সোমবার, ২৪ অক্টোবর, ২০১১

ক্রসফায়ার নয় ঠাণ্ডামাথায় খুন লাশের দাফন নিয়ে তোলপাড়


উন্নত শির আরব সিংহ মুয়াম্মার গাদ্দাফির লাশ নিয়ে এখন তোলপাড়। তার লাশটি কোথায়—এ নিয়ে গোপনীয়তার বাতাবরণ রক্ষায় নানা গালগল্প মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছিল ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল ট্রানজিশনাল কাউন্সিলের (এনটিসি) শীর্ষ নেতারা। সর্বশেষ তারা জানিয়েছে, লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। গাদ্দাফির মৃতদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এনটিসি। এর আগে গাদ্দাফির লাশটি চেয়ে আর্জি জানিয়েছিল তার হতবিহ্বল ছিন্নভিন্ন পরিবারের জীবিত সদস্যরা। এনটিসি, ওআইসি ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের কাছে তাদের ধরনা—অন্তত লাশ দাফনের মানবিক অধিকারটুকু তাদের দেয়া হোক। গাদ্দাফির জন্মশহর সির্তে ইসলামী শরিয়া অনুযায়ী সাবেক এই লিবীয় মহানায়ক ও তার ছেলে মুতাসসিমকে দাফন করতে চায় তারা।
বিবিসি জানায়, মিসরাতায় গাদ্দাফির লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। এনটিসি কর্মকর্তারা একথা জানিয়েছেন বিবিসিকে। কর্মকর্তারা আরও বলেন, লাশ তার পরিবারের কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত হয়েছে। একই সঙ্গে তারা একথাও বলেন, দাফন এ কারণে বিলম্বিত হচ্ছে— কেননা কী করা উচিত—এ প্রশ্নে এনটিসির শীর্ষব্যক্তিরা দ্বিধায় ভুগছেন। এর আগে মিসরাতায় এনটিসির এক সামরিক কর্তা এএফপিকে জানিয়েছিলেন, লাশের ময়নাতদন্ত হবে না। তার লাশ কেউ কাটাকাটি করতে চাচ্ছে না। এনটিসির কর্তাদের বরাতে এএফপি এমন ধারণা দিচ্ছিল যে, গাদ্দাফির লাশ বিন লাদেনের মতো সাগরে সমাহিত করা হতে পারে। সব মিলিয়ে বিষয়টি এখনও পরিষ্কার নয়—লাশ নিয়ে আদতে কী হচ্ছে। এনটিসি কর্তারা আদৌ কি একমত লাশ পরিবারকে ফেরত দেয়ার ব্যাপারে। তাদের সাগর-দাফন পরিকল্পনাটি কি বাদ গেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর চাপে—এ নিয়ে পরিষ্কার ধারণা মিলছে না।
ওদিকে গাদ্দাফিমুক্ত লিবিয়াকে নতুন করে স্বাধীন ঘোষণার নাটকও বেশ জমজমাট। রোববার স্বাধীনতা ঘোষণা করা হবে আফ্রিকান এই আরব দেশটির। এ নিয়ে নানা প্রশ্ন ও কৌতূহল। লিবিয়া কি তবে এতদিন পরাধীন ছিল! গাদ্দাফি কি তার ৪২ বছরের একচ্ছত্র শাসনে দেশটিকে পরাধীন করে রেখেছিলেন! তবে স্বাধীনতার নামে এসব নাটককে তামাশা ও প্রহসন বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। ইউরো-মার্কিন মিত্রশক্তি—যাদের প্রত্যক্ষ মদতে লিবিয়ার এ দৃশ্যপট বদল—তাদের ঈগল-নজর মূলত লিবিয়ার সমৃদ্ধ তেলসম্পদের দিকে। ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফিলিপ হ্যামন্ড এরই মধ্যে ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের ব্রিফকেস গুছিয়ে ত্রিপোলির দিকে রওনা দিতে বলেছেন। গাদ্দাফির রক্ত না শুকাতেই তার উদাত্ত ডাক—ব্রিটেনের ব্যবসায়ীদের আর নষ্ট করার মতো সময় নেই।
৩১ অক্টোবর লিবিয়া অভিযানের সমাপ্তি - ন্যাটো : লিবিয়ায় পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সাত মাসের অভিযান আগামী ৩১ অক্টোবর সমাপ্ত ঘোষণা করা হবে। গত শুক্রবার ন্যাটোর সদর দফতর ব্রাসেলসে এ ঘোষণা দেয়া হয়েছে। তবে লিবিয়ার অন্তর্বর্তী সরকার এবং জাতিসংঘের সঙ্গে আলোচনা করে আগামী সপ্তাহে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া হবে বলে জানানো হয়েছে।
শুক্রবার ব্রাসেলসে ২৮টি সদস্যদেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা শেষে ন্যাটোপ্রধান অ্যানডার্স ফগ রাসমুসেন সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের লিবিয়া অভিযান শেষ পর্যায়ে এ ব্যাপারে আমরা একমত হয়েছি। ঐক্যবদ্ধ নিরাপত্তা রক্ষক হিসেবে লিবিয়া অভিযান আগামী ৩১ অক্টোবর শেষ করার ব্যাপারে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে এর আগে জাতিসংঘ ও লিবিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে আলোচনা করবেন বলে জানিয়েছেন রাসমুসেন। লিবিয়াতে ন্যাটো সফল হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। তিনি জানান, গাদ্দাফির সর্বশেষ ঘাঁটির পতন এবং তিনি নিহত হওয়ার পর এখন ন্যাটো সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে এবং বেসামরিক লোকদের প্রতি যে কোনো হুমকিতে তারা সাড়া দেবে।
লিবিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা করা হবে রোববার : কয়েক মাসের রক্ষক্ষয়ী সংঘর্ষের পর অবশেষে আগামী রোববার স্বাধীনতা ঘোষণা করা হবে লিবিয়ার। লিবিয়ার বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এ স্বাধীনতার ঘোষণা দেবে বলে জানায় এনটিসির এক মুখপাত্র।
মুয়াম্মার গাদ্দাফির বিরুদ্ধে প্রথম যে শহর থেকে বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল সেই বেনগাজিতেই শনিবার স্বাধীনতা ঘোষণা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মুখপাত্র আবদেল রহমান বুশিন বলেন, আনুষ্ঠানিকতার কারণে একদিন দেরি করে রোববার স্বাধীনতা ঘোষণা করা হচ্ছে। তবে আবদেল বুশিন এ বিষয়ে আর কোনো ব্যাখ্যা দেননি। লিবিয়ার বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গাদ্দাফির মৃত্যু নিয়ে বেশ প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছে। কারণ প্রাপ্ত ভিডিওচিত্রে দেখা যায়, গাদ্দাফিকে প্রথমে জীবিত ধরা হয়, কিন্তু পরে তিনি কীভাবে নিহত হলেন, তা অস্পষ্ট রয়ে গেছে এখনও।
গাদ্দাফির লাশ চেয়েছে পরিবার, কাল লিবিয়ার আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা : লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফির লাশ দাফনের সুযোগ চেয়েছে তার পরিবার। সিরিয়াভিত্তিক একটি টেলিভিশন চ্যানেলে দেয়া এক বিবৃতিতে তার পরিবারের সদস্যরা গাদ্দাফি, তার ছেলে মুতাসসিম এবং বৃহস্পতিবার নিহত হওয়া অন্য সদস্যদের লাশ চেয়েছে। এজন্য লিবিয়ার জাতীয় অন্তর্বর্তী পরিষদ বা এনটিসিকে চাপ দিতে গাদ্দাফি পরিবারের সদস্যরা জাতিসংঘ, ইসলামী সম্মেলন সংস্থা বা ওআইসি এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ইসলামী শরিয়া অনুযায়ী নিহতদের দাফনের জন্য সব মরদেহ সির্ত শহরে গাদ্দাফির নিজ গোত্রের কাছে হস্তান্তর করার আহ্বান জানানো হয়েছে ওই বিবৃতিতে।
এদিকে আজ (রোববার) লিবিয়ার জাতীয় অন্তর্বর্তী পরিষদ বা এনটিসি আনুষ্ঠানিকভাবে দেশটির স্বাধীনতা ঘোষণা করবে। গাদ্দাফির মৃত্যুর পর এ ঘোষণা দিতে যাচ্ছে এনটিসি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনটিসির এক কর্মকর্তা জানান, ভোর পাঁচটায় বেনগাজি শহর থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া হবে। এ শহর থেকেই গত ফেব্রুয়ারি মাসে লিবিয়ায় গাদ্দাফিবিরোধী আন্দোলন শুরু হয় এবং সেখান থেকে এনটিসি সব কার্যক্রম পরিচালনা করে।
স্বাধীনতা ঘোষণার পর লিবিয়ায় একটি নতুন অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হবে। এ সরকার দেশটিতে নতুন সংবিধান প্রণয়ন এবং চার দশক পর সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব পালন করবে।
তুলে নেয়া হচ্ছে নো-ফ্লাই জোন : লিবিয়ার ওপর থেকে নো-ফ্লাই জোনের আদেশ তুলে নেয়া হচ্ছে। এজন্য গতকাল জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে আলোচনা হয়েছে। কূটনীতিকরা বলছেন, লিবিয়ার এনটিসির সঙ্গে আলোচনা করে শিগগিরই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হবে। গত মার্চ মাসে জাতিসংঘ লিবিয়ার ওপর নো-ফ্লাই জোন কার্যকরের আদেশ দিয়েছিল।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন