বুধবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১১

পানি আগ্রাসনরে বরিুদ্ধে সংগ্রামরে কথা


অনেকেই হয়তো জানেন না বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান নদী ও আন্তর্জাতিক নদী পদ্মার (গঙ্গার) ওপর ভারত সরকারের তৈরী ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আদালতে ব্যক্তিগত উদ্যোগে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল বিগত নব্বই দশকের শেষের দিকে। খুবই দুঃখ ও লজ্জার সাথে বলতে হয়, বাংলাদেশের মরণফাঁদ নামে দেশ-বিদেশে বহুল পরিচিত আগ্রাসী ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে গত আটত্রিশ বছরে সম্ভবত ‘বন্ধু’ ভারত সরকার বেজায় নাখোশ হবে মনে করে আমরা কোনো বিশেষ বিশেষ ‘চেতনার’ সরকার অথবা বীর মুক্তিযোদ্ধারা কেউ-ই এ মামলাটি করতে পারিনি। পাঠকদের সঠিক তথ্য দেয়ার উদ্দেশ্যে বলছি, ফারাক্কা বাঁধ চালু হওয়ার ২৮ বছর পর এ মামলাটি দায়ের করেছিলেন একাত্তর-পূর্ব অখণ্ড পাকিস্তানের সাবেক কেন্দ্রীয় বাণিজ্যমন্ত্রী ও বড় মাপের মুসলিম লীগ নেতা গোপালগঞ্জের মরহুম ওয়াহেদুজ্জামানের পুত্র ঢাকায় বসবাসকারী নাজিম হাবিবুজ্জামান। উল্লেখ্য, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা প্রদানকারী শক্তি ভারত সরকার একাত্তর-পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশের সাথে যত বড় অন্যায়, বেআইনি ও আগ্রাসী আচরণই করুক না কেন, তার বিরুদ্ধে কোনো শক্ত অবস'ান নেয়া বা কোনো আদালতে মামলা দায়ের করা অন্তত ভারতের প্রতি শর্তহীন চিরকৃতজ্ঞ মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা সম্ভব ছিল না (হয়তো এখনো নয়) হয়তো সেটাই ছিল স্বাভাবিক।

খুবই স্বাভাবিক কারণে স্বাধীন বাংলাদেশের উচ্চ আদালতে এ মামলাটি টেকেনি। ২০০০ সালেই এটি খারিজ হয়ে যায়। মামলা খারিজ হওয়ার কারণ সম্পর্কে সে সময় নথিপত্র ঘেঁটে যা পাওয়া গিয়েছিল তাতে জানা যায়, এজাহারে লিপিবদ্ধ কোনো অভিযোগ বা দাবি মিথ্যা কিংবা কোনো সাক্ষী-সাবুদ পাওয়া যায়নি; এ রকম কোনো কারণে মামলা খারিজ হয়নি। মামলাটি খারিজ হয়েছে ফারাক্কা বাঁধের কারণে দেশ ও জাতির ক্ষতি হলেও মামলা রুজুকারী ব্যক্তি নিজে ব্যক্তিগতভাবে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হননি- এই কারণ দেখিয়ে। ব্যাপারটি খুবই ইন্টারেস্টিং, তাই না?

আজ থেকে এক যুগ আগে দায়ের করা এ মামলার বিবরণ অনুযায়ী সে সময়ের হিসাবে ফারাক্কা বাঁধ না থাকলে বাংলাদেশ প্রাকৃতিকভাবে আটাশ বছর গঙ্গা নদী থেকে স্বাভাবিক যে পরিমাণ পানি পেত, কিন' বাঁধের কারণে তার বেশির ভাগ পায়নি, সেই প্রাপ্য পানির মূল্য বাবদ ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়েছিল চার লাখ কোটি টাকা। এ ছাড়াও ফারাক্কা বাঁধের ভয়াবহ প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চলের প্রায় চার কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা, কৃষি-মৎস্য-গবাদিপশু ও প্রকৃতি ধ্বংসের ফলে যে অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয় তারও যথাযথ ক্ষতিপূরণের দাবি করা হয়েছিল ওই মামলায়।

সে হিসেবে আজ ২০১১ সালে শুধু ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়ায় আটত্রিশ বছরে বাঁধের কারণে না পাওয়া পানির মূল্য বাবদ এবং বাংলাদেশের উৎপাদন ও অর্থনীতিতে যে পরিমাণ ক্ষতি সাধিত হয়েছে, বেসরকারি পরিসংখ্যান মতে তার পরিমাণ টাকার অঙ্কে ১৮ লাখ কোটি টাকার ওপরে। এই হিসাব ফারাক্কার প্রতিক্রিয়ায় গত আটত্রিশ বছরে দেশের মানুষ-জীব-অণুজীব ও পরিবেশ-প্রতিবেশের যে ধ্বংস সাধন হয়েছে, তার বাইরের হিসাব। এ কারণে দেশের অনেকেই দুঃখ ও ক্ষোভের সাথে প্রায়ই বলে থাকেন, ভারত সরকারের শুধু ফারাক্কা আগ্রাসনের কারণে এ দেশের যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, টাকার অঙ্কে সেই পরিমাণ অর্থ দিয়ে দিল্লির মতো কোনো বড় নগরী অনায়াসে কিনে ফেলা যেত। ১৮ লাখ কোটি টাকার অঙ্কটি যদি ঠিক আন্দাজ করা যায় তাহলে দিল্লি কেনাবেচার কথাটি দুঃখ ও ক্ষোভের সাথে বলা হলেও এটি কোনো আজগুবি কথা নয়।


তবুও গঙ্গা নদীর ওপর ফারাক্কা বাঁধ ছাড়াও ভারত সরকার আন্তর্জাতিক আইন ও নীতিমালা লঙ্ঘন করে দুই দেশের আরো ৫৩টি অভিন্ন নদনদীর উজানে বিভিন্ন প্রকার বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে নদনদীগুলোর স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে ভাটির দেশ বাংলাদেশের আরো যে বিশাল ক্ষতি সাধন করেছে তার হিসাব এখনো নিরূপণ করা হয়নি। এসব ঘটনা থেকেই গত চল্লিশ বছরে বাংলাদেশের ওপর ভারত সরকারের লুণ্ঠন-আগ্রাসনের মাত্রা কতটা ভয়াবহ তা সহজেই উপলব্ধি করা যায়।

২.ভারত সরকার উজানে অভিন্ন নদনদীগুলোর পানি অপসারণের মাধ্যমে বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিপন্ন করার যে নিষ্ঠুর খেলা আটত্রিশ বছর ধরে চালিয়ে এসেছে, তা আন্তর্জাতিক আইনের চোখে ও মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণে ভয়ঙ্কর আগ্রাসী কর্মকাণ্ড এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ। ভারত সরকারের এই আগ্রাসনের ভয়াবহতা আমরা যদি ঠিকমতো উপলব্ধি করতে সক্ষম হই তাহলে বুঝব, ফারাক্কা কেবল লোহালক্কর ও কংক্রিটের তৈরী বাঁধ নয়। এটি অন্তত পঁচিশটি পারমাণবিক বোমার সমতুল্য এমন এক ভয়ঙ্কর নীরব মারণাস্ত্র- যার প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের প্রায় চার কোটি মানুষের জীবন ও জীবিকা বিপর্যস্ত হয়েছে, দেশের এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চলের কৃষি-মৎস্য-গবাদিপশু-বনাঞ্চলের ভয়াবহ ধ্বংস সাধন হয়েছে, জীব-অণুজীব-প্রকৃতি ও প্রাণবৈচিত্র্য বিনাশ হয়েছে। কেউ যদি পদ্মার দুই তীর ধরে দুই শ’ কিলোমিটার ভ্রমণ করেন, তিনিই ফারাক্কার ভয়াবহতার বাস্তব প্রমাণ পাবেন।
৩.বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বব্যাপী যে ভয়াবহ সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে, তাতে ভারত সরকারের বেআইনি নদী শাসন ও পানি লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে দুর্বার সংগ্রাম-লড়াই আরো বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে। কারণ যেসব উপায়ে জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চল আক্রান্ত হচ্ছে তার মধ্যে প্রধান দিকগুলো হলো- ১. সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিজনিত কারণে স'ল-ভূখণ্ড পানিতে তলিয়ে যাওয়া, ২. পানি ও মাটিতে ব্যাপক লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়া এবং ৩. নদনদীর প্রবাহের চরমভাবাপন্নতা (নদনদীতে শুষ্ক মওসুমে পানিপ্রবাহের অস্বাভাবিক হ্রাস ও বর্ষা মওসুমে পানিপ্রবাহের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি)। নদীপ্রবাহরে এই চরমভাবাপন্নতা দূর করতে জরুরভিাবে প্রয়োজন নদ নদীগুলোর স্বাভাবিক পূর্ণ প্রবাহ নিশ্চিত করা।

কিন' দুঃখজনক ব্যাপার হলো, ভারত সরকারের নদী ও পানি আগ্রাসনের কারণে বাংলাদেশের অস্তিত্ব যেখানে পুরোপুরি বিপন্ন হতে চলেছে, সেখানে দেশের, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানুষেরা হাতুড়ি-কুড়াল নিয়ে তো দূরের কথা, খালি হাতে সংগ্রাম করাও এখন বন্ধ করে দিয়েছেন। ফারাক্কা, গজলডোবা ও টিপাইমুখ এখন আর আমাদের মনে আতঙ্ক জাগায় না। এগুলো এখন আমাদের গা-সহা হয়ে গেছে। বর্তমান সরকার কর্তৃক পরিকল্পিতভাবে চাপিয়ে দেয়া জনদুর্ভোগের অসংখ্য ইস্যুর নিচে চিঁড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে জনগণের জাতীয় চেতনা ও আত্মমর্যাদাবোধ ভোঁতা হয়ে গেছে। দেশের ইসলামপন'ী শক্তিগুলো অন্তত কিছুকাল আগেও মাঝে মধ্যে ফারাক্কাবিরোধী মিটিং-মিছিল করত। কিন' ইদানীং সরকারের চাপিয়ে দেয়া স্পর্শকাতর নানা অপ্রয়োজনীয় ধর্মীয় ইস্যু নিয়ে আন্দোলনে আটকে পড়ার কারণে ফারাক্কাসহ ভারতীয় আগ্রাসন ও সাম্রাজ্যবাদী লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামে তারা নিষ্ক্রিয়। আরেক দিকে এটা খুবই অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য যে, দেশের একশ্রেণীর বামদলকে কয়েক বছর আগেও একবার দেখা গেছে, তারা ফারাক্কা দিবসে ভারতের নদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কোনো কর্মসূচি গ্রহণ না করে টানবাজারের পতিতা পুনর্বাসনের আন্দোলন নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন।

অন্য দিকে দেশে দেশপ্রেম ও প্রগতির ধ্বজাধারী একশ্রেণীর সুশীল বুদ্ধিজীবী আছেন, তারা ভারত সরকারের নদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলন তো দূরের কথা, এমনকি কূটনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতা পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়ে এখন পরোক্ষভাবে ভারতের তাঁবেদারির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। সমপ্রতি তারা ‘নদীর বিনিময়ে ট্রানজিট’ ও ‘শুল্কের বিনিময়ে কানেকটিভিটি’ প্রভৃতি স্লোগান তুলে ভারতের অন্যায় জবরদখল থেকে নদী-পানি উদ্ধারের বিনিময়ে ট্রানজিট ও কানেকটিভিটির নামে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ভারতকে দেশের সার্বভৌমত্ববিরোধী করিডোর প্রদানের পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন। সার্বভৌমত্ববিরোধী করিডোর ব্যবস'াকে ট্রানজিট বলে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করার কাজও অনেক দিন ধরে চালিয়ে এসেছেন এই শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীরা। এমনকি নেপাল ও ভুটানের সাথে বাংলাদেশের ট্রানজিট আর ভারতকে তার এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে (যুদ্ধ-সঙ্ঘাতময় অঞ্চলে) অবাধ চলাচলের জন্য বাংলাদেশের ভূখণ্ডে দেয়া করিডোর- এ দুটোকে এক বস' বলে প্রচার করে বাঙ্গালকে হাইকোর্ট দেখাচ্ছেন এই বুদ্ধিজীবীরাই। হায়, দুর্ভাগা দেশ!

৪. প্রবাদ আছে- ‘বাঙালি দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বোঝে না’। ফারাক্কার ভয়াবহ পরণিতরি কথাও হাজার বছররে শ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিব যেকোনো কারণেই হোক বুঝতে পারেননি। যদি বুঝতে পারতেন, তাহলে যে শেখ মুজিব ইন্দিরা
গান্ধীকে ধমক দিয়ে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করিয়েছিলেন, সেই মুজিব আটত্রিশ বছর আগে কোনোভাবেই ভারত সরকারকে ফারাক্কা বাঁধ পরীক্ষামূলকভাবেওচালু করার অনুমোদন দিতেন না, বরং তখন পৃথিবীব্যাপী বিশাল ভাবমূর্তি ও প্রভাবের অধিকারী শেখ মুজিব যদি ফারাক্কার ভয়াবহ পরিণতির কথা
বুঝে ওই সময় ফারাক্কা প্রকল্পের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা ঠুকে দিতেন, তাহলে সে মামলা হতো দুনিয়ায় সাড়া জাগানো এক দীর্ঘস'ায়ী মামলা। আর তার ফলে ভারতসরকার ফারাক্কা বাঁধ আজো চালু করতে পারত না। ফারাক্কা নিয়ে আজ মাথাব্যথা বাংলাদেশের হতো না, হতো ভারত সরকারের। সে রকমটি হলে পরবর্তীকালে ভারত সরকার গজলডোবা ও টিপাইমুখসহ অভিন্ন ৫৩ নদীতেও বাঁধ দিতে পারত না।

ফারাক্কার ভয়াবহ পরিণতির কথা বুঝেছিলেন মওলানা ভাসানী। তাই তিনি প্রথম থেকেই ফারাক্কার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন এবং অশীতিপর বয়সে অসুস' অবসয় ন্যুব্জ দেহে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফারাক্কার বিরুদ্ধে লংমার্চ করেছিলেন। মওলানা বুঝেছিলেন, সংগ্রাম ছাড়া শুধু ফারাক্কা কেন, সাম্রাজ্যবাদী-আধিপত্যবাদী কোনো আগ্রাসন থেকেই দেশের মুক্তি হবে না। সুতরাং এটা আজ খুবই পরিষ্কার দিল্লি সরকারের ফারাক্কা, গজলডোবা ও টিপাইমুখ বাঁধসহ দেশী-বিদেশী সব প্রকারের লুণ্ঠন-আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আঞ্চলিকভাবে ঐক্যবদ্ধ ও সমন্বিত গণ-আন্দোলন ও গণপ্রতিরোধ ব্যতিরেকে স্বাধীন বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য আক্রান্ত অঞ্চলের অস্তিত্ব রক্ষা করা যাবে না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন