বুধবার, ২৫ জানুয়ারী, ২০১২

আসিফ নজরুলের ঘরে চড়াও হওয়া কেন?

(অধ্যাপক আসিফ নজরুলের কক্ষে দুর্বৃত্তদের হামলার প্রতিবাদে নিবেদিত)


যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে টেলিভিশন টকশো-তে সৎ-উদ্দেশ্য নিয়ে যুক্তিসঙ্গত কথা বলার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুলের অফিস কক্ষে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার বিরুদ্ধে কোনো জোর প্রতিবাদ কোনো মহল থেকেই উঠতে দেখা যায়নি। এ থেকে বোঝা যায়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষেও কোনো যুক্তিসঙ্গত কথা বলাও এখন বিপজ্জনক। তবু বিবেকের তাড়নায় কিছু সত্যকথা না বলে পারা যায় না। সেই তাগিদেই আসিফ নজরুলের ওপর হামলার প্রতিবাদে এবং প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয়ে আজকের এই লেখা।
প্রথমেই বলে নেই, বাজারে একদিকে যুদ্ধাপরাধের বিচারকে এক বিশেষ মহলের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে এর বিপরীতে আরেক মহলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের বিচার বাধাগ্রস্ত করার অপচেষ্টার অভিযোগও রয়েছে। এই দুই ধরনের অভিযোগই অনভিপ্রেত। কারণ, দেশের মানুষ এ দুটোর একটিও দেখতে চায় না। দেশবাসী প্রকৃত যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার চায়। আর শুধু একাত্তরের নয়, একাত্তর-পরবর্তী সকল মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারও চায় জনগণ। আবার বিচারের নামে কোনো প্রহসনও কেই দেখতে চায় না। কিন্তু জনগণ না চাইলেও প্রহসন কি বন্ধ থাকে? এইসব নিয়েই কিছু কথা এখানে পাড়তে চাই।
এক.
সম্প্রতি একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ২০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ‘যুদ্ধাপরাধের বিচারের আন্দোলনের ২০ বছর : সাফল্য ও ব্যর্থতা’ শীর্ষক এক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সভায় সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সভাপতি ও সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী এ.কে খন্দকার বলেছেন Ñ ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখতে চাইলে টাইব্যুনালের গতি ও মান বাড়াতে হবে। এটি আরো সুসংগঠিত হতে হবে।’ অথচ সরকার ও ট্রাইব্যুনাল কর্তৃপক্ষ বলছেন এর বিপরীত কথা। তাঁরা বরাবর বলে আসছেন যে, ‘ট্রাইব্যুনালের গতি ঠিক আছে, মানও ঠিক আছে, ট্রাইব্যুনালের কর্মকান্ডও পরিচালিত হচ্ছে সুসংগঠিতভাবে।’ সরকারের ভেতরকার দুই মহলের এইরকম পরস্পরবিরোধী বক্তব্য শোনার পর একে প্রহসন ছাড়া আর কী বলা যায়?
দুই.
আলোচনা সভায় সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল আল আবদুল মুহিত খুবই মজার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘যুদ্ধাপরাধের বিচার এক-দুই বছরের ব্যাপার নয়। এটা কোন দিন শেষ হবে বলা মুশকিল।’ প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, দেশের প্রধানমন্ত্রীও একাধিকবার একইভাবে বলেছেন, ‘যুদ্ধাপরাধের বিচার একটা চলমান প্রক্রিয়া।’
বলাবাহুল্য, যুদ্ধাপরাধের বিচার বিতর্কিতভাবে চল্লিশ বছর ঝুলিয়ে রাখার ফলে বিচার নিয়ে ইতিমধ্যে অনেক সন্দেহ ও জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। এই স্পর্শকাতর ইস্যুটি দীর্ঘদিন ঝুলিয়ে রাখার কারণে নতুন প্রজন্মের মধ্যে (যারা সংখ্যায় মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি, তাদের মধ্যে) যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা অন্ধ আবেগে প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের সংখ্যা ছাড়িয়ে বিপুল নিরপরাধ জনগোষ্ঠী পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে। এর ফলে জনগণ বেশি করে বিভক্ত হয়েছে এবং বহির্শক্তির নানাবিধও আগ্রাসন-আধিপত্যের কারণে এরই মধ্যে গোটা জাতির ভয়াবহ ক্ষতি সাধিত হয়েছে। তাই জনগণের জোর দাবি হচ্ছে, জাতির বৃহত্তর ঐক্যের স্বার্থে আর কালক্ষেপণ না করে যুদ্ধাপরাধের বিচার দ্রুত সম্পন্ন করে এই ইস্যুটির সমাপ্তি ঘটানো হোক।
কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে মাননীয় অর্থমন্ত্রীর উপরোক্ত বক্তব্য (বিচার ‘অনন্তকাল’ চলার ‘তত্ত্ব’) পাঠ করার পর আমাদের কাছে তা শুধু প্রহসনই মনে হয়নি, রীতিমতো হতাশাব্যঞ্জকও মনে হয়েছে।
তিন.
ঘাদানিকের ঐ আলোচনা সভায় যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত ট্রাইব্যুনালসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে দুর্বলতা তুলে ধরে মহজোট সরকারদলীয় সাংসদ এবং ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন যথার্থই বলেছেনÑ ‘ট্রাইব্যুনাল গঠন থেকে শুরু করে তদন্ত, মামলা দায়ের পর্যন্ত দুর্বলতা বিদ্যমান’। অথচ এর বিপরীতে ট্রাইব্যুনাল ও সরকারের বক্তব্য হচ্ছে Ñ ‘ট্রাইব্যুনাল গঠনে, যুদ্ধাপরাধের তদন্তে এবং মামলা দায়েরে কোনো প্রকারের দুর্বলতা নেই।’ সরকারের দাবি, ‘সবকিছুই ঠিক মতো চলছে।’ সরকারের মধ্যকার দুই পক্ষের এই ধরনের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যও রীতিমত প্রহসনমূলক এবং বিভ্রান্তিকর।
চার.
একই আলোচনা সভায় ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবির যে বক্তব্য প্রদান করেছেন, তা একদিকে যেমন প্রহসনমূলক ও হতাশাব্যঞ্জক, অন্যদিকে বিভ্রান্তমূলকও বটে! জনাব শাহরিয়ার কবির বলেছেন, ‘২০১৩ সালের মধ্যে যদি বিচার শেষ করা না যায়, তাহলে ২০১৪ সালের নির্বাচনে কী হবে, তা নিয়ে আমরা শঙ্কিত।’ জনাব কবির কী কারণে শঙ্কিত? যুদ্ধাপরাধের বিচার ২০১৩ সালে শেষ না হলে আগামী নির্বাচনে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসতে পারবে না, এ জন্য তিনি শঙ্কিত? কিন্তু অর্থমন্ত্রী আবুল আল আবদুল মুহিত যখন বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধের বিচার এক-দুই বছরের ব্যাপার নয়’ এবং  ‘এটা কোন দিন শেষ হবে বলা মুশকিল’Ñতখন মনে হয়, যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে সরকারের স্ট্র্যাটেজি শাহরিয়ার কবিরের স্ট্যাটেজির বিপরীত। মনে হয় সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচার দেশে ও বিদেশে গ্রহণযোগ্য হওয়ার মতো করতে পারবে না জেনেই তারা আগামী নির্বাচনে ক্ষমতায় আসার জন্য বিচারে কালক্ষেপণ করে জনগণের সামনে যুদ্ধাপরাধ ইস্যুর মূলা ঝুলিয়ে রাখতে চায়। সুতরাং এই দুই পক্ষের পরস্পরবিরোধী কথাবার্তার মধ্যেও কি হতাশা ও প্রহসন কম পরিলক্ষিত হয়?
পাঁচ.
যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে প্রহসনের যেন শেষ নেই। ঘাদানিক আয়োজিত ঐ আলোচনা সভার সভাপতি বিচারপতি গোলাম রব্বানী তাঁর ভাষণে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত শুধুমাত্র প্রমাণিত দোষী ব্যক্তিদেরই বিচার চান না। তিনি দেশের সংবিধান মোতাবেক প্রচলিত গণতান্ত্রিক ধারায় স্বীকৃত ও অনুমোদিত একটি রাজনৈতিক দলের (জামায়াতের) সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার দাবি তুলে বলেছেন Ñ ‘এই দলের বিচার না করে আমরা যুদ্ধাপরাধের রক্তের বীজ রেখে দিচ্ছি।’ বড়ই তাৎপর্যপূর্ণ কথা!
কিন্তু যুদ্ধাপরাধের ‘রক্তের বীজ’ তো জামায়াতের সাইনবোর্ডের মধ্যে থাকে না। রক্তের বীজ থাকে দলের হাজার হাজার নেতা-কর্মীদের মধ্যে। সুতরাং মাননীয় বিচারপতি রব্বানীর ইচ্ছা ও কথামতো ‘যুদ্ধাপরাধের রক্তের বীজ’ নিশ্চিহ্ন করতে হলে তো জামায়াতের সকল নেতা-কর্মীদের ফাঁসিতে ঝুলাতে হয়। আবার রক্ত যেখানে একটা বংশানুক্রমিক ব্যাপার, সে জন্য জামায়াতের সকল নেতাকর্মীর সন্তান-সন্ততিদেরকেও ফাঁসিতে ঝুলানোর দরকার হয়ে পড়ে। জনাব রব্বানী যদি যুদ্ধাপরাধের রক্তের বীজ নিশ্চিহ্ন করতে চান, তাহলে তো তাই করা দরকার হয়ে পড়ে, নাকি? পাঠক লক্ষ্য করুন, কী সাংঘাতিক ‘হিটলারি’ চিন্তা-চেতনার জন্ম নিয়েছে এই স্বাধীন বাংলার মাটিতে। যুদ্ধাপরাধের সুষ্ঠু বিচার আমরা সকলেই চাই। জামায়াতের মধ্যকার প্রকৃত মানবতাবিরোধী অপরাধের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের প্রমাণ সাপেক্ষে উপযুক্ত বিচার হোক এটাও আমরা চাই। আবার জামায়াতের রাজনীতির আমরা কঠোর সমালোচক হলেও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াত ও তার নেতাকর্মীদের সম্পর্কে এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গিকে আমরা ফ্যাসিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বলে মনে করি।
সবশেষে বলবো, যুদ্ধাপরাধের বিচারকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য বিরোধী মহলের অপচেষ্টার কথা হরহামেশাই বলা হয়। কিন্তু বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ বা প্রহসনে পরিণত করার জন্য ‘অর্থাৎ চূড়ান্ত বিশ্লেষণে সুষ্ঠু বিচার বাঁধাগ্রস্ত করার জন্য সরকার ও সরকার পক্ষের উচ্চপর্যায়ের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের বিভ্রান্তিকর, হতাশাব্যঞ্জক ও ক্ষেত্রবিশেষে ‘হিটলারি’ কথাবার্তা কি কম দায়ি? তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার ও সরকার-সমর্থক দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের মুখ বন্ধ না করে আসিফ নজরুলের ঘরে চড়াও হওয়া কেন?
রইস্উদ্দিন আরিফ : রাজনীতিক, লেখক, কলামিস্ট

তারিখ : ২৩-০১-২০১২

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন