রবিবার, ৩ জুন, ২০১২

৭ম নৌবহর নিয়ে তোলপাড়


মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরের ঘাঁটি গড়ার খবরে সারা দেশে তোলপাড় চলছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতীয় গণমাধ্যমের এ খবর ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিলেও দেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা বলছেন ভূকৌশলগত কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব বেড়েছে। ইতোমধ্যে এশিয়ার ছোট দেশগুলোর সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা সহযোগিতা বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিওন প্যানেট্্রা বলেছেন, এশিয়ায় মার্কিন রণতরী আরো বাড়ানো হবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সপ্তম নৌবহরের উপস্থিতির খবর বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ মনে করেন, মার্কিন সপ্তম নৌবহরের ঘাঁটি গড়ার এই খবর আমাদের পররাষ্ট্রনীতির ভয়ানক দুর্বলতাই প্রমাণ করে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীকে সমুদ্রসীমা বিজয়ের জন্য সংবর্ধনা দেয়া হলো ঠিকই কিন্তু সমুদ্রসীমাকে তার সরকার নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি। সুযোগ বুঝেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নৌবহর মোতায়েন করছে। বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনকে দখল করতে এবং বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণের জন্যই যুক্তরাষ্ট্র নৌবহর আনার কথা ভাবছে। তিনি বলেন, বঙ্গোপসাগরে মার্কিন নৌঘাঁটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, উত্তর-পূর্ব ভারত ও চীনকে আরো বেশি ভঙ্গুর করে তুলবে। কৌশলগত কারণে যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গোপসাগরে অবস্থান নিচ্ছে। এর লক্ষণ মোটেও ভালো নয়। আরো কিছু দিন না দেখলে এ বিষয়ে এখনই বিস্তারিত কিছু বলা যাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও কলামিস্ট কবি ফরহাদ মজহার বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ছোট দেশগুলোর সম্পর্কের যে নীতি তাতে পরিবর্তন এসেছে। এশিয়া এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনযোগের কেন্দ্রবিন্দু। তারই পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গোপসাগর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি সপ্তম নৌবহরের উপস্থিতির পরিকল্পনা থাকে তাহলে বুঝতে হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় বঙ্গোপসাগরে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা অনেক দূর এগিয়েছে। যদিও সরকার ভারতীয় পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সপ্তম নৌবহরের ঘাঁটি স্থাপনের খবরকে ভিত্তিহীন বলে প্রতিবাদ জানিয়েছে। অন্য দিকে সিঙ্গাপুরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিয়ন প্যানেট্রা বলেছেন, এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের রণতরী বাড়বে। সরকারের অস্বীকার এবং যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষণার মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সম্ভবত এখন রণতরী পাঠিয়ে ভারত ও চীনে সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া যাচাই করতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি গড়ার কোনো পরিকল্পনা আছে বলে আমার মনে হয় না। তবে মধ্যপ্রাচ্য থেকে মার্কিন সৈন্য অপসারণের পর তার কিছু অংশ চট্টগ্রামে থাকার কথা ছিল। এবার সে ব্যাপারে কোনো চুক্তি হয়েছে কি না তা আমরা এখনো জানি না।
ফরহাদ মজহার বলেন, চট্টগ্রাম ভূকৌশলগত কারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই বন্দর ব্যবহারের ক্ষেত্রে চীন, ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক ধরনের প্রতিযোগিতায় আছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহরের ঘাঁটি গড়ে তোলার কোনো সম্ভাবনা নেই। তিনি বলেন, বিশাল সপ্তম নৌবহরে ৩৫০ এয়ারক্রাফট, ৬০ হাজার মেরিন সেনা নিয়ে ৯টি টাস্কফোর্স কাজ করে। সপ্তম নৌবহর দিয়াগো গার্সিয়া, সিঙ্গাপুর ও গুয়ামে মোতায়েন আছে। এই নৌবহরে যে ডেস্ট্রয়ার আছে সেগুলো বঙ্গোপসাগরের গভীরতায় আসতে পারবে না। ব্রিগেডিয়ার (অব:) সাখাওয়াত মনে করেন, মিয়ানমারে রাজনৈতিক পরিবর্তনে বঙ্গোপসাগরের গুরুত্ব বেড়েছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার সম্পর্ক আরো বাড়তে পারে। এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব মোকাবেলার লক্ষ্য নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ সম্পর্ক বাড়াবে। কিন্তু এ জন্য সপ্তম নৌবহরের উপস্থিতি প্রয়োজন বলে মনে হয় না।
চট্টগ্রামে মার্কিন ঘাঁটি নির্মাণ ও বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহরের উপস্থিতির ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যাখা দাবি করে বিশিষ্ট কলামিস্ট ও জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি বদরুদ্দীন উমর বলেন, মার্কিন নৌবহর মোতায়েনের চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র দীর্ঘদিনের। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গভীর লোভে জাতীয় স্বাধীনতা বিপন্নকারী এই ষড়যন্ত্রের সাথে হাত মিলিয়েছে। তিনি বলেন, হাসিনা দেশবিরোধী এবং তার পকেট ভরতেই এ ধরনের কাজ করা হচ্ছে। ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে, তাই ভারত যুক্তরাষ্ট্রের নৌবহর নির্মাণের খবরটি ফাঁস করেছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে মার্কিন নৌবহর মোতায়েন করার অপর উদ্দেশ্য হলো এ অঞ্চলে ইরাক-ইরাক-আফগাস্তিানের যুদ্ধ পরিস্থিতি আমদানি করা। চীনের সাথে তো আমাদের জড়ানোর কোনো কারণ নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও অন্যান্য দেশের সাথে সম্পাদিত গোপন চুক্তি জনসমক্ষে প্রকাশ করার দাবি করে তিনি বলেন, দেশের নিরাপত্তা বিপন্ন করে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি নির্মাণে তথাকথিত কৌশলগত সহায়তা করা হলে হাসিনা সরকার জাতীয় বেঈমানরূপে অভিহিত হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন, বঙ্গোপসাগরে মার্কিন নৌবহর মোতায়েনের খবর প্রসঙ্গে বলেন, মূলত এশিয়ার মধ্যে ভারত ও চীনের দ্রুত উত্থান দেখেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে অবস্থান নিতে চাইছে। তিনি বলেন, ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ভালো, আবার চীনের সাথে আছে বৈরিতা। এ দিকে মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ভালো নয়। কৌশলগত কারণে বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্র বিকল্প হতে পারে। তাই নানা কৌশলগত কারণে যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গোপসাগরে অবস্থান নিচ্ছে। যদি কোনো টার্গেট নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আসে তবে ভারতের উপকূলীয় রাজ্যগুলো, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে সজাগ হতে হবে। তিনি আরো বলেন, প্রশান্ত মহাসাগর ও ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য আগে থেকেই ছিল। দিয়াগে গর্সিয়া থেকে তারা আস্তে আস্তে অবস্থান পাল্টিয়ে বঙ্গোপসাগরের দিকে আসছে।
নিন্দা ও প্রতিবাদ : মার্কিন সপ্তম নৌবহর চট্টগ্রামে ঘাঁটি করতে চায় শীর্ষক সংবাদে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ ও তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে সংবাদের ব্যাখা দাবি করেছে কয়েকটি বামপন্থী রাজনৈতিক দল। এ দলগুলো বলছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমন এক অশুভ লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে যা দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও জনগণের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎকে হুমকির মুখে ঠেলে দেবে। চট্টগ্রাম বন্দরে মার্কিন ঘাঁটি স্থাপনের এই চেষ্টা আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করে তুলবে।
বাম মোর্চার নেতৃবৃন্দ বলেন, সাম্রাজ্যবাদের কাছে নতজানু বর্তমান সরকার মার্কিনিদের এই যুদ্ধ চক্রান্তে বাংলাদেশকে যুক্ত করার অশুভ নীলনকশা নিয়ে এগোচ্ছে যা দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও জনগণের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎকে হুমকির মুখে ঠেলে দেবে। পরিষদের সমন্বয়ক বজলুর রশীদ ফিরোজ ও খালেকুজ্জামান মিয়া সংবাদপত্রে দেয়া এক বিবৃতিতে এ কথা বলা হয়।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মনজুরুল আহসান খান ও সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এক বিবৃতিতে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, দেশের তেল-গ্যাস-কয়লাসহ প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর সাম্রাজ্যবাদী বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর লোলুপদৃষ্টি রয়েছে। এগুলো তাদের দখলে নেয়ার জন্য তারা নানাভাবে তৎপর রয়েছে। আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মার্কিনিদের হস্তক্ষেপের কথাও দেশবাসীর জানা আছে। চট্টগ্রাম বন্দরে তাদের ঘাঁটি স্থাপনের মধ্য দিয়ে এই হস্তক্ষেপ আরো বৃদ্ধি পাবে। আমাদের দেশের রাজনীতিতে অস্থিতিশীলতার উপাদানও তাতে বহুল পরিমাণে বেড়ে যাবে।
ওয়ার্কার্স পার্টির এক সভায় পার্টি সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, দেশের সমুদ্রসীমায় মার্কিনি প্রতিরা বাহিনীর মোতায়েনের পাঁয়তারার বিরুদ্ধে এ দেশের জনগণকে সতর্ক থাকতে হবে। দেশের নব অর্জিত সমুদ্রসীমায় অথবা দেশের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াইয়ের নামে মার্কিন প্রতিরা বাহিনীর কোনো ধরনের উপস্থিতি এ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে ুণœ করবে। গতকাল ঢাকা মহানগর ওয়ার্কার্স পার্টির সভায় এ কথা বলা হয়।
বাসদ সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান এক বিবৃতিতে বলেন, সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি কিনটনের সফরের সময় স্বাক্ষরিত কথিত অংশীদারি চুক্তির ফলেই চট্টগ্রামে ঘাঁটি করার পাঁয়তারা করছে যুক্তরাষ্ট্র। তিনি মার্কিনিদের সাথে সম্পাদিত সব চুক্তি জনসমক্ষে প্রকাশ এবং জাতীয় স্বার্থবিরোধী সব চুক্তি বাতিলের দাবি জানান।
বাসদের উদ্যোগে আজ বিকেল সাড়ে ৪টায় জাতীয় প্রেস কাবের সামনে এক প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হবে। চট্টগ্রামে বঙ্গোপসাগরে মার্কিন সপ্তম নৌবহরের ঘাঁটি গড়ার চক্রান্তের প্রতিবাদে এই বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন