মঙ্গলবার, ১০ জানুয়ারী, ২০১২

এখন ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ নয়!

 কয়েকদিন আগে ‘একুশে টেলিভিশন’ চ্যানেলের মাধ্যমে তিতাস নদীর বুকে বাঁধ দিয়ে বা রাস্তা নির্মাণ করে নদীটিকে দ্বিখ-িত করার খবর জানা যায়। তিতাস নদীতে রয়েছে দু’টি সাঁকো। একটি সাঁকোর ওপর রয়েছে রেল লাইন। অপর সাঁকোটি কংক্রিটের তৈরি। কিন্তু এই দু’টি সাঁকোর ওপর দিয়ে ভারতের ১৪০ চাকা বিশিষ্ট ৩৫০ টনী ট্রেইলারের চলাচল শুধু ঝুঁকিপূর্ণ নয় ঐসব সাঁকো ভেঙে পড়ার আশঙ্কাও প্রবল। তাই শুধু ভারতীয়দের জন্য মেরে ফেলা হয়েছে একটি নদী, যার নাম তিতাস। এই সেই নদী যার নামে পশ্চিম বঙ্গের কুশলী চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটক বানিয়েছেন একটি নামকরা ছবি, যার নাম ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। এ সম্পর্কে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়া সীমান্ত পর্যন্ত করিডোর পেতে তিতাস নদীসহ ১৮টি ছোট নদী ও খালে বাঁধ দিয়েছে ভারতীয়রা। বাংলাদেশের কোনো সংস্থাকে এর সঙ্গে জড়ানো হয়নি। ভারী গাড়ি যাতায়াতের জন্য ভারতীয় কোম্পানি এ বি সি নিজস্ব তত্ত¦াবধানে বাঁধগুলো তৈরি করেছে। ব্রিজ থাকার পরও নদী-খালে বাঁধ দিয়ে পানিপ্রবাহ বন্ধ করে দেয়ার বিষয়ে বাংলাদেশের কোনো সংস্থাকেই জানানো হয়নি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়ক ও জনপথ বিভাগের একজন প্রকৌশলী বলেন, রাস্তাগুলো এই বিভাগের নিয়ন্ত্রণে। অথচ ভারতীয় ভারী যানবাহন যাতায়াত শুরুর আগে ব্রিজের পাশে নদীতে বাঁধ দেয়া হয়েছে, রাস্তায় কিছু মেরামত কাজ করা হয়েছে- এসব বিষয়ে সড়ক ও জনপথ বিভাগকে কিছুই জানানো হয়নি। সড়ক ও জনপথ বিভাগ কিছুই জানত না। সড়ক ও জনপথ বিভাগকে সম্পূর্ণ পাশ কাটিয়ে এসব করা হয়েছে। রাস্তা থাকার পরও বিভিন্ন মোড়ে বাইপাস করা হয়েছে। কিভাবে হলো সেটা কেউ জানলো না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভারত তাদের মালামাল পশ্চিমাঞ্চল থেকে পূর্বাঞ্চলে পৌঁছাতে করিডোর হিসেবে ব্যবহার করে বাংলাদেশকে। বর্তমান সরকার মতায় আসার পর ভারতকে এই করিডোর দেয়া হয়। পশ্চিমাঞ্চল থেকে প্রথমে জাহাজে করে মালামাল নিয়ে আসা হয় আশুগঞ্জ নদীবন্দরে। সেখান থেকে সড়কপথে পৌঁছানো হয় আখাউড়া সীমান্ত দিয়ে আগরতলায়। আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়া সীমান্ত পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার হচ্ছে সড়কপথ। এ পথ ভারতীয় ১৪০ চাকার ভারি যানবাহন চলাচলের উপযোগী নয়। ব্রিজ ও কালভার্টগুলো এই যান ধারণের মতা রাখে না। এজন্য ভারত নিজেই নিজের মতো করে ব্রিজ-কালভার্টের পাশে বাঁধ দিয়ে রাস্তা তৈরি করে। এতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রাণ হিসেবে পরিচিত তিতাস নদীতেও বাঁধ দিয়ে রাস্তা তৈরি করে ভারত। রাস্তার সাময়িক মেরামত ও ব্রিজ-কালভার্টের পাশে বাঁধ তৈরি করতে ভারত তাদের দেশি কোম্পানি ‘ও টি জি এল’কে দায়িত্ব দেয়। ও টি জি এল আবার ভারতীয় কোম্পানি ‘এ বি সি’কে দায়িত্ব দেয় কাজটি তদারকি করার। এ বি সি বাংলাদেশের ‘গালফ’ নামের একটি কোম্পানিকে কাজটি করার দায়িত্ব দেয়। গালফ বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে রাস্তার মেরামত ও নদী-খালে বাঁধ দেয়ার কাজটি করিয়ে নেয়। কাজ চলাকালীন পুরো তদারকি করেছে ভারতীয় কোম্পানি এ বি সির লোকরা।
আখাউড়ার সুলতানপুর থেকে সীমান্ত পর্যন্ত রাস্তার মেরামত কাজ করেছে ‘আবদুল মোমেন লিমিটেড’ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ওই প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকারের কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান এই কাজে জড়িত ছিল না। আবদুল মোমেন লিমিটেড গালফ থেকে কাজ পেয়েছে। গালফ পেয়েছে ভারতীয় কোম্পানি এ বি সি থেকে। তিনি জানান, আরও কয়েকটি বাংলাদেশী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ভাগে মেরামত ও বাঁধ নির্মাণের কাজ করেছে। কাজের তদারকি করেছে ভারতীয় লোকজন। বাংলাদেশ সরকার বা রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠানকে কোনো রকমের তদারকি করতে দেখা যায়নি বলে জানান আবদুল মোমেন লিমিটেডের ওই কর্মকর্তা।
এখানে বাংলাদেশের কোনো সার্বভৌমত্ব নেই
ওপরে বর্ণিত বাঁধ বা সাঁকো নির্মাণের কাহিনী থেকে স্পষ্ট হচ্ছে যে কিভাবে বাংলাদেশের হাসিনা সরকার ভারতের কাছে জাতীয় সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দিচ্ছে। আমাদের নদীতে এসে বাঁধ দিচ্ছে ভারতীয়রা। নির্মাণ করছে তারা, তত্ত¦াবধানও করছে তারাই। একটি দেশের নদীকে দুই ভাগ করা হলো। তারপরেও বাংলাদেশের কোনো সংস্থাকেই নাকি সেটি জানানো হয়নি। সমগ্র বিষয়টি সড়ক ও জনপথ বিভাগের অধীনে। অথচ তাদের সম্পূর্ণ পাস কাটিয়ে এগুলো করা হচ্ছে। এত বড় একটি কাজ হলো, অথচ বাংলাদেশ সরকার সম্পূর্ণ অন্ধকারে, এমন কথা কি বিশ্বাস করা যায়? সড়ক ও জনপথ বিভাগ জানতে না পারে, পানি উন্নয়ন বোর্ড জানতে না পারে, কিন্তু শেখ হাসিনার সরকার জানে না, এটি সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য ও অগ্রহণযোগ্য।
বাংলাদেশের কোনো কর্তৃত্ব নাই
গত সোমবার রাতে একুশে টেলিভিশনের খবরে দেখানো হয় যে, এই রাস্তা বা বাঁধের ওপর দিয়ে যেসব ভারতীয় ভারী যানবাহন চলাচল করছে সেগুলো চেক করার কোনো মতা বাংলাদেশীদের নেই। তাদের কন্টেইনার বা কার্গোতে কোন ধরনের আইটেম যাচ্ছে সে সম্পর্কে বাংলাদেশী কর্মকর্তরা কিছুই জানেন না। ওগুলোর মধ্যে কি বিস্ফোরক দ্রব্য আছে, গোলাবারুদ আছে, নাকি অস্ত্রশস্ত্র আছে, নাকি অন্য কোনো বাণিজ্যিক পণ্য আছে, সেগুলো চেক করার কোনো মতা বাংলাদেশীদের নাই। ওগুলো যেভাবে আসছে সেভাবে ছেড়ে দিতে হচ্ছে।
আংশিক বলি দেয়া হয়েছে সার্বভৌমত্ব
কোনো একটি ভূখ-কে যদি রাষ্ট্র বলতে হয় তাহলে তার ৪টি অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ থাকতে হয়। এই ৪টি উপকরণ হলো (১) নিন্দিষ্ট ভূ-খ- (২) জনগোষ্ঠী (৩) সরকার (৪) সার্বভৌমত্ব। এরমধ্যে ভূ-খ- নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো অবকাশ নাই। কারণ ভূ-খ- না হলে রাষ্ট্র হতেই পারে না। তেমনি সরকারও আবশ্যকীয় শর্ত। কিন্তু যুগের বিবর্তনে দেখা যাচ্ছে যে, একটি দেশ বা রাষ্ট্রের একটি সরকার থাকলেই  সেটি স্বাধীন সরকার হয় না। সেটার বড় প্রমাণ হলো বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকার। শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারকে কেউ আর স্বাধীন সরকার বলতে চায় না। এই সরকার এমন আচরণ করে যা দেখে মনে হয় যে এটি বুঝি ভারতের কোনো একটি অঙ্গরাজ্যের সরকার। নিজের মান মর্যাদা তারা নিজেরাই খুইয়ে বসে। যদি স্বাধীন সরকারের ব্যক্তিত্ব ও দৃঢ়তা হাসিনা সরকারের থাকতো তাহলে তারা তিস্তার পানি নিয়ে আলোচনার জন্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির কাছে ছুটে যেতেন না। দীপু মনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। পানি নিয়ে হোক আর অন্য যেকোনো বিষয় নিয়ে হোক না কেন, ভিন দেশের সাথে কোনো সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে যদি কথা বলতেই হয় তাহলে তিনি সেই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে কথা বলবেন। কিন্তু বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি তিস্তার পানি নিয়ে কথা বলার জন্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির সাথে দেখা করলেন কেন? মমতা ব্যানার্জিকে যদি দৃশ্যপটে আনতেই হয় তাহলে সেটি করবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী বা ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তারা মমতার সাথে কথা বলবেন এবং অতঃপর তাদের পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবেন। এরপর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে বৈঠক করবেন। সেই বৈঠকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যদি প্রয়োজন মনে করেন তাহলে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে ডাকতে পারেন। কিন্তু সার্বভৌম সমতার সেই নীতি মমতা ব্যানার্জির সাথে বৈঠক করে জলাঞ্জলি দেয়া হয়েছে।
চার দশক পর ভারতীয় চলচ্চিত্র
১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর বাংলাদেশে ভারতীয় ছবি প্রদর্শনী নিষিদ্ধ হয়ে যায়। তারপর দীর্ঘ ৪৫ বছর পার হয়ে গেছে। বাংলাদেশে ভারতীয় সিনেমা আর প্রদর্শন করতে দেয়া হয়নি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারতীয় ছায়াছবি প্রদর্শনের একটি সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৪০ বছর হয়ে গেল, ইন্ডিয়ান সিনেমা বাংলাদেশে ঢুকতে পারেনি। কিন্তু এইবার ২০১১ সালে শেখ হাসিনার রাজত্বকালের তৃতীয় বর্ষে ভারতীয় ছায়াছবি বাংলাদেশে প্রদর্শনের অনুমতি পেয়েছে। গত  শুক্রবার থেকে মহাসমারোহে সেগুলোর প্রদর্শনও শুরু হয়েছে। প্রথমে দেখানো হবে তিনটি বাংলা ছবি। তারপর ৯টি হিন্দি ছবি। হিন্দি ছবির মধ্যে রয়েছে ‘ওম শান্তি’, ‘কাভি আল বিদা না ক্যাহে না’, ‘থ্রি ইডিয়টস’, ‘মাই নেম ইজ খান’, ‘রং দে বাসন্তী’ এবং ‘ম্যায় হু না’ প্রভৃতি। এবার হাসিনার সরকার বাংলাদেশে ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের পথ খুলে দিয়েছে। ভারতের চরণতলে বাংলাদেশ তার সার্বভৌমত্ব আর কতখানি বিসর্জন দেবে? তারা ফারাক্কা চুক্তি করেছে। চুক্তি মোতাবেক বাংলাদেশ পানি পাচ্ছে না। ভারত বাংলাদেশকে তিস্তার পানি দেয়নি। কিন্তু তাতে কি হয়েছে? ‘মেরেছো কলসির কানা/ তাই বলে কি প্রেম দেবো না?’ টিপাইমুখে বাঁধ উঠছে। হাজার হাজার কোটি টাকা লাভ করার স্বপ্ন দেখিয়ে এখন বিনা পয়সায় ভারতকে করিডোর দিচ্ছে। বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে গুলি করে একজন ভারতীয়কেও মারা হয় নাই। কিন্তু ভারতীয়রা বিশেষ করে ভারতের বি এস এফ পাখির মতো গুলি করে বাংলাদেশের মানুষ মেরে ফেলছে। সেখানেও প্রতিবাদ করার কোনো সাহস নেই। এভাবে ধীরে ধীরে বাংলাদেশ তার সার্বভৌমত্ব হারাচ্ছে। সার্বভৌমত্ব হারানোর এই প্রক্রিয়া দেশকে কোথায় নিয়ে যাবে সেটা ভেবে দেশপ্রেমিক মহল দিনের পর দিন শংকিত হচ্ছেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন