সোমবার, ২৬ মার্চ, ২০১২

সমুদ্র বিজয় : প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির প্রশ্ন

প্রফেসর ড: মোহাম্মদ আব্দুর রব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : ইটলস (ITLOS) রায়ে বঙ্গোপসাগরের সমুদ্র সীমায় বাংলাদেশের অধিকার অর্জনে দেশব্যাপী বিজয় উৎসব করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। কেউ বলছেন ‘এটা এক মহাবিজয়'; আবার কেউ বলছেন এ রায়ে ‘এক মাইলফলক অর্জন' হয়েছে। কেউবা এটা বাঙ্গালীর ‘সমুদ্র জয়' বলেও মহাআত্মতৃপ্তি লাভ করছেন। রাজনৈতিক মহলে এটা নিজ নিজ দলের নেতার বিশেষ অর্জন বলে উদযাপনের ধুম পড়েছে। কেউ বুঝে কেউবা না বুঝেই লম্ফঝম্প শুরু করেছেন। কিন্তু আমার বিবেচনায় বিষয়টা এখনো খুবই অস্পষ্ট এবং দারুণভাবে প্রশ্নসাপেক্ষ। বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যকার বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন ট্রাইব্যুনালের (ইটলস) গত ১৪ মার্চের রায় নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মনে নানা অভিব্যক্তির অভ্যুদয় ঘটছে। এ মামলার বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য যেমন গুরুত্ববহ তেমনি বিষয়টি ততোধিক জটিলও। বাংলাদেশের উপকূলীয় ভূ-ভাগের ভূ-রূপতাত্ত্বিক গঠন, উপকূলীয় সমুদ্রাঞ্চলের দ্বীপময় অগভীর বঙ্গোপসাগরের তলদেশের অবস্থা এবং বাংলাদেশের সমুদ্র-শরিকদের উপকূলীয় কাঠামো বাংলাদেশকে বিশেষ অসুবিধাময় পরিস্থিতিতে নিপতিত করেছে।
বাংলাদেশের সমুদ্রাঞ্চলে এই ‘বিজয়' নিয়ে কৃতিত্ব দখলের এক প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। বর্তমান সরকার নির্লজ্জের মত ঘটনা কি ঘটেছে, বা এর ফলশ্রুতি কি হতে যাচ্ছে তা চিন্তা না করেই  মিডিয়ায় এবং সংসদে অতি উৎসাহে নিজেদের পিঠ চুলকাতে শুরু করে দিয়েছেন। তারা বেমালুম ভুলে গিয়েছেন ১৯৭৪ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গোপসাগরের জরিপের কথা প্রথম শুরু করলেও স্বাভাবিক কারণে তিনি এর কোন অগ্রগতি ঘটাতে পারেননি। ১৯৭৫ সালের পরে জিয়াউর রহমান সাহেব তা আবার শুরু করলে ভারত কানাডিয়ান সার্ভে জাহাজকে নৌবাহিনী দ্বারা তাড়া করে। পরে প্রেসিডেন্ট জিয়া দক্ষিণ তালপট্টির দিকে বাংলাদেশের নৌবাহিনীকে পাঠানোর উদ্যোগ নেন এবং তার মৃত্যুর পর বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের  অধিকারের প্রশ্ন চাপা পড়ে যায়। বাংলাদেশের সমুদ্রাঞ্চলের অধিকারের ব্যাপারে প্রথম যৌক্তিক ও জোরালো উদ্যোগ গ্রহণ করেন শহীদ জিয়াউর রহমান। তার শাসনকালে রিয়ার এডমিরাল এম, এইচ. খানের নেতৃত্বে দ. তালপট্টি ও বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা ও সমুদ্র সম্পদ আহরণের নানা উদ্যোগ নেয়া হয়। ঐ সময় NOAMI নামক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে বঙ্গোপসাগরের উপর কয়েকটি গবেষণা কার্য পরিচালনা করা হয়। প্রফেসর ড. মনিরুজ্জামান মিয়া (ঢা. বি.), প্রফেসর ড. এম আই চৌধুরী (জা.বি.), প্রফেসর ড. হাবিবুর রহমান (রা.বি.) এবং প্রফেসর ড. আইনুন নিশাত (বুয়েট) এসব গবেষণা কার্যক্রমে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। শহীদ কমোডর রাববানী এবং কমোডর খুরশেদ আলমও (বাংলাদেশ নৌবাহিনী) বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের আঞ্চলিক সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত গবেষণা ও আইনী তৎপরতায় বিশেষ অবদান রাখেন। কিন্তু মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে নীতিনির্ধারণী এ সর্বশেষ আলোচনা ও উদ্যোগ নেয়া হয় বিগত ২০০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। তখন এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের  তৎকালীন উপদেষ্টা ড. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরীর উদ্যোগে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব  জনাব আবুল কালাম মাহমুদ (কায়েস)কে এ বিষয়ের সেলের প্রধান করে  কমোডর (অব.) মোহাম্মদ খুরশেদ আলমকে  উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়। তখন থেকেই এ ক্ষেত্রে বিশেষ অগ্রগতি শুরু হয়। এ ক্ষেত্রে ধারণা করা হয়, বঙ্গোপসাগরে এবং সংলগ্ন অঞ্চলে মার্কিনী স্বার্থ থাকায় ঐ সময় থেকে বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরের মিয়ানমার উপকূলীয় অঞ্চলের দাবি-দাওয়া নিয়ে মামলা আন্তর্জাতিক ফোরামে বিশেষ গুরুত্ব পেতে থাকে। ২০০৯ সনে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করার পর ঐ মামলা অব্যাহত থাকে এবং জনাব মাহমুদের পরিবর্তে কমোডর (অব.) খুরশেদ আলমকে চুক্তিভিত্তিক অতিরিক্ত সচিবের দায়িত্ব দিয়ে বঙ্গোপসাগরে  বাংলাদেশের দাবি-দাওয়া সংক্রান্ত আনক্লস সেল (UNCLOS CELL)-র নেতৃত্ব দেয়ার ভার অর্পণ করা হয়। তিনি যথেষ্ট যোগ্যতার সঙ্গে সাধ্যানুযায়ী এ বিষয়ে পারঙ্গমতার পরিচয় দেন।
সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে যে, জার্মানীর হামবুর্গে ‘ইটলস' (ITLOS) রায়ের ফলে বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের ১২ নটিক্যাল মাইল আঞ্চলিক সমুদ্রাঞ্চল (Territorial Sea) এবং এ থেকে বেইসলাইন ধরে (Base Line) সোজা দক্ষিণে আরো ২০০ ন.মা. পর্যন্ত একান্ত অর্থনীতিক জোন (Exclusive Economic Zone) লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। শুধু তাই নয়, এ রায়ের ফলে বাংলাদেশ উপকূল থেকে ১ লাখ ১১ হাজার বর্গ কি.মি. সমুদ্রাঞ্চলে (EEZ) একচ্ছত্র সম্পদ আহরণের অধিকার পেলো। যেহেতু এ রায় অপরিবর্তনীয় এবং এতে কোন পক্ষই আপীল করতে পারবে না তাই এখন থেকে বঙ্গোপসাগরের এ বিপুল জলরাশিতে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব কায়েম হবে। শুধু তাই নয়, এ রায়ের মাধ্যমে (সংবাদ মাধ্যমের ভাষ্যে), দক্ষিণে আরো ২০০ নটিক্যাল মাইল মহিসোপানেও (Continental Shelf) বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে (শুধু সম্পদের উপর)। অর্থাৎ, বঙ্গোপসাগরে, এ রায়ের ফলে, প্রায় ২ লাখ বর্গ কি. মি. - এরও বেশি অঞ্চলে বাংলাদেশের এখতিয়ার প্রতিষ্ঠিত হল। আগে ভারত ও মিয়ানমার দেশ দু'টির বঙ্গোপসাগরে ‘সমদূরত্ব পদ্ধতি'র দাবি উপস্থাপনের ফলে (Equi-distance claims) বাংলাদেশের দাবিকৃত সমুদ্রাঞ্চল তীর্যকভাবে এসে এক বিন্দুতে কৌণিকভাবে মিশে বাংলাদেশের পূর্বদিকের এবং পশ্চিমদিকের উপকূলীয় সীমানা বরাবর ই. ই. জেড (EEZ) এবং একই ভাবে মহিসোপানাঞ্চলের (C.S.) জলাঞ্চলের দাবিকৃত এলাকাকে সংকীর্ণ করে বহুগুণ কমিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানের  ‘ইটলস' (ITLOS) - রায়ে, বার্তা মাধ্যমের প্রচারিত বক্তব্য মতে, এ এলাকাকে উল্লেখযোগ্যভাবে বাংলাদেশের অনুকূলে বিস্তৃত করেছে। একই সঙ্গে, যদি না রায়ের প্রচারিত বিবরণ সঠিক হয়, তবে বাংলাদেশ তার যৌক্তিকভাবে দাবিকৃত আঞ্চলিক সমুদ্রসীমা, একান্ত অর্থনীতিক জোন এবং মহিসোপানের সমুদ্রাঞ্চলে অচিরেই বিপুল সামুদ্রিক সম্পদ আহরণের অনুকূল সুবিধা লাভ করতে শুরু করবে।
আদতে বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চল অবতল (Concave) আকৃতির ভূ-কাঠামোর হওয়ার ফলে এবং ভারত-মিয়ানমারের উপকূলীয় ভূ-গঠন উত্তল (Convex) হওয়ায় বাংলাদেশের আঞ্চলিক সমুদ্রাঞ্চল নির্ধারণের মূল ভিত্তিরেখা বা বেইসলাইন  (Base Line) যা নির্ধারণ খুবই জটিল হয়ে যায়। এর ফলে এ দেশের (বাংলাদেশের) বঙ্গোপসাগরেও আঞ্চলিক সমুদ্রাঞ্চল (T.S.) এবং কন্টিগুয়াস জোন (C.Z.) চিহ্নিতকরণ প্রক্রিয়া হয়েছে বিতর্কিত এবং প্রশ্নবিদ্ধ। বাংলাদেশের উপকূলীয় দ্বীপমালাসমূহ মূলত. বদ্বীপীয় (Deltaic) নব-পলল গঠিত দ্বীপ। এগুলো এক সময় মূল বদ্বীপীয় ভূভাগের সাথে মিলে প্লাবন সমভূমিকা দেশের মূলভাগের দক্ষিণাঞ্চলকে প্রবর্ধিত করে আরো দক্ষিণে ক্রমান্বয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতেও বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরের জলরাশির বিভিন্ন ভাগের অঞ্চলে বাংলাদেশের এখতিয়ার বা দাবি প্রতিষ্ঠার মূল ভিত্তি  বা ‘বেইস লাইন'    (Base Line) বাস্তবে ক্রম পরিবর্তনশীল থাকবে। তাই বর্তমান ‘ইলটস'-এর রায়ে যে সমুদ্রাঞ্চলকে আমাদের ‘আঞ্চলিক সমুদ্র সীমা' (T.S.) , ‘একান্ত অর্থনীতিক জোন' (EEZ) বা মহিসোপান (C.S.) হিসেবে নির্ধারিত করে দেয়া হল- সে সীমারেখা বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলের নিকট বা দূর-ভবিষ্যতে নতুন নতুন চর বা দ্বীপ গঠন প্রক্রিয়ায় আরো প্রবর্ধিত হয়ে দক্ষিণে কিংবা পূর্ব-পশ্চিমে বেড়ে চললে ঐ ন্যায়পরায়ণতার হিসেবে চিহ্নিত সীমানা ও আয়তনও পরিবর্তিত হতে বাধ্য। জানি না, এ রায়ে এ বিষয়ে এর কিরূপ প্রতিবিধান বিধৃত হয়েছে।
চরম জনভারাক্রান্ত ও সম্পদ বঞ্চিত বাংলাদেশ যেহেতু মূলত: বঙ্গোপসাগর থেকে জেগে ওঠা একটি বর্ধিষ্ণু প্রধান রাষ্ট্র হেতু আমরা ভূমি, খাদ্য, জ্বালানি এবং যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে সমুদ্রের উপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল। তাই, বাংলাদেশের জন্য এ অপরিসীম গুরুত্বসহ সমুদ্রাঞ্চলে আমাদের মালিকানা প্রতিষ্ঠায় জাতি অত্যন্ত সচেতন ও সংবেদনশীল। জাতিসংঘের সমুদ্র আইন সংক্রান্ত ১৯৬০ ('৬৭) সনের (UNCLOS-II)-এর মাত্র ৬৬টি রাষ্ট্র ১২ নটিক্যাল মাইল আঞ্চলিক সমুদ্রাঞ্চল (T.S.) মেনে তাতে স্বাক্ষর করে। ৮টি দেশ ২০০ ন. মা. দাবি করে এবং বড় বড় নৌ শক্তিগুলো এতে মোটেই স্বাক্ষর করতে রাজি হয়নি, যে ৬৬টি, ১২ ন. মা. (T.S)-এ রাজি হয়েছে সে দেশগুলোর বেশিরভাগের উপকূলই খুবই গভীর এবং ভূ-বৃদ্ধির কোন সম্ভাবনা বা সমুদ্র সম্পদের আহরণের সম্ভাবনাও সেগুলোর বিশেষ নেই। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার গঠন এমন যে দক্ষিণে একশত মাইল চলে গেলেও সেখানে সমুদ্রের অগভীরতা মাত্র কয়েক ফ্যাদম। অর্থাৎ অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে ২০/৩০ মাইল কিংবা তার চেয়ে দূরে পলি জমে নতুন ভূমি জেগে ওঠতে পারে। এভাবে আমাদের দক্ষিণের উপকূলের আরো দক্ষিণে বদ্বীপ গঠনের সাধারণ প্রক্রিয়ায় অগভীর মহিসোপানে ভূমি দক্ষিণে সম্প্রসারিত হয়ে বাংলাদেশের আঞ্চলিক সমুদ্রাঞ্চল, কন্টিগুয়াম জোন (T.S.& C.Z.) বহুদূর দক্ষিণে সম্প্রসারিত হবে। তার ফলে এদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণের বেইস লাইনও (Base Line) আরো দক্ষিণে যাবে। তখনতো বর্তমানের ইটলসের (ITLOS) রায়ে নির্ধারিত বেইস লাইন, অর্থনীতিক জোন ও মহিসোপান (EEZ and Continental Shelf)-এর নির্ধারিত সীমানাও বদলে যেতে বাধ্য।
সংবাদপত্রের খবর এবং বিভিন্নজনের বক্তব্য থেকে জানা যায় যে, ইটলসের এ রায়ের ফলে বাংলাদেশ মিয়ানমারের দাবিকৃত উপকূলীয় সমুদ্রে বিপুল ভূমির আশাতিরিক্ত (আমাদের দাবির চেয়েও বেশি) জলাঞ্চল লাভ করেছে। এখানেও সংবাদপত্রে প্রকাশিত নানা মানচিত্রে ভিন্ন ভিন্ন সীমারেখা চিহ্নিত মানচিত্র ও খন্ডচিত্র আমাদেরকে বিভ্রান্ত করছে। ঐসব বক্তব্য এবং চিত্র থেকে যতটুকু অনুধাবন করা যায় তা থেকে বলা যায়, আসলে এ রায়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের দাবিকৃত মূল চিত্রের খানিকটা পরিবর্তন হলেও ঐ বিভাজন রেখাটি মূলতঃ দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রলম্বিত হয়ে বাংলাদেশের মূল দাবিকৃত বিপুল সমুদ্রাঞ্চলকে গ্রাস করে নিয়েছে। ফলে মিয়ানমার তার দাবিকৃত মহিসোপানের হাইড্রোকার্বন সমৃদ্ধ (গ্যাস ও খনিজ তৈল) বেশিরভাগ ব্লকের মালিকানা পেয়েছে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশ দূরবর্তী গভীর সমুদ্রের তুলনামূলকভাবে কম সম্ভাবনাময় অঞ্চলেই তার EEZ-এর  মালিকানা পেয়েছে। এখানে উল্লেখ্য, মিয়ানমারের সন্নিকটস্থ মহিসোপানেই সবচেয়ে সমৃদ্ধ প্রামাণ্য প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। সুতরাং এখানেও আত্মতৃপ্তির কোন কারণ নেই। ইটলসের (ITLOS) রায়ের ফলে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যকার ২০১৪ সালে নিত্তিতব্য মামলার ইন্টারন্যাশনাল পারমানেন্ট কোর্ট অব আরবিট্রেশনের রায়ের ফলাফল যে একইভাবে প্রভাবিত হবে তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। কারণ, ভারতের মামলার আরজিতে ‘ল' অব ইক্যুটির' স্থলে তাদের উপস্থাপিত ‘ইক্যুইডিস্টেন্স প্রিন্সিপল' যা ‘‘সমদূরবর্তী নীতি’’-সে গ্রহণ করেছে। এখানে স্মর্তব্য, ভারত, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়ার (আন্দামান সাগরে) সাথে সমুদ্রসীমা নির্ধারণে ঐ ‘ইক্যুইডিস্টেন্স প্রিন্সিপল' ভিত্তি করে বিবাদ নিরসন করেছে। তা'ছাড়া ভারত একটি আঞ্চলিক শক্তি। নৌ-শক্তিতে অগ্রগণ্য। তাই ভারত মিয়ানমারের মত তার স্বার্থের বিপক্ষে যাওয়া রায় কিছুতেই মানবে বলে মনে হয় না। ভারতের সাথে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণীতে (বাংলাদেশের পশ্চিমাংশের উপকূলে) বাংলাদেশকে একটি ক্রমবর্ধমান বদ্বীপীয় রাষ্ট্র হিসেবে উপকূলীয় সীমানা নির্ধারণী হাড়িভাঙ্গা নদীর ‘মূল-মধ্যরেখা নীতি' (Mid-channel Thalweg Doctrine) অনুসরণে ভারতের সঙ্গে নিত্তিতে অগ্রসর হতে হয়। কিন্তু এখন যদি ঐ একই ‘ইক্যুটি প্রিন্সিপল' বা ন্যায়পরতার নীতির মাধ্যমে আবার ভারত-বাংলাদেশ সমুদ্রসীমা নিত্তি হয় তবে আবারও বাংলাদেশ ভারতের কাছে তার দাবিকৃত (যৌক্তিক) সমুদ্রাঞ্চল (EEZ এবং C.S)-এর ভূমির অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। আর ভারত তার ইw≈ত দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য তার শক্তিশালী প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে বঙ্গোপসাগরে জেগে ওঠা হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মোহনার নতুন দ্বীপ দক্ষিণ তালপট্টিকে মানচিত্র থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। অনেকে বলে থাকে, বৈজ্ঞানিক নদী শাসন পদ্ধতির মাধ্যমে ভারত ঐ দ্বীপটিকে ধ্বংস করে ফেলেছে। তথাপি এখনো ভাটার সময় ভূ-উপগ্রহচিত্রে দক্ষিণ তালপট্টির অস্তিত্ব পরিদৃষ্ট হয়। ভারত যদি মিয়ানমারের মত ‘ল অব ইকুইটি' যা ন্যায়পরতার নীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণে বাধ্য বা রাজী হয়--তবুও ঐ রায়ের ফলে দু'দেশের মধ্যে নিত্তিকৃত রায়ের নির্ধারিত বিভাজন রেখা সরাসরি দক্ষিণে চলতে থাকলে (যা মিয়ানমারের ক্ষেত্রে সোজা দক্ষিণে না চলে কিছুটা পশ্চিম বেঁকে গিয়েছে বলে দেখা যায়) ভালো। কিন্তু তা'যদি দক্ষিণ-পূর্বদিকে চলতে থাকে (রায়ের ফলে) তবে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলীয় সমুদ্রেও আমাদের EEZ এবং C.S-এর আয়তন বিপুলভাবে কমে যাবে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে বাংলাদেশের সমুদ্র-দাবী ‘‘বলয়বদ্ধ’’ বা ‘‘জোন-লক্ড্’’ (Zone-Locked) হয়ে পড়বে।
পরিশেষে বলা যায়, রায়ের গেজেট প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে লাভক্ষতির চূড়ান্ত মতামত দেয়া কঠিন। তবে একথা অবশ্যই বলা যায় যে, ইটলস রায়ের মাধ্যমে আমরা আমাদের ই. ই. জেড. এর পূর্বাঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ বিশাল সম্পদ সম্ভাবনাময় (তৈল-গ্যাসসমৃদ্ধ) ব্লকসমূহ থেকে বঞ্চিত হতে যাচ্ছি এবং ইটলসের রায়সম্ভূত সীমা নির্ধারণী রেখা পশ্চিম দিকে তীর্যকভাবে চলে বাংলাদেশের অংশের ই.ই.জেড এবং এর ধারাবাহিকতায় মহিসোপানকেও কৌণিকভাবে সংকীর্ণ করে দেবে। শুধু তাই নয়, এই রায় ভারতের সাথে আমাদের হেগের মামলার ফলাফলকেও প্রভাবিত করতে যাচ্ছে। ফলে আমাদেরকে চূড়ান্ত নিত্তিতে একটি ‘ জোনলক্ড্' (Zone-Locked) কন্টিনেন্টাল শেল্ফ্ লাভের দিকে চালিত হতে যাচ্ছে। সুতরাং বেশি উচ্ছবাস দেখিয়ে বা বাহ্ বাহ্ কুড়িয়ে লাভ নেই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন