বৃহস্পতিবার, ৫ মে, ২০১৬

নজরদারি ও বায়োমেট্রিক নিবন্ধন : ১ বিদেশী মোবাইল কম্পানি কেন বায়োমেট্রিক ডাটাবেইজ বানাচ্ছে?

আমি বায়োমেট্রিক সিম নিবন্ধন নিয়ে উদ্বিগ্ন। সেটা রাষ্ট্র করুক, কিম্বা কোন কম্পানি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান- নিজের বায়োমেট্রিক ডাটা রাষ্ট্র কিম্বা বেসরকারি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেওয়ার বিপদ রয়েছে। দুইয়ের মধ্যে ফারাক আছে বটে, কিন্তু অবস্থাভেদে যে কোন প্রকার ডিজিটাল নজরদারি নাগরিকদের জন্য ভয়ঙ্কর হতে পারে। মোবাইল কম্পানি বিশেষত বিদেশী যদি সিম নিবন্ধনের নামে বাংলাদেশের নাগরিকদের বায়োমেট্রিক ডাটাবেইজ তৈরি করে, তাহলে তা জাতীয় প্রতিরক্ষার দিক থেকে বিপজ্জনক। মেনে নেওয়া যায় না। 
বাংলাদেশের নাগরিকদের জাতীয় পরিচয়পত্র তৈয়ার করে রাষ্ট্র নাগরিকদের ওপর নজরদারির যে ডিজিটাল ব্যবস্থা প্রচলন করে তার বিরোধিতা কেন করা উচিত সেটা ব্যক্তির নিজের ‘প্রাইভেসি’ বা অনাকাঙ্ক্ষিত উপদ্রব বা নজরদারি থেকে মুক্ত থাকার অধিকারের সঙ্গে যুক্ত। সে কারণে রাষ্ট্র যখন সেটা করে তখন যুক্তিসঙ্গত আইনের অধীনে গণতান্ত্রিক বিধান অনুযায়ী করছে বলে দাবি করে বটে, কিন্তু ব্যক্তির ওপর রাষ্ট্রের খবরদারি, নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ বাড়ে বৈ কমে না। বিষয়টি ডিজিটাল যুগে আধুনিক রাষ্ট্রের চরিত্র এবং একালে টেকনোলজির বিবর্তনের পর্যালোচনা করে বুঝতে হবে। সারা দুনিয়ার মানুষের ওপর অল্প কিছু ক্ষমতাবান মানুষ ও কর্পোরেশানের কৃৎকৌশলগত নিয়ন্ত্রণের সমূহ সুযোগ ডিজিটাল বিপ্লব এনে দিয়েছে। এ ব্যাপারে আমাদের বিশেষ হুঁশ নাই। তবুও তর্ক আছে যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইনি সুরক্ষার কিছু সুযোগ থাকে। অন্য দেশের ভিসা নেবার সময় বা ভিনদেশে প্রবেশের মুখে সীমান্তে বা এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশানের কাছে আমরা ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিতে বাধ্য থাকি। রাষ্ট্রের আদৌ ডিজিটাল নজরদারির এখতিয়ার আছে কি না তা নিয়ে বিস্তর তর্ক আছে। ইতালির দার্শনিক আগামবেন একবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবার আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি কিছুতেই ফিঙ্গারপ্রিন্ট দেবেন না এবং নিজেকে ডিজিটাল নজরদারির অধীন করার ঘোরবিরোধী অবস্থান নিয়েছিলেন। শেষমেশ তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাননি, এবং নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির কোর্স বাতিল করেছেন। তাহলে বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী তাত্ত্বিক কিম্বা দার্শনিক যুক্তি রয়েছে। এ বিষয়ে আগামবেনের যুক্তি আমাদের শোনা দরকার। তেমনি আরেকজন ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকোকে নিয়েও আমরা কথা বলব। ‘জনগণ’কে নজরদারি ও শাস্তির ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে আধুনিক রাষ্ট্র কিভাবে ‘শৃংখলাধীন’ (বা শৃংখলিত) করে সেই দিক নিয়েও খানিক আলোচনা করব। আধুনিক রাষ্ট্রের চরিত্র পর্যালোচনা এবং এ কালের রাজনৈতিক কর্তব্যগুলো সুনির্দিষ্ট ভাবে বোঝার জন্য বায়োমেট্রিক নিবন্ধন পর্যালোচনা খুবই জরুরি। এই লেখাটির উদ্দেশ্য এটাই।
তাহলে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দেওয়া কিম্বা নিজেকে অন্য কোন বায়োমেট্রিক পদ্ধতির নজরদারির অধীনস্থ করাকে স্বাভাবিক ও যুক্তিসঙ্গত মনে করা মারাত্মক ভুল। এতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করবার কিম্বা তথাকথিত অপরাধ দমনের সম্পর্ক অতি ক্ষীণ। সমাজব্যবস্থাই যদি অপরাধ সংঘটনের কারণ হয়, তাহলে সমাজের সংস্কার বা রূপান্তরের কথা না বলে অপরাধকে টেকনোলজি দিয়ে দমন অবাস্তব। বর্তমান বিশ্ব অসম; পরদেশ লুণ্ঠনসহ যুদ্ধবিগ্রহ সহিংসতা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার নিত্যদিনের কারবার; প্যালেস্টাইন, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া ইত্যাদি দেশ থেকে সাধারণ মানুষকে উৎখাত করা হয়েছে, তাদের দেশান্তরী ও অভিবাসী জীবনে বাধ্য করা হয়েছে; অন্যায় মোচনের পরিবর্তে ক্রমাগত অন্যায় ও অবিচারকে প্রশয় দেয়া হচ্ছে। তাহলে সন্ত্রাস দমনের নামে আরো অধিক সন্ত্রাস, যুদ্ধ ও সহিংসতার বিস্তার ও বিশ্বব্যাপী যুদ্ধকৌশলের অংশ হিসাবেই বায়োমেট্রিক নিবন্ধন ক্ষমতাসীনদের জন্য জরুরি হয়ে পড়েছে। সমাজে যখন ধনি গরিবের ব্যবধান বাড়ে, বিশ্বে যখন অল্প কিছু লোক অধিকাংশের সম্পদ কুক্ষিগত করে, রাষ্ট্র যখন বাজারব্যবস্থার মহিমার নামে মানুষের জীবন ও জীবিকার আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রগুলো সঙ্কুচিত করে সেখানে রাষ্ট্র ও বহুজাতিক কম্পানির বিরুদ্ধে নানান প্রতিরোধ ও বিদ্রোহ ঘটবেই। ডিজিটাল নজরদারি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অব্যবস্থা ও কুব্যবস্থার সমাধান নয়। তাহলে সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্নভাবে বায়োমেট্রিক নিবন্ধন নিয়ে তর্ক করলে ডিজিটাল যুগে নানাবিধ গোয়েন্দাগিরি ও নজরদারির ব্যাখ্যা করা যাবে না। সে কারণে এখানে আমরা সাধারণ ভাবে বায়োমেট্রিক নিবন্ধন ও আধুনিক রাষ্ট্রের নজরদারি নিয়েই কিছু প্রাথমিক আলোচনা শুরু করতে চাইছি, কিন্তু সেটাও দুই এক কিস্তিতে শেষ করা সম্ভব না। বাংলাদেশে এই তর্কটা মোবাইল কম্পানির সিম নিবন্ধনকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে, ফলে সেই বিষয়ে শুরুতে কিছু প্রাথমিক আলোচনা করে নেওয়া যাক।

বিদেশী মোবাইল কম্পানির সিম নিবন্ধন বিপজ্জনক
মোবাইল কম্পানি যাদের অধিকাংশই বিদেশী তাদের কাছে আমাদের ব্যক্তিগত বায়োমেট্রিক তথ্য তুলে দেবার কোনই যুক্তি নাই। সে কারণে যারা এর বিরোধিতা করছেন আমি তাঁদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছি অনেক আগেই। এপ্রিলে সিম নিবন্ধনের সময়সীমা অতিক্রম হয়ে যাবার আগে ফেইসবুকে সেটা প্রকাশও করেছি। নিবন্ধনের সময় সীমা মে মাসের জন্য আবার বাড়ানো হয়েছে। অনেকেই সিম হারাবার ভয়ে এবং মোবাইল কম্পানির প্রচারণার চাপে নিবন্ধন করেছেন। কিন্তু তারা নিদেনপক্ষে তাদের নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে এ ধরনের কোন যুক্তিসঙ্গত আইন না থাকার পরেও মোবাইল কম্পানির কাছে তাঁদের আঙুলের ছাপ দিয়ে নিজেদের নিরাপত্তার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছেন। 
সিমের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের জন্য কোন আইন নাই। নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ ব্যক্তির নিজের ‘প্রাইভেসি’ বা অনাকাঙ্ক্ষিত উপদ্রব বা নজরদারি থেকে মুক্ত থাকার অধিকারের সঙ্গে যুক্ত। বিদেশী মোবাইল কম্পানিগুলোর কাছে সিম ব্যবহারকারী বাংলাদেশের বায়োমেট্রিক নিবন্ধন কেন জরুরি হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় সেটাই বিশাল একটি প্রশ্ন। নাগরিকদের বায়োমেট্রিক ডাটাবেইজ তৈয়ারি ও সংরক্ষণ সরাসরি জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত। তাহলে মোবাইল কম্পানির বায়োমেট্রিক সিম নিবন্ধন জাতীয় নিরাপত্তার জন্যই বিপজ্জনক। 
মোবাইল কম্পানিগুলো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, তদুপরি অধিকাংশই বিদেশী। তারা নাগরিকদের বায়োমেট্রিক তথ্য কিভাবে ব্যবহার করবে, কাকে দেবে, কিম্বা এই ডাটাবেইজের ব্যবসায়িক সম্ভাবনা কিভাবে কাজে লাগাবে এ ব্যাপারে কোন আইন নাই। জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে যুক্ত তথ্যভাণ্ডারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবার কোন আইন না থাকা একটি অতিশয় দুর্বল এবং পরাধীন রাষ্ট্রের লক্ষণ। নাগরিকদের ডাটাবেইজ সংবেদনশীল কিন্তু সেই ক্ষেত্রে জাতীয় প্রতিরক্ষার কোন ব্যবস্থা নাই। তুমুল অরক্ষিত অবস্থায় নাগরিকদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের নামে বিদেশী মোবাইল কম্পানিগুলো মূলত বাংলাদেশের নাগরিকদের ওপর অতিশয় সংবেদনশীল ডাটাবেইজ তৈরি করছে। যা অবশ্যই অবিলম্বে প্রতিরোধ করা উচিত। 
শুধু সিম নিবন্ধন নয়, সাধারণভাবে রাষ্ট্রের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের সঙ্গে নিরাপত্তা, নাগরিকদের ওপর রাষ্ট্র ও সরকারের নজরদারি বৃদ্ধির বিপদ, ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপর হুমকি এবং সর্বোপরি আধুনিক কৃৎকৌশলের সুবিধা নিয়ে অল্প কিছু ব্যক্তির পুরা সমাজকে নিয়ন্ত্রণের ঝুঁকি ইত্যাদি নানা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু জড়িত। এই ক্ষেত্রে বায়োমেট্রিক কায়দায় সিম নিবন্ধন সাধারণভাবে যে কোন প্রকার বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের অন্তর্গত বটে, তবে তাদের মধ্যে পার্থক্য আছে। পাসপোর্ট করতে, ভিসা পেতে এমনকি বিদেশী কোন রাষ্ট্রের সীমান্ত অতিক্রম করবার সময় আমরা ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিতে বাধ্য থাকি। রাষ্ট্র দাবি করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করবার জন্য এটা তাদের এখতিয়ার। আধুনিক রাষ্ট্র তার সার্বভৌম ক্ষমতা বলে ব্যক্তিকে এই টেকনোলজিকাল নজরদারির অধীনস্থ করে। এই দিক থেকে বায়োমেট্রিক নিবন্ধন আধুনিক রাষ্ট্রের বিশেষ চরিত্রের লক্ষণ যা আমাদের আরো ঘনিষ্ঠ ভাবে পর্যালোচনা করে দেখা ও বোঝা উচিত। 
নয়-এগারোর পর বিশ্বব্যাপী ‘নিরাপত্তা’র ধারণা আমূল বদলে গিয়েছে। রাষ্ট্র, ক্ষমতাসীন সরকার কিম্বা রাষ্ট্রের নিরাপত্তাব্যবস্থার চোখে আমরা সকলেই রাতারাতি সম্ভাব্য সন্ত্রাসী বা অপরাধী হয়ে গিয়েছি। এগুলো খুবই মৌলিক ও গুণগত পরিবর্তন। বায়োমেট্রিক নিবন্ধনকে এই নতুন বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখবার কোন উপায় নাই। 
অন্য দিকে ডিজিটাল যুগে একটা নতুন ভূগোলের আবির্ভাব ঘটেছে আর অপরাধ ও সন্ত্রাস দমনের জন্য সেই ডিজিটাল জগৎকে নিয়ন্ত্রিত ও শৃংখলিত করবার জন্য রাষ্ট্রও সমানতালে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আমরা সামাজিক পরিচয় হারিয়ে টেকনোলজির সংকেত সংখ্যায় রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছি। খবর রাখছি না। এই সকল দিকে আমাদের নজর দ্রুত ফেরানো জরুরি হয়ে উঠেছে। 
বাংলাদেশে রাষ্ট্রের নজরদারির বিরুদ্ধে নয়, মোবাইল কম্পানির বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের বিরুরেূ প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ শুরু হয়েছে। আগেই বলেছি, মোবাইল কম্পানির বায়োমেট্রিক নিবন্ধন দরকার হোল কেন সেটা খুবই সন্দেহের বিষয়। ক্ষমতাসীনরা তার অনুমতি দিয়েছে কি? সিম নিবন্ধনের জন্য যে কোন পরিচয়পত্রই যথেষ্ট। বড় জোর তারা জাতীয় পরিচয়পত্রের দাবি করতে পারে। কিন্তু ডিজিটাল বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের অর্থ হচ্ছে তারা রাষ্ট্রের এখতিয়ারের বাইরে আলাদা ডাটাবেইজ তৈরি করতে চায় এবং বাংলাদেশে ডাটাবেইজের নিরাপত্তাসংক্রান্ত আইনের অভাবের সুযোগ নিয়ে এই ডাটাবেইজ দিয়ে আলাদা ব্যবসা করতে চায়। যে ডাটাবেইজ তারা তৈরি করছে তার স্বত্ব কার? সেই ডাটাবেইজের নিরাপত্তা কে দেবে?- এগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। 
অধিকাংশ মানুষ ডিজিটাল ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে নিবন্ধনের সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে হুঁশিয়ার নন। এর মাধ্যমে তৈরি ডাটাবেইজ মুনাফাকারী ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশী রাষ্ট্রের গোয়েন্দাদের কাছেও হস্তান্তর করতে পারে। কিম্বা রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডে যে সকল শক্তি জড়িত তাদের হাতেও স্বেচ্ছায় কিম্বা অনিচ্ছায় কিম্বা টাকার বিনিময়ে তুলে দিতে পারে। এগুলো খুবই সম্ভব। কথা হোল, তারা কি পারে আর কি পারে না সে সম্পর্কে কোন আইন নাই। নাগরিকদের পক্ষে কোন রক্ষা কবচ নাই। বায়োমেট্রিক সিম নিবন্ধনের যারা বিরোধিতা করছেন, তাঁরা ঠিকই বিপদ অনুধাবন করতে পেরেছেন। এখন আমাদের কাজ হচ্ছে ব্যাপারটিকে তথ্য ও বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে আরো স্পষ্ট করে তোলা। 
তাহলে শুরুতেই এই দিকটা আমরা মনে রাখব যে মোবাইল কম্পানি, বিশেষত বিদেশী ও বহুজাতিক কর্পোরেশানের ডিজিটাল বায়োমেট্রিক নিবন্ধন আর রাষ্ট্রের নাগরিক নিবন্ধন এক কথা নয়। রাষ্ট্রের বায়োমেট্রিক নিবন্ধন প্রবল বিতর্কের বিষয় হলেও বহুজাতিক ব্যবসায়ী কম্পানির বায়োমেট্রিক নিবন্ধন খুবই সন্দেহের। এ কারণে যারা বায়োমেট্রিক সিম নিবন্ধনের বিরোধিতা করছেন আমাদের সামষ্টিক নিরাপত্তার জন্য তাঁদের প্রতিবাদকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ মনে করেছি এবং অকুণ্ঠচিত্তে সমর্থন করেছি।
বায়োমেট্রিক নিবন্ধনকে কেন্দ্র করে অনেক কথা অনেকে বলছেন। অনেকের দাবি, এতে মোবাইল ফোন কেন্দ্রিক অপরাধ দমন করা যাবে, কিম্বা সহজ হবে। মোবাইল ফোনগুলো অপরাধ দমনের প্রতিষ্ঠান নয়। তারা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। তারা মুনাফার জন্য বায়োমেট্রিক ডাটাবেইজ নিজেরা ব্যবহার করে নিজেরাই ক্রাইম করবে না তার গ্যারান্টি কী? বায়োমেট্রিক ডাটাবেইজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যভাণ্ডার। এই তথ্যভাণ্ডার গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ ও মুনাফা কামানোর ক্ষেত্র। বিপজ্জনক হচ্ছে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ডাটাবেইজ কে কিভাবে ব্যবহার করবে সেই বিষয়েও আমাদের দেশে কোন আইন নাই। মোবাইল কম্পানিগুলো তাদের বায়োমেট্রিক ডাটাবেইজ কোথায় কিভাবে সংরক্ষণ ও ব্যবহার করবে তার ওপর রাষ্ট্রের কোন নিয়ন্ত্রণ নাই, নীতিমালাও নাই। এই অবস্থায় নাগরিকদের হাতের ফিঙ্গারপ্রিন্ট মোবাইল কম্পানির হাতে তুলে দেওয়া ভয়ানক বিপজ্জনক।
সিমের বায়োমেট্রিক নিবন্ধন অপরাধ দমন করবে বা অপরাধ দমনে সহায়ক হবে এর চেয়ে হাস্যকর অনুমান আর কিছুই হতে পারে না। অপরাধ দমনের জন্য সবার আগে দরকার সুষ্ঠু বিচারব্যবস্থা, স্বচ্ছ প্রশাসন ও পুলিশ, পুলিশি ব্যবস্থাকে দলীয়করণ থেকে মুক্তি, ইত্যাদি। অর্থাৎ একটি দক্ষ ও স্বচ্ছ ফৌজদারি বিচারব্যবস্থা। এখানেই শেষ নয়। দরকার স্বচ্ছ ও বলবৎযোগ্য আইন ও তার সুষ্ঠু প্রয়োগ। নিদেনপক্ষে এই ব্যবস্থাকে আইনানুগ হতে হবে। তো তার কোন খবর নাই কিন্তু মোবাইল কম্পানির সিম নিবন্ধন দিয়ে অপরাধ দমন খুবই হাস্যকর অনুমান। 
আমি ফেইস বুকে সিম নিবন্ধনের বিরোধিতা করায় অনেকে খুব বীর হয়ে গিয়েছেন। লিখেছেন, আমি তো সন্ত্রাসী বা চোর নই তবে কেন ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে সিম নিবন্ধন করতে ভয়? এটা ভীতু বা বীরত্ব প্রদর্শনের তর্ক নয়। অনেকের দাবি এতে ভুয়া আইডি বন্ধ হবে। এটাও হাস্যকর যুক্তি। এতে বরং বিপদ বাড়বে। ঠিক যে এখন অপরাধীরা ভুয়া আইডি ব্যবহার করতে পারে, কিন্তু কোথা থেকে কল করছে নতুন প্রযুক্তিতে তা ট্রেইস করা সম্ভব এবং ধরা মোটেও কঠিন নয়। ফোন কল অনুসরণ করে অপরাধী ধরা পড়েছে তার বিস্তর নজির আছে। কিন্তু এখন ভুয়া আইডি ব্যবহার না করে অপরাধীরা অন্যের নামে, ধরুন আপনার নামে নিবন্ধিত সিম ব্যবহার করবে। অপরাধী হবেন আপনি। মোবাইল কম্পানিগুলো ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, তারা ব্যবসার জন্য ডাটাবেইজ থেকে অন্যের তথ্য ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে অপরাধীদের কাছে সিম বিক্রি করতে পারে। এটা রোধ করার কোন আইনী ব্যবস্থা নাই। তারা যে সেটা করবে না তার গ্যারান্টি কী? নিরপরাধ নাগরিক অপরাধী হিসাবে শাস্তি পেয়ে যেতে পারেন। সাধু সাজার জন্য বা আমি অপরাধী না তাহলে সিম নিবন্ধনে ভয় কী বলে অনেকে সিম নিবন্ধনের যে যুক্তি দিচ্ছেন তারা নিশ্চয়ই জানেন বা অনায়াসেই অনুমান করতে পারেন চোর, ডাকাত, খুনিসহ নানান কিসিমের ছোট-বড় অপরাধীও বায়োমেট্রিক কায়দায় সিম নিবন্ধন করেছে। তো আপনি সিম নিবন্ধন করে একই কাতারেই যোগ দিয়েছেন, সাধু হননি। সিম নিবন্ধনের মধ্যে নিজেকে অপরাধী না ভাবা, নিজেকে সাধু জ্ঞান করা, অন্যে করছে না বলে ভীতু বা অপরাধী ভাবার মতো আহাম্মকি আর কিছুই হতে পারে না। আশা করি তাঁরা বুঝবেন বিষয়টি আরো অনেক বড়।

‘সমাজ নিরপরাধ ও অপরাধীতে বিভক্ত’: সমাজ বোধের মারাত্মক বিকৃতি
অপরাধ দমন তত্ত্বের জায়গায় দাঁড়িয়ে সিম নিবন্ধনের পক্ষে অবস্থানের বিপদ অনেক অনেক গভীরে। এখানে অনুমান হচ্ছে সমাজ অপরাধী ও সাধু এই দুই ভাগে বিভক্ত। অপরাধের আর্থসামাজিক বিচার এখানে অনুপস্থিত। বাজার ব্যবস্থার চোটে ভেঙে পড়া সমাজে সামাজিক সম্পর্ক ও নৈতিক ভিত্তিগুলো কিভাবে দুর্বল হয়ে গিয়েছে সেটা বোঝার কারো অবসর নাই। আধুনিক সমাজে ব্যক্তি আছে, কিন্তু সমাজ নাই, অতএব এই অনুমানই বদ্ধমূল হয় যে নীতিহীনতা ও অপরাধের মোকাবিলা করবে সমাজ থেকে আলাদা ও সমাজের ঊর্ধ্বে থাকা ফৌজদারি আইন ও পুলিশ। তদারকি করবে রাষ্ট্র। সমাজ বিচ্ছিন্ন ব্যক্তির নিরাপত্তার অধিক কোন সামগ্রিক সামাজিক নিরাপত্তার ধারণা করবার সামর্থ্য ব্যক্তিতান্ত্রিক সমাজ হারিয়ে ফেলে। এই ধারণার প্রাবল্যের ওপর পুলিশি রাষ্ট্র গড়ে ওঠে ও শক্তিশালী হয়। যারা নিজেদের অপরাধী মনে করে না তাদের তাই উচিত সিম নিবন্ধন করা- এই ধারণা এই সমাজে গড়ে ওঠার সঙ্গত কারণ রয়েছে। এমনকি নিজের অধিকার ক্ষুণ্ন করে হলেও নিজেকে রাষ্ট্রীয় নজরদারির হাতে সমর্পণ করবার জন্য বায়োমেট্রিক নিবন্ধনকে স্বাগত জানাতে সমাজ গররাজি হয় না। সিম নিবন্ধনের জন্য মানুষের ভিড় দেখে আমরা তা আন্দাজ করতে পারি।
তাহলে দেখা যাচ্ছে বায়োমেট্রিক সিম নিবন্ধনের বিরোধিতা নিয়ে কিছু বলার আগে আমাদের এইসব নানান অনুমান নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে। অথচ বিষয়টি এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে এ বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা-পর্যালোচনা দরকার। 
রাষ্ট্র নাগরিকদের নাম সাকিন পরিচয় নিবন্ধিত করে, এটা নতুন কিছু নয়। নাগরিকদের শাসন ও নিয়ন্ত্রণের জন্য আধুনিক রাষ্ট্র কেন এখন আরো বিস্তৃত ও নিখুঁত টেকনোলজিকাল নজরদারির ক্ষমতা আয়ত্ত করতে চাইছে সেটা একালে ক্ষমতা, আধুনিক সমাজ ও রাষ্ট্রতত্ত্বের প্রধান আলোচ্য বিষয়। যাঁরা ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো কিম্বা ইতালির দার্শনিক আগামবেনের লেখালেখির খোঁজখবর রাখেন তারা নিশ্চয়ই জনগণকে শৃংখলিত ও নিয়ন্ত্রিত রাখবার জন্য আধুনিক রাষ্ট্রের নানাবিধ কারিগরি সম্পর্কে অবহিত। এই কারিগরির বিচার নাগরিকত্ব, কোন প্রকার উপদ্রব ও বাইরের হস্তক্ষেপ ছাড়া ব্যক্তির শান্তিপূর্ণ জীবনের নিশ্চয়তা দেবার প্রতিশ্রুতি- যা ব্যক্তিস্বাধীনতা বা ‘প্রাইভেসি’র অধিকার হিসাবে পরিচিত- ইত্যাদি নানান প্রসঙ্গের সঙ্গে জড়িত। তাহলে আধুনিক রাষ্ট্রের নজরদারির শক্তি ও বিস্তৃতি ভয়ানক ভাবে বৃদ্ধির সঙ্গে এ কালে আধুনিক রাষ্ট্রের রূপান্তর জড়িত। কী সেই রূপান্তর সেটা আমাদের বোঝা দরকার। এই দিকটি না বুঝলে একালে কোন প্রকার অর্থপূর্ণ গণমানুষের রাজনীতির বিকাশ ও পুনর্গঠন অসম্ভব।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন