শনিবার, ২৫ মার্চ, ২০১৭

নেলির গণহত্যা: ফিরে দেখা

উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্য আসামে গত ২৪শে এপ্রিল যে সব এলাকায় ভোটগ্রহণ হলো, তার মধ্যে রয়েছে নগাঁও কেন্দ্রটিও। এই কেন্দ্রেরই একটা অঞ্চল নেলি। আশির দশকে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় যখন অসমীয়া জাতীয়তাবাদীদের আন্দোলন চরমে, সেই সময়েই নেলিতে সংঘটিত হয়েছিল স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় গণহত্যা। এক বেলাতেই হত্যা করা হয়েছিল তিনহাজারেরও বেশী বাঙালী মুসলমানকে। একত্রিশ বছর ধরে সেখানে নিয়মিতই ভোট নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু মৃতদের স্মৃতিসৌধ থেকে নলকূপ বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র কিছুই পায় নি গণহত্যার কবলে পড়া বসনতোরি, বুকডোবা হাবি বা বরবরি গ্রামগুলো।
বাসনতরি গ্রামের জোহরা খাতুন। ৫/৬ দিন ধরে মৃত মায়ের দেহের ওপর পড়ে ছিল ছয় মাসের জোহরা।

বাসনতরি গ্রামের জোহরা খাতুন। ৫/৬ দিন ধরে মৃত মায়ের দেহের ওপর পড়ে ছিল ছয় মাসের জোহরা।
বসনতোরিতে দেখা হয়েছিল যুবতী জোহরা খাতুনের সঙ্গে। ১৯৮৩ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারিতে তার বয়স ছিল মাত্র ছয়মাস। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, ''বড় হয়ে শুনেছি বাবা-র কাছে যে ছয়মাসের আমাকে কোলে নিয়ে পালাতে গিয়ে মা গুলি খেয়ে মাঠে পড়ে গিয়েছিল। আমি নাকি পাঁচ-ছয় দিন মরা মায়ের গায়ের ওপরেই পড়ে ছিলাম। পরে পুলিশ আমাকে নিয়ে গিয়ে বাবাকে খুঁজে বার করে।”
১৮ই ফেব্রুয়ারি সকালে যখন অসমীয়া জাতীয়তাবাদী শক্তির সমর্থক কয়েক হাজার দুষ্কৃতকারী বসনতোরির একের পর এক বাড়ী জ্বালিয়ে দিচ্ছিল, তখন গ্রামের পুরুষ-মহিলা- শিশুরা বৃদ্ধ মুহাম্মদ আব্দুল হকের বাড়ীর ঠিক পেছনেই চাষের ক্ষেতে জড়ো হয়েছিলেন। মি. হক বলছিলেন, “সকাল সাতটা নাগাদ বাড়ি-ঘর জ্বালানো শুরু হয়েছিল। গ্রামের দুই প্রান্ত থেকেই ঘর জ্বালাতে জ্বালাতে এগচ্ছিল ওরা। সব মানুষ আমার বাড়ির ঠিক পেছনের ক্ষেতে জমা হয়েছিল। হঠাৎ দেখলাম অনেকগুলো গাড়ি থেকে অস্ত্র হাতে লোকজন নামছে। মুখে গামছা বাঁধা। তারপরেই শুরু হয়েছিল গুলি আর তীর ছোঁড়া।“
প্রাণে বাঁচার জন্য দিকবিদিক জ্ঞানশূণ্য হয়ে দৌড়িয়েছিলেন পশ্চিমদিকের নদীর দিকে। সাঁতরে নদী পার হতে যাঁরা পেরেছিলেন, তাঁরাই এখনও জীবিত রয়েছেন সেই বিভৎসতার বর্ণনা দেওয়ার জন্য।
বসনতোরি গ্রামের গণকবর। এখানে ২৬০০ মানুষের লাশ রয়েছে।

বসনতোরি গ্রামের গণকবর। এখানে ২৬০০ মানুষের লাশ রয়েছে।
আব্দুল হক নিজেও স্ত্রী, পুত্র, মেয়েকে হারিয়েছেন ওই পাইকারি হত্যাকান্ডে। ওই দুটো গ্রামেই মারা গিয়েছিলেন ২০০০ ছ’শোরও বেশী মানুষ।
পাশের গ্রাম বুকডোবা হাবির বাসিন্দা মোসলেমুদ্দিনেরও ৫ বছরের মেয়ে, স্ত্রী সহ প্রায় পুরো পরিবারই সেদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল।
“আমরা তো সব হারালাম, কিন্তু এতদিন পরেও তার কোনও বিচার পেলাম না। মৃতদেহ পিছু ৫০০০ করে টাকা আর কিছু ঢেউ-টিন দিয়েছে,” বলছিলেন মি. মোসলেমুদ্দিন।
বসনতোরি-বুকডোবা হাবি থেকে বেশ অনেক কিলোমিটার দূরে – পাহাড়ের কোলে চা বাগান ঘেঁষা গ্রাম বরবরি। একই দিনে সেখানেও হামলা হয়েছিল। সাড়ে পাঁচশো মহিলা-পুরুষ-শিশুকে সেদিন মেরে ফেলা হয়েছিল।
পরিকল্পনাটা ছিল একই রকম। চারদিক থেকে হাজার হাজার সশস্ত্র মানুষ দিয়ে প্রথমে বাড়ী-ঘর জ্বালিয়ে দাও। তারপরে প্রাণভয়ে মানুষ যখন পালাবে, তখন গুলি বা তীর ছুঁড়ে মেরে ফেল। যদিও দু'দিন আগেই থানায় ডেকে নিয়ে গিয়ে শান্তি কমিটি তৈরী করে নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছিল পুলিশ। কিন্তু ঘটনার দিন বেশ কয়েক ঘন্টা কোনও পুলিশ আসে নি।
মোসলেমুদ্দিন, বুকডোবা হাবি গ্রামের বাসিন্দা

মোসলেমুদ্দিন, বুকডোবা হাবি গ্রামের বাসিন্দা
বসনতোরির মুহাম্মদ আব্দুল হক বলছিলেন, “কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা রক্ষীরা গন্ডগোল আঁচ করতে পেরেছিল, গুলির শব্দও হয়তো শুনেছিল। কিন্তু স্থানীয় থানার অফিসারেরা বাহিনীকে গ্রামে নিয়ে না এসে অন্যান্য দিকে টহল দেওয়াচ্ছিল। পরে কয়েকজন মহিলা কেন্দ্রীয় বাহিনীর গাড়ীগুলির পথ আটকালে তারা বুঝতে পারে কী ঘটছে ভেতরের গ্রামগুলোতে। দুষ্কৃতিরা তখনই পালাতে শুরু করে।“
বরবরির কয়েকজন নিয়ে গিয়েছিলেন গ্রামের কবরস্থানে, যেখানে গণকবর দেওয়া হয়েছিল প্রায় ৫০০ মৃতদেহ। সেখানেই একটা শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ ৩০ বছরেও গড়ে তোলার জন্য কেউ সাহায্য করে নি। শুধু কয়েকটা লোহার রড মাটিতে পোঁতা হয়েছে।
আর বসনতোরি গ্রামের বাইরে যেখানে কয়েকহাজার মানুষকে গণকবর দিয়েছিল নিরাপত্তা বাহিনী, প্রাণে বেঁচে গ্রামে ফিরে সেই জায়গাটার কী অবস্থা দেখেছিলেন, সেটাই বলছিলেন আব্দুল সোবহান।

তাঁর কথায়, “দিন তিনেক পরে যখন গ্রামে আসতে পারলাম, দেখি যাকে যেভাবে পেরেছে, কবর দিয়েছে। কারও হাত বেরিয়ে আছে, কারও পা। রাত্রিবেলা নিরাপত্তাবাহিনীই কবর দিয়েছে। পরে আমরা সেগুলোর ব্যবস্থা করে মৃতদের শান্তিতে থাকার ব্যবস্থা করি।“
একত্রিশ বছর ধরে প্রতিবারই ভোট দেন বসনতোরি বা বরবরির মানুষ। '৮৩-র গণহত্যা ঘটে যাওয়া গ্রামগুলোতে এবারের নির্বাচনের প্রচার চালিয়েছে কংগ্রেস, আসামের মুসলমানদের রাজনৈতিক দল এআইইউডিএফ, এমনকি যে অসমীয়া জাতীয়তাবাদের জিগির তুলে গণহত্যা হয়েছিল, তাদেরই উত্তরসূরী অসম গণ পরিষদও। কিন্তু গত তিন দশকে তাঁদের অবস্থাটা পাল্টায় নি। কোনও সরকারই ফিরে তাকায় নি সব-হারা এই বাঙালী মুসলমান গ্রামগুলোর দিকে, যদিও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি গিয়ানি জৈল সিং থেকে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী- প্রতিশ্রুতি দিয়ে গিয়েছিলেন সকলেই।
বসনতোরি, বরবরি, বুকডোবা হাবির রাস্তা তিন দশক পরেও পাকা হয় নি, গ্রামের ১৮০০ মানুষের জন্য একটাই নলকূপ, কোনও স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই, নেই কোনও কাজের সুযোগ। গ্রামের ছেলেদের কাজের খোঁজে যেতে হয়েছে দক্ষিণ ভারতের কেরালায়।
অথচ চোখে পড়ল বরবরির কয়েক কিলোমিটার দূরেই, জাতীয় সড়কের ওপরে ধরমতুলকে গড়ে তোলা হচ্ছে আদর্শ গ্রাম হিসাবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন