মঙ্গলবার, ২৬ জুলাই, ২০১৬

রামপাল প্রকল্প যে উত্তর মানুষের জানা দরকার

সম্প্রতি রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। রামপাল পরিবেশগতভাবে সংবেদনশীল জায়গা সুন্দরবনের পাশে হওয়ায় এর পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে জনমনে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। এই নিবন্ধে যে ১০টি প্রশ্নের অবতারণা করা হয়েছে সেগুলোর উত্তর পাওয়া গেলে বোঝা যাবে, এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ক্ষেত্রে পরিবেশগত প্রভাবকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনার ও কয়লা ব্যবহারের মানদণ্ডের ব্যাপারে স্বচ্ছতা আছে কি না।
যেকোনো দেশের উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎ অপরিহার্য। এক হাজার মেগাওয়াটের বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জ্বালানি হিসেবে সাধারণত কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস, তেল ও পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশের বেলায়ও এর ব্যতিক্রম হওয়ার সুযোগ নেই। সে কারণে উচিত হবে, কয়লাসহ বিদ্যুৎ উৎপাদনের সব জ্বালানির কথাই বিবেচনা করা। কথা হচ্ছে, এসব প্রযুক্তিরই পরিবেশগত প্রভাব রয়েছে। আর এই প্রভাব কীভাবে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনার জন্য কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সে বিষয়ে মানুষের স্পষ্ট ধারণা থাকা উচিত। এতে তারা নিশ্চিত থাকতে পারে যে, সেই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে পরিবেশগত প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
প্রশ্ন ১: রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে নাইট্রোজেন অক্সাইড নিঃসরণের হার কমানোর লক্ষ্যে এসসিআর (সিলেক্টিভ ক্যাটালিস্ট রিঅ্যাক্টর) বা এ ধরনের অন্য কোনো প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে কি না?
কয়লা পোড়ানোর সময় এই নাইট্রোজেন অক্সাইড নির্গত হয়। এটি বায়ুদূষণ করে। এই নাইট্রোজেন অক্সাইডের কারণে ধোঁয়াশা সৃষ্টি ও অ্যাসিড বৃষ্টি হয়। ওজোন গ্যাস নির্গত হয়। এটা মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
প্রশ্ন ২: রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে কি এফজিডি (ফুয়েল-গ্যাস ডিসালফারাইজার্স) অথবা সালফার অক্সাইডের নিঃসরণ কমানোর অন্য কোনো প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে?
এই সালফার অক্সাইডও বায়ুদূষণ করে। কয়লা পোড়ানোর সময় এটি নির্গত হয়। এর ফলে অ্যাসিড বৃষ্টি হয়। মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর এটি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।
প্রশ্ন ৩: রামপাল প্রকল্পে পার্টিকুলেট ম্যাটার্সের মাত্রা কমানোর জন্য কি ব্যাগহাউস বা ইএসপি (ইলেকট্রোস্ট্যাটিক প্রিসিপিট্যাটর) বা অন্য কোনো যথাযথ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে?
এই পার্টিকুলেট ম্যাটার্স বায়ুদূষণ করে, যেটাকে কখনো পিএম ২.৫ (যে পার্টিকুলেট ম্যাটারের পরিধি ২ দশমিক ৫ মাইক্রনের কম, মানুষের চুলের ১০০ ভাগের এক ভাগেরও কম প্রস্থ) বলা হয়। এই কণাগুলোর মধ্যে ছোট কণাগুলোই বেশি মাথাব্যথার কারণ। কারণ, এগুলো যদি শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে মানুষের ফুসফুসের অনেক গভীরে চলে যায়, তাহলে ফুসফুসের স্বাভাবিক সুরক্ষা ভেঙে পড়বে।
প্রশ্ন ৪: রামপাল প্রকল্পে কি মারকারি রিমুভাল (পারদ দূরীকরণ) প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে?
কথা হচ্ছে, এই প্রযুক্তি কার্যকরভাবে ব্যবহার করা গেলে নিঃসরণের মাত্রা কমানো সম্ভব। মানবস্বাস্থ্যে পারদের ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে। বিশেষ করে, স্নায়ুরোগের সঙ্গে এর সম্পর্ক রয়েছে।
প্রশ্ন ৫: রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে কি পানি পরিশোধন প্রযুক্তির মাধ্যমে দূষিত তরল নির্গমন কমানো হবে?
পানি পরিশোধনের কার্যকর ব্যবস্থা না থাকলে অনেক বায়ুদূষণকারী উপাদান পানিতে চলে যেতে পারে, আর সেই পানি যথাযথভাবে পরিশোধন করে ছাড়া না হলে সুন্দরবনের মতো বাস্তুতান্ত্রিকভাবে সংবেদনশীল একটি এলাকা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
প্রশ্ন ৬: রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে কি কয়লা থেকে উৎপন্ন ছাই শুকনো অবস্থায় ফেলার প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে?
কথা হচ্ছে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সবচেয়ে ক্ষতিকর কঠিন বর্জ্য হচ্ছে ছাই, যার মধ্যে আবার অনেক দূষণকারী উপাদান রয়েছে। ছাই শুকনো অবস্থায় যথাযথভাবে ফেলা গেলে তা আর আশপাশের জলাধারে মিশতে পারবে না।
প্রশ্ন ৭: রামপাল প্রকল্পে কি কার্যকর অনলাইন মনিটরিং ব্যবস্থা থাকবে?
কার্বন নিঃসরণের মাত্রা সব সময় নজরদারির মধ্যে রাখা গেলে এটা নিশ্চিত করা যাবে যে, কেন্দ্রটি পরিকল্পনামতোই কাজ করছে। কারণ, এর সঙ্গে পরিবেশগত নিঃসরণের সম্পর্ক আছে।
প্রশ্ন ৮: রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে কি পার্শ্ববর্তী সামুদ্রিক প্রাণীর ওপর তাপীয় প্রভাব কমানোর প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে?
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বাষ্পকে ঠান্ডা ও ঘনীভূত রাখার জন্য বিপুল পরিমাণে পানি ব্যবহার করা হয়। ফলে এসব কেন্দ্র থেকে যে গরম পানি ছাড়া হয়, তা আশপাশের সামুদ্রিক প্রাণীর ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে, যদি সে পানির তাপমাত্রা কমিয়ে ছাড়া না হয়। এই পানির তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় ১০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি হবে না।
প্রশ্ন ৯: এই প্রকল্পে কি স্থানীয় প্রতিবেশের ওপর কয়লা আনা-নেওয়া ও ব্যবহারের প্রভাব কমানোর ব্যবস্থা করা হবে?
কথা হচ্ছে, কয়লা জাহাজে ওঠানো-নামানো ও ব্যবহারের কারণে স্থানীয় প্রতিবেশ মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হতে পারে। এই প্রভাব একদম কমিয়ে আনার জন্য যথাযথ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
আর ১০ নম্বর প্রশ্নটি হচ্ছে, এই রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য কি এর পূর্ণাঙ্গ পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন করে তার ফলাফল জনগণের সামনে হাজির করা হয়েছে? কথা হচ্ছে, সে রকম একটি প্রতিবেদন দেওয়া হলে ও তাতে পরিবেশগত প্রভাব কমানোর মনোভঙ্গি থাকলে মানুষ অনেকাংশেই নিশ্চিত হতে পারবে, রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পে পরিবেশগত প্রভাব একদম সর্বনিম্নে রাখার প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।
আরশাদ মনসুর: যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বিদ্যুৎ প্রকৌশলী।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন