শুক্রবার, ৮ জুলাই, ২০১৬

অশনি সংকেত শেখ হাসিনা সতর্ক হোন

দীর্ঘদিন ধরে কোনো রাজনৈতিক সংগঠন, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আমার সরাসরি কোনো সম্পৃক্ততা নেই। আমার রক্তের কণায় কণায়, চেতনার রন্ধ্রে রন্ধ্রে, অনুভূতির পরতে পরতে রাজনীতির যে সুস্পষ্ট অনুরণন আমি প্রতিনিয়ত অনুভব করি, তা থেকে একথা নিশ্চিত বলা যায়, রাজনীতি থেকে কখনোই আমি নিজেকে দূরে রাখতে পারিনি। শুধু একটা বিশাল-সংখ্যক রাজনীতিকের সঙ্গে আমার পার্থক্য এখানেই যে, ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশের ঋতু পরিবর্তনের মতো আমি সুবিধামতো আমার বিশ্বাসের রঙ পাল্টাতে পারি না। বোধহয় সেই কারণেই বঙ্গবন্ধুকে একটি মুহূর্তের জন্য বিস্মৃত না হয়েও একান্তে বসে ভাবি এবং আল্লাহ্‌র কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি যে, তার মননশীলতার বিবর্তনের আঙ্গিকে একদলীয় (বাকশাল) শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী প্রণয়নের প্রাক্কালে আমি আমার নেতার (প্রাণের চাইতে যাকে আজও বেশি ভালোবাসি) বিরোধিতা করেছিলাম। কিন্তু আজ যখন একান্ত অবসরে তখনকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে চিন্তা করি, তখন মনটা কেমন আড়ষ্ট হয়ে ওঠে, অনুভূতিটা কেমন দুমড়ে-মুচড়ে যায়। একটা সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন মুজিব ভাই। 

স্বাধীনতার পূর্ব হতেই যারা নির্বাচনে অবিশ্বাসী ছিলেন, তাদের বিশ্বাস ছিল- ক্ষমতার উৎস বন্দুকের নল, জনগণ নয়। ৭০’র নির্বাচনকে বর্জন করে যারা সশস্ত্র বিপ্লবের প্রসব-যন্ত্রণায় ভুগতেন, তখনকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আমরা যারা নির্বাচনে বিশ্বাস করতাম, আমাদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও কৌশলের কাছে পরাভূত হয়ে তারা ৭০’র নির্বাচনে আসতে রাজি হন। কিন্তু তাদের বিপ্লবের চেতনার লেলিহান শিখা সাময়িকভাবে অবদমিত হলেও ছাত্রলীগের গণতন্ত্রে বিশ্বাসী অংশের কালজয়ী কৌশলে ঐতিহাসিক ৭০’র নির্বাচন সংঘটিত না হলে এই নিরঙ্কুশ ম্যান্ডেটটির অভাবে আমরা নিঃসন্দেহে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে অভিহিত হতাম। এ কথাগুলো আমি আমার বচনে (তৃতীয় মাত্রা, চ্যানেল আই), লেখনীতে, বক্তব্যে বারবার উল্লেখ করেছি। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীরা বঙ্গবন্ধুর ছত্রছায়া হতে বিতাড়িত হতে চাননি বলে অনেকটা ইচ্ছার বিরুদ্ধেই মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত ঘাপটি মেরে ছিলেন। 

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রাক্কাল থেকেই তাদের স্থির প্রত্যয়ে ধারণা ছিল, বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানিরা হত্যা করবে। তাই তারা সেখানে ভারতের মাটিতে বসে প্রচণ্ডভাবে প্রবাসী সরকারের বিরোধিতা শুরু করে এবং মুজিব বাহিনী নামে একটা সশস্ত্র ক্যাডার গ্রুপ তৈরি করে। যদিও মণি ভাই মুজিব বাহিনীর সাংগঠনিক প্রধান ছিলেন, তবুও তার ঔদার্য ও উদারতার সুযোগ নিয়ে জনাব সিরাজুল আলম খান নিজস্ব ক্যাডার সদস্যদের দিয়ে মুজিব বাহিনীর সদস্যদের এই কাউন্সেলিং দিতে থাকেন যে, স্বাধীনতা-উত্তরকালে মুজিব ভাইয়ের অবর্তমানে প্রবাসী সরকার দেশে প্রত্যাবর্তন করে ক্ষমতাসীন হলে তাদেরকে গেরিলাযুদ্ধে উৎখাত করে ক্ষমতা করায়ত্ব করবেন। ষড়যন্ত্রটি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ভারতেই ফাঁস হয়ে যায়। তাজউদ্দীন ভাইয়ের পক্ষ থেকে পরিকল্পনাটির কথা ভারত সরকারকে অবহিত করলে তারা সচেতন হয়ে ওঠে। নিয়মিত সেনাবাহিনীর সদস্যদের বাইরে মুক্তিযুদ্ধে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন ডিপি ধর।

সৌভাগ্যক্রমে তার সঙ্গে আমার বহুবার বৈঠক হওয়ার কারণে আমারও সুযোগ হয় তাকে বিষয়টি শুধু অবহিত করা নয়, মুজিব বাহিনীর মূল উদ্দেশ্য সম্বন্ধে অবহিত করা এবং ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে তাকে সম্যক ধারণা দেওয়ার। আমি শতভাগ নিশ্চিত ডিপি ধর এ বিষয়ে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে যথাযথ পরামর্শ দিয়েছিলেন। মুজিব বাহিনী দেরাদুনে ট্রেনিং নিয়েছে তবে মুক্তিযুদ্ধে তেমন সম্পৃক্ততা গড়ে তুলতে পারেনি। এক্ষেত্রে আমার আরেকটি বিশেষ অবদান, মুজিব বাহিনীর বিকল্প শক্তি হিসেবে সিএনসি স্পেশাল (বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপ্রধান বিধায় মুক্তিযুদ্ধে সিএনসি ছিলেন) নামে একটি রাজনৈতিক ও অস্ত্রভিত্তিক ক্যাডার গ্রুপ তৈরী করি। চট্টগ্রামের মহীউদ্দীন চৌধুরী, মৌলভী সৈয়দ; যশোরের খান টিপু সুলতান, খুলনার মাহবুবুল আলম হিরণ, বালু, কুষ্টিয়ার রশীদুজ্জামান দুদু, দিনাজপুরের মোকসেদ ছাড়াও প্রতি জেলার গণতান্ত্রিক চেতনায় বিশ্বাসী প্রধান প্রধান নেতৃত্বকে নিয়েই এক বিশাল বাহিনী গড়ে তুলতে আমরা সক্ষম হই। তারা অবশ্য স্ব স্ব জেলায় অস্ত্রসহ প্রবেশ করে মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র গেরিলা কর্মকাণ্ড অমিত বিক্রমে শুরু করে। যাই হোক দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১০ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু যখন স্বশরীরে দেশে ফিরে এলেন তখন ঐ বিপ্লবীরা আবার বঙ্গবন্ধুর আশ্রয়ে চেম্বারলেনের ছাতার নিচে আশ্রয় গ্রহণের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখলেন। 

ছাত্রলীগের সম্মেলনের পূর্বেই এই বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীদের উদ্ধত আচরণে বঙ্গবন্ধু বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীদের বিরুদ্ধে কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিন্তু ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু একটি মারাত্মক ভুলের শিকার হন। যখন বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাদের সকল অস্ত্র জমা দেয়ার আহ্বান জানান, তখন সিরাজুল আলম খানের একটা কুমন্ত্রণার শিকার হন মুজিব ভাই। আর সেটা হলো, স্বাধীনতা বিরোধীদের হাতে অস্ত্র রয়ে গেছে, এখন আমরা পুরোপুরি সকল অস্ত্র জমা দিলে স্বাধীনতা-বিরোধীরা মুক্তিযোদ্ধাদের নিঃশেষ করে ফেলবে- নেতাকে এই কথাটি বিশ্বাস করিয়েই জনাব সিরাজুল আলম খান তার ক্যাডারদের একটি অস্ত্রও জমা না দিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যান। পরবর্তীকালে সেই অস্ত্র দিয়েই তারা গণবাহিনী সৃষ্টি করেন। দুঃখজনক হলেও এই কথাটি শতভাগ সত্যি। আশ্রয় ও অর্থের লোভে তারা স্বাধীনতা-বিরোধীদের আশ্রয়ে চলে যায় এবং ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের হত্যার একটি অলিখিত চুক্তিতে তারা আবদ্ধ হয়। এই গণবাহিনী সরকারকে অকার্যকর ও অস্থিতিশীল করার জন্য আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতৃত্বকে নির্বিচারে হত্যা করতে শুরু করে। ঈদের জামাতে কুষ্টিয়ার সংসদ সদস্য কিবরিয়া সাহেবকে তারা নিষ্ঠুরভাবে গুলি করে হত্যা করে। হাটে-বাজারে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে পেলে তারা নির্বিচারে হত্যা তো করতোই, হত্যাকাণ্ডের পর পৈশাচিক উল্লাস করে বলতো, মানুষ মারি নাই, কুত্তা মারছি। সে কী বীভৎসতা! গণবাহিনী নির্বিচারে এমনভাবে ব্যভিচার করেছে যেটা বর্ণনাতীত। সেই গণবাহিনীর অন্যতম নেতা আজকের মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এবং জাসদ সম্পর্কে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামসহ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। জাসদ-বাসদ তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে শুধু বহুধা-বিভক্তই হয়নি, বরং পরস্পরকে হত্যা করে নিজেরাই নিজেদেরকে শেষ করেছে। 

জনকল্যাণ ও জনসম্পৃক্ততা-বিবর্জিত অন্তঃসারশূন্য জাসদ দলটি এই সেদিনও আবারও বিভক্ত হয়েছে। এখন টিকে থাকতে হলে ইনু’র জন্য শেখ হাসিনা’র আশীর্বাদ অত্যাবশ্যকীয়। গণবাহিনী, তাহের বঙ্গবন্ধু হত্যার অন্যতম রূপকার। ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর ট্যাংকের উপর দাঁড়িয়ে উল্লাসরত ইনু’র ছবি সেদিনের অনেক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। শেখ হাসিনা নিশ্চয়ই এ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত। তাই ‘ঢাল নাই তলোয়ার নাই, নিধিরাম সর্দার’ জাসদ নেতা ইনুকে মন্ত্রিসভায় না রাখার পরামর্শ যৌক্তিক। তাকে তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রাখা খুবই বিপদজনক বলে অনেকের সাথে আমিও মনে করি। শেখ হাসিনা আজ দুর্দমনীয় ক্ষমতার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তাঁর মন্ত্রী পরিষদের শিক্ষা, কৃষি, তথ্যসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় আদর্শবিচ্যুত সুবিধাবাদী ভ্রান্ত বামদের হাতে! এটা অশনি সঙ্কেত। শেখ হাসিনা, সতর্ক হোন। উপসংহারে আমাকে বলতেই হয়, বারো মণ দুধে এটা একসের গো-চনা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আজকে যে অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা ও অশনি সঙ্কেত- ভ্রান্ত বামদের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান এর জন্য অনেকটাই দায়ী। টক-শো ও লেখনীতে গণবাহিনী ও জাসদের ভয়াবহতা সম্পর্কে আমি অনবরত যে সতর্কবার্তাটি উচ্চারণ করতাম, সেটির উপলদ্ধিগত বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর জন্য আমি মহান আল্লাহ্‌তায়ালার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। নিঃসন্দেহে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের এক্ষেত্রে ধন্যবাদ প্রাপ্য বলে আমি মনে করি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন