মঙ্গলবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০১১

টিপাইমুখ বাঁধ : প্রধানমন্ত্রীর তুঘলকি প্রজ্ঞা

বিজয় দিবস আমাদের সামনে। সম্মানিত পাঠককে বিজয় দিবসের অভিনন্দন। বিজয়ের সে মুহূর্তে কতজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম, তার কোনো সুনির্দিষ্ট প্রত্যয়নপত্র দেয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। গত ৪০ বছরে সরকার যে কাজটি পারেনি, আমার মতো একজন অধমের সে সংখ্যা না জানারই কথা।
সময় যত গড়িয়ে যাচ্ছে, দেশ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ক্রমেই বিদায় নিচ্ছেন। সহায়ক মুক্তিযোদ্ধা, সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা, শব্দশিল্পী মুক্তিযোদ্ধা, সংস্কৃতি জগতের মুক্তিযোদ্ধা, কৃষক-শ্রমিক মুক্তিযোদ্ধা, মন্দিরের পুরোহিত, মসজিদের ইমাম, ঘরের গৃহিণী, বাসচালক, কন্ডাক্টর, পেট্রলপাম্পের কর্মচারী কিংবা স্কুলের শিক্ষিকা হোন। ডজনের পর ডজন বর্ণনা দেয়া যাবে- কত ধরনের সহায়তা ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে করেছেন। যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, তাদের বর্ণনা দেয়ার জন্য বিজয়ের মাস নয়।
যারা বিভিন্ন ধরনের সহায়তা করেছেন তাদের বর্ণনা দেয়াই আমার আজকের উদ্দেশ্য। কিন' এবারের বিজয় দিবসের প্রাক্কালে ‘বিজয় আনন্দ’ বিষাদে পরিণত হয়ে সবার মনে উদ্বিগ্নতা সৃষ্টি করেছে। আজ থেকে দুই সপ্তাহ আগেও মানুষ এতটুকু উদ্বিগ্ন ছিল না। হঠাৎ করে যখন ঘোষণা পাওয়া গেল ঢাকা মহানগরীকে দ্বিখণ্ডিত করা হচ্ছে, ঠিক তখন ঢাকা শহরের এক কোটি মানুষ উদ্বেগ-আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে পড়ল। কয়েক দিন যাবৎ এটি প্রধান আলোচ্য ও দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্মানিত পাঠকের কাছে ঢাকা দ্বিখণ্ডিত করার বিবরণের আগে যে বিষয়টি জানানো দরকার তা হলো, টিপাইমুখ বাঁধ প্রসঙ্গ। কারণ, ঢাকা দ্বিখণ্ডিত হওয়ার খবরের ঠিক আগের খবর হচ্ছে টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ হবে এ মর্মে ভারতীয় সরকারের ঘোষণা।
ক. ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং যখন আমাদের দেশে বেড়াতে এসেছিলেন, তখন বলে গিয়েছিলেন, বাংলাদেশের ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ ভারত সরকার করবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট অডিটরিয়ামে তথা নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী ভবনে তিনি সে ভাষণ দিয়েছিলেন, সুনির্দিষ্ট মনোনীত কিছু ব্যক্তির মধ্যে আমি সেখানে থাকার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমি নিজের কানে তার এই প্রতিশ্রুতি শুনেছি। এখন প্রশ্ন হলো। টিপাইমুখ বাঁধ বাংলাদেশের ক্ষতি করবে-কি-করবে না? এ প্রসঙ্গে সমালোচনা করার মতো আমি অভিজ্ঞ ব্যক্তি নই। আমি পরিবেশবিদ কিংবা পানিবিজ্ঞানীদের মতো অভিজ্ঞ ব্যক্তিও নই। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে- সমালোচনা করার জন্য আমার যোগ্যতা কী? আমি বাংলাদেশের একজন নাগরিক, চিন্তাশীল ব্যক্তি এবং এ দেশের জন্য ১৯৭১ সালে যুদ্ধ করেছিলাম। তাই এ দেশের যেন কোনো ক্ষতি না হয়, সে চিন্তা করার অধিকার আমার আছে। সেনাবাহিনীর উচ্চপদে আসীন ছিলাম। দেশের সার্বিক নিরাপত্তা আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে, নিঃশ্বাসে এবং প্রশ্বাসে বিরাজমান। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে আমার পরিকল্পনা, চিন্তাচেতনা এক দিনের নয়। এটা কয়েক যুগ পুরনো। বারবার ইস্যুটি চোখের সামনে ভেসে আসে। তা ছাড়া ইন্টারনেটের যুগে গোপনীয়তা রক্ষা করা খুবই কঠিন। ইন্টারনেটের মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম এবং বিশ্বের সব মানুষ জানতে পেরেছে, ভারত সরকার টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে কখন কী চিন্তা করেছে। এবং তা কত বছরের পরিকল্পনা। মনিপুরের জনগণ কখন কী দুশ্চিন্তা করেছে, কার কী উদ্বেগ, কার কী অসুবিধা, পৃথিবীব্যাপী পরিবেশবিদেরা এ সম্পর্কে কী বলেছেন এ নিয়ে আগে থেকে সচেতন।
টিপাইমুখ বাঁধ দিয়ে সেখানে যে পানি জমানো হবে আমি সে প্রসঙ্গে বলি। বাঁধ নির্মাণ করে সেখানে পানি জমাতে নাকি দেড় বছর সময় লাগবে। তাহলে এই দেড় বছর সময় অন্তত ওই বাঁধের দরজাগুলো বন্ধ রাখা হবে, যেন পর্যাপ্ত পানি জমতে পারে। তাহলে ওই দেড় বছর আমার দেশের নদী সুরমা, কুশিয়ারা, মেঘনা ও গঙ্গায় পানি কোত্থেকে আসবে?
মনে করলাম ভারত সরকার এবং তার দেশের জনগণ ‘হাতেম তাই’-এর চেয়েও বেশি দয়াবান। তারা আমাদের কোনো ক্ষতি করবে না কিন' তা যদি তাদের বাঁধের পেছনে জলাধারে পানিই জমাতে চায়, এই সময় তারা আমাদেরকে পানি দেবে কোত্থেকে?
দ্বিতীয়ত, যে পরিমাণ পানি জমানো হবে সে পরিমাণ পানির ওজন অবশ্যই ওই ভূগর্ভে পড়বে। তা ছাড়া এটি ভূ-কম্পনপ্রবণ অঞ্চল। অতএব পানি চলাচলের কারণে পানির ওজন ভূগর্ভের এক শ’ থেকে দেড় শ’ মাইল নিচে যদি কোনো ধরনের অসুবিধা সৃষ্টি হয়, তাহলে একটা ভূমিকম্প নিশ্চিতভাবেই হতে পারে। যদি ভূমিকম্প হয়, সেই ভূমিকম্পের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে মনিপুরের জনগণ এবং ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে ওই বাঁধটির। যদি ওই বাঁধে কোনো ধরনের ফাটল সৃষ্টি হয়, তাহলে সে পানি অবশ্যই সেখান থেকে ছুটে পড়বে। ২৪ ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই সে পানি সিলেট শহরে প্রবেশ করবে।
বিভিন্ন সূত্র এবং বৈজ্ঞানিক তথ্যের আলোকে জানতে পারলাম, সিলেট শহরের ওপর দিয়ে তখন আট ফুট উচ্চতার পানির প্রবাহ বয়ে যাবে। বাড়িঘর, দালানকোঠা, বৃক্ষরাজি, পুল-কালভার্ট ইত্যাদি সব কিছু প্রবল স্রোতে তলিয়ে-ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। মুহূর্তেই বিলীন হয়ে যাবে সব কিছু। অতঃপর সে পানি সুরমা নদী দিয়ে এসে পড়বে মেঘনায়, মেঘনা নদী দিয়ে যাবে বঙ্গোপসাগরে। যাওয়ার সময় দুই পাশ ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।
সেখানে যে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে বলে ভারত সরকার বলেছে, সে মর্মে তারা খুব সুন্দর (!!) একটি প্রস্তাব দিয়েছে।
এরা বোঝাতে চাচ্ছে, বাংলাদেশ সরকারও যেন এখানে বিনিয়োগ করে। এবং তার বিনিময়ে এই প্রকল্পের ভাগীদার হবে এবং প্রকল্প থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বাংলাদেশ নিতে পারবে। ভালো (!!)
খ. আমাকে বিষ খাওয়ানোর জন্য যে ফ্যাক্টরি দেয়া হচ্ছে। আবার আমাকে সেই বিষ উৎপাদনকারী ফ্যাক্টরির মালিকানাও দেয়া হচ্ছে। আমি এই নিয়মে এটাকে ব্যাখ্যা করতে চাই। প্রকারান্তরে, যে ব্যক্তি আমার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করবে, সে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরকারী ব্যক্তিকে আমি নিজের হাতে দুধ-কলা, মিষ্টি খাইয়ে স্বাস'্যবান করার দায়িত্বভার নিয়েছি বা নিচ্ছি।
টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প পরিদর্শন করার জন্য আমাদের সংসদীয় কমিটির একটি বিশেষ দল সেখানে গিয়েছিল। সংসদীয় দলের একজন সদস্য যথাসম্ভব হামিদুর রহমান যাননি। ওইখানে যাওয়ার পর তারা কী দেখেছেন, আর কী দেখেননি, তার বিস্তারিত তথ্য আমরা মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পেরেছি। এবং এরূপ জানা গেছে, ওইখানে হেলিকপ্টারে বসে কেউ কোরআন শরিফ পড়ছিলেন, অন্যরা দোয়া-দরুদ জপছিলেন ভয়ে। নিচে নেমে এরা কারো সাথে কথা বলতে পারেননি এবং এলাকা পর্যবেক্ষণও করেননি।
ভদ্রলোকেরা এসে বলে দিলেন সেখানে কোনো বাঁধ হয়নি। নির্বোধ পরিদর্শক দল বললে আমার জন্য বেয়াদবি হবে, তাই বলছি না। কিন' তারা কেন যে দেশবাসীকে নির্বোধ মনে করে এটা অন্তত বলতে পারি।
আপনাদেরকে সেখানে বাঁধ হয়েছে কি হয়নি, কত ফুট উচ্চতায় হয়েছে তা দেখার জন্য তো পাঠানো হয়নি? আপনাদেরকে পাঠানো হয়েছিল বাঁধ হলে আমাদের কী ক্ষতি হবে? কোনো ভয়াবহ বিপদ হবে কি না? সে স'ান পর্যবেক্ষণ করে ফলাফল জানাতে। আর এসে বললেন অন্য কথা।
আজ ভারত সরকার কোনোক্রমেই যৌথ জরিপে রাজি হচ্ছে না। যৌথ সমীক্ষায় বসছে না। বসছে না কোনো পর্যালোচনায়। এটা ভারত সরকারের একগুঁয়েমি, একরোখা ও দাদাগিরিসুলভ আচরণ।
আমরা চতুর্দিকে ভারতবেষ্টিত। সবাই কথাবার্তায় কেন জানি আমাদেরকে চরম অসহায় বানিয়ে ফেলে। এ মর্মে যে, আমাদের চার পাশে ভারত? ভারতের সাথে সম্পর্ক খারাপ হলে আমরা বাঁচব কিভাবে? আমি তাদেরকে ধিক্কার দিই। অপর দিকে আহ্বান জানাই, নিজের মনোবলকে শক্ত করুন।
পৃথিবীতে কি কোনো এতিম বাচ্চা বাঁচে না? যার মা-বাবা, বড় ভাই, বড় বোন কেউ নেই, এমন ব্যক্তি কি পৃথিবীতে উজ্জ্বল হয়নি তার জীবন-সংগ্রামে এবং পেশায়।
পৃথিবীতে কি আর কোনো দেশ নেই? যারা প্রতিবেশী দেশের সাথে বিপদে আছে। তারা কি বেঁচে নেই। এমন কোনো রাষ্ট্র আছে কি- যারা প্রতিবেশীর আক্রমণে ধ্বংস হয়ে গেছে? তাহলে কেন আমরা আমাদের আচরণে এমন মনোভাব ফুটিয়ে তুলি যে, ভারতের সাথে গভীর সুসম্পর্ক ও বন্ধুত্ব না রাখলে আমরা পৃথিবীতে টিকে থাকতে পারব না? আমি বন্ধুত্ব চাই। দাদাগিরি কিংবা নমনীয় নয়।
বাংলাদেশের দু’জন উচ্চপদস' ব্যক্তি, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি। সমপ্রতি দিল্লি থেকে সফর করে এসেছেন। তারা এসে বললেন, টিপাইমুখ বাঁধে খারাপ কিছুই নেই এবং এটি দুশ্চিন্তার বিষয় নয়। এখানে বাংলাদেশের অংশীদার হওয়াই ভালো। এ দুজন প্রতিনিধিদলের উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি। একজন বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তা ছিলেন। অপরজন সারা জীবন বিদেশী সরকারের কর্মকর্তা ছিলেন।
আমি জনগণের প্রতি তাদের ভালোবাসা ও দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন করি? একজন গত মাস ছয়েক আগে বলছিলেন, ট্রানজিট ভারতকে দিব। তার বিনিময়ে মাশুল চাওয়া সভ্যতার নিদর্শন নয়। এই বাংলাদেশ কারো বাপের দেশ নয় যে, তিনি বিনামূল্যে একজনকে এ দেশের মাটির ওপর দিয়ে যেতে দিবেন, আবার আমাদেরকে সভ্যতা শেখাবেন।
আর অন্যজনকে মনেই হয়, তিনি দিল্লির সেবাদাস। তিনি পাঁচ বছর নতুন দিল্লিতে ছিলেন। সে মর্মে নতুন দিল্লির আকাশ-বাতাস এবং মাটি-পানি তার শরীরে ও রক্তে মিশে আছে। এটা বাস্তব সত্য।
কিন' প্রধানমন্ত্রী কেন যে তাকে উপদেষ্টা বানালেন তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। প্রধানমন্ত্রী এবং তার মধ্যে একটা বড় মিল আছে। প্রধানমন্ত্রীও সত্তর দশকের শেষে এবং আশির দশকের শুরুতে দিল্লিতে পাঁচ থেকে ছয় বছর ছিলেন। আর এই উপদেষ্টা মহোদয়ও নব্বইয়ের দশকের শেষে এবং এ দশকের প্রথম দিকে পাঁচ থেকে ছয় বছর দিল্লিতে ছিলেন। সুতরাং দিল্লি যোগ দিল্লি। আমাদের প্রাপ্তি শূন্য।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার সরকারের কাছে আমাদের আবেদন- টিপাইমুখ নিয়ে পুনরায় পর্যালোচনা করুন। আপনাদের ভয়ের কোনো কারণ নেই। বাঁধ হলে এ দেশের ভয়াবহ ক্ষতি হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
তাই বাংলাদেশের জনগণকে বাঁচানোর জন্য আপনি যেই উদ্যোগই নেবেন, সে উদ্যোগে বাংলাদেশের জনগণ আপনাদের পাশে থাকবে। কিন' আপনার উপদেষ্টাদের সামনে না এনে পেছনে রাখুন। তাদেরকে পছন্দ এবং বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। তাদেরকে তিরস্কার করছি এবং তাদেরকে দেশে না থাকার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।
আমি বাংলাদেশের একজন মুক্তিযোদ্ধা জীবিত থাকাবস'ায় তাদের এমন মন্তব্য এবং তাদের দেশে উপসি'তি অসহ্য ও জ্বালাময়ী অনুভব করছি।
গ. টিপাইমুখ বাঁধের জ্বালা মাথা থেকে যাওয়ার আগেই সেই মাথাকে কেটে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলা হয়েছে। কোনো একজন সম্মানিত কার্টুনবিদ যদি কোনো একটি পত্রিকার কার্টুন আঁকতেন যে, একটি মানবদেহে দু’টি মাথা। প্রকৃতির খেয়াল মানুষের পক্ষে বোঝা মুশকিল।
অনেক সময় অনেক শিশু জন্মায়। যেমন দু’টি শিশুর বুক ও পেট মিলিত। দু’টি মাথা আলাদা। অথবা দু’টি শিশু দুই দিকে মুখ করা দু’টি মাথা আলাদা। বুক ও পিঠ এক। অথবা দু’টি শিশুর দু’টি মাথা, কিন' মাথাগুলো পেছনের দিকে এক। অথবা কোনো একটি পাশে মিলিত। আবার এমন শিশুও জন্মেছে দু’টি মাথা একটি দেহ।
এগুলো প্রকৃতির বৈচিত্র্য খেলা এবং ব্যতিক্রম। এটা নিয়ম হতে পারে না। এ ধরনের ব্যতিক্রমী শিশুদের শতের মধ্যে সাড়ে ৯৯ জন শিশুই বাঁচে না।
অথচ বাংলাদেশ সরকার বলেছে, ঢাকাকে দুই ভাগ করা হয়নি। শুধু প্রশাসনকে দুই ভাগ করা হয়েছে।
তাহলে আপনার শরীর কে চালায়- প্রশাসন যন্ত্রের মাধ্যমে আপনার ব্রেইন। সে ক্ষেত্রে শরীর একটি থাক, আপনি দু’টি ব্রেইন বসিয়ে দিন।
একটি ব্রেইন দুর্নীতি করে কিভাবে টাকা পয়সা জমানো যায় সে চিন্তায় মগ্ন থাকবে। অপর ব্রেইন কিভাবে দিনের বেলায় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ কালাম পড়ে সৎ কাজ করা যায় সে চিন্তায় রত থাকবে।
আমি একটি গল্প লিখে আমার লেখা শেষ করব। গল্পটি সবার জানা।
অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র থাকাবস'ায় র‌্যাপিড রিডার হিসেবে পড়ার জন্য পেয়েছিলাম।
বিখ্যাত ঔপন্যাসিক যার ছদ্মনাম ‘যাযাবর’ তথা কলামি নাম যাযাবর। যার অতি বিখ্যাত বইয়ের নাম দৃষ্টিপাত। সেখানে পড়েছিলাম। অন্তত সাত শ’ বছর আগে তুঘলক বংশ দিল্লিতে শাসন করত। তাদের সাম্রাজ্য অনেক বড় ছিল। গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের দ্বিতীয় সন্তান। মুহাম্মদ বিন তুঘলক যখন সিংহাসনে আরোহণ করেন, তখন তিনি চিন্তা করলেন- এত বড় সাম্রাজ্য দিল্লি তো একটু উত্তরে বেশি। তাই রাজধানীকে দক্ষিণ অঞ্চলে নিয়ে যাওয়া হোক। সেই সাত শ’ বছর আগে মানুষজন হাতির পিঠে, ঘোড়ার পিঠে, উটের পিঠে ও খচ্চরের পিঠে চড়ে সব মালামাল নিয়ে রওনা করল নতুন রাজধানীর উদ্দেশে। বিন্দা পর্বত পার হয়ে তুঘলাবাদ।
কথিত আছে যত জন লোক নিয়ে সম্রাট রওনা হয়েছেন, পথিমধ্যে চার ভাগের এক ভাগ লোক মারা যায়। দু-এক বছর নতুন রাজধানীতে ওই বহর ছিল। রাজধানী গড়ে তুলতে ব্যস্ত ছিল তারা। তাদের মধ্যে চার ভাগের আরো এক ভাগ ওই দু-এক বছরে মারা যায়।
এরপর চরম ব্যর্থ ও অসহ্য হয়ে সব শেষে উপদেষ্টাদের পরামর্শক্রমে বাধ্য হয়ে সম্রাট বললেন, রাজধানীকে দিল্লিতে ফেরত নাও। ফেরত আসার সময় চার ভাগের এক ভাগ লোক পথিমধ্যে মারা যায়। অর্থাৎ যতসংখ্যক লোক দিল্লি ছেড়েছে তার চার ভাগের এক ভাগ দিল্লিতে ফেরত আসে। এটাকে উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, ‘তুঘলকি কারবারের উত্তম উদাহরণ’। বাংলাদেশে একটি তুঘলকি কারবার হয়েছে এখন থেকে আড়াই বছর আগে, যখন ঘড়ির কাঁটাকে লাফ দিয়ে এক ঘণ্টা কমিয়ে কিংবা বাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। দেশের লাল বাতি জ্বালানো হয়েছিল। তাই বলছি ঘড়ির কাঁটা নয়, নিজেদের কাঁটাকে ঠিক করুন। এখন দ্বিতীয়বার আরেকটি তুঘলকি কাণ্ড ঘটানো হয়েছে। নিশ্চিতভাবেই মুহাম্মদ বিন তুঘলকের মতো এ কাজটি সরকার বাতিল করবে। তত দিনে চার ভাগের তিন ভাগ লোক রূপক অর্থে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাবে।
ঢাকা মহানগরীকে দ্বিখণ্ডিত করার প্রতিবাদে রোববার হরতাল হয়েছে। অসংখ্য গবেষক এবং বুদ্ধিজীবী লেখালেখির মাধ্যমে প্রতিবাদ করেছেন। দুঃখজনক হলেও অতি সত্য। একটি সংবাদপত্রের বিশ্লেষণ কিংবা কোনো কলামিস্টের লেখায় পেলাম না। কোনো টেলিভিশনের টকশো অথবা কথা বলতে গিয়ে একজন সিএনজি কিংবা রিকশাচালক অথবা অবসরপ্রাপ্ত কোনো সরকারি কর্মকর্তা পেলাম না, যারা এ কর্মকে সমর্থন করেছেন? সমর্থন করেছে একমাত্র আওয়ামী লীগের কিছুসংখ্যক কর্মী। তবে হ্যাঁ, এখানে আওয়ামী লীগের একটি স্বার্থ নিহিত। কারণ দ্বিখণ্ডিত ঢাকার একটি ঢাকায় তারা জিততে চায়। পুরান ঢাকায় তারা জিতবে বলে আশাবাদী। কারণ পুরান ঢাকায় অনেক সম্মানিত হিন্দু ভোটার আছেন, যারা আওয়ামী লীগের দীর্ঘকালের সমর্থক। ইতোমধ্যে অর্পিত সম্পত্তি বিল পাস করা হয়েছে। যেন ১৯৬৫ ও ’৭১ সালে ক্ষতিগ্রস্ত বিতর্কিত অর্পিত সম্পত্তির ঘটনায় যারা সম্পৃক্ত, সে অর্পিত সম্পত্তি ফেরত দেয়ার নামে সে ভোটারদের সামনে একটি মুলা ঝোলানো আছে। পুরান ঢাকায় অর্পিত সম্পত্তি নতুন ঢাকাতে নয়। পুরান ঢাকায় হিন্দু ভোটাররা, নতুন ঢাকায় নেই। তাই পুরান ঢাকাকে আলাদা করা হলো। নতুন সিটি করপোরেশনে যে তাদের পছন্দের একজন প্রার্থী নির্বাচিত হন এবং তা নিশ্চিতভাবে আওয়ামী লীগের মধ্য থেকে হবে।
পাঠক লক্ষ করুন। অর্পিত সম্পত্তি বিল অনেক দিন ঠাণ্ডা ফ্রিজে থাকার পর হঠাৎ করে পাস হয়ে গেল। এবং অর্পিত সম্পত্তি বিল পাস হচ্ছিল না বলে সম্মানিত পার্লামেন্টারিয়ান বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ বর্তমানে রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত কয়েক মাস আগে ধমকের সুরে বলেছিলেন, হিন্দুদেরকে রেজিস্টার্ড আওয়ামী লীগের ভোটার মনে করার কোনো গ্যারান্টি নেই। সেই সুরঞ্জিত বাবুকে মন্ত্রী করা হলো। ঢাকাকে বিভক্ত করা হলো। আর এসব ঘটনা মাত্র সাত দিনের মধ্যে। তাই আমার আবেদন থাকবে- পাঠক যেন বিষধয়গুলো নিয়ে গভীরচিন্তা করেন। কেন এই কাণ্ডগুলো ঘটিয়েছে বর্তমান সরকার? কী স্বার্থ রয়েছে এর পেছনে? বিজয়ের দিবসের আগে দেশকে কোন দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে? (!!)
লেখক : গবেষক, নিরাপত্তা বিশ্লেষক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন