সোমবার, ৯ জানুয়ারী, ২০১২

তিতাস নদীর বাঁধ কেটে দেশ রক্ষা করতে হবে


ভারতকে করিডোর সুবিধা দিতে গিয়ে বর্তমান সরকার বাংলাদেশের অভ্যন-রে তিতাস নদীসহ ছোট বড় ১৮ নদীতে বাঁধ দিয়েছে। নিজ দেশকে চিরতরে পঙ্গু করে অন্য আরেকটি দেশকে এভাবে উজাড় করে দেয়ার নজির বিশ্বে আর কোথাও আছে কি না আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে জানা নেই। ইতোমধ্যে তিতাস নদীসহ অন্যান্য নদীর ওপর তৈরি করা বাঁধের বিরূপ প্রভাব নিয়ে বিভিন্ন দৈনিকে বেশ কয়েকটি রিপোর্ট, সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় প্রকাশিত হয়েছে। টিভিও প্রচার করেছে সচিত্র প্রতিবেদন। দৈনিক আমার দেশ-এর সম্পাদক দেশের খ্যাতিমান লোকজন সাথে নিয়ে তিতাস নদীর বাঁধ কোদাল দিয়ে কেটে প্রতীকী প্রতিবাদ করে এসেছেন।
ভারতের স্বার্থ ক্ষরা করতে গিয়ে দেশ, জাতি ও জনগণের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে এমন সর্বনাশা বাঁধ আওয়ামী লীগের মতো মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি দাবিদার সরকার করেছে ভাবতেও অবাক লাগে! তিতাস নদীর বাঁধসংক্রান- পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টগুলো ও টিভির সচিত্র প্রতিবেদন দেখে চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারিনি। বারবার মন চেয়েছে ওখানে গিয়ে নিজ হাতে বাঁধটি কেটে দিয়ে জনগণের দুঃখ- দুর্দশাকে একটু লাঘব করি।
মিডিয়ায় প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে তিতাস নদীর বাঁধ সম্পর্কে যে তথ্য প্রকাশ পেয়েছে তা রীতিমত ভয়াবহ। যেকোনো দেশপ্রেমিক মানুষ রিপোর্টগুলো দেখলে আতঙ্কিত না হয়ে পারবেন না। ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দিতে প্রায় সাড়ে তিন শ’ টন ওজনবাহী ভারতীয় ট্রেলার চলাচলের সুবিধা করতে একটি নদীর বুক চিরে তৈরি করা হয়েছে এই বিশেষ পথ। আখাউড়া ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া সংযোগস'লে তিতাস নদীতে বছরখানেক আগে সিমেন্ট আর বালুর বস-া ফেলে তৈরি করা হয়েছে এটি। কারণ নদীর ওপর বিশাল ব্রিজ থাকলেও এত ভার বহন করার মতো ক্ষমতা তার নেই। ভারতের ট্রানজিট সুবিধা নির্বিঘ্ন হলেও তিতাসের বুকে বাঁধ দেয়ায় বিরূপ প্রভাব পড়ছে এলাকার লাখ লাখ হেক্টর জমিতে ফলস উৎপাদনে। এরই মধ্যে মাছের অভাবে পেশা বদলাচ্ছেন জেলেরা। তিতাসকে আগলে বেঁচে থাকা নৌকার মাঝিসহ অন্যান্য কর্মজীবী মানুষের জীবনে নেমে এসেছে জীবিকার অনিশ্চয়তা। বাঁধ দিয়ে তিতাস নদীকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়ার কারণ জানতে স'ানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডে যাওয়া হলে কথা বলার মতো পাওয়া যায়নি কাউকেই। জীবিত একটি নদীকে এভাবে দুই ভাগ করে ফেলায় হতবাক, বিস্মিত এখানকার মানুষেরা। দৈনিক আমার দেশ-এর ধারাবাহিক রিপোর্টের একটি রিপোর্টের শিরোনাম হচ্ছে- ‘বাঁধ কাইট্টা দেন আমাদের বাঁচান’। এই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, টিপাইমুখে ভারতের বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে যখন জাতীয় রাজনীতি উত্তপ্ত, তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষের আকুতি, ‘তিতাস নদীর বাঁধ কাইট্টা দেন, আমাদের বাঁচান।’ ভারতকে করিডোর দিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও আখাউড়ার সংযোগস'লে তিতাস নদীতে দেয়া বাঁধ মারণফাঁদে পরিণত হওয়ার শঙ্কায় রয়েছেন এলাকার মানুষ। (আমার দেশ, ১১.১২.২০১১)।
উল্লিখিত রিপোর্টগুলোর আদ্যোপান- না পড়েও যেকোনো কাণ্ডজ্ঞানওয়ালা মানুষ বলে দিতে পারেন একটি নদীতে বাঁধ দিলে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়। ফারাক্কা বাঁধই তার জ্বলজ্যান- সাক্ষী। ফারাক্কা বাঁধের কারণে বাংলাদেশের বিশাল একটি এলাকা মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। ভারত গ্রীষ্মকালে এক ফোঁটা পানি না দিয়ে এবং বর্ষাকালে বন্যার পানি আমাদের দেশে ঠেলে দিয়ে খরা ও বন্যা দিয়ে তিলে তিলে আমাদের ধ্বংস করে ফেলছে। এটি নতুন কোনো খবর নয়, পুরনো খবর। নতুন খবর হচ্ছে টিপাইমুখে বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশের আরেক প্রান-কে মরুপ্রান-রে পরিণত করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে তারা। ভারত তার স্বার্থে যা ইচ্ছে তা-ই করে যাচ্ছে শুধু জোর খাটিয়ে, আন-র্জাতিক কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারত তার স্বার্থের ষোলআনা আদায় করেছে, আমাদের স্বার্থের দিকে তাকায়নি মোটেও।
কিন' ভারতের আবদার মেটাতে গিয়ে খোদ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ১৮টি নদীতে বাঁধ দেয়ার ঘটনা বোধ হয় মানব ইতিহাসে এই প্রথম। নিজের দেশ ও জাতিকে নিজ হাতে হত্যা করার এই নজির বিশ্বের আর কোথাও মিলবে কি না সন্দেহ। আওয়ামী লীগ সরকারের এই দেশবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্য বিরোধী দল দায়ী কম কিসে? বর্তমান সরকার নিজ থেকেই বিরোধী দলের সামনে হাজারো ইস্যু ছুড়ে মারলেও বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো এ নিয়ে কোনো ধরনের আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। পারেনি জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। সংবিধান থেকে আল্লাহর ওপর আস'া বাদ, কুরআনবিরোধী নারী নীতিমালা, সেকুলার শিক্ষানীতি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের আইন বাতিল, শেয়ারবাজারের হাজার কোটি টাকা লুট, অর্থনীতির চরম দুর্দশা, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অগ্নিমূল্য, বারবার তেল বিদ্যুতের দাম বাড়ানো, ভারতকে ফ্রি করিডোর প্রদান, ঐতিহ্যবাহী ঢাকাকে দুই ভাগ, টিপাইমুখে বাঁধ প্রদানে ভারতকে সহায়তাসহ অসংখ্য বাজে দৃষ্টান- স'াপন করেছে এ সরকার। দেশের মানুষ বিরোধী দলের প্রতি চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থেকেও কোনো ফল পায়নি। জনগণ হতাশ হয়েছে বিরোধী দলের অপারগতায়।
বরাবর যে পরিবেশবাদীরা রাজধানীতে একটি পুকুর ভরাট হতে দেখলেও ব্যাপক হইচই শুরু করেছেন। তারাও মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন। দল ও মতের কাছে মাথা বিক্রি করলে যা দশা হওয়ার তা-ই হয়েছে তাদের বেলায়। তা না হলে ১৮টি নদীকে দিনদুপুরে এ সরকার বাঁধ দিয়ে লাখ লাখ মানুষের পেটে আঘাত করল, পরিবেশকে হুমকির মুখে ফেলল অথচ পরিবেশবাদীরা নাকে সরিষার তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছেন! সত্যিই কী বিচিত্র!
ভারতকে করিডোর দিতে গিয়ে বর্তমান সরকার আমাদের দেশের বিভিন্ন নদীতে যে বাঁধ তৈরি করেছে, এর বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে জনগণকে সচেতন ও এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে সব পত্রপত্রিকা ও টিভি মিডিয়াকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের চোখের সামনে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি সোনার বাংলাদেশ পঙ্গু হয়ে যাবে তা মেনে নেয়া যায় না।
তাই আসুন, বাংলাদেশের অভ্যন-রে নদীগুলোকে খুন করে যে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে সেই বাঁধগুলো নিজ হাতে কেটে দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কষ্ট লাঘবে এগিয়ে যাই। দেশপ্রেমের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে জনগণকে সাথে নিয়ে কোদাল নিয়ে বাঁধ কেটে প্রমাণ করি আমরা দেশের পরম বন্ধু। এ কাজটি করতে পারলে এটিই হতে পারে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ক্ষরা আন্দোলনের মাইলফলক।
॥ মুহাম্মদ আমিনুল হক ॥
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, আন-র্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম
aminulhoque_iiuc@yahoo.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন