বৃহস্পতিবার, ৫ জুলাই, ২০১২

যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার সনদ লঙ্ঘন করছে


বিশ্বজুড়ে মানবাধিকারের জোরালো সমর্থক হিসেবে যে ভূমিকা যুক্তরাষ্ট্র পালন করে এসেছে, তা দেশটি পরিত্যাগ করছে।
এই মর্মে তথ্য উদ্ঘাটিত হয়েছে যে, মার্কিন শীর্ষ কর্মকর্তারা বিদেশে লোকজনকে হত্যার জন্য টার্গেট করছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন মার্কিন নাগরিকও। আমাদের জাতির দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘন কতটা বিস্তৃত হয়েছে, তার সর্বসাম্প্রতিক ও উদ্বেগজনক প্রমাণ এটা। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসবাদী হামলার পর এই প্রবণতার সূচনা। (ডেমোক্র্যাটিক ও রিপাবলিকান) দুই দলেরই প্রশাসনিক ভূমিকা এবং কংগ্রেসের কার্যক্রমের মাধ্যমে এর অনুমোদন দিয়ে এটাকে বাড়িয়ে তোলা হয়েছে। আর সাধারণ জনগণও এ ব্যাপারে ভিন্ন মত প্রকাশ করেনি। এর ফল হলো, এ ধরনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আমাদের দেশ আর নৈতিক কর্তৃত্বের সাথে জোর দিয়ে কথা বলতে পারছে না।
যুক্তরাষ্ট্র অতীতে ভুল করেছে। তবে অবস্থার নাটকীয় অবনতি ঘটে গত দশকে মানবাধিকারের ব্যাপক লঙ্ঘনের মাধ্যমে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ১৯৪৮ সালে ‘মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা’ গৃহীত হয়েছিল। এটা ছিল ‘স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার ও শান্তির ভিত্তি’। এতে এ মর্মে সাহসী ও সুস্পষ্ট অঙ্গীকার ছিল যে, জনগণকে নির্যাতন-নিপীড়ন করার হাতিয়ার হিসেবে আর ক্ষমতা ব্যবহৃত হবে না। এই ঘোষণা সবার সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছিল জীবন, স্বাধীনতা, ব্যক্তির নিরাপত্তা, আইনি সুরক্ষা এবং নির্যাতন কিংবা স্বেচ্ছাচারীভাবে বন্দী করা অথবা বলপূর্বক নির্বাসন থেকে মুক্ত থাকার ক্ষেত্রে।
বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে একনায়কতন্ত্র হটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আইনের শাসন মজবুত রাখার জন্য মানবাধিকার সংগ্রামীরা ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় প্রেরণা পেয়েছেন এই ঘোষণা থেকে।
এটা উদ্বেগজনক যে, আমাদের (যুক্তরাষ্ট্র) সরকারের সন্ত্রাসবাদবিরোধী নীতিগুলো এসব মূলনীতি জোরদার না করে এখন মানবাধিকার সনদের ৩০টি ধারার অন্তত ১০টি সুস্পষ্টভাবেই লঙ্ঘন করছে। এর মধ্যে ‘নিষ্ঠুর অমানবিক অথবা অমর্যাদাকর আচরণ বা শাস্তি’র ওপর যে নিষেধাজ্ঞা, সে ধারাটিও রয়েছে।
কোনো ব্যক্তি সন্ত্রাসবাদী সংগঠন বা ‘সংশ্লিষ্ট বাহিনী’গুলোর সাথে জড়িত থাকার সন্দেহে তাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্দী রাখার অধিকার মার্কিন প্রেসিডেন্টকে দেয়া হয়েছে আইন করে। এই ব্যাপক ও অস্বচ্ছ ক্ষমতার অপব্যবহার হতে পারে যদি আদালত কিংবা কংগ্রেস কার্যকর নজরদারি না রাখে। অবশ্য একজন ফেডারেল জজ আইনটি বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধক দাঁড় করিয়েছেন। এই আইন মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার লঙ্ঘন করেছে। তদুপরি অপরাধীরূপে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত যেকোনো ব্যক্তি নির্দোষ বলে গণ্য হবেন, এই অধিকারেরও পরিপন্থী উপরিউক্ত আইন। এই দুই বিষয়ে দু’টি ধারা আছে মানবাধিকার ঘোষণায়।
মার্কিন নাগরিকেরা হত্যাকাণ্ড এবং অনির্দিষ্টকালীন অন্তরীণের টার্গেট হচ্ছেন। এর সাথে যোগ হলো সাম্প্রতিক কিছু আইন, যেগুলো বিদেশী গোয়েন্দা নজরদারি আইন, ১৯৭৮-এর নিবৃত্তিমূলক বিধানগুলো বাতিল করে দিয়েছে। এটা করা হয়েছে আমাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকারের নজিরবিহীন লঙ্ঘনের উদ্দেশ্যে। তা হবে, পরোয়ানা ছাড়াই ফোনে আড়ি পেতে এবং ইলেকট্রনিক যোগাযোগব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করে। এমন সব আইন বিদ্যমান, যেগুলো শুধু চেহারা, প্রার্থনার স্থান এবং কারো সাথে সংশ্লিষ্টতার কারণে বন্দী করার অনুমতি দেয়।
চালকবিহীন বিমান বা ড্রোনের হামলায় যে-ই নিহত হোক, তাকেই শত্রু সন্ত্রাসী ঘোষণা করার স্বেচ্ছাচারী বিধান রয়েছে। তদুপরি তার কাছে উপস্থিত থাকা নির্দোষ নারী-শিশুর মৃত্যুকে ধরে নেয়া হয়েছে ‘অনিবার্য’। আফগানিস্তানে এ বছর নিরস্ত্র মানুষের ঘরবাড়িতে ৩০ বারের বেশি বিমান হামলার পর প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই এটা বন্ধ করার দাবি জানালেন। কিন্তু পাকিস্তান, সোমালিয়া ও ইয়েমেনের বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের হামলা চলছেই। অথচ এসব স্থান ‘যুদ্ধ এলাকা’র অন্তর্ভুক্ত নয়। এসব হামলায় কত শত নিরীহ নির্দোষ বেসামরিক লোক মারা পড়েছে, আমরা জানি না। এর প্রতিটি হামলাই ওয়াশিংটনে সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত। অতীতে এটা চিন্তাও করা যেত না। এসব কিছু আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতিকে নিশ্চিতই ক্ষতিগ্রস্ত করছে। উচ্চপর্যায়ের গোয়েন্দা ও সেনাকর্মকর্তারা এবং মানবাধিকার সমর্থকেরা জোর দিয়ে বলেছেন, ড্রোন হামলা অনেক বেড়ে গেছে এবং এতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোর দিকে ঝুঁকছে। এ হামলা সাধারণ মানুষকে আমাদের বিরুদ্ধে ুব্ধ করে তুলেছে। নির্যাতক সরকারগুলো ড্রোন হামলার দোহাই দিয়ে নিজেদের স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ বৈধ করার প্রয়াস পাচ্ছে।
এ দিকে কিউবার গুয়ান্তানামো বের বন্দিশিবিরে এখনো ১৬৯ জন আছেন। তাদের অর্ধেকই মুক্তি লাভের অনুমতি পেয়েছেন। অথচ তাদের কোনো দিন মুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলা চলে। মার্কিন কর্তৃপক্ষ বলেছে, দোষ স্বীকার করার জন্য বিচারাধীন (তাও শুধু সামরিক আদালতে) কয়েকজনকে নির্যাতন করা হয়েছে। তাদের এক শ’ বারেরও বেশি পানিতে চুবিয়ে অথবা সেমিঅটোমেটিক অস্ত্র ও ড্রিল মেশিনের ভয় দেখিয়ে নতুবা তাদের মায়ের ওপর যৌন হামলার হুমকি দিয়ে এটা করা হয়েছে। বিস্ময়কর হলো, এসব সত্য ঘটনাকে অভিযুক্ত নিজের সমর্থনে ব্যবহার করার উপায় নেই। কারণ মার্কিন সরকার দাবি করছেÑ ‘জাতীয় নিরাপত্তা’র জন্যই এসব করা হয়েছে। অন্যান্য বন্দীর কখনো বিচার হওয়ার কিংবা তাদের ব্যাপারে চার্জশিট দেয়ারও সম্ভাবনা নেই।
যখন জনগণের বিপ্লব দুনিয়া কাঁপিয়ে দিচ্ছে, তখন যুক্তরাষ্ট্র আইনের মৌলিক বিধিবিধান এবং মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের মূলনীতিগুলো দুর্বল না করে শক্তিশালী করা উচিত। কিন্তু পৃথিবীকে নিরাপদ করার বদলে আমেরিকা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। এটা আমাদের শত্রুদের উসকে দিচ্ছে আর দূরে সরিয়ে দিচ্ছে বন্ধুদের।
উদ্বিগ্ন নাগরিক হিসেবে চলার পথ পাল্টে মানবাধিকারের মাপকাঠি মোতাবেক নৈতিক নেতৃত্ব ফিরে পেতে ওয়াশিংটনকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। মানবাধিকারের নীতিমালাকে আমরা নিজেদের বলে গ্রহণ করেছি সরকারিভাবেই। বছরের পর বছর আমরা এগুলোকে লালন করেছি।
দ্য নিউইয়র্ক টাইমস ২৪ জুন
লেখক : যুক্তরাষ্ট্রের ৩৯তম প্রেসিডন্ট। ২০০২ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী। কার্টার সেন্টার প্রতিষ্ঠাতা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন