শুক্রবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

‘বিষবৃক্ষ’ চাষে হুমকির মুখে জীববৈচিত্র! নিকোটিনের প্রভাবে প্রাণীকূলে শ্বাসকষ্ট ও ক্যান্সারসহ পরিবেশ ধ্বংসের যজ্ঞ চলছে

দেশের সুপেয় পানি ও দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপদ মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র চট্টগ্রামের হালদা নদী। আর নদীর উৎপত্তিস্থল খাগড়াছড়ির ঐতিহাসিক মহকুমা শহর রামগড়ের ‘হালদাছড়া’। এ ছড়ার মুখ থেকে ১০/১২ কিলোমিটার নিচেই হালদা খালের মূল অংশ। আর এ মূল অংশের উজানে রয়েছে হালদার অনেকগুলো উপ-নদী বা ছড়া। এসব ছড়ার চারিপাশে রয়েছে সমতল কৃষি জমি। সম্প্রতি এসব কৃষি জমিতে প্রতিযোগিতা দিয়ে শুরু হয়েছে ‘বিষবৃক্ষ’ তামাকের চাষ! ফলে এ অঞ্চলের বাড়ছে মানুষের শ্বাসকষ্ট, ক্যান্সারসহ নানা রোগবালাই। শুধু তাই নয় তামাকের চুল্লির অপরিশোধিত বিষাক্ত পানি গিয়ে পড়ছে হালদাখালে! এতে হালদার জীববৈচিত্র চরম হুমকির মুখে পড়েছে। হালদা গবেষকরা এ নদীর পরিবেশ রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সরকারের সাথে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে এশিয়াখ্যাত এ নদী ধ্বংসের কাজে লিপ্ত রয়েছে একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী মহল। 

হাদলা নদীর উৎপত্তিস্থল পার্বত্য খাগড়াছড়ির প্রাচীন মহাকুমা শহর রামগড়ের পাতাছড়া ইউপির ‘হালদাছড়া’। পাহাড়ের চূড়া থেকে নেমে আসা ঝর্নার পানি ধীরে ধীরে অনেক প্রতিকূলতা ডিঙ্গিয়ে মংরাজ পরিবারের আবাসভূমি মানিকছড়ির পশ্চিমাংশ দিয়ে সেমুতাং গ্যাসফিল্ড সংলগ্ন স্থল হয়ে চট্টগ্রামের দিকে পুরোদমে বয়ে চলেছে হালদা নদীর পানি। আর এ সুপেয় পানিতেই রুই, কাতলা, মৃগেলসহ মিঠাপানির ‘মা’ মাছগুলো অনায়াসে ডিম ছাড়ে এ মৌসুমে। সম্প্রতিকালে এ নদীর চারিপাশে স্থাপিত শিল্পকারখানা, অপরিকল্পিত আবাসন থেকে নির্গত দূষিত পানি ও ময়লা-আর্বজনার কারণে নদী তার প্রকৃতি সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। মৎস্য গবেষকদের নিরলস গবেষণায় এ চিত্র উঠে আসায় জাতীয় নদী রক্ষা কমিটি ও জাতীয় নদী ট্রাস্কর্পোস কমিটির সদস্যরা হালদার উজানের পরিবেশ রক্ষায় গত ১৬ জানুয়ারি জরুরি বৈঠকে বসেন। কিন্তু ওই গবেষকদল কিংবা সংশ্লিষ্টদের হয়ত জানা নেই হালদার উজানে নবউদ্যমে চলছে ‘বিষবৃক্ষ’ তামাক উৎপাদনের মহাযজ্ঞ! সরে জমিনে দেখা গেছে, হালদার উজান অংশ মানিকছড়ির বাটনাতলী, থলিবাড়ী, নামারপাড়া, ছদুরখীল, বড়বিল, তুলাবিল, গোরখানা, বাঞ্চারামপাড়া, হেডম্যানপাড়া, যোগ্যাছোলা এবং ফটিকছড়ির পিলখানা লোকালয়ের সমতল ভূমি এবং হালদার কাছাকাছি জনপদের দৃষ্টিজুড়ে তামাক আর তামাক! সমতল ভূমির যেদিকে দৃষ্ঠি যায় তামাকের সবুজ দৃশ্যে নয়ন জুড়িয়ে যায় । আর চুল্লির আশেপাশে গন্ধ আর গন্ধ! চুলার দূষিত পানি অনায়াসে নামছে হালদার উপ-শাখা ও প্রশাখাগুলোতে। অথচ এসব ছড়াগুলা থেকে মূল হালদার দূরত্ব ৩/৫ কিলোমিটার। 

এসব জনপদে হালদা চাষে কৃষকদের উদ্ধুদ্ধ করছে জেলা শহরে অবস্থানকারী ট্যোবাকো কোম্পানীর হর্তা-কর্তারা। তারা গ্রামের হত-দরিদ্র চাষাদের মাঝে দাঁদন হিসেবে অগ্রিম অর্থ বিতরণ করে তামাক চাষাবাদে উৎসাহ দিয়ে তা চাষ করাচ্ছে। ফলে অজ্ঞ কৃষকরা তামাকের ক্ষতিকর বিষয়ে না জেনে বসতবাড়ির আশেপাশে, নদীর চরে, কিংবা শাক-সবজির ক্ষেতে তামাক চাষ করেছে। উপজেলা কৃষি অফিস থেকে প্রাপ্ত কৃষি ঋণ সুবিধা নিয়ে অনেকে ধান ও সবজি চাষ না করে তামাক চাষ করেছে! নাম প্রকাশ না করার শর্তে ছদুরখীল ও তুলাবিলের একাধিক কৃষক জানান, ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকো থেকে ঋণ নিয়ে এ অঞ্চলের গ্রামীণ কৃষকরা তামাকের চাষ করেছে। এখন জমি থেকে পাতা তুলে চুল্লিতে তা পুড়াতে ব্যস্ত সবায়। প্রতিটি চুলায় ৭০ বেল তামাকপাতা এক সাথে পুরাতে হয়। প্রতি বেলে ৪০ কেজি। এক হেক্টর জমিতে কমপক্ষে ৭০ বেল পাতা হয়ে থাকে। আর এ পাতা পোড়াতে চার টন কাঠ প্রয়োজন হয়। এতে একদিকে যেমন তামাকের নিকোটিনে মানুষের শ্বাস-কষ্ট ও ক্যান্সার রোগ বাড়ছে। অন্যদিকে বন সম্পদ হচ্ছে সাবার। আর তামাকের ১নং পাতা ১৫০ টাকা কেজি হারে মাঠ পর্যায়ের কৃষকরা পায়। পাতা পোড়ানো শেষ হলে ট্রাকে ট্রাকে তা প্রশাসনের নাকের ডগা দিয়েই অনায়াসে সমতলে পাচার করা হয়। প্রকাশ্য এভাবে মানব দেহের ক্ষতিকর নিকোটিনের অবাধ চাষাবাদ হলেও প্রশাসন নিশ্চুপ! উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মোঃ শফিকুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের বার বার তামাকের কুফল সম্পর্কে অবহিত করেও ক্ষান্ত করা যাচ্ছে না। 

চাষাদের অজ্ঞতাকে পুঁজি করে তামাক উৎপাদনকারী সংস্থাগুলো দূর্গম লোকালয়ে চাষ অব্যাহত রাখছে। আমরা লোকালয়ে গিয়ে তামাকের ক্ষতিকর দিক সর্ম্পকে জনগণকে সচেতন করছি। তামাকের প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক ডা. মো. মহিউদ্দীন বলেন, এটি নিঃসন্দেহে দুঃসংবাদ! এর প্রভাবে এ এলাকায় শ্বাসকষ্ট ও ক্যান্সার রোগী বাড়তে শুরু করেছে। প্রতিদিন অসংখ্য শ্বাসকষ্টের রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসছে। অচিরেই যদি তামাকের চাষ রোধ করা না যায় তাহলে এ অঞ্চলের জন-জীবন হুমকির মুখে পড়বে! সবার উচিত দ্রুত এর ক্ষতিকর প্রভাব সর্ম্পকে জনসচেতনা সৃষ্টি করা। উপজেলা নির্বাহী অফিসার যুথিকা সরকার বলেন, তামাকের কুফল সর্ম্পকে জনগণকে অবহিত করলে কৃষকরা নিরুৎসাহিত হবে। এ জন্য প্রথমে জরুরি জনপ্রতিনিধিসহ সচেতন ব্যক্তিদের এগিয়ে আসা। বিষয়টি সরেজমিনে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। 

এ প্রসঙ্গে হালদার মৎস্য গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের সহযোগি অধ্যাপক মোঃ মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, হালদার জীববৈচিত্র রক্ষায় দেশী-বিদেশী সংস্থা এবং সরকার যখন আন্তরিকতার সাথে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করছেন ঠিক সে মুহূর্তে হালদার উজানে তামাক চাষের আগ্রাসন নদীটির পরিবেশকে নতুনভাবে সঙ্কটের মুখে পতিত করবে। অচিরেই হালদার উজানের তামাক চাষ বন্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবি জানাচ্ছি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন