রবিবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০১১

টিপাইমুখ বাঁধ : আশ্বাস ও আশ্বস্ত হওয়ার রাজনীতি

কল্লোল মোস্তফা • দিল্লির আশ্বাস, ঢাকার আশ্বস্ত হওয়া আর বরাক নদীর ভাটির ভারতের মণিপুর-মিজোরাম এবং বাংলাদেশের মানুষের প্রতিবাদ বিক্ষোভের মধ্যেই টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে ধারাবাহিকভাবে। সর্বশেষ ২২ অক্টোবর টিপাইমুখ বাঁধ ও জলবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ভারতের ন্যাশনাল হাইড্রোইলেক্ট্রিক পাওয়ার কোম্পানি (এনএইচপিসি), সাটলুজ জলবিদ্যুৎ নিগম লিমিটেড (এসজেভিএন) এবং মণিপুর সরকারের মধ্যে বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার খবর বাংলাদেশের মিডিয়ায় এসেছে ১৯ নভেম্বর। এনএইচপিসি’র ওয়েবসাইট থেকে দেখা যায় পরিকল্পনা অনুসারে ভারত সরকার অর্থ ছাড় করতে শুরু করলে মণিপুর রাজ্যের চারুচাঁদপুর জেলার বরাক নদীর ওপর টিপাইমুখ নামক স্থানে ১৫০০ মেগাওয়াটের এই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটি নির্মাণ করতে সময় লাগবে ৮৭ মাস। গণমাধ্যমে এখন এই খবরটিকে ‘হঠাৎ চুক্তি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে পরিবেশন করা হলেও এর আগে গত ১৩ মে, ২০১০ সালে সাপ্তাহিক বুধবারে ‘টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণে আরো একধাপ অগ্রগতি : সরকার নীরব’ শীর্ষক লেখায় এই তিনটি কোম্পানির মধ্যে ২৮ এপ্রিল, ২০১০ সালে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের ব্যাপারে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছিল। সে সময় বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলো ক্ষমতাসীন সরকার ও শাসকশ্রেণীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে ২০১০ সালের ১২ জানুয়ারির বাংলাদেশ-ভারত যৌথ ইস্তেহারে মনমোহন সিংয়ের দেওয়া ‘বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর কিছু করা হবে না’ জাতীয় ফাঁপা আশ্বাসের প্রচার চালাচ্ছিল, দেশের মানুষকে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের ধারবাহিক অগ্রগতির বিষয়টি জানতে দেয়নি- পাছে টিপাইমুখ বাঁধ ইস্যুটি ভারত-বাংলাদেশের ‘বন্ধুত্বের জোয়ার’-এ বাধা হয়ে দাঁড়ায়!


২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় ভারত-বাংলাদেশ যৌথ ইস্তেহারের দফা ৩০-এ বলা হয়েছিল : ‘‘ভারতীয় প্রধামন্ত্রী টিপাইমুখ প্রকল্পে বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ার আশ্বাস পুনর্ব্যক্ত করেছেন।’’ এরপর ২০১১ সালে মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় ঘোষিত যৌথ ইস্তেহারে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া মনমোহনের বক্তৃতায় একই ‘আশ্বাস’ আবারো উচ্চারিত হয়। খেয়াল করার বিষয় এসব ঘোষণায় মনমোহন কিন্তু কোথাও বলেননি যে, ভারত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করবে না, বলেছে ‘বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর হয়’ এমন কিছু করা হবে না। এটা তো নতুন কোনো কথা নয়, টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনার শুরু থেকেই ভারতের বক্তব্য হলো এটা ভাটি অঞ্চলের আসাম-মণিপুর-মিজোরাম কিংবা বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর তো নয়ই বরং এই বাঁধ নাকি বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি বন্যা নিয়ন্ত্রণ করে বাড়তি উপকার করবে। বাংলাদেশ এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের টিপাইমুখ বাঁধবিরোধীদের কাছে  নদীর প্রবাহ, অববাহিকার কৃষি ও মৎস্যসহ গোটা পরিবেশের জন্য যে বাঁধ ক্ষতিকর, ভারতের কাছে তা রীতিমত ‘উপকারি’। ফলে ধারাবাহিকভাবে ভারত বাঁধ নির্মাণের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে আর বলছে বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর হয় এমন কিছু টিপাইমুখে তারা করবে না। বাংলাদেশের শাসক শ্রেণীও ভারতের এই ফাঁপা আশ্বাস জনগণের কাছে প্রচার করছে।

গত ২০০৯ সালে ভারতের টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের তৎপরতার খবরে সারাদেশে তীব্র গণ-অসন্তোষের চাপে বাংলাদেশ থেকে একটি সংসদীয় প্রতিনিধি দল হেলিকপ্টারে করে টিপাইমুখ ঘুরে এসেও সেই একই আশ্বাসের বাণী শুনিয়েছিল। শুধু তাই না, সাম্প্রতিক বিনিয়োগ চুক্তির খবরের প্রতিক্রিয়ায় সেই প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য সংসদ সদস্য আবদুর রহমান ১৯ নভেম্বর, ২০১১ বিবিসির কাছে বলেছেন : ‘‘প্রতিনিধি দলে আমাদের কারিগরি কমিটি ছিল, তারাও সে জিনিসটি তাদের কাছ থেকে বুঝেছে যে ওখানে ড্যাম বা বাঁধ নির্মাণ করা হলে বাংলাদেশ বরং উপকৃত হবে। কারণ বর্ষা মৌসুমে যখন পানি থাকবে, তখন বাংলাদেশ প্লাবিত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে রক্ষা পাবে এবং যখন শুস্ক মৌসুমে পানি থাকবে না, তখন বাংলাদেশ পানি সেখান থেকে পাবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থ বরং রক্ষিতই হবে।’’ দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে যারা টিপাইমুখ বাঁধ বিষয়ে তদন্ত করতে ভারত গিয়েছিলেন তারা নিজেরাও ভারতের সুরে সম্ভাব্য ক্ষতির হিসাবের বদলে উল্টো ‘উপকার’ হওয়ার কথা বলছেন! যদিও তারা স্বীকার করেছেন ভারত ‘আরও সম্ভাব্যতা যাচাই এবং যৌথ সিদ্ধান্ত নেওয়ার’ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। এখন যখন দেরিতে হলেও গণমাধ্যমে আসলো যে ভারত টিপাইমুখ বাঁধের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তখনো বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিবাদ করেনি, দল্লির বাংলাদেশ হাইকমিশনার তারিক ই করিম এখনো তথ্য জানতে চাওয়ার পর্যায়ে রয়ে গেছেন। ২১ নভেম্বর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মিজারুল কায়েস সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘বাংলাদেশকে ভারত কোনো তথ্য দেয়নি। আমরা ভারতের কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার আশা করেছিলাম। কিন্তু তা পাইনি।’

অথচ বাংলাদেশের বরাক নদীর ওপর এই টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণে সময়মত প্রতিরোধ করা না গেলে তা বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি, পরিবেশ, জীব-বৈচিত্র্য, গাছপালা-বনভূমি, নদীর ওপর নির্ভরশীল দুপারের মানুষের জীবন-জীবিকা ইত্যাদির ওপর ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। বরাক নদী সিলেটের অমলসিদ পয়েন্টের কাছে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে সুরমা ও কুশিয়ারা নামে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশের মোট জলপ্রবাহের উৎসের শতকরা ৯ ভাগ জল আসে এই নদী দিয়ে। ইন্সটিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের (আইডব্লিউএম) গবেষণা অনুসারে টিপাইমুখ বাঁধের মাধ্যমে এই জলপ্রবাহের নিয়ন্ত্রণ ভারতের হাতে চলে গেলে বরাক নদী থেকে অমলসিধ পয়েন্টে সুরমা-কুশিয়ারা-মেঘনা নদীর দিকে পানি প্রবাহ জুন মাসে ১০%, জুলাই মাসে ২৩%, আগস্ট মাসে ১৬% এবং সেপ্টেম্বর মাসে ১৫% কমে যাবে। এ অঞ্চলের প্লাবনভূমির প্লাবনের ধরন, মৌসুম এবং প্লাবিত হওয়ার পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বর্ষা মৌসুমে সুরমা ও কুশিয়ারার প্রাকৃতিক জলপ্রবাহ শুস্ক করার ফলে কমপক্ষে ৭টি জেলা- সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনার ধান উৎপাদন ব্যাহত হবে- যে জেলাগুলোতে দেশের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ধান উৎপাদন হয়। এর মধ্যে সিলেট ও মৌলভীবাজার এলাকাতেই প্লাবনভূমির পরিমাণ কমে যাবে যথাক্রমে ৩০,১২৩ হেক্টর (২৬%) এবং ৫,২২০ হেক্টর (১১%)। আবার ভারতের কথা মতো শুকনো মৌসুমে অমলসিদ পয়েন্টে ১২১% পানি বাড়বে। আর তার ফলে হাওর অঞ্চলের পরিবেশ ও জীবিকার ওপর ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে। বছরে বেশিরভাগ সময় পানির নিচে থাকা ২৫০০০ বর্গকিলোমিটারের হাওর অঞ্চলের ওপর কিন্তু প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ২ কোটি লোকের জীবিকা নির্ভরশীল। এ অঞ্চলের লোকজন জীবিকার জন্য মূলত মাছ ধরে এবং শুকনো মৌসুমে কৃষিকাজ করে। শুকনো মৌসুমে কৃষিকাজ বলতে হাওর অঞ্চলে বোরো ধান চাষ। হাওর অঞ্চল ছাড়া এই উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পাহাড়ি এলাকায় তেমন কোনো ধান চাষ করা যায় না। যে কারণে আশুগঞ্জ, ভৈরব এবং অন্যান্য অঞ্চলের চাল-কলগুলো ধানের জন্য এ অঞ্চলের ওপর নির্ভরশীল। শুকনো মৌসুমে যখন হাওরের পানি কমে যায় তখন তারা বোরো আবাদ করে আর বর্ষা আসার আগেই সে ফসল ঘরে তোলে। বর্ষায় পলি জমে উর্বর হাওরের বুকে তখন সহজেই বোরোর বাম্পার ফলন ঘটে। এখন টিপাইমুখ বাঁধের ফলে শুকনো মৌসুমেও যদি ভারতের ‘বদান্যতায়’ হাওর অঞ্চল পানিতে পূর্ণ থাকে তাহলে কৃষক আগের মতো আর বোরো ধান আবাদ করতে পারবে না।


প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধের একেবারে অক্ষ বা অ্যাক্সিসটিই অবস্থিত হলো বহুল পরিচিত তাইথু ফল্টের ওপর অবস্থিত যা সম্ভাব্য ক্রিয়াশীল একটি ফল্ট এবং ভবিষ্যতের যে কোনো ভূমিকম্পের কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে। তাছাড়া ভারত এবং বার্মার টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষের জন্য এলাকাটি দুনিয়ার অন্যতম একটি ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা। কাজেই এরকম একটি এলাকায় ১৬৮.২ মিটার উচ্চতার একটি জলাধার নির্মাণ করা মানে বাংলাদেশ ও ভারতের পুরো এলাকার জন্য সেধে ঘন ঘন ভূমিকম্প এবং তার ফলে বাঁধ ভাঙার বিপদ ডেকে আনা ছাড়া আর কিছু না। আর বাঁধ ভেঙে গেলে ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে বাঁধের সঞ্চিত পানি মোটামুটি ৫ মিটার উচ্চতা নিয়ে বাংলাদেশে হাজির হবে এবং ২৪-৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পানি তার সর্বোচ্চ উচ্চতা ২৫ মিটারে পৌঁছবে যা প্লাবনভূমির উচ্চতার চেয়ে ৮ মিটার বেশি উঁচু, ফলে প্লাবনভূমিকে ৮ মিটার পানির নিচে তলিয়ে রাখবে ১০ দিন বা তারচেয়েও বেশি সময় ধরে!

কাজেই এসব বিপদ বিবেচনা করে অনেক আগেই বাংলাদেশের উচিত ছিল ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স্বাক্ষরিত গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তিতে উল্লেখিত ‘উভয় দেশের সীমানার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত আন্তর্জাতিক নদ-নদীর পানির অংশীদ্বারিত্ব পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে করা’র প্রতিশ্রুতি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আইন যেমন হেলসিংকি রুল (লন্ডন, আন্তর্জাতিক আইন সংস্থা, ১৯৬৭) কিংবা জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক নদী ব্যবহারের কনভেনশন (১৯৯৭) ইত্যাদির আওতায় টিপাইমুখ বাঁধের ব্যাপারে আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক ফোরামে প্রতিবাদ করা এবং প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক আদালতের স্মরণাপন্ন হওয়া। অথচ বাংলাদেশের নতজানু শাসক শ্রেণীর সেদিকে কোনো নজর তো নেই-ই বরং বাংলাদেশের বন্দর, স্থল ও নৌট্রানজিটের চুক্তি থেকে শুরু করে একের পর এক বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক দাসত্বমূলক চুক্তিতে আবদ্ধ হচ্ছে! এ অবস্থায় শক্তিশালী গণআন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশের শাসক শ্রেণীকে বাধ্য করতে হবে দ্বিপাক্ষিক ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বিষয়টি উত্থাপন করে ভারতের এই টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প ঠেকানোর জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন