মঙ্গলবার, ১৯ জুন, ২০১২

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের বক্তব্য নিয়ে সংসদে স্পিকারের রুলিং : বিচারপতি সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন


হাইকোর্টের বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী জাতীয় সংসদ এবং সংসদের স্পিকার সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করে সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। হাইকোর্ট বেঞ্চে বিচারপতির বক্তব্য সম্পর্কে গতকাল সংসদে দেয়া দীর্ঘ রুলিংয়ে স্পিকার আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেট এ কথা বলেন। স্পিকার বলেন, ‘২৯ মে সংসদে আমার বক্তব্যের প্রেক্ষিতে ৫ জুন হাইকোর্টের একজন মাননীয় বিচারপতি সংবিধানের ৭৮(১) অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করে সংসদ সম্পর্কে, আমার সম্পর্কে যেসব মন্তব্য করেছেন তা কোন বিবেকমান মানুষ উচ্চারণ করতে পারেন কিনা, আমার সন্দেহ আছে। প্রথমেই তিনি বলেছেন, আমার বক্তব্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। আমার কথাগুলোর কোনটি রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে পড়ে, তা আমার বোধগম্য নয়। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ উত্থাপনের আগে রাষ্ট্রদ্রোহিতা কী, কোন কাজ রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে পড়ে, রাষ্ট্রদ্রোহিতার বিষয়টি কে নির্ধারণ করতে পারেন—এসব বিষয় গভীরভাবে চিন্তা করলে বিজ্ঞ বিচারপতি বিজ্ঞতার পরিচয় দিতেন।’ স্পিকার আরও বলেন, আদালতের এ ধরনের আচরণে কী করণীয় থাকতে পারে, মাননীয় প্রধান বিচারপতি সে বিষয়টি ভেবে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন তাতে আমাদের সমর্থন থাকবে। এর ফলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা হয়তো সম্ভব হবে।’ গত ২৯ মে সড়ক ভবন ছেড়ে দেয়ার বিষয়ে হাইকোর্টের আদেশ নিয়ে সংসদে আলোচনা হয়। সেদিন স্পিকার এবং সংসদ সদস্যরা এ বিষয়ে তাদের মতামত দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৫ জুন হাইকোর্টের বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী সংসদ এবং স্পিকারকে উদ্দেশ করে কিছু মন্তব্য করেন।
গতকাল সংসদ অধিবেশনের শুরুতে প্রশ্নোত্তর পর্ব টেবিলে উত্থাপনের পরপরই স্পিকার রুলিংটি দেন। ২২ মিনিটের এ লিখিত রুলিং পাঠকালে স্পিকার বেশ কয়েকটি বাক্য জোর দিয়ে একাধিকার বার পাঠ করেন। এ সময় উপস্থিত সংসদ সদস্যরা বেশ কয়েকবার টেবিল চাপড়ে স্পিকারের প্রতি সমর্থন জানান। ‘সংসদের স্পিকারের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে সংসদের সব সদস্যের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে’ স্পিকারের এ বক্তব্যকালে উপস্থিত সদস্যরা ‘ইয়েস’ ‘ইয়েস’ বলে সমর্থন জানান। আবার কখনও ‘শেম’ ‘শেম’ বলে সংশ্লিষ্ট বিচারপতির প্রতি ধিক্কার জানান।
স্পিকারের এ রুলিংয়ের সময় প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা সংসদে অনুপস্থিত ছিলেন। তবে সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী এবং আইনমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী সংসদে উপস্থিত ছিলেন। এদিকে এ ইস্যুতে গত ২৯ মে এবং ৫ ও ৬ জুন সংসদে বক্তব্যদানকারী এমপিদের মধ্যে ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন, জাসদের মইন উদ্দিন খান বাদল, জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নু ও আওয়ামী লীগের শাহরিয়ার আলম থাকলেও আওয়ামী লীগের তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও শেখ ফজলুল করিম সেলিম সংসদে ছিলেন না।
উল্লেখ্য, গত ২৯ মে সড়ক ভবন নিয়ে কয়েকজন সদস্যের পয়েন্ট অব অর্ডারের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে এক পর্যায়ে স্পিকার বলেছিলেন, ‘সরকারও স্বৈরাচারী হয়ে গেলে জনগণ তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। তেমনি সংসদ যদি জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন করে, তবে এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যেতে পারে। এমনকি জনগণ কোর্টের রায়ের ওপরে ক্ষুব্ধ হলে বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে।’
রুলিংয়ে স্পিকার সংসদে সিনিয়র সদস্যরা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে ওই বিচারপতিকে অপসারণের যে দাবি জানিয়েছেন এবং এ বিষয়ে সংসদে প্রস্তাব গ্রহণ করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোর যে প্রস্তাব করেছেন তার প্রতি সমর্থন জানান। তিনি বলেন, ‘একজন বিচারকের অশোভন আচরণ রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে বিদ্যমান সুসম্পর্ককে ব্যাহত করতে পারে না। এ মহান সংসদের অভিভাবক হিসেবে বলতে চাই—আমরা ১৬ কোটি জনগণের প্রতিনিধিরা একজন ব্যক্তিবিশেষের আচরণ দিয়ে পুরো বিচার বিভাগকে মূল্যায়ন করতে পারি না।’ বিচারপতি বিজ্ঞতার পরিচয় দিতে সমর্থ হননি বলে উল্লেখ করেন স্পিকার। বিচারপতির মন্তব্যকে দুঃখজনক ও অনভিপ্রেত উল্লেখ করে রুলিংয়ে স্পিকার আবদুল হামিদ আরও বলেন, ‘আদালতের এ ধরনের আচরণে কী করণীয় থাকতে পারে মাননীয় প্রধান বিচারপতি সে বিষয়টি ভেবে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন তাতে আমাদের সমর্থন থাকবে। এর ফলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা হয়তো সম্ভব হবে।’ বিচারপতির মন্তব্যকে অসৌজন্যমূলক ও ব্যক্তিগত আক্রমণপ্রসূত উক্তি হিসেবে উল্লেখ করে স্পিকার বেশ জোরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিচারপতিকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে, বর্তমানে এ দেশ পাকিস্তান নয়, বাংলাদেশ। আবারও বলছি—বাংলাদেশ।’
উল্লেখ্য, ৫ জুন হাইকোর্টে বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী স্পিকারের সংসদে দেয়া বক্তব্যকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। এছাড়া স্পিকারের শিক্ষা ও আইনজীবী সনদ নিয়েও মন্তব্য করেন তিনি। পরে ৬ জুন জাতীয় সংসদ বিচারপতির ওই বক্তব্যকে ঘিরে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তিনদিনের মধ্যে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর অপসারণ করা না হলে সংসদে সংবিধান সংশোধন করে বিচারপতি অপসারণের বিধান পুনর্বহাল করবেন বলে হুশিয়ারি দিয়েছিলেন। সিনিয়র সদস্য তোফায়েল আহমেদ বিচারপতিকে ‘স্যাডিস্ট’ বলে অভিহিত করেন। জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নু বিচারপতি মানিককে ‘মানসিক বিকারগ্রস্ত’ বলে উল্লেখ করেন।
পরে সংসদে সভাপতির দায়িত্ব পালনকারী ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী জানান, স্পিকার বিষয়টি নিয়ে রুলিং দেবেন। কিন্তু ৮ জুন আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিচার বিভাগ সম্পর্কে মন্তব্য করতে সতর্কতা অবলম্বন করার জন্য দলীয় এমপিদের নির্দেশনা দেয়ার পর মূলত বিষয়টা নিয়ে মহাজোটের এমপিরা কিছুটা চুপসে যান। তারা অনেকটা হার্ডলাইন থেকে সরে আসেন। স্পিকার রুলিং দেবেন কি না এ নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা চলতে থাকে। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের মনোভাব অনুযায়ীই স্পিকার বিষয়টি সুরাহা করবেন—এমন কথাও শোনা যায়। স্পিকার আইন ও সংবিধান খতিয়ে দেখছেন এবং বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ করছেন এমন কথাও মহাজোটের অনেকে সংবাদমাধ্যমকে বলেন। এভাবে স্পিকারও তার রুলিং বিলম্বিত করতে থাকেন। এরই মধ্যে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর বিচারিক বেঞ্চ পরিবর্তন করা হয়। রিটের বেঞ্চ থেকে তাকে সরিয়ে দেয়া হয়। অন্যদিকে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে এক আইনজীবী সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করলে সেটি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য। সর্বশেষ ঘটনার ১২ দিন পর গতকাল স্পিকার তার বহুল প্রতীক্ষিত রুলিং দেন। গতকাল রুলিং দেয়ার পর স্পিকার তার বক্তব্যটি সম্ভব হলে পত্রিকায় হুবহু প্রকাশের অনুরোধ করেন। নিম্নে স্পিকারের রুলিং তুলে ধরা হলো:
“মাননীয় সদস্যবৃন্দ,
গত ২৯ মে ২০১২ তারিখ মহান এ সংসদে কয়েকজন মাননীয় সংসদ সদস্যের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে আমি কিছু কথা বলেছিলাম। আমার বক্তব্যের বিষয় ছিল মূলত সংসদ, আদালত ও নির্বাহী বিভাগের সাথে জনগণের সম্পর্ক এবং তাদের কল্যাণ সাধন। মাননীয় সংসদ সদস্যদের বক্তব্যের প্রেক্ষিতেই তাত্ক্ষণিকভাবে কিছু সাধারণ মন্তব্য করা হয়েছিল। পরবর্তীতে গত ৫ জুন ২০১২ তারিখে ইন্টারনেট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এ মর্মে সংবাদ পরিবেশিত হয় যে, হাইকোর্ট বেঞ্চের একজন মাননীয় বিচারপতি আমার বক্তব্যকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল বলে মন্তব্য করেছেন এবং আমার ও জাতীয় সংসদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ ও অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্য করেছেন। ওইদিনই সংসদ চলাকালীন সময়ে আপনাদের মধ্যে সিনিয়র কয়েকজন মাননীয় সদস্য Point of Order-এ এ বিষয়ে সংসদের সার্বভৌমত্ব রক্ষাকল্পে উক্ত মাননীয় বিচারপতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এমনকি সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনপূর্বক অপসারণের দাবি জানিয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন। উপস্থিত সকল মাননীয় সদস্য উক্ত বক্তব্য সমর্থন করেন যা গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে। ওইদিন স্পিকারের দায়িত্ব পালনরত মাননীয় ডেপুটি স্পিকার এ বিষয়ে আমার সাথে আলোচনা করে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে আপনাদের জানিয়েছিলেন। স্পিকার তথা সংসদকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্যের প্রেক্ষিতে সংবিধানের ৭৮(১) অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন না করা, সংসদের সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং সংসদকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখার জন্য সেদিন আপনারা এ বিষয়ে তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন এবং বিভিন্ন দাবি উত্থাপন করেছিলেন। বস্তুত সেই মুহূর্তে সেটাই স্বাভাবিক ছিল। আপনাদের এ সেন্টিমেন্টকে আমি শ্রদ্ধা করি, আপনাদের প্রতি জানাই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।
মাননীয় সদস্যবৃন্দ,
এটা প্রণিধানযোগ্য যে, রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক ও সমন্বয়, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, যথাযথ Check & balance গড়ে তোলার জন্য পৃথিবীর অনেক দেশ শত শত বছর নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছে। কারণ আমরা সবাই অবগত যে, Democracy is not a system only, it is a culture too. আমরাও এই মহান সংসদে সেই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি অর্জনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
আর তাই কিছুদিন আগে আমাদের দেশের একজন অধ্যাপক, বরেণ্য শিক্ষাবিদ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বিষয়ে সংসদে কিছু আলোচনা হয়েছিল। যখনই সংসদের কাছে তাঁর বক্তব্য সম্পর্কিত সঠিক ব্যাখ্যা গোচরীভূত হয়, তখনই সংসদ এ ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করেছে। অপ্রয়োজনীয় অংশ এক্সপাঞ্জ করেছে। আমাদের প্রত্যাশা ছিল, মাননীয় বিচারপতি সমস্ত বিষয়টি হৃদয়ঙ্গম করবেন এবং মাত্রা অতিক্রমকারী বক্তব্য পরিহারে যথাযথ পদক্ষেপ নেবেন। কিন্তু তিনি তা করেননি।
মাননীয় সদস্যবৃন্দ,
আমার বক্তব্যকে কেন্দ্র করে মহামান্য হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতি যে বিষয়গুলোর অবতারণা করেছেন এবং পরবর্তীতে এ নিয়ে যে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে, তা সত্যিই দুঃখজনক এবং অনভিপ্রেত। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম, এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দেব না বা মন্তব্য করব না। সবাই স্বীয় বিবেচনায় বিষয়টি অনুধাবন করবেন। কিন্তু পরে দেখলাম, এটির সাথে আমার এবং মহান সংসদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। আমার অবস্থান স্পষ্ট না করলে মহান সংসদ এবং আমার সম্পর্কে অনেকেরই ভুল ধারণা থেকে যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তি মনে পড়ছে। তিনি বলেছেন, “যেটা নিয়ে অন্যের সঙ্গে ব্যবহার চলছে, যার প্রয়োজন এবং মূল্য সত্যভাবে স্থির হওয়া উচিত, সেটা নিয়ে কোন যাচনদার যদি এমন কিছু বলেন যা আমার মতে সংগত নয়, তবে চুপ করে গেলে নিতান্ত অবিনয় হবে।’’ শেষে ঠিক করেছি, এ বিষয়ে আমি আমার বক্তব্য স্পষ্ট করব।
সেদিন অর্থাত্ ২৯ মে ২০১২ তারিখে মাননীয় সংসদ সদস্য জনাব শাহরিয়ার আলম সংসদে সড়ক বিভাগের অফিস অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার জন্য সময় বৃদ্ধির বিষয়টি মাননীয় আইনমন্ত্রীর নজরে আনার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। আমি বলেছিলাম, মাননীয় আইনমন্ত্রী নেই, থাকলে হয়তো তিনি ব্যাপারটি দেখতেন। এরপর আমি যে কথাগুলো বলেছি, তার সারমর্ম হচ্ছে—মহামান্য আদালতের প্রতি আমাদের সবার শ্রদ্ধা আছে। আদালত সম্পূর্ণ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ। সড়ক ভবনের বিষয়টি একটি স্পর্শকাতর বিষয়। রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ—আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগ একে অপরের পরিপূরক। এগুলো একটি আরেকটিকে সহযোগিতার জন্য রয়েছে। হঠাত্ এ ভবনকে সরিয়ে নিলে এর কার্যক্রম paralised হয়ে যাবে, যা সরকারকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
এ বিষয়গুলো যেন মহামান্য আদালত বিচার বিবেচনা করেন, সে অনুরোধটুকু সেদিন করেছিলাম। প্রয়োজনে এ বিষয়ে সরকারের সাথে বিচার বিভাগের আলোচনার মাধ্যমে তা সুরাহা হলে সুন্দর হয় বলেও উল্লেখ করেছিলাম। শেষে রাষ্ট্রের সকল অঙ্গের মধ্যে সহযোগিতার মনোভাব রাখার কথা বলে এ পর্যায়ে আমার বক্তব্য শেষ করি।
মাননীয় সদস্যবৃন্দ,
ওইদিন পরবর্তীতে মাননীয় সংসদ সদস্য জনাব মইন উদ্দীন খান বাদল আদালত সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বক্তব্য রাখলে আমি হাস্যচ্ছলে বলেছি, আমার স্পিকারশিপের মেয়াদ শেষ হলে আমাকে আবার কালো কোট পরে কোর্টে যেতে হবে। সুতরাং হিসাব করে কথা বলতে হয়। আবার কোনো সমস্যায় না পড়ে যাই। মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে রিলিফ নাও পেতে পারি। এরপর গণমানুষের কাছে সবার জবাবদিহিতার বিষয়টি তুলে ধরতে গিয়ে বলেছিলাম, সংসদে সংসদ সদস্যরা যে আইনগুলো পাশ করেন সেগুলো যদি জনগণের বিরুদ্ধে যায়, তাহলে শেষ পর্যন্ত জনগণ আমাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে। কোর্টের বিচারে যদি দেশের মানুষ ক্ষুব্ধ হয়, তাহলে বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে মানুষ একদিন হয়তো রুখে দাঁড়াতে পারে। একইভাবে যদি কোনো সরকার স্বৈরাচারী আচরণ করে সে ক্ষেত্রে জনগণের রুখে দাঁড়ানোর ইতিহাস আছে। সবাইকে চিন্তা-ভাবনা করে চলা প্রয়োজন। আত্মঅহমিকা বিসর্জন দিয়ে দেশ ও মানুষের কল্যাণে কাজ করার কথা বলেছি। কোনো আদালত বা কোনো মামলা বা কোনো বিচারপতিকে উদ্দেশ করে কোনো কথা বলা হয়নি। মূলত রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের কাজে কোনো ব্যত্যয় ঘটলে কী হতে পারে, তারই একটা ধারণার কথা বলেছি।
২৯ মে ২০১২ তারিখে সংসদে আমার বক্তব্যের প্রেক্ষিতে ৫ জুন ২০১২ তারিখে হাইকোর্টের একজন মাননীয় বিচারপতি সংবিধানের ৭৮(১) অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করে সংসদ সম্পর্কে, আমার সম্পর্কে যেসব মন্তব্য করেছেন তা কোনো বিবেকবান মানুষ উচ্চারণ করতে পারেন কিনা আমার সন্দেহ রয়েছে। প্রথমেই তিনি বলেছেন, আমার বক্তব্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। আমার উপরোক্ত কথাগুলোর কোনটি রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে পড়ে তা আমার বোধগম্য নয়। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ উত্থাপনের আগে রাষ্ট্রদ্রোহিতা কী, কোন কাজ রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে পড়ে, রাষ্ট্রদ্রোহিতার বিষয়টি কে নির্ধারণ করতে পারেন—এসব বিষয় গভীরভাবে চিন্তা করলে বিজ্ঞ বিচারপতি তাঁর বিজ্ঞতার পরিচয় দিতেন।
মাননীয় সদস্যবৃন্দ,
পত্রিকার মাধ্যমে জেনেছি, ওইদিন আদালতের বিচারক বলেছেন— “আদালত স্বাধীনভাবে কাজ করছে। বিচার বিভাগের কাজে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের কোনো চাপ নেই। অথচ স্পিকার সংসদে বলেছেন, আইনমন্ত্রী উপস্থিত থাকলে সড়ক ভবনের সম্পত্তির বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে তাঁকে বলা যেত। তাহলে কি স্পিকার মনে করেন আইনমন্ত্রীর নির্দেশে বিচার বিভাগ চলে?” বিজ্ঞ বিচারপতি আমার বক্তব্য ভালোভাবে না শুনে না পড়ে যে মন্তব্য করেছেন, তাতে তিনি তাঁর বিজ্ঞতার পরিচয় দিতে সমর্থ হননি মর্মে অনুমিত হয়। আসলে ওইদিন মাননীয় সংসদ সদস্য স্পিকারের মাধ্যমে মাননীয় আইনমন্ত্রীর কাছে সড়ক ভবন সরিয়ে নেয়ার জন্য সময় প্রদানের বিষয়টি উত্থাপন করতে চেয়েছিলেন। মাননীয় আইনমন্ত্রী তখন সংসদে উপস্থিত না থাকায় আমি বিষয়টি সংসদকে অবহিত করি এবং বলি ‘থাকলে হয়তো তিনি ব্যাপারটা দেখতেন’। এটুকুই বলেছি। এখানে আইনমন্ত্রীকে সড়ক ভবনের বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বলেছি— এ ধরনের কোনো কথা বলিনি।
আমার জ্ঞান, মেধা, যোগ্যতা ও আইনজীবী হিসেবে আমার সনদ নিয়ে কটাক্ষ করা হয়েছে। আমি প্রায়ই বলি, আমি কম লেখাপড়া জানা মানুষ। ষাটের দশকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে, তাঁর সান্নিধ্যে এসে ছাত্র অবস্থায় এদেশের মানুষের স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েছিলাম। রাজনীতির পাশাপাশি আইনজীবী হিসেবে দীর্ঘ ৩৭ বছর কাজ করেছি। সুপ্রিম কোর্ট বার-এর সদস্য হিসেবে হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করেছি। সাবেক মাননীয় প্রধান বিচারপতি জনাব এম এম রুহুল আমিন, জনাব এবিএম খায়রুল হক ও বর্তমান মাননীয় প্রধান বিচারপতির আদালতে আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। বড় বড় বই হয়তো পড়িনি কিন্তু সাধারণ মানুষের মনের কথাটি বিগত ৫৪ বছর ধরে পড়ে আসছি। অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষের কাছ থেকেও আমি সারাজীবন অনেক কিছু শিখেছি। তাঁদের মনের কথাটি পড়তে পারি বলেই হয়তো তাঁদের মনে ঠাঁই পেয়েছি। জনগণ আমাকে সত্তরের নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত করেছিলেন। গণমানুষের কল্যাণে জনগণের নেয়া নির্বাচনী পরীক্ষায় বারবার উত্তীর্ণ হয়ে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছি।
দ্বিতীয়বার স্পিকার হিসেবে কাজ করার দায়িত্ব পেয়েছি। তবে স্পিকার হিসেবে আমি একক কোনো সত্তা নই। এ সংসদের অনেক সদস্য আছেন যাঁরা লেখাপড়ায় উচ্চশিক্ষিত, জ্ঞানগরিমায় আমার চেয়ে অনেক সমৃদ্ধ। তারপরও সরকারি দল, বিরোধী দল ও অন্যান্য দল আমাকে সর্বসম্মতিক্রমে স্পিকার নির্বাচিত করেছেন। আমার জ্ঞান, যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তা সংসদের সকল মাননীয় সদস্যের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এ ধরনের উক্তি করার আগে বিজ্ঞ বিচারক আরও গভীরভাবে চিন্তা করলে ভালো করতেন। বিজ্ঞ বিচারক আরও অনেক বিষয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছেন যা আমি এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি না।
মাননীয় সদস্যবৃন্দ,
আদালতের মাননীয় বিচারকের মন্তব্যের সূত্র ধরে অনেকেই, বিশেষ করে পত্রপত্রিকাগুলো একে সংসদের সাথে বিচার বিভাগকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে মর্মে উল্লেখ করেছেন। সংসদ ও বিচার বিভাগের মধ্যে আসলে এটি কোনো বৈরিতা নয়। এটি সংসদ সম্পর্কে জনৈক মাননীয় বিচারপতির কিছু অসৌজন্যমূলক মন্তব্য এবং ব্যক্তিগত আক্রমণ-প্রসূত উক্তি। পুরো বিচার বিভাগকে এর সাথে জড়ানো ঠিক হবে না। আমাদের সকলকে মনে রাখতে হবে, বর্তমানে এ দেশ পাকিস্তান নয়— বাংলাদেশ। আবারও বলছি— বাংলাদেশ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে রয়েছে ৪০ বছর ধরে গড়ে ওঠা গভীর সম্প্রীতি ও আস্থার সম্পর্ক। পারস্পরিক এ সুসম্পর্কের কারণেই অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এ দেশটি আজ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি একজন সংসদ সদস্য হিসেবে এবং স্পিকার হিসেবে সবসময় বিশ্বাস করি রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ—আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগ একে অপরের পরিপূরক এবং প্রত্যেকে নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বাধীন। এক্ষেত্রে কর্ম-পদ্ধতি ভিন্ন হতে পারে কিন্তু লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এক এবং তা হলো সর্বাবস্থায় জনগণের কল্যাণ সাধন। দেশ ও জাতির কল্যাণে এ সম্পর্ক আরও অটুট হোক—এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা।
মাননীয় সদস্যবৃন্দ,
গত ৫ জুন ২০১২ তারিখে মাননীয় সংসদ সদস্যরা তাদের ক্ষোভ প্রকাশের একপর্যায়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনপূর্বক উক্ত মাননীয় বিচারপতিকে অপসারণের দাবি জানিয়েছিলেন এবং এ বিষয়ে একটি রেজ্যুলুশন গ্রহণ করে মহামান্য রাষ্ট্রপতি বরাবর প্রেরণের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। আপনাদের প্রস্তাবকে আমি সমর্থন করে বিনীতভাবে বলতে চাই—একজন বিচারকের অশোভন আচরণ রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে বিদ্যমান সুসম্পর্ককে ব্যাহত করতে পারে না। এ মহান সংসদের অভিভাবক হিসেবে আরও বলতে চাই, আমরা ষোল কোটি জনগণের প্রতিনিধিরা একজন ব্যক্তিবিশেষের আচরণ দিয়ে পুরো বিচার বিভাগকে মূল্যায়ন করতে পারি না। আপনারা সবাই সিদ্ধান্ত নিলে আমার জন্য তা নরহফরহমং হয়ে যায়। সার্বিক বিবেচনায় যেহেতু এ ধরনের কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ সমীচীন হবে বলে আমি মনে করি না, তাই আমি বিনীতভাবে অনুরোধ করব—সংসদে আপনাদের উত্থাপিত প্রস্তাবটি আপনারা আমার সাথে একমত হয়ে প্রত্যাহার করবেন।
আমি আশা করব, মাননীয় বিচারপতির সংসদ সম্পর্কিত মন্তব্যের বিষয়ে মাননীয় সংসদ সদস্যবৃন্দ, বিচার বিভাগের মাননীয় বিচারক ও বিজ্ঞ আইনজীবীবৃন্দ, নির্বাহী বিভাগের সম্মানিত সদস্যবৃন্দ, সুশীল সমাজের সম্মানিত প্রতিনিধিগণ, সম্মানিত বুদ্ধিজীবী, সম্মানিত সাংবাদিকসহ সব পেশার মানুষ, সর্বোপরি আমার পরম শ্রদ্ধেয় ও প্রিয় দেশের আপামর জনসাধারণ স্বীয় বিবেচনায় মূল্যায়ন করবেন। একই সাথে বলব, আদালতের এ ধরনের আচরণে কী করণীয় থাকতে পারে, মাননীয় প্রধান বিচারপতি সে বিষয়টি ভেবে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন তাতে আমাদের সমর্থন থাকবে। এর ফলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা হয়তো সম্ভব হবে।
মাননীয় সদস্যবৃন্দ,
রাষ্ট্রের ভিত্তি সংবিধান। সংবিধানের মূল স্তম্ভ সংসদ। এই সংসদই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করেন। রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ দেন। এই পদ্ধতিতেই জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। সংবিধান আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে। আমরা সবাই নিজ নিজ অবস্থানে থেকে সংবিধানকে সমুন্নত রাখব—দেশবাসী এটাই প্রত্যাশা করে।
আশা করি, আমার এ বক্তব্য প্রদানের মধ্য দিয়ে এ আলোচনার অবসান হবে। আপনাদের সকলকে অশেষ ধন্যবাদ।”

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন