রবিবার, ১৭ জুন, ২০১২

'কালা' ঘৃণা থেকে টাইম বোমা শঙ্কায় বাংলাদেশ


বাংলাদেশ ইতিপূর্বে দু'বার রোহিঙ্গাদের বিপদের সময় স্বাগত জানিয়েছে এবং তার অভিজ্ঞতা খুবই তিক্ত। সেটা বিবেচনায় রেখেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন, নতুন করে কোনো শরণার্থীকে স্বাগত জানানো হবে না। এ সমস্যা মানবিক_ তাতে সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের জনগণ ১৯৭১ সালে এ ধরনের পরিস্থিতির শিকার হয়েছিল। ভারতে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি আশ্রয় নিয়েছিল এবং মাসের পর মাস সেখানে অবস্থান করে। আমাদের পূর্ণ সহানুভূতি রয়েছে অত্যাচারিত রোহিঙ্গাদের প্রতি। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে, সমস্যা আমাদের নয়, বরং মিয়ানমারের এবং
তাদেরই এর সমাধান
করতে হবে

রোহিঙ্গা ইস্যু ফের আলোচনায়। বর্তমান মিয়ানমারের রোহিং (আরাকানের পুরনো নাম) এলাকায় এ জনগোষ্ঠীর বসবাস। রোহিঙ্গা কারা? ইতিহাস ও ভূগোল বলছে, রাখাইন প্রদেশের উত্তর অংশে বাঙালি, পার্সিয়ান, তুর্কি, মোগল, আরবীয় ও পাঠানরা বঙ্গোপসাগরের উপকূল বরাবর বসতি স্থাপন করেছে। তাদের কথ্য ভাষায় চট্টগ্রামের স্থানীয় উচ্চারণের প্রভাব রয়েছে। উর্দু, হিন্দি, আরবি শব্দও রয়েছে।
রাখাইনে দুটি সম্প্রদায়ের বসবাস_ মগ ও রোহিঙ্গা। মগের মুল্লুক কথাটি বাংলাদেশে পরিচিত। দস্যুবৃত্তির কারণেই এমন নাম হয়েছে তাদের। এক সময় তাদের দৌরাত্ম্য ঢাকা পর্যন্ত পেঁৗছেছিল। মোগলরা তাদের তাড়া করে জঙ্গলে ফেরত পাঠায়।
রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে একটি প্রচলিত গল্প রয়েছে এভাবে_ সপ্তদশ শতাব্দীতে বঙ্গোপসাগরে ডুবে যাওয়া একটি জাহাজ থেকে বেঁচে যাওয়া লোকজন উপকূলে আশ্রয় নিয়ে বলেন, আল্লাহর রহমে বেঁচে গেছি। এই রহম থেকেই এসেছে রোহিঙ্গা। তবে এটা নিছকই কাহিনী। ইতিহাস এ ধরনের কোনো সাক্ষ্য দেয় না।
তবে ইতিহাস এটা জানায় যে, ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত ২২ হাজার বর্গমাইল আয়তনের রোহিঙ্গা স্বাধীন রাজ্য ছিল। মিয়ানমারের রাজা বোদাওফায়া এ রাজ্য দখল করার পর বৌদ্ধ আধিপত্য শুরু হয়।
এক সময়ে ব্রিটিশদের দখলে আসে এ ভূখণ্ড। তখন বড় ধরনের ভুল করে তারা এবং এটা ইচ্ছাকৃত কিনা, সে প্রশ্ন জ্বলন্ত। আমাদের 'প্রাক্তন প্রভুরা' মিয়ানমারের ১৩৯টি জাতিগোষ্ঠীর তালিকা প্রস্তুত করে। কিন্তু তার মধ্যে রোহিঙ্গাদের নাম অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এ ধরনের কত যে গোলমাল করে গেছে ব্রিটিশরা!
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি মিয়ানমার স্বাধীনতা অর্জন করে এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু হয়। সে সময়ে পার্লামেন্টে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। এ জনগোষ্ঠীর কয়েকজন পদস্থ সরকারি দায়িত্বও পালন করেন। কিন্তু ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলে মিয়ানমারের যাত্রাপথ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে শুরু করে। রোহিঙ্গাদের জন্য শুরু হয় দুর্ভোগের নতুন অধ্যায়। সামরিক জান্তা তাদের বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করে। তাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। ধর্মীয়ভাবেও অত্যাচার করা হতে থাকে। নামাজ আদায়ে বাধা দেওয়া হয়। হত্যা-ধর্ষণ হয়ে পড়ে নিয়মিত ঘটনা। সম্পত্তি জোর করে কেড়ে নেওয়া হয়। বাধ্যতামূলক শ্রমে নিয়োজিত করা হতে থাকে। তাদের শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ নেই। বিয়ে করার অনুমতি নেই। সন্তান হলে নিবন্ধন নেই। জাতিগত পরিচয় প্রকাশ করতে দেওয়া হয় না। সংখ্যা যাতে না বাড়ে, সে জন্য আরোপিত হয় একের পর এক বিধিনিষেধ। এ যেন এক স্লো-জেনোসাইড।
রোহিঙ্গাদের এটাই জীবন। সত্তরের দশকের শুরুতে তাদের সমস্যা জাতিসংঘে তোলা হয়। কিন্তু প্রতিকার মেলেনি। মাঝে মধ্যেই তাদের বাংলাদেশে জোরপূর্বক পাঠানোর চেষ্টা চলত। স্বাধীনতার পরপরই আমি কক্সবাজারে এসডিও হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। সমুদ্রসৈকতে একটি ছোট্ট দলকে ঘুরতে দেখে জিজ্ঞেস করে জানতে পারি, এরা রোহিঙ্গা।
মিয়ানমারের মূল ভূখণ্ডের অনেকের কাছেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী 'কালা' নামে পরিচিত। বাঙালিদেরও তারা 'কালা' বলে। ভারতীয়দেরও একই পরিচিতি। এ পরিচয়ে প্রকাশ পায় সীমাহীন ঘৃণা।
১৯৭৮ সালে জাতিগত নিপীড়ন চরমে উঠলে বাংলাদেশে তাদের প্রবেশের সুযোগ করে দেওয়া হয়। রাতারাতি একের পর এক শিবির গড়ে উঠতে থাকে। জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশন এ প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়ে। মিয়ানমারের সামরিক সরকার তাদের ফেরত নিতে গড়িমসি করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অনেকে ফেরত যায়। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে নতুন করে রোহিঙ্গা শরণার্থী আসা শুরু হয়। ঘটনাক্রমে উভয় সময়েই ক্ষমতায় ছিল বিএনপি_ প্রথমবার জিয়াউর রহমান এবং দ্বিতীয়বার বেগম খালেদা জিয়া। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ ভূখণ্ডে স্থায়ীভাবে ঠাঁই দেওয়া হবে_ এটা কেউ ভাবেনি। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় উদ্যোগে উল্লেখযোগ্য সংখ্যককে ফেরত পাঠানো হলেও বাংলাদেশে থেকে যাওয়া রোহিঙ্গাদের সংখ্যা অফিসিয়ালি '২৮ হাজার'। কিন্তু প্রকৃত সংখ্যা তিন থেকে পাঁচ লাখের মধ্যে বলে সংশ্লিষ্টদের র্অিভমত। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেও এমন একটি সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে বসবাস করছে তাদের একটি অংশ সম্পর্কে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। কেউ কেউ অসাধুতার আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ও মালয়েশিয়ায় চাকরি নিয়ে গেছে এবং সেখানে তাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের দায় নিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।
মিয়ানমারে সংস্কারপন্থিরা ক্ষমতায়। তারা গণতন্ত্রের পথে চলতে সংকল্প ব্যক্ত করেছে। অং সাং সু চি এখন মুক্তজীবনে এবং পার্লামেন্টে তার নির্বাচন নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়েছে। ঠিক এ সময়ে কেন রোহিঙ্গাদের ওপর নতুন করে অত্যাচার শুরু হলো? এটা ধরে নেওয়া যায় যে, সামরিক বাহিনী এখনও যথেষ্ট শক্তিশালী এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া তাদের সবার পছন্দ নয়। অং সান সু চি থাইল্যান্ড সফরকালে এক সমাবেশে তার দেশের গণতন্ত্রের পথে চলা নিয়ে খুব বেশি আশাবাদ পোষণ বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন। তার এ মন্তব্য জান্তা ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। রোহিঙ্গা সমস্যা অং সান সু চির জন্য অগি্নপরীক্ষা বলা যায়। তিনি যদি রোহিঙ্গাদের পক্ষ গ্রহণ করেন, তাহলে সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারেন। অন্যদিকে যদি রোহিঙ্গাদের পাশে না থাকেন, তাদের মানবাধিকার নিষ্ঠুরভাবে লঙ্ঘিত হওয়ার পরও সোচ্চার না হন, তাহলে বিশ্ব সম্প্রদায়ে যে উদার ও গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত রয়েছে; সেটা দারুণভাবে ক্ষুণ্ন হবে। এমনও ধারণা করা হয় যে, সামরিক বাহিনীর কেউ কেউ রাজনৈতিক খেলা খেলছে, যার মূল লক্ষ্য অং সান সু চিকে কোণঠাসা করে ফেলা। তিনি এখন ইউরোপ সফরে রয়েছেন। লক্ষণীয়, তিনি বা তার দল এ গুরুতর সমস্যার ব্যাপারে এখনও অবস্থান ব্যক্ত করেননি।
বাংলাদেশ ইতিপূর্বে দু'বার রোহিঙ্গাদের বিপদের সময় স্বাগত জানিয়েছে এবং তার অভিজ্ঞতা খুবই তিক্ত। সেটা বিবেচনায় রেখেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন, নতুন করে কোনো শরণার্থীকে স্বাগত জানানো হবে না। কেউ বাংলাদেশে প্রবেশ করতে চাইলে তাকে অবশ্যই বাংলাদেশে প্রবেশের আগে সীমান্তের অপর পারেই থামিয়ে দিতে হবে। এ সমস্যা মানবিক_ তাতে সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের জনগণ ১৯৭১ সালে এ ধরনের পরিস্থিতির শিকার হয়েছিল। ভারতে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি আশ্রয় নিয়েছিল এবং মাসের পর মাস সেখানে অবস্থান করে। আমাদের পূর্ণ সহানুভূতি রয়েছে অত্যাচারিত রোহিঙ্গাদের প্রতি। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে যে, সমস্যা আমাদের নয়, বরং মিয়ানমারের এবং তাদেরই এর সমাধান করতে হবে। অন্য কোনো দেশের রাজনৈতিক এজেন্ডার দায়ভার আমরা বহন করতে পারি না। সরকার যথার্থ অবস্থান নিয়েছে এবং তার প্রতি সব রাজনৈতিক দল ও সামাজিক শক্তির সমর্থন থাকা চাই। একই সঙ্গে সরকারকে সক্রিয় কূটনীতিও শুরু করতে হবে। সমস্যা নিয়ে দ্রুত মিয়ানমারের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করা চাই। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। সমুদ্র সীমানা নিয়ে যে বিরোধ ছিল, তার নিষ্পত্তি হয়েছে এবং উভয় পক্ষ আন্তর্জাতিক আদালতের রায়কে স্বাগত জানিয়েছে। শান্তি বিঘি্নত হয়_ এমন কোনো কিছুই এখন কাম্য হতে পারে না। আমরা সম্পর্কের নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করতে চাই। এ পথে কেউ যেন বাগড়া লাগাতে না পারে, সে বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা থাকতে হবে।
বাংলাদেশের সেনা এবং অন্যান্য বাহিনী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শান্তি রক্ষায় সফলতা দেখিয়ে চলেছে। এ জন্য কেবল সশস্ত্র শক্তি প্রদর্শন নয়, কূটনৈতিক কার্যক্রমেরও প্রয়োজন পড়ে। অন্যদের জন্য আমরা যে কাজ সফলতার সঙ্গে করছি, নিজেদের প্রয়োজনে সেটা কেন করতে পারব না? এ উদ্যোগে ভারত, চীন ও অন্যান্য দেশ এবং জাতিসংঘকে সংশ্লিষ্ট রাখতে হবে। তবে জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনের অবস্থানের সঙ্গে আমাদের কোনোভাবেই সহমত হওয়ার অবকাশ নেই। তারা মনে হয় একটি 'কাজ' পেয়েছে এবং এ নিয়ে কিছুদিন কাটাতে চায়। কিন্তু এর বোঝা বাংলাদেশের দুর্বল অর্থনীতির ওপর যে কত বড় হতে পারে_ সেটা তাদের বুঝতে হবে। একই সঙ্গে শরণার্থীদের উপস্থিতির কারণে যে সামাজিক সমস্যার মুখোমুখি আমরা ইতিমধ্যে হয়েছি তার তিক্ত অভিজ্ঞতাও মনে রাখতে হবে। প্রকৃতই পরিস্থিতি টাইম বোমার মতো হয়ে আছে। সম্মিলিত চেষ্টায় তা নিষ্ক্রিয় করা সম্ভব। তবে প্রধান দায় অবশ্যই মিয়ানমার সরকারের। রোহিঙ্গাদের অধিকার অবশ্যই মেনে নিতে হবে এবং তাদের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাও পূরণ করতে হবে।
বাংলাদেশ অনেক সম্ভাবনার_ সেটা বিশ্ববাসীই বলছে। আমরা এগিয়ে চলতে দৃঢ়পণ। দেশের আয়তনের প্রায় সমান একটি সমুদ্র অঞ্চল আমাদের অধিকারে এসেছে। উন্নত হওয়ার জন্য আমরা সবার সহযোগিতা চাই, বন্ধুত্ব চাই। মিয়ানমারকেও পাশে চাই। গণতন্ত্রের পথচলায় সংকল্পবদ্ধ মিয়ানমারের শাসকদের জন্যও এটা কিন্তু বড় চ্যালেঞ্জ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন