একুশে পদক জাতির শ্রেষ্ঠ পুরস্কারের
অন্যতম একটি। সেসঙ্গে বাংলা একাডেমী পুরস্কারও মর্যাদাসম্পন্ন। জাতির জন্য
অবদান রাখলে একুশে পদক এবং সাহিত্যে অবদান রাখলে বাংলা একাডেমী পুরস্কার
লাভ করা সম্ভব। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকে একুশ, বাংলা একাডেমী এবং
স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে অর্থাৎ পদক প্রাপ্তদের মনোনয়নে
পক্ষপাত, দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি বা অস্বচ্ছতা দেখা যায়নি অনেকগুলো বছর। ফলে পদক
তালিকা নিয়ে বিতর্কও সৃষ্টি হয়নি।
সম্প্রতিকালে বিভিন্ন সময়ে এই পদক
তালিকায় এমন ব্যক্তিদের নাম উঠে আসে যে, তা বিতর্কের জন্ম দেয়। যেমন কৌতুক
অভিনেতা এবং ‘ইত্যাদি’ নামক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান নির্মাতা হানিফ সঙ্কেতকে
একুশে পদক দেয়া হয়েছে দু’বছর আগে। জাতির প্রতি তার অবদান কী? জাতিকে
হাসানোই কি তার অবদান? হানিফ সঙ্কেত একুশে পদক লাভ করেছেন, অথচ অনেক
গুণীজন এখনও একুশে পদক পাননি বা রাষ্ট্র দ্বারা মূল্যায়িত হননি। এদের
সংখ্যা কম নয়। এটি একটি উদাহরণ।
এ
কথা সত্যি যে, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশিদের কেউ যখন একুশে পদক বা
বাংলা একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন, তখন প্রত্যেক প্রবাসী বাংলাদেশির বুক
গর্বে ভরে যায়। কিন্তু পদক প্রাপ্ত ব্যক্তির যথার্ততা যখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়,
তখন একুশে পদক বা বাংলা একাডেমী পুরস্কারের মর্যাদাও ম্লান হয়ে যায়। ২০১০
সালে নিউইয়র্কে বসবাসরত বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি শহীদ কাদরী যখন একুশে
পদক লাভ করেন, তখন প্রবাসী বাংলাদেশিরা ভীষণ আনন্দিত হয়েছেন। আবার ২০০৭
সালে যখন পরলোকগত মোজাম্মেল হোসেন মিন্টু বাংলা একাডেমী পুরস্কার লাভ
করেছিলেন, তখন কিন্তু বিতর্কের জন্ম হয়েছিল। সমালোচকদের বক্তব্য হচ্ছে,
মোজাম্মেল হোসেন মিন্টু বাংলা সাহিত্যে এমন কোন অবদান রাখেননি যে, তাকে এই
পুরস্কার দেয়া যায়। ১৯৭৪ সালে ড. জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত এবং ১৯৭৬ সালে দিলারা
হাশেম বাংলা একাডেমী পুরস্কার লাভ করেছেন। তারা বর্তমানে মার্কিন প্রবাসী।
ফলে তাদের জন্য প্রবাসী হিসাবে আমরাও গর্বিত। এ বছর একুশে পদক পেয়েছেন
নিউইয়র্কের পরিচিত মুখ ‘খান টিউটোরিয়ালস’ এর প্রতিষ্ঠাতা ড. মনসুর খানকে।
তিনি হলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত দ্বিতীয় মার্কিন প্রবাসী বাংলাদেশি। তাকে
একুশে পদক দেয়া হয়েছে, বাংলাদেশি ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষাদান করে নিউইয়র্ক
সিটির ভালো ভালো স্কুলে ভর্তির সুযোগ করে দিতে বিশেষ অবদানের জন্য।
তার
প্রতিষ্ঠান থেকে গত ১৬ বছরে প্রায় ১২ হাজার শিক্ষার্থী সিটির বিভিন্ন ভালো
স্কুলে ভর্তি হবার সাফল্যতা অর্জন করেছে বলে পত্রিকায় খবর প্রকাশ পেয়েছে।
এটিকে বিবেচনা করা হয়েছে মার্কিন শিক্ষাঙ্গনে বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীদের
সাফল্য সৃষ্টিতে ড. খানের অবদানকে। ‘অবদান’ শব্দটির অর্থ নিয়েই বিতর্কের
জন্ম হয়েছে। ড. খান নিউইয়র্কে একটি টিউটোরিয়াল প্রতিষ্ঠান খুলেছেন
ব্যবসায়িক কারণে। এই টিউটোরিয়াল প্রতিষ্ঠানটি ছিল ড. খানের পরিবারের
জীবিকা উপর্জানের মাধ্যম। ‘খান টিউটোরিয়াল’ বাংলাদেশি কমিউনিটিতে
বাংলাদেশি মালিকানাধীন প্রথম টিউটোরিয়াল প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান থেকে
প্রতি বছর বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীরা ভালো ভালো স্কুলে ভর্তির সুযোগ
পাচ্ছে-এ কথা ঠিক। আরো বেশ কয়েকটি টিউটোরিয়াল প্রতিষ্ঠান থেকেও বাংলাদেশি
ছাত্র-ছাত্রীরা ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে। সংখ্যার দিক থেকে খান টিউটোরিয়াল
সবার চেয়ে এগিয়ে আছে। অন্য কোন বাংলাদেশি মালিকানাধীন টিউটোরিয়াল
প্রতিষ্ঠান থেকে উল্লেখযোগ্য হারে ছাত্রছাত্রী সিটির খ্যাতিসম্পন্ন ভালো
স্কুলে ভর্তির সুযোগ পেলে ঐ প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারকে সরকার একই অবদানের
স্বীকৃতি স্বরূপ ‘একুশে পদক’ দেবে-এ কথা কেউ বলতে পারবেন? বলার অপেক্ষা
রাখে না, খান টিউটোরিয়াল কিংবা এ ধরনের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান
ছাত্র-ছাত্রীদের টিউটোরিং করার বিনিময়ে অর্থ নিয়ে থাকে। খান টিউটোরিয়ালের
সকল ছাত্র-ছাত্রীকে ক্লাসে প্রবেশের আগে অর্থ চুকিয়ে দিতে হয়। অধিকাংশজন
নগদ অর্থ প্রদান করে থাকে। এই পদ্ধতি মার্কিন সমাজে অনেক প্রশ্নের জন্ম
দেয়। যে পরিমাণ নগদ অর্থ এই প্রতিষ্ঠানে উপার্জিত হয়, এর যথাযথ আয়কর দেয়া
হয় কিনা-এ নিয়ে প্রশ্ন আছে। এই প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে অস্বচ্ছতা এবং
নৈতিকতার বিষয়টিও চলে আসে। বিভিন্ন সময়ে একাধিক অভিবাবক অভিযোগ করেছেন,
খান টিউটোরিয়ালে কোন ছাত্রকে বিশেষ ছাড় দেয়া হয় না। ঘন্টায় ২৫ ডলার
পেমেন্ট করিয়ে অনেক বাবা-মা তার সন্তানকে এখানে টিউটোরিং করাতে পারেন না।
তাহলে ঐ সকল বাবা-মা বা তাদের সন্তানের প্রতি খান টিউটোরিয়াল কী অবদান
রেখেছে বা রাখছে? আরেকটি বিষয় হল, খান টিউটোরিয়ালে ভর্তি হতে
ছাত্র-ছাত্রীদের মেধা যাচাইয়ের পরীক্ষা নেয়া হয়। জানা গেছে, নূন্যতম মেধা
না থাকলে ঐ ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তি নেয়া হয় না এই টিউটোরিয়ালে। এই
টিউটোরিয়ালে মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের গাইড করিয়ে ভালো স্কুলে ভর্তির সুযোগ
করিয়ে দেয়ায় কতটা অবদান দাবি করা যায়? যদি এমন হত, একেবারেই মেধাবী নয়,
এমন ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তি করিয়ে তাদের মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীতে পরিণত
করছে-তাহলে এই টিউটোরিয়ারে অবদান বিশেষভাবে বিবেচনা করা যেত। টিউটোরিয়াল
ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালু করে মার্কিন অভিবাসী সমাজে ‘খান টিউটোরিয়াল’
বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীদের জন্য অবদান রাখছে এই কারণে সরকার যদি তাকে একুশে
পদক দেয়, তাহলে এখানে প্রথম বাংলাদেশি মাছ-মাংশ শব্জির দোকান (গ্রোসারী)
খোলার জন্য ‘বাংলা বাজার’ গ্রোসারী’র (এস্টোরিয়ায় ৩০ এভিনিউতে প্রথম চালু
হয়েছিল) মালিককে, বা ম্যানহাটানে প্রথম বাঙালি রেষ্টুরেন্ট (কস্তুরি)
খোলার কারণে নির্মল পালকেও সরকার এমন পদক দিতে পারে। নিম্ন আয়ের (এ
পর্যন্ত) ৮ শতাধিক বাংলাদেশিকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আইটি সেক্টরে ঈর্ষণীয়
বেতনের চাকরি দিয়েছে পিপল এন টেক। এর সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পেলে পিপল এন টেক
এর কর্ণধার আবু হানিপকে একুশে পদক দেবে কি সরকার? কিন্তু আমরা জানি, এমন
হবে না। কারণ, সরকারের উচ্চ পর্যায়ে তাদের সখ্যতা বা যোগাযোগ নেই। অনেকে
জানেন, ড. খান এর স্ত্রী নাঈমা খান শেখ রেহেনার স্কুল জীবনের বান্ধবী।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন