রবিবার, ২২ জানুয়ারী, ২০১২

উদ্বিগ্ন দিল্লি : ঢাকায় গণতন্ত্রের বিকাশ রুখতে চায় মৌলবাদীরা

 

আনন্দবাজার পত্রিকার খবর

‘উদ্বিগ্ন দিল্লি : ঢাকায় গণতন্ত্রের বিকাশ রুখতে চায় মৌলবাদীরা’ শিরোনামে ভারতের কলকাতা থেকে প্রকাশিত আনন্দবাজার পত্রিকা আজ রোববার এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনটি লিখেছেন আনন্দবাজারের নয়া দিল্লি প্রতিনিধি জয়ন্ত ঘোষাল।
প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ মুজিবের রক্তের দাগ এখন শুকিয়ে গিয়েছে। কিন্তু সাউথ ব্লক মনে করছে, বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থানের আশঙ্কা আগের তুলনায় কমে গেলেও এখনও সেই মৌলবাদী প্রচেষ্টা অব্যাহত। সম্প্রতি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তেমনই একটি প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়ার পরে দিল্লির উদ্বেগ যথেষ্টই বেড়েছে।
এতে আরো বলা হয়, মুজিব খুন হন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। সে দিন বরফ ঢাকা কফিনে মুজিবের লাশ ছিল গাড়ি বারান্দার নীচে। আর্টিলারি ও আর্মাড কোরের সেনারা প্রহরারত। পরের দিন মেজর মহিউদ্দিন কয়েক জন সেনা নিয়ে হেলিকপ্টারে করে লাশ নিয়ে টুঙ্গিপাড়ায় যান। তাড়াহুড়ো করে লাশ দাফন করতে চাপ দেন মেজর মহিউদ্দিন। কিন্তু স্থানীয় মৌলবি সাহেব বলেন, মুসলমানের লাশ ‘গোসল’ না করিয়ে কবর দেয়া যাবে না। সেনাবাহিনী ১০ মিনিট সময় দেয়। তখন তাড়াহুড়ো করে ৫৭০ মার্কা কাপড় কাচা সাবান দিয়ে লাশ গোসল করিয়ে দাফন করা হয়। অভ্যুত্থানকারীরা পরের দিন শেখ মুজিবেরই দীর্ঘদিনের সহকর্মী খোন্দকার মোস্তাক আহমেদকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে মতায় বসান। বেতার ঘোষণার মাধ্যমে সামরিক শাসন জারি হয়। বাংলাদেশের ৪০ বছরের ইতিহাসে একাধিক দফায় সেই সামরিক শাসন চলেছে বেশ কিছু দিন ধরে। এর মধ্যে পদ্মা ও গঙ্গা দিয়ে অনেক পানি বয়ে গেলেও ভারতের আশঙ্কা পুরোপুরি কাটেনি। আজও সিঁদুরে মেঘ দেখলে হাসিনা যেমন ভয় পান, তেমনই ভয় পায় দিল্লিও। আশঙ্কায় থাকেন সনিয়া গাঁন্ধী, মনমোহন সিং অথবা প্রণব মুখোপাধ্যায়।
এই আশঙ্কার যথেষ্ট কারণ আছে। বয়সে নবীন দারিদ্রপীড়িত দেশে সামরিক অভ্যুত্থানের আশঙ্কা সব সময়েই থাকে।
আনন্দবাজার জানায়, প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় সূত্র বলছে, ১৯৫৮ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৬৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১২ বছরে সামরিক বাহিনী দুনিয়ার ৫২টি দেশে ৮৮বার অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল। ফ্রান্স কিংবা গ্রিসের মতো দেশেও সামরিক বাহিনী নানা সময়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করেছে। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, সদ্য স্বাধীন হওয়া দারিদ্রপীড়িত দেশগুলো সামরিক শাসনের প্রধান শিকার। সে দিক থেকে বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম হয়নি। জিয়াউর রহমান বা হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের মতো সামরিক শাসকের অধীনে থাকার অভিজ্ঞতাও আছে সে দেশের।
কিন্তু এখন সেখানে গণতন্ত্র। ভোটে নির্বাচিত হয়েই প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন শেখ হাসিনা। তিনি তো বটেই, সে দেশের সুপ্রিম কোর্টও ধর্মনিরপে রাষ্ট্র হিসেবে গণতন্ত্রের উত্তরণের পথ পরিষ্কার করতে চায়। সেখানে সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টার খবর সবার কাছেই উদ্বেগজনক। দিল্লির কাছে আরো উদ্বেগের, এই প্রচেষ্টার পিছনে কাজ করছে বাংলাদেশী সেনাবাহিনীরই কট্টরপন্থী একটি অংশ। যে অংশটির উপরে প্রভাব বিস্তার করে হাসিনাকে উৎখাতের চেষ্টা করছে পাকিস্তানি সেনা তথা আইএসআই। ভারতেও তো সম্প্রতি সেনাপ্রধানের সাথে প্রতিরামন্ত্রীর সংঘাত হয়েছে। তাতে কি কপালে ভাঁজ পড়েনি মনমোহন সিংহের? পড়েছে। কিন্তু সাউথ ব্লকের এক কর্তার ভাষায়, এ দেশের গণতন্ত্র যথেষ্ট পরিণত। তাই এই বিরোধ ভারত সামলে নিতে পারে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানই ভারতে শেষ কথা বলে। সামরিক বাহিনী নয়। কিন্তু প্রতিবেশী পাকিস্তান ও বাংলাদেশ দু’দেশেই এ মুহূর্তে সামরিক বাহিনী সক্রিয়। তবে পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের অনেকটাই ফারাক। পাক সেনা দীর্ঘদিন ধরে একটি সমান্তরাল শাসনব্যবস্থা এবং কর্তৃত্ব তৈরি করেছে। তা ছাড়া তাদের উপরে জামায়াত-আইএসআই তথা মোল্লাতন্ত্রের প্রভাব যথেষ্ট। বাংলাদেশের েেত্র কিন্তু কট্টরপন্থীরা এতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে সে দেশের জন্ম। তাই সেখানে ইসলামী ধর্মীয় সত্তার পাশাপাশি বাঙালি জাতিসত্তাও যথেষ্ট গুরুত্ব পায়। নাগরিক সমাজ বাংলাদেশে তাই সমান শক্তিশালী। তারাও গণতন্ত্র বাঁচিয়ে রাখতে চায়।
আনন্দবাজারের ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, দিল্লির চিন্তার কারণ, এই গণতন্ত্রের বিকাশকে আঘাত করতে চায় পাকিস্তানি মৌলবাদীরা। তারা নিজেদের দেশের মতোই বাংলাদেশেও ইসলামী মৌলবাদী সত্তাকে উস্কে দিয়ে গণতন্ত্রের পুনরুত্থানের সামনে চিনের প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে পড়তে চায়। সে জন্য তারা বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর কট্টরপন্থী অংশটিকে কাজে লাগাতে চাইছে। যেমন ভাবে ১৯৭৫ সালে তারা মুজিবকে খুন করিয়ে সামরিক শাসনের পথ পরিষ্কার করেছিল। এ বারে অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে ঠিকই। কিন্তু গণতন্ত্রের মধ্যেই সেই আশঙ্কা আবার তৈরি করে দিয়েছে।
পত্রিকাটি জানায়, দেশে এখন পাক সেনাবাহিনীর অবস্থা কেমন? পাক সেনাপ্রধান এই মুহূর্তে চাইছেন ভোটের আগেই প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারিকে মতাচ্যুত করতে। আপাতত প্রত্যভাবে না হলেও পাক সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির সাহায্য নিয়ে সেনাবাহিনী জারদারি-বিরোধী অভিযান চালাচ্ছে। কিন্তু গিলানি ও জারদারি অপ্রত্যাশিতভাবে একজোট হয়ে গিয়েছেন। পাকিস্তানের নাগরিক সমাজও ক্রমে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। ফলে আগের মতো এত সহজে পাকিস্তানেও সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানো যাচ্ছে না। এমনকী, এক সময়ে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মতায় আসা পারভেজ মুশাররফও বলেছেন, ভোটের মাধ্যমেই এখন ঠিক হবে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ। কোনো সামরিক অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা তিনি উড়িয়ে দিয়েছেন। এ অবস্থায় পাকিস্তান কিন্তু বাংলাদেশে অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা জারিই রেখেছে। কারণ, শেখ হাসিনা মতাসীন হওয়ার পর প্রায় আড়াই বছর অতিবাহিত। তার সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা বাড়ছে। এ সুযোগ কাজে লাগাতে চাইছে পাক সেনা। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও মনে করে, যখন শেখ হাসিনা সঙ্কীর্ণ মৌলবাদ পরিহার করে ধর্মনিরপে রাষ্ট্র গঠনে সচেষ্ট হচ্ছেন, যখন তিনি উন্নয়নমুখী বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে চাইছেন, ঠিক তখন তারা সামরিক বাহিনীর ভিতর মৌলবাদের প্রভাব বাড়িয়ে হাসিনা সরকারকে আঘাত হানার চেষ্টা করছে। এ প্রচেষ্টাকে গণতন্ত্রের দু:সময় বলে মনে করছে ভারত। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নন, এমন জেনারেল এবং বিচারপতিরাও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের তোয়াক্কা না করে যদি দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে উঠতে চান, তাহলে ভারত তা সমর্থন করবে না। তা সে বাংলাদেশই হোক বা পাকিস্তান।
আনন্দবাজার জানায়, দিল্লি আরো মনে করছে, সেনাবাহিনী, বিশেষ করে সেনাপ্রধানের সাথে এখন মধুর সম্পর্ক অটুট রাখা উচিত হাসিনার। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও সেই পথে হেঁটেই ঘটনার দিন সেনাবাহিনীকে দিয়ে সংবাদ সম্মেলন করিয়েছিলেন। তিনি জানেন, ইসলামী ধর্মীয় সত্তার মোকাবিলা করতে হবে বাঙালি জাতিসত্তা দিয়েই। ভারত মনে করে, এ ভাবে ধর্মনিরপে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনই হাসিনার কাছে এখন সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন