রবিবার, ৪ অক্টোবর, ২০১৫

চীনে মুসলিম আবাস

উইঘুর উগ্রপন্থীদের জালে বাংলাদেশ?
থাইল্যান্ডে আশ্রয় নেওয়া উইঘুর শরণার্থীচলতি বছর চীন তার গণপ্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ৬৬ বছর, বাংলাদেশ-চীন কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৪০ বছর এবং শিনচিয়াংয়ের মুসলিমদের জন্য বিশেষ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল প্রতিষ্ঠার ৬০ বছর পূর্তি উদ্যাপন করছে। প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খান গত ৩১ আগস্ট থেকে ৯ সেপ্টেম্বর চীনের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ শিনচিয়াং ও রাজধানী বেইজিং সফর করেন। চীনের, বিশেষ করে শিনচিয়াংয়ে ধর্মীয় ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা নিয়ে তাঁর ধারাবাহিক প্রতিবেদনের প্রথম কিস্তি প্রকাশিত হলো আজ।

চীনের পশ্চিম অঞ্চলে অবস্থিত স্বর্ণ, তেল ও গ্যাসসম্পদে সমৃদ্ধ শিনচিয়াং প্রদেশটি আয়তনে ১০টি বাংলাদেশের সমান, আটটি দেশের সঙ্গে তার সীমান্ত আছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ১০ শতাংশ হওয়া সত্ত্বেও চীন সরকারের মতে প্রদেশটি অনগ্রসর। কিন্তু সেখানকার পশুপালনকারী রাখাল ছেলেটিরও মাসিক গড় আয় প্রায় ৯০ হাজার টাকা। এই প্রদেশে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। সোয়া দুই কোটি মানুষের মধ্যে এক কোটিই দেখতে মধ্য এশীয়দের মতো—উইঘুর সুন্নি মুসলমান। তারা চীনা নয়, উইঘুর ভাষায় কথা বলে, যা তুর্কি ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত। বিচ্ছিন্নতাবাদ ও ধর্মীয় জঙ্গিবাদের হিংসাত্মক তৎপরতায় জেরবার এই প্রদেশ। উইঘুর জঙ্গিদের প্রধান সংগঠন ইস্ট তুর্কিস্তান ইসলামিক মুভমেন্টকে (ইআইটিএম) যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করেছে। একই সঙ্গে তারা শিনচিয়াংয়ের মানবাধিকার পরিস্থিতি ও উইঘুরদের ওপর নিপীড়ন নিয়ে উচ্চকিত। মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে তুরস্ক চীনের সমালোচনায় উচ্চকিত। কিন্তু বিশ্বের অধিকাংশ দেশ শিনচিয়াংয়ের পরিস্থিতিকে চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে মনে করে।
চীনে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) চেয়ারম্যান মুন্সি ফয়েজ প্রথম আলোকে বলেন, পশ্চিমা জগৎ শিনচিয়াং নিয়ে যা বলে, তাতে অতিরঞ্জন আছে। আবার এও ঠিক যে তিব্বত ও শিনচিয়াং নিয়ে চীন সত্যিই সংকটে আছে। তবে বাংলাদেশ কখনো এ বিষয়ে বক্তব্য রাখেনি।
‘ভারত শিনচিয়াংয়ের পরিস্থিতিকে চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে মনে করে’, মুঠোফোনে প্রথম আলোকে মন্তব্য করেছেন ভারতের শীর্ষস্থানীয় বিদেশনীতি বিশ্লেষক ও কলামিস্ট সি. রাজামোহন। গত ১৭ আগস্ট থাইল্যান্ডের হিন্দু মন্দিরে সন্দেহভাজন উইঘুর উগ্রপন্থীদের বোমা হামলার বিষয়ে তিনি অবশ্য কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশীয় বিশেষজ্ঞ এবং সিল্করুট-সংক্রান্ত জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আফগানিস্তান ও পাকিস্তান টাস্কফোর্সের বিশেষজ্ঞ গ্রুপের সদস্য সিগফ্রিড ও. উলফ প্রথম আলোকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে শিনচিয়াংয়ের উগ্রপন্থীরা বাংলাদেশ ভূখণ্ড ব্যবহার করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) মনিরুজ্জামান, যিনি বর্তমানে ওয়াশিংটন সফর করছেন, তিনিও একই আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন।
বিশ্বের ১৩টি দেশের সাংবাদিকদের সঙ্গে সম্প্রতি শিনচিয়াং সফরে গিয়ে বারবার প্রশ্ন জেগেছে, এখানকার মুসলিম মৌলবাদীদের সঙ্গে কি বাংলাদেশের একশ্রেণির জিহাদিদের কোনো ধরনের যোগাযোগ ঘটে থাকতে পারে?
২ সেপ্টেম্বর শিনচিয়াং কলেজ অব এথনোলজি অ্যান্ড সোসিওলজির অধ্যাপক দিলমুরাত ওমর এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, ‘না, এখন পর্যন্ত আমরা বাংলাদেশের কোনো উগ্র গোষ্ঠীর সঙ্গে শিনচিয়াংয়ের উগ্র গোষ্ঠীর যোগসাজশের হদিস পাইনি।’
আট দিন বাদে ১০ সেপ্টেম্বরে ঢাকায় অবতরণ করেই পত্রপত্রিকায় শিরোনাম দেখলাম, ১৭ আগস্ট থাইল্যান্ডের একটি হিন্দু মন্দিরে বোমা হামলার প্রধান সন্দেহভাজন আইজান ঢাকায় এসেছিলেন। অবশ্য এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনাও হতে পারে। ওই বোমা হামলায় ২০ জন প্রাণ হারিয়েছে। থাইল্যান্ডের পুলিশ বলেছে, ইতিমধ্যে এটা পরিষ্কার হয়েছে যে এই হামলার পেছনে একটি আন্তরাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের সক্রিয়তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আরেক সন্দেহভাজন ব্যক্তি বিস্ফোরণের ঠিক আগে পাকিস্তানে প্রবেশ করে বলে পাকিস্তান সরকার স্বীকার করেছে। মালয়েশীয় সরকার দুই মালয়েশীয় ও একজন পাকিস্তানিকে গ্রেপ্তার করেছে। থাই পুলিশ বলেছে, তারা তাদের দেশের দক্ষিণ সীমান্তে রোহিঙ্গা পাচারের ওপর সাম্প্রতিক ক্র্যাকডাউনের আলোকেও বোমা হামলার বিষয়টি খতিয়ে দেখছে। মিয়ানমারে গ্রেপ্তার হওয়া এক বাংলাদেশির ব্যাপারেও সতর্ক রয়েছেন থাইরা।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় উইঘুর মুসলিমরা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বেশ জায়গা করে নিচ্ছে। ধারণা করা হয়, গত জুলাইয়ে থাইল্যান্ডে আশ্রয় নেওয়া ১০৯টি উইঘুর পরিবারকে জবরদস্তি করে চীনের কাছে হস্তান্তর করার কারণে থাইল্যান্ডে প্রতিশোধমূলক হামলার ঘটনা ঘটে। ২২ সেপ্টেম্বর থাই পুলিশপ্রধান জেনারেল সোমিয়ত বলেন, ‘গত মে মাসে রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশিদের গণকবর আবিষ্কারের সময় অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানে চীনা উইঘুররাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমরা আন্তর্দেশীয় আদম পাচারের আস্তানা গুঁড়িয়ে দিয়েছিলাম। এটা তারই প্রতিশোধ।’
ঢাকার চীনা দূতাবাসের একজন মুখপাত্র প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা বিষয়টি মিডিয়ায় দেখেছেন। এখন তদন্ত করে দেখছেন।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো চীনা উগ্রপন্থীর বাংলাদেশে অবস্থান প্রকাশ পেল। এটা দুঃখজনক যে পুলিশ প্রথমে এটা স্বীকার করতে চায়নি। পরে থাই সরকারের চাপের মুখে তারা স্বীকার করেছে। তাদের উচিত হবে এ বিষয়ে একটি সর্বাত্মক তদন্ত চালানো; বাংলাদেশ সাম্প্রতিক কালে নাশকতাকারীদের একটি আঞ্চলিক নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে। গত ১৫ আগস্টকে ঘিরে ভারতে সম্ভাব্য হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে হায়দরাবাদে সম্প্রতি বাংলাদেশি হুজির দুজন সদস্য ধরা পড়েছে।’
উল্লেখ্য, উইঘুর উগ্রপন্থীরা সিরিয়া, আইএস, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও ভিয়েতনামে ছড়িয়ে পড়েছে। শিনচিয়াং পরিস্থিতি সম্পর্কে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ জেনারেল মনিরুজ্জামান বলেন, ‘অন্তত এটা অনুমেয় যে ওই চীনা সন্দেহভাজন আইজানের পক্ষে একটি সমর্থক নেটওয়ার্ক ঢাকায় থাকলেও থাকতে পারে। বাংলাদেশে নিরাপদে তাঁর দুই সপ্তাহ অবস্থানও ইঙ্গিত দেয় যে এ দেশে তাঁর পূর্বযোগাযোগ থাকতে পারে। এটাও লক্ষণীয় যে থাইল্যান্ডের নাশকতার পরিকল্পনা করে তিনি ঠিক বিস্ফোরণের দিনটিতে বাংলাদেশে থাকাই তাঁর পরিকল্পনার জন্য অনুকূল ও নিজের জন্য বেশি নিরাপদ মনে করেছেন। তাই আমি বলব, বাংলাদেশ একটি নতুন নিরাপত্তাগত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।’
অবশ্য সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ, যিনি চীনা ভাষা রপ্ত করেছেন এবং একাধিকবার শিনচিয়াং সফর করেছেন, তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টিকে অবশ্যই সঠিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা উচিত। চীনের পশ্চিমাঞ্চল বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরে। সুতরাং, সেখানকার উগ্রপন্থীদের বাংলাদেশের জঙ্গিদের সঙ্গে যোগসাজশ করে ফায়দা লাভ করা দুরূহ।
মুন্সি ফয়েজের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে জার্মান বিশেষজ্ঞ সিগফ্রিড বলেন, ‘একে একটি ইঙ্গিত হিসেবে দেখতে হবে যে উইঘুর সন্ত্রাসীরা তাদের লক্ষ্য ও কৌশলগত পরিধি বিস্তৃত করছে। তাদের লক্ষ্য কেবল শিনচিয়াংয়ের স্বায়ত্তশাসন কিংবা বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্য লড়াই চালানো নয় বরং আন্তর্জাতিকভাবে “মূলধারার জিহাদের” সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করা। এটা মনে রেখেই উল্লেখ করা প্রয়োজন যে বাংলাদেশ একটি অসাধারণ ভূরাজনৈতিক অবস্থানে রয়েছে।’ ভবিষ্যতে হতে পারে, তবে এই মুহূর্তে বাংলাদেশকে উইঘুুরদের ব্যবহার জুতসই নয়, মন্তব্য করেছেন ডিবির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম। উল্লেখ্য, ১৬ থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর ইন্টারপোল তুরস্কে ‘বিদেশি সন্ত্রাসী যোদ্ধা’ বিষয়ে প্রায় ৫০টি দেশের গোয়েন্দাদের নিয়ে বৈঠক করেছে, যার মধ্যে বাংলাদেশও ছিল। এতে নিবন্ধকারদের অনেকেই চীনাসহ বিদেশি জঙ্গিদের মধ্যে আন্তর্দেশীয় যোগাযোগ জোরালো হওয়ার কথা উল্লেখ করেন। মনিরুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের কেউ কেউ মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছেন।
এদিকে পুলিশ কর্মকর্তাদের অনেকে নিরাপদে আইজানের ঢাকায় অবস্থান এবং প্রস্থানের ঘটনায় বিস্মিত হয়েছেন। পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (গণমাধ্যম ও জনসংযোগ) মো. নজরুল ইসলাম ১৯ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোকে বলেন, ‘থাই সরকার আমাদের ১০ সেপ্টেম্বরে আইজানের উপস্থিতির কথা জানিয়েছিল। এর ১০ দিন আগেই তিনি বাংলাদেশ ত্যাগ করেন। বাংলাদেশে অবস্থানকালে তিনি কোথায়, কীভাবে ছিলেন, তা এখন গোয়েন্দারা খতিয়ে দেখছে।’ তবে গতকাল সোমবার ডিবির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘১৬ সেপ্টেম্বর তিনি বাংলাদেশ বিমানে চেপে ঢাকায় পৌঁছানোর আগে ঢাকা বুকিংডটকমের মাধ্যমে বনানীর একটি মধ্যম মানের হোটেলে রিজার্ভেশনের চেষ্টা করেন। কিন্তু বাংলাদেশে প্রায় তিন সপ্তাহ অবস্থানকালে ওই হোটেলে তিনি ওঠেননি। চলতি বছরে ঢাকায় এটি ছিল তাঁর দ্বিতীয় সফর।’ ইন্টারপোল আইজানের বিষয়ে বাংলাদেশের কাছে তথ্য চেয়েছে।
চীনের মোট ভূখণ্ডের ছয় ভাগের এক ভাগজুড়ে থাকা প্রদেশটিতে দীর্ঘকাল ধরে চাপা রাজনৈতিক উত্তেজনা ও ধরপাকড় চলছে। ১ থেকে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শিনচিয়াং ও বেইজিংয়ে বাংলাদেশসহ ১৩টি দেশের ২৩ জন জ্যেষ্ঠ মিডিয়া প্রতিনিধির সঙ্গে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ও সরকারি কর্মকর্তারা সিল্করুট বাস্তবায়ন, ধর্মীয় উগ্রতা ও সন্ত্রাস দমন বিষয়ে মতবিনিময় করেন। তাঁরা বলেছেন, শিনচিয়াং পরিস্থিতি চীন সরকারের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং সেখানে ব্যাপকভিত্তিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়িত হচ্ছে। তবে ধর্মীয় উগ্রবাদ ও সন্ত্রাস শিনচিয়াংয়ের উন্নয়নের প্রতি একটি হুমকি হয়ে আছে। উইঘুুর সন্ত্রাসীরা বিদেশের মাটিতে ‘কামানের গোলা’ হিসেবে বিক্রিও হচ্ছে।
ধর্মীয় স্বাধীনতা মানে বিধিনিষেধ না থাকা নয়
শিনচিয়াংয়ের কাশগরের সড়কদ্বীপে মুসলিম ঐতিহ্যপ্রশ্ন করতেই ভদ্রলোক বললেন, ধর্ম সম্পর্কে তিনি তাঁর মনোভাব জনসমক্ষে প্রকাশ করেন না। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি নিয়ে পড়েছেন। এখন পেশায় দোভাষী। তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। কিন্তু তিনি নিজে এর সদস্য হতে আগ্রহী হননি। বললেন, ‘আমি আমার ধর্মবিশ্বাস সমাজে ফলাও করে প্রচার করি না, কিন্তু সেটা আইনের ভয়ে নয়। আইনে বাধাও নেই। কিন্তু আমি অন্যের ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি সংবেদনশীল।’ চীনের সরকারি অফিস-আদালতে যত ধরনের ফরম পূরণ করতে হয়, তার কোথাও চীনা নাগরিকদের বাধ্যতামূলকভাবে ধর্মবিশ্বাস প্রকাশ করতে হয় না। ১৮ বছর বয়সে যে-কেউ তাঁর ধর্ম পরিবর্তন করতে পারেন।
২ সেপ্টেম্বর চীনের মুসলিম-অধ্যুষিত পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ শিনচিয়াংয়ের ইনস্টিটিউট অব এথনোলজি অ্যান্ড সোসিওলজির পরিচালক অধ্যাপক দিলমুরাত ওমর বাংলাদেশসহ ১৩টি দেশের ২৩ জন জ্যেষ্ঠ মিডিয়া প্রতিনিধির সামনে চীনের ধর্মীয় নীতি ও মুসলিম-অধ্যুষিত শিনচিয়াংয়ের বর্তমান পরিস্থিতি বিষয়ে একটি নিবন্ধ পেশ করেন। এতে উল্লেখ করা হয়, ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রশ্নে চীন এমন এক নীতি অনুসরণ করছে, যার মূল কথা হলো, ‘চীন ধর্মীয় স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তাই বলে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন ধর্মের প্রশ্নে কারও ওপর জোরাজুরি করতে পারে না। ধর্মীয় স্বাধীনতা মানে বিধিনিষেধ না থাকা নয়। কারও ধর্মীয় বিশ্বাস থাকুক আর না-ই থাকুক, তা নিয়ে কোনো বৈষম্য চলবে না। এ বিষয়ে কোনো ব্যত্যয় বা আইন লঙ্ঘিত হওয়া মাত্রই তার প্রতিকার হতে হবে।’
উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের ২০১৫ সালের বার্ষিক ধর্মীয় স্বাধীনতাবিষয়ক প্রতিবেদন বলেছে, ‘চীনা সংবিধানে ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা আছে। তবে পাঁচটি (বৌদ্ধ, তাও, ইসলাম, ক্যাথলিক ও প্রোটেস্টান্ট) নিবন্ধিত ধর্মের অনুসারীরা ধর্মকর্ম পালন করতে পারেন। এর বাইরের ধর্মাবলম্বীরা বেশি দুর্বল। চীনা সরকার ও পার্টির সদস্যসহ ৭০০ মিলিয়নের বেশি লোকের কোনো ধর্মীয় পরিচয় নেই। কিন্তু ধর্মানুসারীরা শক্তিশালী এবং সংখ্যায় বাড়ছে। চীনে লোকধর্ম অনুসারী ২৯৪ মিলিয়নের বেশি, বৌদ্ধ ২৪০ মিলিয়নের বেশি, খ্রিষ্টান ৬৮ মিলিয়ন এবং প্রায় ২৫ মিলিয়ন মুসলমান।’
চীনের মোট মুসলিম জনসংখ্যার অর্ধেকের বাস শিনচিয়াংয়ে, প্রদেশটির ২ কোটি ১৮ লাখ লোকের মধ্যে দেড় কোটি উইঘুর মুসলিম। ইসলাম ছাড়া সেখানে বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, ক্যাথলিক, প্রাচ্যদেশীয় খ্রিষ্টধর্ম বা ইস্টার্ন অর্থোডক্সি ও তাওধর্ম রয়েছে। অধ্যাপক দিলমুরাতের ভাষায়, শিনচিয়াং ধর্মের পাঁচ প্রকৃতি: যৌথতা, নৃতাত্ত্বিকতা, ধারাবাহিকতা, আন্তর্জাতিকতা ও মিশ্রতা। তাঁর বর্ণনায়, শিনচিয়াং ইসলামের সাতটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ১. দীর্ঘ ইতিহাসের সঙ্গে মিশেছে ঐতিহ্যগত জাতিগত সংস্কৃতি, ২. সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম ইসলাম, ৩. সমাজ রক্ষণশীল ও বদ্ধ, ৪. ধর্মীয় ইস্যু রাজনৈতিক ইস্যুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। ৫. বিশিষ্ট আলেম ও উলামারা স্থানীয় মুসল্লিদের ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেন। ৬. ধর্মীয় ইস্যু সর্বদাই জাতিগত ইস্যুর সঙ্গে সম্পৃক্ত। ৭. সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো, উইঘুর জাতিগত সংখ্যালঘু গঠনে ইসলাম অসামান্য ভূমিকা রেখেছে।
উইঘুরদের সম্পর্কে মার্কিন প্রতিবেদন বলেছে, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার নামে তারা প্রদেশটিতে মুসলিমদের ওপর ‘নিগ্রহ’ (দ্য ইকোনমিস্টও ‘নিগ্রহ’ শব্দটি ব্যবহার করে) বাড়িয়েছে। সেখানে সহিংস উইঘুর প্রত্যাঘাত (রিপ্রাইজাল) বাড়ছে। এই প্রতিবেদনে এ কথাও আছে, ‘উইঘুর, তিব্বতের বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টানরা নজিরবিহীন পীড়নের শিকার।’
গত মার্চে ওয়াশিংটন-ভিত্তিক পিউ রিসার্চ সেন্টার বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল ২৫টি দেশের ধর্মীয় স্বাধীনতার চিত্র এঁকে বলেছে, চীন ও ভারতে উচ্চমাত্রায় নিপীড়ন চলে, যুক্তরাষ্ট্রে ও বাংলাদেশে ধর্মীয় প্রশ্নে সামাজিক বৈরিতা বেড়েছে। গত ১১ জুলাই দ্য ইকোনমিস্ট লিখেছে, ‘চীন যদিও রোজা নিষিদ্ধ না করার দাবি করেছে; কিন্তু তারা সত্যিই উইঘুর সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণ করছে, সে তার আমলা, শিক্ষক ও ছাত্রদের রোজা না রাখতে বলেছে।’ চীন পশ্চিমা মিডিয়ার এই প্রতিবেদনকে পাশ্চাত্যের ‘রোগ’ হিসেবে দেখে থাকে। গত আগস্টে বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত মা মিংশিয়াং প্রথম আলোর দপ্তরে বলেছিলেন, এই রোজা নিষিদ্ধ করার বিষয়টি একটি নির্জলা অসত্য প্রচারণা। আরেক চীনা কূটনীতিক প্রতিবেদককে বলেন, পশ্চিমা মিডিয়ার দাবিমতে এটা শিনচিয়াংয়ে ঘটেছে, তাহলে চীনের অবশিষ্ট মুসলমানরা কী করে নির্বিঘ্নে রোজা রাখেন? অধ্যাপক দিলমুরাত ওমর জানান, শিনচিয়াংয়ে তাঁর পরিবার ও আত্মীয়স্বজন রোজা রেখেছেন। গত জুনে আল-জাজিরা, সিএনএন, ব্রিটেনের টেলিগ্রাফসহ আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশ করা হয়েছিল যে শিনচিয়াংয়ে রোজা রাখার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। চীন তাৎক্ষণিক তা অসত্য বলে নাকচ করেছে। তবে এই খবর চীনা কর্মকর্তাদের এখনো পীড়িত করে। এ-সংক্রান্ত এক প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক দিলমুরাত ওমর অবশ্য উল্লেখ করেন, ‘কর্মক্ষেত্রে ধর্মীয় আচার–অনুষ্ঠানের সুযোগ নেই।’
উল্লেখ্য, শিনচিয়াং জনসংখ্যার মধ্যে উইঘুর ৪৭ শতাংশ। আর মুসলমানদের মধ্যে তারাই ৮০ শতাংশ। বাকি ২০ শতাংশ হলো অন্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। এরা হলো কাজাখ, কিরগিজ, তাজিক, তাতার, দংশিয়াং, পাওয়ান ও সালার। এদের বেশির ভাগই সুন্নি। তবে তাই বলে তাদের সংস্কৃতি ও রীতিনীতি কিন্তু মোটেই এক নয়। এমনকি তাদের মসজিদের গঠনশৈলীতেও ভিন্নতা আছে। দশম শতাব্দীতে ইসলাম এসেছে শিনচিয়াংয়ে। শিনচিয়াংয়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নি উইঘুর মুসলিমরা অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘুর চেয়ে উন্নতি কতটা করেছে—এর উত্তরে বলা হয়েছে, উন্নয়ন নিয়ে তারা তুলনামূলক আলোচনা করে এলাকার সঙ্গে এলাকার, সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্প্রদায়ের নয়। চীনা কর্মকর্তারা স্বীকার করেন যে উইঘুর-অধ্যুষিত দক্ষিণ শিনচিয়াং উত্তরাঞ্চলের হানদের চেয়ে অনগ্রসর। চীনাভাষী হানরা প্রদেশটির জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ। কর্মকর্তরা এ–ও স্মরণ করিয়ে দেন, কোনো একটি ধর্মের লোক সংখ্যায় বেশি হলেও তারা পুরো জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে না। চীনে ৫৫ জাতিগত সংখ্যালঘুর বাস, কমবেশি সবারই আবাস রয়েছে শিনচিয়াংয়ে।
সরকারি নীতি হলো, সবার আগে মানুষ পরিচয়। অধ্যাপক দিলমুরাত ওমর ব্যাখ্যা করলেন এভাবে: ‘ধর্মীয় নেতা ও ধর্মীয় অনুসারীরা সবার আগে চীনের নাগরিক হবেন। তাঁরা জাতি ও জনগণের স্বার্থ সবার ওপরে স্থান দেবেন এবং সংবিধান, আইন ও নীতির প্রতি তাঁরা তাঁদের দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবেন।’
এক কোটির বেশি মুসলিমের প্রদেশ শিনচিয়াংয়ে মসজিদের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। চীনের অন্য অঞ্চলের মুসলিমদের চেয়ে তাদের ধর্মকর্ম পালনের আলাদা রীতিনীতি স্পষ্ট। চীনা সরকারের উন্মুক্তকরণ ও সংস্কারনীতি বাস্তবায়নের শুরুতে মসজিদ ছিল দুই হাজার, এখন তা ২৪ হাজার ১০০। মুফতির সংখ্যাও তিন হাজার থেকে ২৮ হাজারে উন্নীত হয়েছে। তবে যে-কেউ যেকোনো স্থানে চাইলেই মসজিদ বানাতে পারেন না। এ বিষয়ে সরকারি বিধিবিধান আছে। সেটা মেনে দরখাস্ত করতে হয়। সরকারি পরিদর্শকের অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু তা নির্মাণে সরকারি অর্থ ব্যয় হয় না। যদিও সরকারের বিশেষ বরাদ্দে মসজিদের উন্নয়ন ঘটে। মসজিদ ও তার স্টাফের বেতন স্থানীয়ভাবে মুসল্লিরাই বহন করেন। অধ্যাপক দিলমুরাত ওমর প্রথম আলোকে বলেন, ‘ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সরকারি অর্থ খরচ করা হয় না, কারণ চীন রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে পৃথক্করণের নীতি অনুসরণ করে থাকে।’ তবে মুফতিরা বেশ প্রভাবশালী। মুসল্লিদের ওপর তাঁদের প্রভাব যথেষ্ট। মসজিদের খুতবার বক্তব্য কঠোরভাবে ধর্মীয় অনুশাসন ব্যাখ্যার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। তবে ধর্মের প্রশ্নে তাঁরা খুতবায় সরকারি নীতি কী, সেটা ব্যাখ্যা করে থাকেন। ফতোয়াবাজি নেই। ফতোয়ার কারণে শাস্তিভোগ নেই। তবে অধ্যাপক দিলমুরাত ওমর ইঙ্গিত দেন, কট্টরপন্থীদের কেউ কেউ ফতোয়া দেওয়ার কিছু চেষ্টা চালিয়ে থাকেন।
১৪৪২ সালে নির্মিত কাশগরের ঈদগাহ মসজিদে প্রতিদিন দুই থেকে তিন হাজার মুসল্লি নামাজ পড়েন। শুক্রবার মুসল্লির সংখ্যা ছয় হাজার ছাড়িয়ে যায়। বৃহত্তম উৎসব ঈদুল আজহা। ঈদগাহ মসজিদে কমপক্ষে ৩০ হাজার লোক নামাজ আদায় শেষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দেন। এই মসজিদের সামনেই বর্ণাঢ্য উৎসবমুখর পরিবেশে তিন দিন ধরে চলে দলগত সামা নৃত্য। গত ৫ সেপ্টেম্বর এই মসজিদ পরিদর্শনকালে এর চত্বরে একটি মাত্র মাইক চোখে পড়ল। মাইকে আজানের ধ্বনি নির্দিষ্ট মাত্রায় ভেসে আসে। এই মাত্রা আইন দ্বারা নির্দিষ্ট করা আছে। আজানের ধ্বনি আশপাশে যাঁরা নিয়মিত নামাজে আসেন, তাঁরাই কেবল শুনতে পান বলে উইঘুর নারী দোভাষী উল্লেখ করলেন। তবে মসজিদ-সংলগ্ন বাজারে যথারীতি টুপি ও তসবির দোকানের কোনো কমতি নেই।
উল্লেখ্য, ধর্মীয় উগ্রতা ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় শিনচিয়াং প্রদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ‘বিজ্ঞানসম্মত পাঁচটি প্রধান কর্মকৌশল’ গ্রহণ করেছেন। এর আওতায় ধর্মীয় আইনের উদ্দেশ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা, লোকজ রীতি সংরক্ষণ, নির্দিষ্টভাবে সমস্যা চিহ্নিতকরণ এবং সে অনুযায়ী সমাধান দেওয়া, ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ও ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাপূর্ণ আচরণ দেখানো ও তা উপলব্ধিতে নেওয়া এবং সরকারি আদেশ দিয়ে পরিবর্তন চাপিয়ে দেওয়ার নীতি পরিহার করার বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

বাকস্বাধীনতাই কি শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি?
চীনে মুদ্রণমাধ্যমে প্রকাশিত কিছু পত্রিকার প্রচ্ছদশিনচিয়াংয়ে চীনের সিনহুয়া নিউজ এজেন্সির ডেপুটি এডিটর ইন চিফ হা চানচুন এবং বেইজিংয়ে চায়না পিক্টোরিয়ালের ডেপুটি এডিটর ইন চিফের সঙ্গে চীনা গণমাধ্যমের সাম্প্রতিক প্রবণতা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার সুযোগ হলো। এককথায় যা বুঝলাম, তা হলো, আমরা যেভাবে সরকার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে মিডিয়ার স্বাধীনতা বুঝি, সেভাবে তাঁরা বোঝেন না। মিডিয়া চীনা শাসনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
তাঁরা মরিয়া হয়ে নিজেদের বিশালত্ব বোঝানোর চেষ্টা করেন। সিসিটিভির (চায়না সেন্ট্রাল টেলিভিশন) ৫০ তলা ভবনে গিয়েও মনে হলো, তারা অবয়বে কত বড়, সেটা দেখিয়েই বিশ্বকে মুগ্ধ করতে চায়। বিশ্ব সিনহুয়া বা সিসিটিভি প্রচারিত খবরকে কতটা বিশ্বাসযোগ্য মনে করে, সেটা জানা-বোঝা বা যাচাইয়ের ব্যাপারে তারা কান খাড়া করে রেখেছে, তা কখনো মনে হয়নি।
কিন্তু সিনহুয়ার ওই সাংবাদিক এটা বলে গর্ববোধ করছিলেন যে সিনহুয়া একটি বিশ্বমানের সংবাদ সংস্থা। এই ‘বিশ্বমান’ কথাটার মানে হলো, তারা রয়টার্স, এপি, এএফপির সমকক্ষ। কিছু দিক থেকে নিশ্চয় তুলনীয়, কিন্তু সর্বজনীন মর্যাদা ও বিশ্বাসযোগ্যতার দিক থেকে?
চীনা প্রশাসনিক ব্যবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল—এমন একজনকে বললাম, মুশকিলটা কি জানেন, সিনহুয়া বা সিসিটিভি বিশ্বের যে প্রান্তে বসেই কোনো সর্বোচ্চ গুণমান দিয়ে কোনো খবর প্রচার করুক না কেন, ওতে অনেক পাঠক চীনা সরকারের গন্ধ পাবেন। এটা থাকলে স্বাধীনতার হানি ঘটে। তিনি একমত হলেন। বললেন, বড় নেতাদের ভেতরকার দুর্নীতির খবর প্রকাশের পর শুনলাম নিউইয়র্ক টাইমস আর পড়তে দেওয়া হয় না। ওর ওয়েবসাইট দেখা যায় না।
তিনি আরও বললেন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে অনেক দিন ধরেই পার্টিতে আলোচনা চলছে। কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা যাচ্ছে না। বললাম, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের মতোই এই খাতে চীন বেসরকারি বিনিয়োগকে শর্ত সাপেক্ষে উৎসাহিত করতে পারে। চীনা নেতারা ভবিষ্যতে মিডিয়ার ওপর কঠোর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ থাকাকে রাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক মনে করলে অবাক হব না।
বিপদটা হলো সত্য জানতে না পারা, বা কম জানতে পারার কারণে সুশাসনে ঘাটতি পড়া। তথ্যের অবাধ প্রবাহ—দুর্ভিক্ষ বা অপশাসন, দুটোরই রাশ টানতে পারে। সিসিটিভি দিয়ে সিপিসি শাসনের স্থিতাবস্থাকে আরও দীর্ঘকাল আগলে রাখা যেতে পারে; কিন্তু বিশ্ববাসীর সমীহ অর্জনটা বহুলাংশে অধরা থেকে যেতে পারে। আমি বিনা শর্তে পশ্চিমা ধাঁচের স্বাধীনতাকে নকল করতে বলি না। আমরা ভুলব না, ইরাক ও আফগানিস্তানে মুসলিম নিধনে বুশের উন্মাদনাকে তথাকথিত মূলধারার পশ্চিমা মিডিয়া কবুল করেছিল।
চীন চায় গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও আইনের শাসন চীনা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হোক। কিন্তু মিডিয়ায় তা অতটা চলবে কী। দেখলাম, মিডিয়ার চীনায়িত হওয়া নয়, বিশ্বায়িত হওয়ারই আকাঙ্ক্ষা তাদের তীব্র। চানচুন বলেছেন, ‘প্রথমত জনমত, বিশেষ করে নিউ মিডিয়া আসার পরে আরও বেশি বিচিত্র হতে বসেছে। ইন্টারনেটের কারণে “অবৈধ তৎপরতা” বেড়েই চলেছে। সামাজিক স্থিতিশীলতা ও চীনা অর্থনীতি সুরক্ষায় কোনো একটিমাত্র “মূলধারার জনমত” নির্দিষ্ট করা কষ্টসাধ্য হয়ে উঠছে। চলতি চীনা সমাজ একটি ক্রান্তিকাল পার করছে। চীন ক্রমবর্ধমান হারে অধিকতর ভিন্নমতের আদর্শ, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা স্পষ্ট হয়ে উঠছে।’ আমার বিবেচনায় চীনে নীরবে যে একটি ভিন্নধর্মী সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটছে, এসব হয়তো তারই লক্ষণ।
দ্বিতীয়ত, তথ্য যোগাযোগের ডিজিটালাইজেশন ঐতিহ্যগত নিয়ন্ত্রণকে ছারখার করে দিচ্ছে। শিনচিয়াং থেকে বেইজিং—সর্বত্র দেখলাম পর্নোর ছড়াছড়ি। গুগল, ফেসবুক যারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তারা কেন পর্নো আটকাতে পারে না। চীনা বাইদু ডটকম নাকি এক শক্তিমানের। গত নভেম্বরে বেইজিংয়ে জ্যেষ্ঠ এক চীনা নেতা ফেসবুক নিয়ন্ত্রণের পক্ষে যুক্তি দিতে তাঁর স্কুলগামী মেয়ের নৈতিকতা সুরক্ষার কথা বলেছিলেন। কিন্তু বাইদু ডটকমে এ কী দেখলাম। চীনারা অবশ্য মানছেন, জনমত গঠনে মিডিয়া আগের চেয়ে বেশি প্রভাব ফেলছে। মুদ্রণ সংবাদপত্র মুখ থুবড়ে পড়লেও নাসদা, সিনো উইবো (চীনা টুইটার) স্টক মার্কেটে মিলিয়ন ডলার ব্যবসা করছে।
তবে চানচুন তৃতীয় যেটা বললেন, সেটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এটা চীনের এক নম্বর চ্যালেঞ্জ। চানচুন বলেন, ‘চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি, কিন্তু বিশ্বে দ্রুত বর্ধনশীল চীনের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি যেভাবে বাড়ছে, তার সঙ্গে চীন সম্পর্কে বিশ্ববাসীর মনে যে “গৎবাঁধা ভাবমূর্তি” রয়েছে, তার মধ্যে “ব্যবধান” আরও বাড়ছে।’ এর সরল মানে দাঁড়ায়, চীন বড় ধনীর মর্যাদা পাচ্ছে। বড় মিয়ার মাথায় মানুষ ছাতাও ধরছে। কিন্তু মিডিয়া-মর্যাদায় ঘাটতি চলছেই। চীনের চিনচিনে ব্যথাটা এখানেই।
ডাক্তারদের মতো চীনও সাংবাদিকদের লাইসেন্স দিচ্ছে। এর সঙ্গে নাকি নিয়ন্ত্রণের সম্পর্ক নেই। কারণ, নীতি মানতে হবে। কিন্তু এসব লঙ্ঘনের দায়ে সাম্প্রতিক কালে কতজন জেলে গেছেন? সেমিনারে আমার প্রশ্নের উত্তরে চানচুন বললেন, কিছু বিচ্যুতির জন্য শাস্তি হয়েছে।
চীন তার অর্থনৈতিক সফট পাওয়ারের জোর খাটিয়ে আমেরিকার মোড়লিপনায় ভাগ বসিয়ে আসছিল। কিন্তু এখন তার নতুন অনুভূতি হলো নিউ মিডিয়ার রাজত্বে এই সফট পাওয়ার আর ধন্বন্তরি মনে হচ্ছে না। তাই চিনচান বলছেন, ‘চীনা
সফট পাওয়ার বৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক বিষয়-আশয় পরিচালনায় চীনাদের সম্পৃক্ত থাকার কাজ অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় কঠিনতর হয়ে
পড়েছে।’ বিশ্ব শাসনে মিডিয়া চাই। তাই ‘সভ্যতার সংঘাতের’ পরিবর্তে কি সামনে চোখ ধাঁধাবে নিউ মিডিয়া সংঘাত?
১ হাজার ৯০০ দৈনিক সংবাদপত্র এবং ৯ হাজার ৮০০ সাময়িকীর একটিও আরামবাগ মার্কা প্রকাশনা নয়। তিন হাজারের বেশি চ্যানেলসহ প্রায় আড়াই শ টিভি স্টেশন নিয়ে চীন ই-শাসনের নবযাত্রায় শামিল হয়ে গেছে। তার প্রতিটি প্রদেশ, পৌরসভা ও স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল প্রশাসনিকভাবে কেব্ল টিভির মাধ্যমে যুক্ত। ২ হাজার ৭০০ ফ্রিকোয়েন্সিসহ ২০০ রেডিও স্টেশনও কিন্তু ই-শাসন, বিনোদন ও খবরের জোগান দিচ্ছে। তবে, সেগুলোতে সরকার বা দলের নিয়ন্ত্রণ কতটুকু, তা অস্পষ্ট। উইঘুরসহ বড় জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিজ নিজ ভাষায় টিভি চ্যানেল আছে। সবচেয়ে চমকপ্রদ হলো, মুদ্রণমাধ্যমের দোকানপাট যখন ধুপধাপ বন্ধ এবং তার সার্বিক বিজ্ঞাপন যথেষ্ট কমে গেছে, তখনো চীনা জিডিপির প্রবৃদ্ধির তুলনায় চীনা মিডিয়াশিল্পের জিডিপির প্রবৃদ্ধি বেশি। আসলে কাগজ সভ্যতার সূতিকাগার চীন ইতিমধ্যে কাগজমুক্ত এক নতুন সভ্যতা গড়ে তুলেছে। ‘রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত’ সিনহুয়া ডেইলি টেলিগ্রাফ প্রতিদিন ১৬ লাখ ছাপে, স্বাধীন নিউইয়র্ক টাইমস–এর চেয়ে তা ৩ লাখ বেশি। নারীদের সাপ্তাহিক ফেমিনা ১৬ লাখের বেশি। আর চীনের শীর্ষ দৈনিক রেফারেন্স নিউজ-এর দাম ১৫ শতাংশ বৃদ্ধির পরেও ৩২ লাখ ছাপা হয়।
‘নিউ মিডিয়া’ নয়া চীন তৈরি করছে। কোটি কোটি মানুষ রাতবিরাতে অবাধে ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের ‘কথা’ বলছেন। বিনিসুতোর এই কথামালায় চীনের বাক্স্বাধীনতা বাড়ছে। এই কথামালা চীনের সব কটি জানালা খুলে দিতে পারে। সামাজিক মিডিয়ার প্রবৃদ্ধি ‘বিস্ফোরণোন্মুখ’। মাত্র চার বছর আগে চীনে ব্লগ ও দুই বছর আগে চ্যাট এসেছে। ১৩৭ কোটি মানুষের দেশটির ৩০ কোটি লোক বছর না ঘুরতেই ‘উইচ্যাট’-এ নিবন্ধিত হয়েছে। এই উইচ্যাট প্রতিমুহূর্তে এক চীনা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ স্বাধীন সমাজের রূপান্তরকরণ তীব্র করছে। নিউ মিডিয়াকে তারা জনমত যাচাইনির্ভর ই-শাসনে; বিশেষ করে নেতাদের জবাবদিহি ও প্রশাসন চালানোর ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারে।
শিনচিয়াংয়ের বৃহৎ টিভি ভবনে প্রশ্ন করলাম, এই যে এতগুলো চ্যানেলে খবর ও অনুষ্ঠান সম্প্রচার চলে, তার এক নম্বর ব্যক্তি কে? কোনটি যাবে আর কোনটি যাবে না, তা ঠিক করেন কে? উত্তর পেলাম, এটা একটি মাথা থেকে আসা কোনো ব্যাপার নয়, সম্পাদকীয় পর্ষদ নীতি অনুযায়ী যে যার মতো সিদ্ধান্ত নেয়।
চীনে সংস্কার কথাটি সবচেয়ে জনপ্রিয়। তাদের নয়া নীতি—গো গ্লোবাল। এরও সারকথা হলো চীনের আন্তর্জাতিক মর্যাদার সঙ্গে তার তথ্য যোগাযোগ ঘাটতি পূরণ করা। কত দ্রুত তারা নিজেদের বদলাতে পারে, সেটা সত্যি অনুকরণীয়। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং মূলধারার মিডিয়ার সংস্কারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে বলেছেন। চীনারা গর্বের সঙ্গে বলেন, ইন্টারনেটের সঙ্গে খাপ খাওয়াতেই ৩ হাজারের বেশি খবরের কাগজ ও সাময়িকীর সাড়ে ৯৬ শতাংশ, ৫৮০টির বেশি প্রকাশনা সংস্থা, ৩ হাজারের বেশি সিনহুয়া
বুকস্টোর, ৮৫০টি চিত্র তৈরি সংস্থা, ৫৭ টিভি সিরিজ নির্মাতা ও ৩৮টি দলীয় পত্রিকা বণ্টন ইউনিট রকেটগতিতে ‘এন্টারপ্রাইজে’, অর্থাৎ নতুন ধাঁচের কাঠামোতে পরিণত হয়েছে। এগুলো জনবিচ্ছিন্ন নয়। কিন্তু তাদের চাই বিশ্ববাসীর মর্যাদা। উইঘুরের মুসলমানরা রোজা রাখতে পারেন না—এই রকম খবর চীনা মিডিয়া নাকচ করলেও তা পশ্চিমা মিডিয়ার অতিরঞ্জন বা বিভ্রান্তিকর খবরকেই বেশি বিশ্বাসযোগ্য করে রাখে। এটাই চীনের অস্বস্তি।
‘পশ্চিমা মিডিয়ার একচেটিয়া প্যাটার্ন’ তাই চীন ভাঙতে চায়। ‘প্রাচ্যের চেয়ে পাশ্চাত্য শ্রেষ্ঠ’—চীন এই গতানুগতিক ধারণাকে ভাঙতে চায়। আমি বলি, একে উল্টে দেওয়ার দরকার নেই। যার যা শ্রেষ্ঠ তাই টিকবে, চীনা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বাক্স্বাধীনতা পশ্চিমের ‘অবাধ’ বাক্স্বাধীনতার মানকে ছাপিয়ে যাবে কি না, জানি না। তবে সতর্কতার সঙ্গেই বলব, পাশ্চাত্যের অনেকের মতো সংবিধানে বাক্স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কোনো আইন কংগ্রেস করবে না বলে আড়ি পাতার মতো শত কালাকানুন আরোপের পথে হাঁটছে না চীন।

শিনচিয়াংয়ের জাতিগত উন্নয়ন মডেল
কাশগরের একটি বাড়ি। ৫ সেপ্টেম্বর তোলা ছবিগত ৫ সেপ্টেম্বর শিনচিয়াংয়ের কাশগর, যার জনসংখ্যার ৯০ শতাংশের বেশি মুসলিম, সেই শহরে শত বছরের প্রাচীন একটি চায়ের দোকানে চা পান করছিলেন ১৩ দেশের ২৩ সাংবাদিক। বনেদি কাঠের পাটাতনের দ্বিতল দোকানটি প্রাচীনকালের এশিয়ান হর্স টি রোড ছুঁয়ে আছে। দোকানটির জৌলুশ ঠিকরে পড়ছে। প্রাচীনকালের সিল্ক রুটের অংশ হিসেবে এই সড়ক বাংলাদেশেও পৌঁছেছে। গত নভেম্বরে দক্ষিণ ইউনানের মিয়ানমার সীমান্ত লাগোয়া পুইয়ারে হর্স টি রোডের শুরুতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। প্রাচীনকালে ঘোড়সওয়ারিরা চা বয়ে বার্মা হয়ে বাংলাদেশেও পৌঁছেছিল।
পুইয়ার থেকে কাশগর সাড়ে ৩ হাজার কিলোমিটারের বেশি। কিন্তু সিল্ক রুটেরই অংশ। সেদিন ওই দোকানে স্থানীয়দের মধ্যে যাঁরা চা পান করছিলেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করি। তাঁরা চীনা ভাষায় কথা বলেন না। বলেন উইঘুরে। আমার প্রশ্ন ও তার উত্তরও তাই তিন ভাষায় তরজমা হচ্ছিল। অবশ্য ‘আসসালামু আলাইকুম’ বললে আর কথা নেই। দরাজ কণ্ঠে, অমায়িক হাসিতে প্রত্যুত্তর মিলেছে: ওয়ালাইকুমআস্লাম। নারী-পুরুষে কোনো তফাত নেই। আমি খুব আস্থা নিয়ে উইঘুরদের সঙ্গে সালাম বিনিময় করেছিলাম।
দুই হাজার এক শ বছরের প্রচীন নগরী কাশগরই হলো বহুল আলোচিত সিল্ক রুটের অন্যতম মুখ্য রুট। কারণ, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, ইউরোপ—এককথায় অবশিষ্ট বিশ্বের সঙ্গে সড়কপথে সেতুবন্ধ স্থাপনে চীনের সিংহদ্বার হলো কাশগর। আবার ইসলাম, চীনা, ভারতীয় ও গ্রিক-রোমান—বিশ্বের এই চার প্রধান সাংস্কৃতিক সভ্যতা শিনচিয়াংয়ে একত্রে মিশেছে। তাই বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প বাস্তবায়ন করে শিনচিয়াংকে উন্নয়নে ভাসিয়ে নেওয়াটা হয়ে পড়েছে বেইজিংয়ের অগ্রাধিকার। অনগ্রসর উইঘুর সমস্যার সুরাহা যে শুধু অর্থনৈতিক বৈষম্য নয়; রাজনৈতিক—সেটা চীনা নেতারা সম্প্রতি বিবেচনায় নিয়েছেন। তাই তাঁরা রাজনৈতিক সমস্যাকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করার মন্ত্র কবুল করেছেন। প্রদেশটির পাবলিসিটি প্রধান শুয়েজুন বললেন, ‘আমরা ধর্মের নৈর্ব্যক্তিক আইন (অবজেকটিভ ল অব রিলিজিয়ন) এবং ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের পরামর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকছি। প্রশাসনিক আদেশ দিয়ে যে কোনো পরিবর্তন আনা যাবে না, তা বুঝেছি । আদর্শগত, সাংস্কৃতিক, লোকাচারসংশ্লিষ্ট, ধর্মীয় ও সন্ত্রাস–বিষয়ক সমস্যা সুরাহায় পাঁচটি মুখ্য কর্মকৌশল নেওয়া হয়েছে।’ খোঁজ নিয়ে জানলাম, এটা প্রাদেশিক সরকারের সিদ্ধান্ত; কেন্দ্র থেকে নাজেল হয়নি।
দুই কাশগরির সঙ্গে অল্পবিস্তর কথা হলো। তাঁরা ফুলের পাপড়িসদৃশ চা পান করছিলেন মিছরি দিয়ে। কারও চোখেমুখে তাড়াহুড়ো ছিল না। প্রবীণদের ভিড়টাই বেশি। ইসলাম রাজি, বয়স ৮৪। তিনি এই প্রতিবেদকের নোটবুকে উইঘুর ভাষাতেই নিজের নাম লিখলেন। বয়সটা লিখলেন ইংরেজিতে। আরেকজন হলেন আহাত অবুল, বয়স ৬০। তিনি নিজের নাম ইংরেজিতেই লিখেছেন। তাঁরা উভয়ে বলেন, হিংসা বা বিচ্ছিন্নতায় তাঁদের সমর্থন নেই। তাঁরা শান্তিপূর্ণ জীবন ও উন্নয়নে বিশ্বাস করেন। তবে প্রশ্নের জবাবে তাঁরা মাথা নাড়ালেন যে, কিছু বিক্ষোভকারী তাঁদের চেনাজানা।
১৯৫৫ সালে চীন শিনচিয়াংয়ে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করে। এর অন্যতম লক্ষ্য ছিল জাতিগত সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় ও সংস্কৃতিগত সংবেদনশীলতা বজায় রেখে উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা। ৩১ আগস্ট শিনচিয়াংয়ের রাজধানী উরুমচিতে পৌঁছার পরে চোখে পড়ল ইউরোপীয় কায়দায় আকাশ ছোঁয়া দালানকোঠা। উরুমচিতে প্রাচীন বাড়িঘর চোখে পড়ল না। তদুপরি খুব ভালো করে তাকালে মুসলিম ঐতিহ্যের ছাপ চোখে পড়ে। কিন্তু উরুমচি থেকে ১ হাজার ৫৮৮ কিলোমিটার দূরের পুরান কাশগর (পুরান ঢাকার মতো) মুসলিম স্থাপত্যের আকর্ষণীয় নিদর্শন হিসেবেই দাঁড়িয়ে আছে। শিনচিয়াংয়ে মেয়েদের হিজাব পরা নিষিদ্ধের খবর পড়েছি। কিন্তু আমি তো উরুমচি, শানচি ও কাশগরের কোথাও হিজাব বা স্কার্ফ ছাড়া কাউকে দেখিনি। এমনকি কাশগরে মধ্যরাতের পরে বন্ধুদের সঙ্গে চলাচলরত স্কার্ট পরা রমণীকেও হিজাব পরিহিত দেখলাম।
কাশগর ও খোতান এই দুটি কাউন্টিতেই ১৪ হাজার মসজিদ ও ১৬ হাজার মুফতি আছেন। শিনচিয়াং ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বড় ধরনের শিরোনাম তৈরি করে। কারণ, মুসলিম-হান দাঙ্গায় ২০০ লোক নিহত হয়। এর দায়ে বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ও উইঘুর ভিন্নমতালম্বী তোহতির যাবজ্জীবন জেল হয়েছে। বারাক ওবামা এর সমালোচনা করেছিলেন। গত বছর চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের উরুমচি অবস্থানকালে বোমা হামলার ঘটনায় আটজনের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। এর পরে আরও কয়েকটি সহিংস হামলায় অন্তত ৩৯ জন প্রাণ হারান। সন্ত্রাসের দায়ে ৪৫ ব্যক্তির চার বছর থেকে যাবজ্জীবন মেয়াদে জেল হয়েছে। নিষিদ্ধ পূর্ব তুর্কিস্তান ইসলামি মুভমেন্ট ও তালেবানের দলে যোগদান চেষ্টার দায়ে কাশগরের পাঁচ ব্যক্তির ৮ থেকে ১০ বছরের জেল হয়েছে।
নব্বইয়ের দশকে উইঘুরদের রাজপথের প্রতিবাদ বেশি ছিল। সেতু ও সড়ক নির্মাণের মতো কিছু বিষয়ে কয়েক মাস আগের একটি সমাবেশের কথা প্রশ্নের উত্তরে উল্লেখ করেন কাশি মিউনিসিপ্যাল সরকারের তথ্য বিভাগের কর্মকর্তা ঝান কাই। তবে অভিযোগ হলো উন্নত চাকরিতে হানদের প্রাধান্য, উইঘুররা বৈষম্যের শিকার। আর সরকারি ভাষ্য হলো, ২০১০ থেকে তারা উইঘুরদের জীবনমান উন্নতকরণকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিচ্ছে। গত পাঁচ বছরে একজনেরও কর্মসংস্থান না থাকা এমন ৪৩ হাজার ৮০০ পরিবারের জন্য ৫০ হাজারের বেশি চাকরি সৃষ্টি করা হয়েছে। স্বায়ত্তশাসন ও বিকেন্দ্রীকরণ কার্যকর না থাকলে এ রকম পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যায় না। তাই মডেল আমদানি করতে চাইলে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল অনেকেই তা নিতে পারে। প্রদেশটির সোয়া ২ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় ২ কোটি ইতিমধ্যে বিমাকৃত।
দেড় কিলোমিটার বিস্তৃত পুরান কাশগর, যেখানে সেই বিখ্যাত মোল্লা নাসিরুদ্দিনের বাসস্থান, সেখানে দেখলাম সরকারি খরচে জনগণের বাড়ি তৈরি করে দেওয়ার কীর্তি। ৭০ হাজার উইঘুরের সাড়ে ২৬ হাজার বাড়ি মুসলিম স্থাপত্য মেনে সংশ্লিষ্ট বাড়ি মালিকের সম্মতিতে নির্মিত হয়েছে। ভালো লাগল দেখে অধিকাংশই তাদের প্রাচীন বাড়ির ডিজাইন অবিকল বজায় রেখেছেন। প্রাচীন বাড়ির ছবি ও নতুন বাড়ির ছবিও বাঁধাই করা আছে। তবে তা ধর্মীয় সংখ্যালঘু বিবেচনায় নয়, প্রাচীন ঐতিহ্য সংরক্ষণ প্রকল্পের অংশ হিসেবে। গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ-সংযোগও সরকারের। কেবল তারা বিল শোধ করেন। এসব বাড়ি ক্রয়-বিক্রয়ে আবার তারা স্বাধীন। এক গৃহিণী বললেন, এ বাড়ির বংশধরেরা এখানে ৩০০ বছর ধরে আছে।
প্রদেশটির নাগরিকদের বার্ষিক মাথাপিছু আয় ৬ হাজার ৬০০ ডলার, যা বাংলাদেশিদের চেয়ে চার গুণ বেশি। তবে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা হলো সেরা মাপকাঠি। শিনচিয়াংয়ের স্বায়ত্তশাসনের কান্ডারিদের অভিনন্দন জানাই। কারণ, তারা মৌলিক স্বাস্থ্যসেবায় মাথাপিছু ভর্তুকি ৪ হাজার টাকার বেশি করেছে, যা চীনের অন্যত্র নেই। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলগামীর হার ৯৮ ভাগের বেশি। ‘প্রাক-স্কুল থেকে উচ্চশিক্ষা’ চলছে সরকারি খরচে। দুই ভাষায় প্রি-স্কুল শিক্ষার হার ৯০ ছুঁই ছুঁই। আর উইঘুর অধ্যুষিত দক্ষিণ শিনচিয়াংয়ের চারটি প্রিফেকচারে (জেলার মতো) সবার জন্য ১৪ বছরের বাধ্যতামূলক শিক্ষাপদ্ধতি সম্প্রতি চালু করা হয়েছে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসহ জরুরি ত্রাণ এবং গৃহায়ণ ব্যয়ের ৭০ শতাংশের বেশি জোগান দিচ্ছে সরকার। পশ্চিমা মিডিয়া যদি এসব বিষয় উল্লেখ বা খণ্ডন করে শিনচিয়াংকে চিত্রায়িত করে, তাহলে সেখানকার পরিস্থিতি বুঝতে বিশ্ববাসীর সহায়ক হবে। কিন্তু বাস্তবে তার একটা বেশ ঘাটতি চলছে।
যে ১৯৪টি দেশের সঙ্গে শিনচিয়াংয়ের বাণিজ্য রয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের নামও সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে। যদিও ৭৮ কোটি টাকার বাণিজ্য, কিন্তু এটা ইঙ্গিত দেয় যে প্রয়োজনই ব্যবসায় সম্পর্ক তৈরি করে, পথের দূরত্ব কোনো বাধা নয়। যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের সঙ্গে স্থলভাগে চীনকে যুক্ত করেছে এই শিনচিয়াং। বাংলাদেশ যে ভারত বা বর্মি ভূখণ্ড দিয়ে অবশিষ্ট বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত হতে চাইছে, তারও অন্যতম মাধ্যম এই শিনচিয়াং। সোয়া দুই কোটি মানুষের তেলের রিজার্ভ চীনের মোট স্থল তেল সম্পদের শতকরা ৩০ ভাগ, গ্যাস ও কয়লা চীনের মোট রিজার্ভের যথাক্রমে ৩৪ ও ৪০ ভাগ।
চীনের মোট আন্তর্জাতিক স্থলসীমান্তের ৪০ শতাংশই শিনচিয়াংয়ে। কারণ, তাকে ঘিরে আছে মঙ্গোলিয়া, রাশিয়া, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও ভারত। সুতরাং, বহুপক্ষীয় স্বার্থে সিল্ক রুটের পুনরুত্থান শুধু সময়ের ব্যাপার। এটা সত্যি লক্ষণীয় যে প্রদেশটিতে বস্ত্র, খনি, খাদ্য ও অন্যান্য খাতে দু-এক ডজন মাত্র নয়, ৫১৯টি বাণিজ্যপ্রতিষ্ঠান গড়ছে চীনের দুই স্বীকৃত প্রতিদ্বন্দ্বী—যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান। রাশিয়া ও তার সাবেক স্যাটেলাইট দেশগুলোও পুরোদমে প্রদেশটিতে তাদের বাণিজ্যের প্রসার বিস্তার করে চলেছে। আর শিনচিয়াং নিজেকে একটি বহুমুখী পরিবহন দিয়ে বিশ্বশ্রেষ্ঠ বনে যেতে নিজেকে প্রস্তুত করছে। 
বিদেশে প্রদেশটির বর্তমান বিনিয়োগ প্রায় ৪৬ লাখ কোটি টাকা, এর মধ্যে পাকিস্তান এবং ভারতের গুজরাটও আছে। শুধু এখনো বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্ত হয়নি। বিদেশে বছরে ৭ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা রপ্তানি করে—এমন ৬৫টি প্রতিষ্ঠান আছে প্রদেশটির। আমরা যখন অবকাঠামো ছাড়াই কানেকটিভিটির চুক্তি করি, তারা তখন আট প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সোয়া লাখ কোটি টাকার সীমান্ত–বাণিজ্য করে। ২৯টি আন্তর্জাতিক মানের স্থলবন্দর থাকাই প্রমাণ করে, তারা কী অবকাঠামো গড়ছে। প্রতিবেশীদের এখন হাইস্পিড রেল, মহাসড়ক ও আকাশপথে চারদিক থেকে ব্যাপকমাত্রায় যুক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে। চীন-মধ্য এশিয়া-ইউরোপ-মধ্যপ্রাচ্য রেল ও কার্গো ট্রেন এখন আর স্বপ্ন নয়, আর এটা হলে দক্ষিণ এশিয়াও এর সঙ্গে মিশে যাবে। বিরোধের কারণে বাণিজ্য না আটকানোর নীতিতে চলছে চীন। গত বছর তুরস্ক বলেছিল, চীনাদের দ্বারা উইঘুর মুসলিমদের মানবাধিকার লঙ্ঘনে তারা বিচলিত। চীন চটেছে। কিন্তু গত বছরেই তুরস্কের সঙ্গে শিনচিয়াংয়ের ১ হাজার ৬ কোটি ২০ লাখ টাকার বাণিজ্য হতে তা বাধা হয়নি।
গত ৪ সেপ্টেম্বর শিনচিয়াং বাণিজ্য বিভাগের মহাপরিচালক হা ইমিং প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘বাংলাদেশে বিনিয়োগে এবং বাণিজ্য সম্পর্কের প্রসার ঘটাতে শিনচিয়াংয়ের আগ্রহের কমতি নেই। আমরা আপনার মাধ্যমেই এ বিষয়ে বাংলাদেশি ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।’
শিনচিয়াং একাডেমি অব সোশ্যাল সায়েন্সের প্রেসিডেন্ট গাও চিয়ানলং সিল্ক রুট প্রতিষ্ঠা এবং ‘শিনচিয়াং অর্থনৈতিক উন্নয়ন স্ট্র্যাটেজি’ শীর্ষক এক নিবন্ধে উল্লেখ করেন যে কানেকটিভিটি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাচ্ছে। পৌনে দুই লাখ কিলোমিটার হাইওয়ের মধ্যে ৪ হাজার ৩১৬ কিলোমিটার এক্সপ্রেস হাইওয়ে এবং ১৬টি বিমানবন্দরে ১৫৫টি আকাশ রুট চালু অবস্থায় আছে। গত বছরে প্রদেশটিতে বেসরকারি বিনিয়োগ হয়েছে ৫ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা, যা কিনা তার মোট বিনিয়োগের ৪০ শতাংশ। ২০১০ সাল থেকে প্রতিবছর গড়ে ১০০ কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। এখানে বছরে পাঁচ লাখ শহুরে চাকরি সৃষ্টি হয়। চাকুরেদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই নয় বছরের বাধ্যতামূলক শিক্ষা সম্পন্ন করেছে। ২০১০ সালে শিক্ষায় প্রাদেশিক সরকারের বাজেট আড়াই শ বিলিয়ন ইউয়ান ছাড়িয়ে যায়, ২০১৪ সালে যা ছিল, তার জিডিপির ৬ দশমিক ৪৭ শতাংশ। আয়ুষ্কাল ৭২ বছরের বেশি। ১৯৭৮ সালেও মাথাপিছু জিডিপি ছিল চার হাজার টাকা। মাত্র ৩৬ বছরের ব্যবধানে তা পাঁচ লাখ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। স্বায়ত্তশাসন কী দিয়েছে? ৬০ বছরে প্রদেশটির জিডিপি ১১৫ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি করেছে। একজন প্রবীণ সাংবাদিক ৩ অক্টোবর আমাকে বললেন, ১৯৫২ সালে কার্জন হলে তাঁরা উইঘুর মুসলিমদের জন্য একটি সভা করেছিলেন। রুহি উইঘুর নামের একজন তাঁদের কাছে পাঠানো এক নিবন্ধে কষ্টের কথা লিখেছিলেন। তখন সত্যিই চরম দারিদ্র্য ছিল। হান ও হুই মুসলিমদের চেয়ে উইঘুর অনগ্রসর হলেও এটা মানতে হবে যে প্রদেশটির সাফল্যে উইঘুররাও গর্বিত অংশীদার ও সুবিধাভোগী। চার বছর আগে প্রথম এই প্রদেশেই সবার জন্য মৌলিক পেনশন ও স্বাস্থ্যবিমা-ব্যবস্থা চালু করা হয়। গ্রামের মানুষের মাসিক প্রকৃত আয় এক লাখ টাকা আর শহরে দ্বিগুণের বেশি। জার্মান নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ড. সিগফ্রিড উলফ আমাকে বলেন, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ উইঘুর শান্তিপ্রিয়। তারা বিচ্ছিন্নতা চায় না। কারণ, তারা জানে, যারা সহিংসতায় যুক্ত, তাদের লক্ষ্য স্বাধীনতা বা অধিকতর স্বায়ত্তশাসন নয়, বিশ্ব জিহাদের সঙ্গে যুক্ত হওয়া।’
শিনচিয়াং দুই হাজার বছর ধরে চীনা শাসনের কথা চীনারা বললেও আসলে ১৯৪৯ সালেই প্রথম প্রদেশটি কার্যকরভাবে চীনা কেন্দ্রীয় সরকারের করতলগত হয়। যদিও ১৮৮৪ সালে চীন শিনচিয়াংকে প্রদেশ ঘোষণা করেছিল। এরপর উইঘুর জাতীয়তাবাদীদের একাংশ সোভিয়েত সমর্থনে ১৯৩৩ সালের ১২ নভেম্বর শিনচিয়াংকে ইস্টার্ন তুর্কিস্তান ইসলামিক রিপাবলিক ঘোষণা করেছিল। এটা অবশ্য ৮৬ দিনে মিলিয়ে যায়। জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক জেমস এ মিলওয়ার্ডের মতে, ‘রাজনৈতিকীকরণ চীনা সূত্রগুলো এখন নিয়মিতভাবে ধর্মীয় কট্টরপন্থা এবং বিদেশি উসকানির সঙ্গে উইঘুর বিচ্ছিন্নতাবাদকে সমানভাবে বিবেচনা করে।’ ওই বিষয়ে চীনা মত হলো, বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় শিনচিয়াংয়ের কতিপয় উগ্র বিচ্ছিন্নতাবাদী ও ধর্মীয় কট্টরপন্থী প্রাচীন ঔপনিবেশিক (ইউরোপীয়) শক্তির সৃষ্ট মিথ্যা বিশ্বাসের আলোকে ‘পূর্ব তুর্কমেনিস্তানের’ রূপকথা রচনা করেছিল। হোজা নিয়াজ ‘প্রেসিডেন্ট’ ও মাসুদ সাবরি ‘প্রধানমন্ত্রী’ হয়েছিলেন। তবে শিনচিয়াংয়ের ইতিহাস অত্যন্ত জটিল ও সর্পিল। সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ভেঙে বেরিয়ে এসেছে শিনচিয়াং। ব্রিটিশ ভারতের বাংলার জমিদারদের মতোই কৃষকদের ওপর সামন্ত ও গোত্রপ্রভুরা নিপীড়ন চালিয়েছেন। ১ অক্টোবরে শিনচিয়াং প্রদেশের বর্তমান উইঘুর চেয়ারম্যান সোহরাত জাকির যে শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছেন, তাতেই লেখা, ‘গণচীন প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকালে চরম দারিদ্র্য আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের মধ্য দিয়ে গেছে শিনচিয়াং। ১৯৪৯ সালে শান্তিপূর্ণভাবে স্বাধীনতা লাভ করে।’
একেবারে গোড়ায় কেন্দ্রীয় কমিউনিস্ট পার্টিতে তাতার মুসলিম বুরহান শাহিদিকে করা হয় প্রদেশের চেয়ারম্যান আর ভাইস চেয়ারম্যান হন উইঘুর সাইফ আল-দিন। তিনি মস্কো গিয়েছিলেন। ১৯৫০ সালে মাও সেতুং ও চৌ এন লাই স্তালিনের সঙ্গে প্রদেশটির তেল আহরণ নিয়ে ‘কৌশলগত’ জয়েন্ট স্টক কোম্পানি করার চুক্তি করেছিলেন; মার্কিনরা বলেছিল, প্রদেশটিকে গিলে ফেলার এ এক সোভিয়েত দুরভিসন্ধি। আসলে শিনচিয়াংকে নিয়ে মস্কো ও বেইজিং যা করেছে, তাতে এক খণ্ড মহাভারত লেখা যায়। ১৯৫৫ সালে শিনচিয়াংয়ে যে উইঘুরদের নামে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের নামকরণ করা হয়েছিল, তার নেপথ্যে মাওয়ের সঙ্গে সোভিয়েত নেতাদের সমঝোতা। আমাদের দেশে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের বছরে (১৯৫৪) ওই চুক্তি বাতিল হয়। আর ১৯৫৫ সালের ১ অক্টোবরে সোভিয়েতপন্থী ও রুশ ভাষায় পারদর্শী উইঘুর সাইফ আল-দিনকেই পদোন্নতি দিয়ে পুনর্গঠিত প্রদেশটির প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে দেখা গেল। 
উইঘুরদের চেয়ে হুই মুসলিমরা কিন্তু অনেক এগিয়ে। তাদের সঙ্গে হান মিত্রতা একেবারে গোড়া থেকেই। কিছু পশ্চিমা মিডিয়া সব সময় হান ও উইঘুরদের সম্প্রীতির চেয়ে দূরত্বকে বড় করে দেখায়। অথচ ১৯১১ সালে কেন্দ্রনিযুক্ত শাসক ইয়ানানের হান সম্প্রদায়ের ইয়াং জেনশিন ছিলেন মুসলমানদের বন্ধু। চীনের একজন বিখ্যাত নকশবন্দি সুফি ইব্রাহিম (মা মিংশিন), তাঁর ওস্তাদ পবিত্র নগরী মক্কা ও মদিনায় ১৬ বছর অধ্যয়ন করেছিলেন। সুফি ইব্রাহিমের আনুকূল্য নিয়ে জেনশিন ১৯১১ থেকে ১৯২৮ সালে উরুমচিতে তাঁকে হত্যার আগ পর্যন্ত শিনচিয়াং শান্তিপূর্ণভাবে শাসন করেন। তখন তিনি একটি মসজিদকেন্দ্রিক হুইদের নিয়েই গড়েছিলেন তাঁর সামরিক বাহিনী। তখন উইঘুর ও হান উভয়ে হুইদের বাঁকা চোখে দেখেছে। ইয়াং হত্যাকাণ্ডের পরে নতুন প্রশাসক হন শেং। বিদ্রোহ, আগ্রাসন ও রক্তপাতের মধ্যে ১৯৩৪ ও ১৯৩৭ সালে প্রদেশটিতে প্রত্যক্ষ সোভিয়েত সামরিক হস্তক্ষেপ ঘটেছিল। তাই বলি, অতীতে মুসলিমরা কেবলই বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রবণতা দেখিয়েছে তা সত্য নয়। অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এন্ড্রু ফোর্বসের মতে, চীনা প্রাদেশিক চেয়ারম্যান শেংয়ের আমলে শিনচিয়াং সোভিয়েত পুতুলরাষ্ট্রে ও সেখানে ‘সন্ত্রাসের রাজত্ব’ কায়েম হয়েছিল। উরুমচির রুশ কনস্যুলেটের অঙ্গুলিহেলন ছাড়া শিনচিয়াং সরকার চলত না। স্তালিনের বশ্যতা মেনে শেং সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েছিলেন। এসব পুরোনো কাসুন্দি আর না ঘেঁটে শেষ করি। 
অভিন্ন ধর্মের একটা মেলবন্ধন কোথাও যেন ফল্গুধারার মতো বইতে থাকে। ১ সেপ্টেম্বরে রাজধানী উরুমচির একটি হোটেলে প্রেস ওয়ার্কশপের উদ্বোধন করেছিলেন শিনচিয়াং উইঘুর অটোনোমাস রিজিওনাল কমিটির প্রচার বিভাগের প্রধান লি শুয়েজুন। আমার টেবিলে রাখা অনেকগুলো বইয়ের একটি প্রচ্ছদে নৃত্যরত উইঘুর তরুণীদের আলোকচিত্র ছিল। সেদিকে ইঙ্গিত করে তিনি বাংলাদেশ আর শিনচিয়াংয়ের অভিন্ন মুসলিম ঐতিহ্য স্মরণ করিয়ে দিলেন। বেইজিংয়ে আনুষ্ঠানিক বিদায়ী নৈশভোজে এসেছিলেন সিপিসির আরেকজন নেতা, যিনি শিনচিয়াংয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত। আমি বক্তৃতায় বললাম, আমরা একদা কাশগরের দরজার কাছের প্রতিবেশী ছিলাম। কাশগরের লাগোয়া ভারতীয় কাশ্মীর সীমান্ত। ১৯৬৩ সালে পাকিস্তান চীনের সঙ্গে তার গিলগিট এলাকায় একটি মাইলফলক সীমান্তচুক্তি সই করেছিল। জওহরলাল নেহরু অমূলক সন্দেহের বশে তার বিরোধিতা করেছিলেন। আমরা পূর্ববঙ্গবাসী সেই চুক্তিকে সানন্দে সমর্থন করেছিলাম। তিনি খুবই প্রীত হলেন। উল্লেখ্য, ইত্তেফাক পত্রিকায় মোসাফির (তাফাজ্জাল হোসেন মানিক মিয়া) কাশগর চুক্তি নিয়ে কলাম লিখেছিলেন।
ভবিষ্যতে আমরা স্থলে যেমন, তেমনি সমুদ্র সিল্ক রুটেও শিনচিয়াংয়ের সঙ্গে যুক্ত হতে পারি। প্রস্তাবিত আন্তমহাদেশীয় তেলের পাইপলাইনে যুক্ত হওয়ারও হাতছানি আছে। এই হাতছানিকে কাজে লাগিয়ে আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থের পক্ষে সুসম্পর্কটি কাজে লাগাতে প্রস্তুতি কতটুকু বা আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে আছি—সে প্রশ্নটি বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে আমার এই সফর।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন