বুধবার, ২৮ অক্টোবর, ২০১৫

টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের কাজ অব্যাহত রেখেছে ভারত

  1. গবেষক-পরিবেশবিদদের বিরোধিতা সরকারের সমর্থন
  2. ভারতের স্বার্থেরই প্রাধান্য বাংলাদেশের স্বার্থ উপেক্ষিত 
  3. বাংলাদেশের অন্তত ৪টি সেচ প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে
  4. পূর্বাঞ্চলের বিশাল অংশ ভূ-তাত্বিক প্রতিকূলতায় পড়বে


ফারাক্কা বাঁধের পর সর্বাধিক আলোচিত-সমালোচিত বরাক নদীতে বহুমুখি প্রকল্প ‘টিপাইমুখ বাঁধ’ নির্মাণের কাজ শেষ পর্যন্ত অব্যাহত রেখেছে ভারত। এযাবৎ প্রচার মাধ্যমে এ বিষয়ে নানান লুকোচুরি চললেও ভেতরে ভেতরে তারা এর নির্মাণ কাজ চালিয়ে গেছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের জনগণের প্রবল আপত্তিকে কোনো রকম আমলেই নেয়ার প্রয়োজন মনে করা হয়নি। এই প্রকল্প বাংলাদেশের জন্য বড়রকম ক্ষতির কারণ হবে বলে জানা গেছে। 

সাম্প্রতিক সময়ে একটি ওয়েবসাইটের ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ১০০ কিলোমিটার উজানে ভারতের বরাক নদীর ওপর এই টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে। ‘টিপাইমুখ’ নামক স্থানটি বরাক এবং টুইভাই নদীর মিলনস্থলে অবস্থিত। এই মিলনস্থলের ১ হাজার ৬০০ ফুট দূরে বরাক নদীতে ৫০০ ফুট উঁচু ও ১ হাজার ৬০০ ফুট দীর্ঘ বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে সেচের জন্য পানি সংরক্ষণাগার (রিজার্ভার) নির্মাণ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং ১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। অভিন্ন নদীর উজানে এই বাঁধ ভাটির বাংলাদেশের পরিবেশ আর অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা করেন বিশেষজ্ঞরা। এই বাঁধ নির্মাণে ভারতের মনিপুরের নাগরিকরাও প্রবল আপত্তি জানিয়ে আসছেন। তারা এর বিরুদ্ধে আন্দোলনও করছেন। 

ভারতের বহুমুখি লক্ষ্য : বরাক নদীর উপর ড্যাম নির্মাণের প্রথম প্রস্তাব উঠে ১৯৫৫ সালের দিকে। নির্মাণকাজ শুরুর উদ্যোগ নেয়া হয় ১৯৯৩ সালের দিকে। কিন্তু ভারতের কিছু অঞ্চলসহ বাংলাদেশের নদী-প্রবাহের উপর বিরূপ প্রভাবের কথা ব্যাপক আলোচিত হওয়ার প্রেক্ষিতে এর গতি কিছুটা থমকে যায়। বর্তমানে এই বাঁধের নির্মাণ কাজ অব্যাহত রয়েছে। সূত্রে জানা গেছে, পুরো প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৫ হাজার ২শ’ কোটি ভারতীয় রূপি। বহুমুখি এই প্রকল্পটির প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল মূলত বরাক উপত্যকায় পানি ধারণের মাধ্যমে ২ হাজার বর্গকিলোমিটারের বেশি এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ। পরবর্তীকালে এই ড্যামের মাধ্যমে পানিবিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনাও করা হয়। এর সম্ভাব্য লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ১৫০০ মেগাওয়াট। টিপাইমুখ ড্যামের মাধ্যমে বরাকের পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে কাছাঢ় সমতলে সেচ প্রদানের ব্যবস্থা করাও এই প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত। এছাড়াও টিপাইমুখ ড্যামে যে জলাধার নির্মাণ করা হচ্ছে তার মোট পানি ধারণ ক্ষমতা হবে প্রায় ১৬ মিলিয়ন কিউবিক মিটার। এই জলাধারে পানি জমিয়ে রাখতে গিয়ে বাংলাদেশ অংশ পানি বঞ্চিত হবে এবং পূর্বাঞ্চলের বিশাল ভূ-ভাগ ভূ-তাত্বিক প্রতিকূলতার শিকার হবে। এদিকে, মনিপুর রাজ্যের টিপাইমুখে ভারতের বৃহত্তর প্রকল্পের মাধ্যমে ১৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ ছাড়াও বারাক ও তার শাখা এবং উপনদীগুলোকে কেন্দ্র করে আরো ২৯টি প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাঁচাই কাজ চলছে বলে প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে। 

বাংলাদেশের ব্যাপক ক্ষতি : উল্লেখ করা যেতে পারে, বরাক নদীর উৎপত্তি ভারতের মণিপুর রাজ্যের কাছাঢ় পর্বতে। অতঃপর তা মণিপুর, আসাম ও মিজোরামের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে অমলসিধের কাছে সুরমা ও কুশিয়ারা নামে দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বরাক নদীর ভারতে প্রবাহিত অংশের দৈর্ঘ ৪৯৯ কিলোমিটার। অন্যদিকে কুশিয়ারা, কালনী এবং মেঘনা নামে বঙ্গোপসাগরে পতিত হওয়া পর্যন্ত এর দৈর্ঘ ৪০৩ কি.মি.। বরাক বাংলাদেশের প্রধানতম নদী মেঘনার সাথে সরাসরি যুক্ত বলে বরাকের গুরুত্ব অনেক বেশি। বাংলাদেশে উজান থেকে আসা পানির মোট ৭ থেকে ৮ ভাগ প্রবাহ আসে ভারতের বরাক নদী থেকে। মৎস্য সম্পদ আহরণ ও চাষাবাদের জন্য বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ বরাক নদীর পানি প্রবাহের উপর নির্ভরশীল। পরিবেশবিদরা আশঙ্কা করছেন, এই বাঁধ নির্মাণের ফলে সুরমা, কুশিয়ারা ও মেঘনা অববাহিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা, অর্থনীতি, প্রাণবৈচিত্র্যসহ সার্বিক পরিবেশের উপর স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কুফল দেখা দেবে। টিপাইমুখ ড্যাম সক্রিয় করা হলে এর রিজার্ভারে পানি সংরক্ষণের কারণে স্বাভাবিকভাবে এর ভাটিতে পানিপ্রবাহ বিঘিœত হবে, যা ঐ অঞ্চলের স্বাভাবিক পরিবেশ ও ইকোসিস্টেমকে বাধাগ্রস্ত করবে। মৎস্য প্রজননে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, টিপাইমুখ ড্যাম নির্মাণের ফলে শুষ্ক মৌসুমে সুরমা-কুশিয়ারা অববাহিকায় প্লাবনভূমির পরিমাণ শতকরা ৬০ ভাগ এবং ভরা মওসুমে অন্তত ২২ ভাগ হ্রাস পাবার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়াও সুরমা- কুশিয়ারায় বন্যার পরিমাণ কমে যাবে ফলে পলল সমভূমিগুলো পলিমাটি বঞ্চিত হবে এবং নদী অববাহিকার মধ্যবর্তী সমভূমিগুলো নদীর সাথে সংযোগহীন হয়ে পড়বে। এছাড়া বাংলাদেশের অন্তত ৪টি প্রকল্প টিপাইমুখ বাঁধের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রকল্পগুলো হচ্ছে, আপার সুরমা-কুশিয়ারা রিভার প্রজেক্ট, সুরমা রাইট ব্যাংক প্রজেক্ট, সুরমা-কুশিয়ারা-বাউলাই বেসিন প্রজেক্ট এবং কুশিয়ারা বিঝনা ইন্টারবেসিন প্রজেক্ট। বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নদী মেঘনা বরাক তথা সুরমা-কুশিয়ারার সাথে সরাসরি যুক্ত বলে মেঘনার প্রবাহ হ্রাসের আশঙ্কা করা হচ্ছে। মেঘনার প্রবাহ হ্রাস পেলে এই অঞ্চলের কৃষি ও মৎস্যসহ মানুষের নদীকেন্দ্রিক জীবনধারায় অস্বাভাবিক পরিবর্তন আসবে। এমনকি উজানের পানিপ্রবাহ হ্রাসের কারণে সাগর থেকে লবণাক্ততা উঠে আসার মত পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কাও রয়েছে। পাহাড়ি নদী হবার কারণে বিপুল খরস্রোতা বারাক ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো ছাড়াও বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে পানি ও প্রাকৃতিক সম্পদের উৎস হিসেবে অবদান রেখে চলেছে। ভারতের প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হয়ে ভারত প্রায় চার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ও সেচের সুবিধা পেলেও বাংলাদেশ হবে ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার। সম্প্রতি ভারতের মণিপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক জানিয়েছেন, এ বাঁধ নির্মিত হলে রিখটার স্কেলের ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে এর পার্শ্ববর্তী ২০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হতে পারে। 

ক্ষমতাসীনদের ‘উদারতা’য় প্রশ্ন : আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে কোন দেশ অভিন্ন নদীর উজানে কোন কাঠামো নির্মাণ করতে হলে অবশ্যই এর ভাটিতে বসবাসকারী জনপদের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কথা ভাবতে বাধ্য। কিন্তু ভারতের পক্ষ থেকে তাতে কর্ণপাত করা হয়নি। অন্যদিকে, বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন মহলের পক্ষ থেকে এই প্রকল্পের প্রতি একপ্রকার সমর্থন জ্ঞাপন করা হয়। এনিয়ে উদারতা প্রদর্শণ করা হয়। কোন বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে নয়, রাজনৈতিক নেতৃত্বের মাধ্যমে এই প্রকল্পের স্থান পরিদর্শন করিয়ে এতে ‘বাংলাদেশের কোন ক্ষতি হবে না’ বলে সনদপত্র প্রদান করা হয়। আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় থাকাকালে তৎকালীন পানি সম্পদমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি সংসদীয় প্রতিনিধি দল টিপাইমুখে পাঠানো হয়। তারা হেলিকপ্টারে চড়ে প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেন এবং ফিরে এসে প্রকল্পের পক্ষে অভিমত জ্ঞাপন করেন। পরের দফায় ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান ও ড. গওহর রিজভী ২০১১-র অক্টোবরে দিল্লী যান তাদের অভিমত জানাতে। ওদিকে তখন মনিপুরে টিপাইমুখ প্রকল্প নির্মাণে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমঝোতাপত্র স্বাক্ষরিত হচ্ছিলো। পরে ডিসেম্বরে ড. রিজভী বাংলাদেশের একটি ইরেজি দৈনিকে এ সম্পর্কে একটি নিবন্ধ লেখেন। কিন্তু এতে টিপাইমুখের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে কোন ভাষ্য না থাকায় সচেতন জনমনে হতাশা দেখা দেয়। ভারতের সঙ্গে ‘উচ্চ সম্পর্ক’ রক্ষার অজুহাতে বাংলাদেশের বড়রকম ক্ষতিকেও হজম করে ফেলা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন