েছেন নৃশংস প্রতিহিংসার শিকার।
বিদ্রোহীদের হাতে ধরা পড়ার সেই কালো দিনের এক বছর পূর্তি হলো ২০ অক্টোবর। এর তিন দিন আগে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ‘ডেথ অব এ ডিক্টেটর: ব্লাডি ভেনেগান্স ইন সির্তে’ তথা ‘এক স্বৈরশাসকের মৃত্যু: সির্তে শহরে রক্তপিপাসু প্রতিহিংসা’ নামের প্রতিবেদন প্রকাশ করে। গাদ্দাফির মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রসঙ্গ থাকলেও মূলত মুয়াম্মার গাদ্দাফি ও তাঁর পরিবার এবং ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের হত্যার অমানবিকতার বিষয়টিই এই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এখানে ভয়ংকর সেই দিনের কথাই আপনাদের শোনাব।
ধুলার ঘূর্ণি থেকে মরুঝড়
২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গাদ্দাফিবিরোধী প্রথম বিক্ষোভ দেখা যায়। মাত্র অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই অসম্ভব দ্রুততার সঙ্গে বেনগাজি শহরে ঘাঁটি গেড়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এনটিসি প্রতিষ্ঠা করে। ১৭ মার্চ সরকারি বাহিনী বেনগাজি ঘিরে ফেললে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ লিবিয়ার ওপর ‘উড়ালনিষিদ্ধ’ সিদ্ধান্ত পাস করে। তারা একই সঙ্গে দখলদার বাহিনী পাঠানো ছাড়া বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষায় প্রয়োজনীয় যেকোনো ব্যবস্থা (সামরিকও অন্তর্ভুক্ত) নেওয়ার সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলে। এই সিদ্ধান্তের ফলেই চালু হয় ‘অপারেশন ইউনিফায়েড প্রটেক্টর’ সম্মিলিত রক্ষা অভিযান। বিমান উড়াল নিষিদ্ধ হওয়ায় বেনগাজি দখলে ব্যর্থ হয় সরকার। ফ্রান্স, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে পশ্চিমা কয়েকটি সরকার বিদ্রোহীদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দেয়। কাতার পরে স্বীকার করে, কয়েক হাজার কাতারি সৈন্যও গাদ্দাফির বিরুদ্ধে লড়াই করে।
বর্বরতার জবাবে বর্বরতা
বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ামাত্রই গাদ্দাফির অনুগত বাহিনীগুলো কঠোর হাতে দমনে নেমে পড়ে। ইতিহাস সাক্ষী, পরদেশি শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের চেয়ে কোনো অংশে কম নৃশংস হয় না স্বদেশিদের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধ। এই যুদ্ধে গাদ্দাফি ছিলেন একা এবং তাঁর বিরুদ্ধে ন্যাটোসহ আরবের যুক্তরাষ্ট্রপন্থী রাষ্ট্রগুলো। উভয় পক্ষই মরিয়া হয়ে সংক্ষিপ্ততম সময়ে জয়ের জন্য চরম নৃংশস পদ্ধতি অবলম্বন করে। সরকারি বাহিনী হাজারো লোককে আটক করে। তাদের অনেকে বন্দী অবস্থায় নিহত ও নির্যাতিত হয়। বেসামরিক এলাকায় মর্টার হামলা, বোমাবর্ষণ ও গ্র্যাড রকেট নিক্ষিপ্ত হয়। ত্রিপোলির পতনের ঠিক আগে আগেই কমপক্ষে ৪৫ জনকে হত্যা করে। ২০টির মতো গণধর্ষণের ঘটনাও জানা যায়। এসবই ছিল যুদ্ধের আইনের লঙ্ঘন। বিদ্রোহীরাও কাউকেই ছাড় দেয়নি। অজস্র বিচারবহির্ভূত হত্যা, বন্দী অবস্থায় নির্যাতন, ধর্ষণ, গাদ্দাফির অনুগত শহরে নির্বিচার হামলা চলে। সাব-সাহারান আফ্রিকার অভিবাসী শ্রমিকদের ওপরও লাগামছাড়া আক্রমণ হয়।
এইচআরসি গৃহযুদ্ধকালীন মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিবিড় বিবরণটি তুলে ধরে মিসরাতা শহরের ব্যাপারে। গাদ্দাফি বাহিনী প্রায় দুই মাস শহরটি অবরোধ করে ছিল। এ দুই মাসে নিয়মিতভাবে তারা শহরটিতে বোমাবর্ষণ করে গেছে। মিসরাতার বিদ্রোহীদের এ জন্য গাদ্দাফির প্রতি বিশেষ প্রতিহিংসা তৈরি হয়েছিল। আবার মিসরাতা দখলে রাখা বিদ্রোহীরা শহরটি ধরে রাখায় সাফল্যের পরপরই ৩০ হাজার মানুষকে ঘরবাড়িতে ফিরতে বাধা দেয়। এদের অনেককেই আটক করে নির্যাতন কিংবা হত্যা করা হয়। পরিণামে মিসরাতার এই বেয়াড়া বাহিনীর ঠিক মাঝখানে গিয়ে পড়েন গাদ্দাফি ও তাঁর গাড়িবহর। গাদ্দাফিকে মর্মান্তিক মৃত্যু ও অবমাননার জন্য মিসরাতার বিদ্রোহীদেরই দায়ী করা হয়।
জন্মশহরই ধ্বংসশহর
বেনগাজি ছাড়াও বিদ্রোহীদের বড় ঘাঁটি ছিল গাদ্দাফির আপন শহর মিসরাতা। রাজধানী ত্রিপোলি হাতছাড়া হওয়ার পর গাদ্দাফি তাঁর ঘনিষ্ঠজন এবং দুই ছেলেসহ পরিবারের লোকদের নিয়ে এ শহরের দিকেই পালিয়ে আসেন। ঠিক এভাবেই ইরাকের পতিত শাসক সাদ্দাম হোসেন বাগদাদ থেকে পালিয়ে জন্মস্থান তিকরিতে এসে আত্মগোপন করেন এবং ধরা পড়েন। এফবিআইয়ের জেরা থেকে সাদ্দামের শেষ দিনগুলো সম্পর্কে জানা গেলেও গাদ্দাফির সেই ভাগ্য বা দুর্ভাগ্য ঘটেনি। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের জন্যও গাদ্দাফির শেষ দিনগুলোর চিত্র হাজির করা তাই কঠিন ছিল। প্রথমত, তাঁর সঙ্গীদের বেশির ভাগই বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হন। ভাগ্যের জোরে বেঁচে যাওয়া গাদ্দাফির ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি পিপলস গার্ড বাহিনীর প্রধান মনসুর ধাও একজন সাক্ষী। গাদ্দাফির মৃত্যুর দুদিন পরে নিউইয়র্ক টাইমস ও এইচআরসি মিসরাতার এক জেলে তাঁকে পায় এবং বিস্তারিত সাক্ষাৎকার নেয়। তবে ঘটনাস্থলের আশপাশে থাকা অন্য জীবিত ব্যক্তিদের কাছ থেকেও ধাওয়ের বিবরণের সত্যতা নিশ্চিত করা হয়।
বিদ্রোহীদের হাতে ত্রিপোলির পতন হয় ২৮ আগস্ট। তখন কয়েকটি গাড়িবহরে বিভক্ত হয়ে গাদ্দাফি ঘনিষ্ঠজনদের নিয়ে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়েন। পরদিনই এ রকমই এক গাড়িবহরে থাকা অবস্থায় গাদ্দাফির পুত্র খামিস গাদ্দাফি, তিনি ছিলেন এলিট খামিস ব্রিগেডের অধিনায়ক—ন্যাটোর বিমান হামলায় নিহত হন। আরেক পুত্র সাইফ আল ইসলামের গাড়িবহরেও একইভাবে বিমান হামলা হলেও আহত অবস্থায় তিনি পালাতে পারেন। পরে লিবিয়ার দক্ষিণ সীমান্তে তিনি বিদ্রোহীদের হাতে ধরা পড়েন। তৃতীয় পুত্র মুতাসিম পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা রক্ষার দায়িত্বে সির্তে শহরেই অবস্থান করছিলেন।
গাদ্দাফির শেষযাত্রা
গাদ্দাফি সির্তের দিকেই রওনা হন। সেখানে তাঁর সঙ্গে মিলিত হন মনসুর ধাওসহ বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। সামরিক প্রতিরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত মুতাসিম বাবার সঙ্গে একত্রে না থাকলেও নিয়মিতভাবে এসে দেখা করতেন। গাদ্দাফির অবস্থান ছিল শহরের কেন্দ্রস্থলের একটি ভবনে। কিন্তু সেখানে নিয়মিতভাবে আক্রমণ ও বোমা হামলা হতে থাকায় অনবরত তাঁদের আশ্রয় বদলাতে হয় এই ভবন থেকে সেই ভবনে। এদিকে বিদ্রোহীদের ঘেরাও ক্রমে কাছে চলে আসছিল। এই বেপরোয়া পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়েছেন ধাও এভাবে:
‘বেশির ভাগ সময় গাদ্দাফি কোরআন পাঠ আর নামাজ পড়ে কাটাতেন। দুনিয়ার সঙ্গে তাঁর সব যোগাযোগ ছিল বিচ্ছিন্ন। খাবার নেই, পানি নেই, ওষুধ নেই। বিভিন্নজনকে ফোন করে আল-রাই, রাশিয়া টুডে, বিবিসি অথবা ফ্রান্স ২৪-এর সংবাদ শুনে নিতাম। কারোরই কোনো কাজ ছিল না। ঘুমাতাম আর জেগে থাকতাম।’
চার-পাঁচ দিন পরপর তাঁরা জায়গা বদলাতেন। ‘ফাঁকা জনহীন বাড়িতে থাকতাম। কোনো এলাকা ফাঁকা হয়ে গেলেই সেখানে গিয়ে আশ্রয় নিতাম। এক বা দুটি গাড়িতে করে দফায় দফায় লোক আনা-নেওয়া করা হতো। প্রায়ই আমাদের থাকার জায়গায় হামলা হতো।...গাদ্দাফি দিনকে দিন রগচটা হতে থাকলেন। মূলত বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারা তাঁকে ক্ষিপ্ত করে তুলত।’
অন্তিম সময়ে আত্মীয়-বন্ধু-পরিজন
সির্তে শহরের দ্বিতীয় অংশে সে সময় বেশ কিছু বেসামরিক মানুষও ছিল। অনেকে বাড়িঘর ছেড়ে যেতে চায়নি। অনেকে গাদ্দাফির প্রতি অনুগত। আহত অনেককেও হাসপাতাল থেকে সরিয়ে সেখানে রাখা হয়েছিল। অল্প কয়েকজন নারী ও শিশুও তাঁদের সঙ্গে ছিলেন। বাইরে তুমুল লড়াই চলছে। ভুতুড়ে ভবনগুলোয় লুকিয়ে প্রাণ বাঁচাতে চাওয়া মানুষগুলো তখনো জানে না, কী ঘটবে একটু পর। একটু পর গাদ্দাফি প্রায় সশস্ত্র গাড়িবহর নিয়ে বের হবেন নিয়তির রাজপথের শেষ মঞ্জিলের উদ্দেশে। সকালে আহত, নিহত ও জীবিত ব্যক্তিদের সংখ্যা গুনে জানা যাবে,
সেখানে ছিল আড়াই শ জন, যাদের এক শ জনই নিহত হবে।
২০ অক্টোবর রাত এল গোলাবর্ষণের মধ্যেই। মুতাসিম ভাবছেন, দলবল নিয়ে অবরোধ ভেঙে বেরিয়ে যাবেন ভোরের দিকে। ওদিকে বিদ্রোহী মিলিশিয়ারাও হামলার জন্য প্রস্তুত। ন্যাটোর স্যাটেলাইটও ইগলচক্ষু মেলে রেখেছে গাদ্দাফির অবস্থানের দিকে। ভূমধ্যসাগরের কিনারে তখন ওত পেতে আছে মার্কিন যুদ্ধজাহাজ। প্রস্তুত আছে ব্রিটিশ যুদ্ধবিমান টর্নেডো, মার্কিন ড্রোন প্রিডেটর এবং ফরাসি রাফালে জেট। গাদ্দাফির কনিষ্ঠ পুত্র মুতাসিম এ সময়টাকেই পিতাকে নিয়ে ব্যূহ ভেঙে বেরিয়ে যাওয়ার এবং বাঁচার ক্ষণ হিসেবে বেছে নিলেন।
২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে গাদ্দাফির বিরোধীরা লিবিয়াজুড়ে সরব হওয়া শুরু করে। কিন্তু লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ সেই প্রতিবাদ শুনল না, উল্টো শোনাল সিংহের হুঙ্কার। পরিণাম—বিদ্রোহ। লিবিয়ার মরুসিংহ বিদ্রোহীদের তাড়িয়ে বেড়ালেন। কিন্তু মরুসিংহকে তাঁর সুরক্ষিত গুহা থেকে বের করে আনার ব্যবস্থা করল ন্যাটো। ভূমিতে বিদ্রোহীদের মর্টার আক্রমণ, আকাশ থেকে ন্যাটোর ড্রোন আর মিসাইল বর্ষণ; হার মানতে হলো গাদ্দাফিকে। দিনের শেষে দেখা গেল গাড়িবহর নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। গৃহযুদ্ধের ডামাডোলে জনশূন্য শহরের ভুতুড়ে বাড়ি থেকে বাড়িতে লুকিয়ে দিন কাটতে থাকল তাঁর। দুনিয়ার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। খাবার, পানি, এমনকি ওষুধ পর্যন্ত নেই। তাঁর খোঁজে চারদিক দাবড়ে বেড়াচ্ছে বিদ্রোহী মিলিশিয়ারা। আকাশে চক্কর দিচ্ছে ড্রোন। মার্কিন স্যাটেলাইটের সর্বদর্শী চোখ তাঁর জন্মস্থান লিবিয়ার ইঞ্চি ইঞ্চি মাটি তন্ন তন্ন করে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
মুয়াম্মার গাদ্দাফি ৪২ বছর ধরে ছিলেন লিবিয়ার পরম ক্ষমতাধর। বলা হয়, পরম ক্ষমতা চরম দুর্নীতিবাজ। এটা বলা হয় না, ক্ষমতার খুঁটিগুলো সরে গেলে পরম ক্ষমতাই চরম অসহায় হয়ে পড়ে। বিরাট বাহিনী, বিপুল শানশওকত, অজস্র বিমান আর ট্যাংক ছিল তাঁর। কিন্তু তাঁকে কিনা মরতে হলো প্রায় খালি হাতে পালাতে পালাতে ধরা পড়া অবস্থায়। বেআইনি হত্যা নিজে করেছেন, তাঁকেও হত্যা করা হয়েছে বেআইনিভাবে। যুদ্ধবন্দী হওয়া সত্ত্বেও হয়েছেন নৃশংস প্রতিহিংসার শিকার।
বিদ্রোহীদের হাতে ধরা পড়ার সেই কালো দিনের এক বছর পূর্তি হলো ২০ অক্টোবর। এর তিন দিন আগে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ‘ডেথ অব এ ডিক্টেটর: ব্লাডি ভেনেগান্স ইন সির্তে’ তথা ‘এক স্বৈরশাসকের মৃত্যু: সির্তে শহরে রক্তপিপাসু প্রতিহিংসা’ নামের প্রতিবেদন প্রকাশ করে। গাদ্দাফির মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রসঙ্গ থাকলেও মূলত মুয়াম্মার গাদ্দাফি ও তাঁর পরিবার এবং ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের হত্যার অমানবিকতার বিষয়টিই এই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এখানে ভয়ংকর সেই দিনের কথাই আপনাদের শোনাব।
ধুলার ঘূর্ণি থেকে মরুঝড়
২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গাদ্দাফিবিরোধী প্রথম বিক্ষোভ দেখা যায়। মাত্র অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই অসম্ভব দ্রুততার সঙ্গে বেনগাজি শহরে ঘাঁটি গেড়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এনটিসি প্রতিষ্ঠা করে। ১৭ মার্চ সরকারি বাহিনী বেনগাজি ঘিরে ফেললে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ লিবিয়ার ওপর ‘উড়ালনিষিদ্ধ’ সিদ্ধান্ত পাস করে। তারা একই সঙ্গে দখলদার বাহিনী পাঠানো ছাড়া বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষায় প্রয়োজনীয় যেকোনো ব্যবস্থা (সামরিকও অন্তর্ভুক্ত) নেওয়ার সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলে। এই সিদ্ধান্তের ফলেই চালু হয় ‘অপারেশন ইউনিফায়েড প্রটেক্টর’ সম্মিলিত রক্ষা অভিযান। বিমান উড়াল নিষিদ্ধ হওয়ায় বেনগাজি দখলে ব্যর্থ হয় সরকার। ফ্রান্স, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে পশ্চিমা কয়েকটি সরকার বিদ্রোহীদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দেয়। কাতার পরে স্বীকার করে, কয়েক হাজার কাতারি সৈন্যও গাদ্দাফির বিরুদ্ধে লড়াই করে।
বর্বরতার জবাবে বর্বরতা
বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ামাত্রই গাদ্দাফির অনুগত বাহিনীগুলো কঠোর হাতে দমনে নেমে পড়ে। ইতিহাস সাক্ষী, পরদেশি শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের চেয়ে কোনো অংশে কম নৃশংস হয় না স্বদেশিদের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধ। এই যুদ্ধে গাদ্দাফি ছিলেন একা এবং তাঁর বিরুদ্ধে ন্যাটোসহ আরবের যুক্তরাষ্ট্রপন্থী রাষ্ট্রগুলো। উভয় পক্ষই মরিয়া হয়ে সংক্ষিপ্ততম সময়ে জয়ের জন্য চরম নৃংশস পদ্ধতি অবলম্বন করে। সরকারি বাহিনী হাজারো লোককে আটক করে। তাদের অনেকে বন্দী অবস্থায় নিহত ও নির্যাতিত হয়। বেসামরিক এলাকায় মর্টার হামলা, বোমাবর্ষণ ও গ্র্যাড রকেট নিক্ষিপ্ত হয়। ত্রিপোলির পতনের ঠিক আগে আগেই কমপক্ষে ৪৫ জনকে হত্যা করে। ২০টির মতো গণধর্ষণের ঘটনাও জানা যায়। এসবই ছিল যুদ্ধের আইনের লঙ্ঘন। বিদ্রোহীরাও কাউকেই ছাড় দেয়নি। অজস্র বিচারবহির্ভূত হত্যা, বন্দী অবস্থায় নির্যাতন, ধর্ষণ, গাদ্দাফির অনুগত শহরে নির্বিচার হামলা চলে। সাব-সাহারান আফ্রিকার অভিবাসী শ্রমিকদের ওপরও লাগামছাড়া আক্রমণ হয়।
এইচআরসি গৃহযুদ্ধকালীন মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিবিড় বিবরণটি তুলে ধরে মিসরাতা শহরের ব্যাপারে। গাদ্দাফি বাহিনী প্রায় দুই মাস শহরটি অবরোধ করে ছিল। এ দুই মাসে নিয়মিতভাবে তারা শহরটিতে বোমাবর্ষণ করে গেছে। মিসরাতার বিদ্রোহীদের এ জন্য গাদ্দাফির প্রতি বিশেষ প্রতিহিংসা তৈরি হয়েছিল। আবার মিসরাতা দখলে রাখা বিদ্রোহীরা শহরটি ধরে রাখায় সাফল্যের পরপরই ৩০ হাজার মানুষকে ঘরবাড়িতে ফিরতে বাধা দেয়। এদের অনেককেই আটক করে নির্যাতন কিংবা হত্যা করা হয়। পরিণামে মিসরাতার এই বেয়াড়া বাহিনীর ঠিক মাঝখানে গিয়ে পড়েন গাদ্দাফি ও তাঁর গাড়িবহর। গাদ্দাফিকে মর্মান্তিক মৃত্যু ও অবমাননার জন্য মিসরাতার বিদ্রোহীদেরই দায়ী করা হয়।
জন্মশহরই ধ্বংসশহর
বেনগাজি ছাড়াও বিদ্রোহীদের বড় ঘাঁটি ছিল গাদ্দাফির আপন শহর মিসরাতা। রাজধানী ত্রিপোলি হাতছাড়া হওয়ার পর গাদ্দাফি তাঁর ঘনিষ্ঠজন এবং দুই ছেলেসহ পরিবারের লোকদের নিয়ে এ শহরের দিকেই পালিয়ে আসেন। ঠিক এভাবেই ইরাকের পতিত শাসক সাদ্দাম হোসেন বাগদাদ থেকে পালিয়ে জন্মস্থান তিকরিতে এসে আত্মগোপন করেন এবং ধরা পড়েন। এফবিআইয়ের জেরা থেকে সাদ্দামের শেষ দিনগুলো সম্পর্কে জানা গেলেও গাদ্দাফির সেই ভাগ্য বা দুর্ভাগ্য ঘটেনি। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের জন্যও গাদ্দাফির শেষ দিনগুলোর চিত্র হাজির করা তাই কঠিন ছিল। প্রথমত, তাঁর সঙ্গীদের বেশির ভাগই বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হন। ভাগ্যের জোরে বেঁচে যাওয়া গাদ্দাফির ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি পিপলস গার্ড বাহিনীর প্রধান মনসুর ধাও একজন সাক্ষী। গাদ্দাফির মৃত্যুর দুদিন পরে নিউইয়র্ক টাইমস ও এইচআরসি মিসরাতার এক জেলে তাঁকে পায় এবং বিস্তারিত সাক্ষাৎকার নেয়। তবে ঘটনাস্থলের আশপাশে থাকা অন্য জীবিত ব্যক্তিদের কাছ থেকেও ধাওয়ের বিবরণের সত্যতা নিশ্চিত করা হয়।
বিদ্রোহীদের হাতে ত্রিপোলির পতন হয় ২৮ আগস্ট। তখন কয়েকটি গাড়িবহরে বিভক্ত হয়ে গাদ্দাফি ঘনিষ্ঠজনদের নিয়ে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়েন। পরদিনই এ রকমই এক গাড়িবহরে থাকা অবস্থায় গাদ্দাফির পুত্র খামিস গাদ্দাফি, তিনি ছিলেন এলিট খামিস ব্রিগেডের অধিনায়ক—ন্যাটোর বিমান হামলায় নিহত হন। আরেক পুত্র সাইফ আল ইসলামের গাড়িবহরেও একইভাবে বিমান হামলা হলেও আহত অবস্থায় তিনি পালাতে পারেন। পরে লিবিয়ার দক্ষিণ সীমান্তে তিনি বিদ্রোহীদের হাতে ধরা পড়েন। তৃতীয় পুত্র মুতাসিম পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা রক্ষার দায়িত্বে সির্তে শহরেই অবস্থান করছিলেন।
গাদ্দাফির শেষযাত্রা
গাদ্দাফি সির্তের দিকেই রওনা হন। সেখানে তাঁর সঙ্গে মিলিত হন মনসুর ধাওসহ বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। সামরিক প্রতিরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত মুতাসিম বাবার সঙ্গে একত্রে না থাকলেও নিয়মিতভাবে এসে দেখা করতেন। গাদ্দাফির অবস্থান ছিল শহরের কেন্দ্রস্থলের একটি ভবনে। কিন্তু সেখানে নিয়মিতভাবে আক্রমণ ও বোমা হামলা হতে থাকায় অনবরত তাঁদের আশ্রয় বদলাতে হয় এই ভবন থেকে সেই ভবনে। এদিকে বিদ্রোহীদের ঘেরাও ক্রমে কাছে চলে আসছিল। এই বেপরোয়া পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়েছেন ধাও এভাবে:
‘বেশির ভাগ সময় গাদ্দাফি কোরআন পাঠ আর নামাজ পড়ে কাটাতেন। দুনিয়ার সঙ্গে তাঁর সব যোগাযোগ ছিল বিচ্ছিন্ন। খাবার নেই, পানি নেই, ওষুধ নেই। বিভিন্নজনকে ফোন করে আল-রাই, রাশিয়া টুডে, বিবিসি অথবা ফ্রান্স ২৪-এর সংবাদ শুনে নিতাম। কারোরই কোনো কাজ ছিল না। ঘুমাতাম আর জেগে থাকতাম।’
চার-পাঁচ দিন পরপর তাঁরা জায়গা বদলাতেন। ‘ফাঁকা জনহীন বাড়িতে থাকতাম। কোনো এলাকা ফাঁকা হয়ে গেলেই সেখানে গিয়ে আশ্রয় নিতাম। এক বা দুটি গাড়িতে করে দফায় দফায় লোক আনা-নেওয়া করা হতো। প্রায়ই আমাদের থাকার জায়গায় হামলা হতো।...গাদ্দাফি দিনকে দিন রগচটা হতে থাকলেন। মূলত বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারা তাঁকে ক্ষিপ্ত করে তুলত।’
অন্তিম সময়ে আত্মীয়-বন্ধু-পরিজন
সির্তে শহরের দ্বিতীয় অংশে সে সময় বেশ কিছু বেসামরিক মানুষও ছিল। অনেকে বাড়িঘর ছেড়ে যেতে চায়নি। অনেকে গাদ্দাফির প্রতি অনুগত। আহত অনেককেও হাসপাতাল থেকে সরিয়ে সেখানে রাখা হয়েছিল। অল্প কয়েকজন নারী ও শিশুও তাঁদের সঙ্গে ছিলেন। বাইরে তুমুল লড়াই চলছে। ভুতুড়ে ভবনগুলোয় লুকিয়ে প্রাণ বাঁচাতে চাওয়া মানুষগুলো তখনো জানে না, কী ঘটবে একটু পর। একটু পর গাদ্দাফি প্রায় সশস্ত্র গাড়িবহর নিয়ে বের হবেন নিয়তির রাজপথের শেষ মঞ্জিলের উদ্দেশে। সকালে আহত, নিহত ও জীবিত ব্যক্তিদের সংখ্যা গুনে জানা যাবে,
সেখানে ছিল আড়াই শ জন, যাদের এক শ জনই নিহত হবে।
২০ অক্টোবর রাত এল গোলাবর্ষণের মধ্যেই। মুতাসিম ভাবছেন, দলবল নিয়ে অবরোধ ভেঙে বেরিয়ে যাবেন ভোরের দিকে। ওদিকে বিদ্রোহী মিলিশিয়ারাও হামলার জন্য প্রস্তুত। ন্যাটোর স্যাটেলাইটও ইগলচক্ষু মেলে রেখেছে গাদ্দাফির অবস্থানের দিকে। ভূমধ্যসাগরের কিনারে তখন ওত পেতে আছে মার্কিন যুদ্ধজাহাজ। প্রস্তুত আছে ব্রিটিশ যুদ্ধবিমান টর্নেডো, মার্কিন ড্রোন প্রিডেটর এবং ফরাসি রাফালে জেট। গাদ্দাফির কনিষ্ঠ পুত্র মুতাসিম এ সময়টাকেই পিতাকে নিয়ে ব্যূহ ভেঙে বেরিয়ে যাওয়ার এবং বাঁচার ক্ষণ হিসেবে বেছে নিলেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন