শনিবার, ২ জুন, ২০১২

আখের গোছাচ্ছেন সচিবরা


সরকারের সময় যতই শেষ হয়ে আসছে, আখের গোছাতে শুরু করেছেন সরকারি কর্মকর্তারা। অন্তত এক ডজন সচিব এরই মধ্যে বিদেশে বাড়ি নিয়েছেন। এদের বেশিরভাগই বাড়ি বানিয়েছেন কানাডা, নিউইয়র্ক ও অস্ট্রেলিয়ায়। মালয়েশিয়ায়ও বাড়ি বানিয়েছেন কেউ কেউ। বেশ ক’জন সচিব তাদের পরিবারকে এরই মধ্যে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন। অনেকে সন্তানদের বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন পড়ালেখার নাম করে। শুধু সচিবই নন—অতিরিক্ত সচিব, সাবেক জেলা প্রশাসক, পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তা, সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের বেশ কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে রয়েছে এ অভিযোগ। বিশেষ করে, গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে স্বেচ্ছায় দুর্নীতির কথা স্বীকার করা ২৬৫ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর অনেকেরই বিদেশে বাড়ি রয়েছে বলে জানা গেছে। একটি গোয়েন্দা সংস্থা এরই মধ্যে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে।
জানা গেছে, সচিব কাজী মো. আমিনুল ইসলাম অস্ট্রেলিয়ায় বাড়ি করেছেন। তার স্ত্রী-সন্তানরা ওই বাড়িতেই থাকছেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক এই কর্মকর্তা বর্তমানে বিশ্বব্যাংকের বিকল্প পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন ওয়াশিংটনে।
সচিব বরুণ দেব মিত্র বাড়ি করেছেন নিউইয়র্কে। তার ফ্যামিলি বর্তমানে ওই বাড়িতেই থাকছে বলে জানা গেছে। সপ্তাহখানেক আগে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে কর্মরত অবস্থায় বরুণ দেব মিত্রের চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়। গত ২৩ মে তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগদান করেছেন। এখন তিনি নিউইয়র্কে তার পোস্টিং নিশ্চিত করতে তত্পর। শুধু তা-ই নয়, কাউন্সেলর পদে হলেও নিউইয়র্ক যেতে চান সচিব বরুণ দেব মিত্র। যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার একটি পদে একজন সচিবের পোস্টিং পাওয়ার আগ্রহ নিয়ে ব্যাপক কৌতূহল তৈরি হয়েছে।
জানা গেছে, বরুণ দেব মিত্র যে কোনো মূল্যে নিউইয়র্ক যেতে চান। এক্ষেত্রে কাউন্সেলর পদে হলেও তার কোনো আপত্তি নেই। কারণ, ওখানে রয়েছে তার পুরো পরিবার। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, বরুণ দেব মিত্র মাসখানেক ধরে তার চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করার জন্য তদবির করে আসছিলেন। তার স্ত্রী ও দুই মেয়ে বেশ আগে থেকেই নিউইয়র্কে বসবাস করছেন। তার স্ত্রী রাখি মিত্র চৌধুরী নিউইয়র্কে ইউনিসেফ সদর দফতরে কর্মরত। আর বড় মেয়ে রুদ্রাক্ষী মিত্র নিউইয়র্কের স্টেট ইউনিভার্সিটিতে এবং ছোট মেয়ে নিলাক্ষী মিত্র নিউইয়র্কের স্টেডিসেন্ট হাইস্কুলে পড়ছে।
স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় সচিব আবু আলম শহীদ খানের বাড়ি রয়েছে কানাডার টরেন্টোতে। সেখানে তার দুই মেয়ে ছাড়াও থাকছেন বড় বোন ও ছোট ভাই। জনতার মঞ্চের এ কর্মকর্তাকে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে এক বছরের মাথায় সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে তিন দফা পদোন্নতি দিয়ে সচিব করেছেন। তার সঙ্গে কথা বলতে গতকাল বার বার ফোনে চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি।
অতিরিক্ত সচিব অপূর্ব বিশ্বাসের বাড়ি রয়েছে কানাডায়। কানাডার ওই বাড়িতেই থাকছে তার পরিবার।
এছাড়া ইআরডি সচিব ইকবাল মাহমুদের অস্ট্রেলিয়া, মত্স্য ও প্রাণিসম্পদ সচিব উজ্জ্বল বিকাশ দত্তের আমেরিকায়, যুগ্ম সচিব ইব্রাহীম হোসেন খানের কানাডা, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব, ঢাকার সাবেক জেলা প্রশাসক জিল্লার রহমানের ব্যাংককে বাড়ি রয়েছে। গতকাল জিল্লার রহমানকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অতিরিক্ত সচিব শাহ কামাল, আবদুল মালেকসহ আরও অনেকের বিদেশে বাড়ি রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সূত্র জানায়, এসব আমলার কেউ নিজের নামে আবার অনেকে আত্মীয়ের (ভাই, বোন, শ্বশুর, শালা) নামে এসব বাড়ি কিনেছেন। জানা গেছে, দুই শতাধিক সরকারি কর্মকর্তার সন্তানরা এখন বিদেশে পড়ালেখা করছে। আবার এদের অনেকের পরিবারও থাকছে বিদেশে। অর্থপাচার, সম্পদ ও পরিবারকে দেখার জন্য এসব কর্মকর্তা সরকারি টাকায় ঘন ঘন বিদেশও সফর করছেন। কোনো কোনো কর্মকর্তা গত তিন বছরে ২০ বারেরও বেশি বিদেশ সফর করেছেন।
গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে স্বেচ্ছায় দুর্নীতির কথা স্বীকার করা ২৬৫ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে অনেকেরই বিদেশে বাড়ি রয়েছে বলে জানা গেছে। লঘুদণ্ড মেনে নিয়ে বিলুপ্ত ট্রুথ কমিশনের রায়ে দুর্নীতির দায় থেকে এরা মুক্ত হয়েছিলেন। অবশ্য আত্মস্বীকৃত এসব দুর্নীতিবাজের কারও কারও বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়া আবার শুরু হয়েছে।
জানা যায়, হাইকোর্ট ২০০৮ সালের শেষে ট্রুথ কমিশনকে (সত্য ও জবাবদিহি কমিশন) বিলুপ্ত ও কমিশনের সব কার্যক্রম বাতিল করে। এরপর এদের নিয়ে পত্রিকায় লেখালেখি শুরু হলে প্রশাসন এখন আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু করেছে। এসব কর্মকর্তা-কর্মচারী এতদিন নিরাপদে কাজ করেছেন। অনেকের পদোন্নতিও হয়েছে। আবার কাউকে কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। গত বছরের ১৬ মে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ থেকে বিলুপ্ত ট্রুথ কমিশনের কার্যক্রমকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। এরপর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ওইসব আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের তাগিদ দেয়া হলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কাজ শুরু করে।
বিলুপ্ত ট্রুথ কমিশনে অনুকম্পার জন্য রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ মোট ৪৯১ জন আবেদন করেন। ট্রুথ কমিশন থেকে ৪৫২ জনকে শর্তসাপেক্ষে মার্জনাপত্র দেয়া হয়েছিল। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ডেসা, নিবন্ধন পরিদফতর, ওয়াসা, টিঅ্যান্ডটি, পোস্টাল, তিতাস গ্যাস, বন বিভাগ, গৃহায়ন অধিদফতর, সওজ, বিটিসিএল ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ২৬৫ জন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ২৮ জন তাদের স্ত্রী। তারা ৩৩ কোটি ৮০ লাখ ২১ হাজার ৬৬৮ টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেন।
দুর্নীতির কথা স্বীকার করে বিলুপ্ত ট্রুথ কমিশন থেকে যারা অনুকম্পা গ্রহণ করেছিলেন, তাদের মধ্যে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে তাগিদ দেয়ার পর সওজের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করেছে এ মন্ত্রণালয়। এরই মধ্যে কিছু সংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারীর দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলার ফাইল সংগ্রহ করা হয়েছে।
জানা গেছে, আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজ সওজের প্রকৌশলী শাহাবউদ্দিন তিরস্কৃত হওয়ার পরিবর্তে হয়েছেন পুরস্কৃত। অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী থেকে তাকে পদোন্নতি দিয়ে প্রতিষ্ঠানের প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্ব দেয়া হয়। অবশ্য সম্প্রতি তিনি অবসরে গেছেন। একই প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আরিফুর রহমান জিন্নাহকে পদোন্নতি দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেনবিশিষ্ট সড়ক প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়। নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল আজিজ জোয়ার্দার পদোন্নতি পেয়ে ম্যানেজমেন্ট ও সার্ভিসেস উইংয়ের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব পান। এখানকার শীর্ষস্থানীয় আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজদের মধ্যে প্রকৌশলী গোলাম মোস্তফা টাঙ্গাইল জোনের নির্বাহী পরিচালক ও জর্জিস হোসেনকে ময়মনসিংহ জোনের নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব দেয়া হয়। বিদেশে বাড়ি থাকার কথা অভিযুক্তদের কেউ স্বীকার করেননি।

1 টি মন্তব্য:

  1. আমার কিছু প্রশ্ন -
    ১) রাষ্ট্রীয় আইনে তাদের কি দেশের বাইরে বাড়ি করা নিষেধ ?
    ২) নিষেধ না হলে কেন এটা নিয়ে কথা বলছি ?
    ৩) নিষেধ না হলেও তাদের টাকার উত্স কি দেখা হয়না ?
    ৪) নিষেধ হলে এরা কি আইনের উর্ধে ?
    ৫) এই লেখাটা দিয়ে কি বলতে চাচ্ছেন পাঠকদের ?

    উত্তরমুছুন