সোমবার, ১২ অক্টোবর, ২০১৫

ধর্মের পর্যালোচনা ও বাংলাদেশে ইসলাম-১০

ফয়েরবাখের সঙ্গে তরুণ মার্কস তার হিসাব-নিকাশ চুকিয়ে দিতে গিয়ে ১৮৪৫ সালের বসন্তকালে ব্রাসেলসে তাঁর নিজের বোঝাবুঝির জন্য নোটখাতায় বেশ কিছু খসড়া মন্তব্যমূলক বাক্য টুকটাক লিখে রেখেছিলেন। লুদভিগ ফয়েরবাখ সম্পর্কে অ্যাঙ্গেলস তাঁর নিজের বই ১৮৮৮ সালে প্রকাশের সময় মার্কসের টোকা মন্তব্যগুলোর শিরোনাম দেন ‘ফয়েরবাখ সংক্রান্ত থিসিস’। এর ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয় ১৯৩৮ সালে। আগের লেখায় ফয়েরবাখ কিভাবে খ্রিস্টধর্মের পর্যালোচনা করেছেন, আমরা সে সম্পর্কে কিছু ধারণা দিয়েছি। আমরা সেই থিসিসগুলোর আলোকে মার্কস কিভাবে ফয়েরবাখের পর্যালোচনা করেছেন তা নিয়ে আলোচনা করব। এতে বোঝা যাবে, মার্কস কেন ধর্ম বা দর্শন নিয়ে কোন তত্ত্ব চর্চা করেননি। কেন এইসকল বিষয়ে তিনি কোনো বই লেখেননি। সর্বোপরি, ফয়েরবাখের চিন্তার পর্যালোচনা করেই তত্ত্বীয় দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে তিনি কোথায় এবং কিভাবে হুঁশিয়ার হয়ে গিয়েছিলেন।
আমরা যখন কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা বা ধ্যান করি, তখন জগৎ আমাদের বাইরে চিন্তা বা ধ্যানের বিষয় হিসাবে হাজির থাকে। চিন্তাপ্রক্রিয়ার দিক থেকে এই দিকটা বিষয়গত বা অবজেক্টিভ দিক। চিন্তা বা চিন্তাপ্রক্রিয়ার বাইরে চিন্তার, জ্ঞানের বা ধ্যানের বিষয়ের উপস্থিতি সম্পর্কে আমরা যতটা সজ্ঞান ও সচেতন থাকি, চিন্তার কর্তা বা সাবজেক্টিভ দিক সম্পর্কে ততটা সচেতন থাকি না। চিন্তা করা, কোনো বিষয় নিয়ে ধ্যান করা, কিম্বা কোনো কিছু জানার নিশ্চয়ই একজন কর্তা থাকেন। চিন্তাপ্রক্রিয়ার এটা হচ্ছে বিষয়ীর দিক বা বিষয়ী পক্ষ। কিভাবে বিষয়ী বা চিন্তার কর্তা কোন্ বিষয় উপলব্ধি করছেন এবং তার উপলব্ধি জ্ঞানে রূপান্তর ঘটাচ্ছেন, সেটা একটা প্রক্রিয়া। যদি সেই প্রক্রিয়াকেও চিন্তার বিষয় হিসাবে গণ্য করি, তাহলে সেটাও চিন্তার বাইরে ঘটা প্রক্রিয়া হিসাবেই হাজির হয়। সেটা তখন নৈর্ব্যক্তিক বা চিন্তার অবজেক্টিভ দিক হয়ে ওঠে। চিন্তা করা এক জিনিস, আর কি করে আমরা চিন্তা করি, সেই বিষয় নিয়ে ভাবনা ভিন্ন ব্যাপার। ভাত খাওয়া ও হজম করা একটি শারীরিক ব্যাপার, সেটা আমাদের শরীরের অভ্যন্তরে ঘটতে থাকে। কিন্তু যখন আমরা কিভাবে হজম করি তা নিয়ে ভাবি, তখন তা শরীরের অভ্যন্তরীণ বিষয় আর থাকে না। সেটা তখন গবেষণা ও চিন্তার বিষয় হয়ে ওঠে, যাকে শাস্ত্র বা বিজ্ঞান হিসাবে আমরা অ্যানাটমি, ফিজিওলজি ইত্যাদি নানা নামে চর্চা করি। তেমনি আমরা যখন চিন্তা করি তখন সেটা চিন্তার অভ্যন্তরীণ বিষয়। কিন্তু যখন কিভাবে চিন্তা করি সেই প্রক্রিয়া নিয়ে ভাবি, তখন এ প্রক্রিয়া চিন্তার বিষয়ে পরিণত হয়। চিন্তাপ্রক্রিয়াকে চিন্তার বিষয় হিসাবে ভাবার অর্থ হচ্ছে, তাকে অবজেক্টিভ বা নৈর্ব্যক্তিক প্রক্রিয়া হিসাবে ভাবা। একেই আমরা তখন যুক্তিশাস্ত্র, লজিক, ব্যাকরণ বা সাম্প্রতিককালে বিষয়বিদ্যা ইত্যাদি শাস্ত্র হিসাবে চর্চা করি।
বাইরের জগতের সঙ্গে আমাদের সংবেদনার দরজা হচ্ছে, আমাদের ইন্দ্রিয়। ইন্দ্রিয়ের মধ্য দিয়ে বাইরের জগৎ সম্পর্কে আমরা যে সংবেদনা লাভ করি, তাকে বিশেষ কালে ও বিশেষ দেশে ‘বস্তু’ বা ‘বাস্তব সত্তা’ হিসাবে হাজির বলে আমরা উপলব্ধি করি। বস্তু বা বাস্তবতা সম্পর্কে আমাদের সাধারণ ধারণা হচ্ছে, যা কিছু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বা ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ, সেটাই বস্তু। ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষের সংবেদনাকে উপলব্ধিতে এবং উপলব্ধিকে বুদ্ধির স্তরে বিচার-বিশ্লেষণের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমরা জ্ঞানের স্তরে উপনীত হই। অর্থাৎ, বস্তু সম্পর্কিত ইন্দ্রিয় সংবেদনাকে জ্ঞানে পরিণত করি। এখন এ রকম একটা জ্ঞানচর্চার ধারা গড়ে উঠতে পারে, যেখানে দাবি করা হয়, কোনো কিছু ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ বস্তু বা বস্তুজাতীয় না হলে তা সত্য নয়; অবজেক্টিভ বা নৈর্ব্যক্তিক নয়- সেই দিক থেকে চিন্তা বা চিন্তাপ্রক্রিয়া হচ্ছে বস্তুর বিপরীত জিনিস। সেটা ভাব। বস্তু ও ভাবের এই ফারাক বজায় রেখে জ্ঞানচর্চার ধারা সাধারণত বস্তুবাদ নামে পরিচিত। এর বিপরীত হচ্ছে ভাববাদ। 
বস্তুবাদ অনুসারে, যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বা ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ নয় তা বস্তু নয়। আর যদি তা বস্তু না হয় তাহলে তার কোনো সত্যতা নাই। সেটা ভাব মাত্র। বস্তুবাদ এই প্রকার অনুমান বা আগাম ধারণার ভিত্তিতে জগতের সত্য-মিথ্যা নির্ণয় করে থাকে। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, চিন্তা বা চিন্তাপ্রক্রিয়া কি বস্তু? নাকি ভাব? যদি ভাব হয় তাহলে তার নিজের কোনো সত্যতা থাকতে পারে না। কারণ এই সত্য ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়। যদি আমরা আমাদের আলোচনাকে বাংলাদেশের জন্য সরাসরি আরো প্রাসঙ্গিক করতে চাই, তাহলে প্রশ্ন তুলতে পারি- ‘আল্লাহ’ কি বস্তু, নাকি ভাব? আল্লাহ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় নন। এতে অসুবিধা নাই। কিন্তু যদি দাবি করি যেহেতু ‘আল্লাহ’ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় নন, ভাব মাত্র, অতএব, আল্লাহ সত্য নন, নিছকই চিন্তার একটি ধারণা মাত্র, তখন বস্তুবাদ নাস্তিকতা হয়ে ওঠে; আল্লাহকে নাকচ করে নাস্তিকতার পক্ষ নেয়। 
সাধারণত ধর্মপ্রাণ মানুষ এতে আপত্তি জানান। সেই আপত্তি মাঝে মধ্যে ঘোরতর সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে। কিন্তু আপত্তি জানাতে গিয়ে ধর্মপ্রাণ বিশ্বাসী মানুষ বস্তুবাদী যুক্তির ফাঁদে পড়ে যান, নিজেকে বিশ্বাসী প্রমাণ করতে গিয়ে বস্তুবাদীর যুক্তি ও অনুমান মেনে আল্লাহকেও বস্তুর মতোই ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ সত্তা হিসাবে প্রমাণ করবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু আল্লাহ তো আসলে বস্তু নন, এবং বস্তুগুণসম্পন্ন হওয়ার মধ্যে কোনো বিষয়ের সত্য-মিথ্যা নির্ণীত হয় না; বিষয়ের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতাই শুধু প্রমাণিত হয়। আল্লাহকেও বস্তুর মতোই ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ সত্তা হিসাবে প্রমাণ করতে গিয়ে আল্লাহর সঙ্গে বস্তুর তুলনা তখন শিরক-এর পর্যায়ে চলে যায়। অতএব কেউ বিশ্বাসী বা নিজেকে ঈমানদার ভাবলেই তিনি বস্তুবাদী নন, সেটা বলা যাবে না। কারণ বস্তুবাদীর মতো তিনিও ভাবতে অক্ষম যে, আল্লাহর সত্য-মিথ্যা নির্ণয়ের তর্ক বস্তুবাদ বনাম ভাববাদের তর্ক নয়। অর্থাৎ অত্যন্ত সৎ ও ঈমানদার মানুষও বুঝতে পারেন না, আল্লাহ দেশকালের অধীন ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ বিষয় নন। বুঝতে পারেন না, দেশকালের অতীত ‘আল্লাহ’ মানুষের চিন্তা বা প্রজ্ঞার বিষয় হয়ে বিরাজ করেন বলে তিনি মিথ্যা হয়ে যান না। সত্য হতে হলে তাঁকে বস্তুর গুণ ধারণ করার প্রয়োজন পড়ে না।
এর আগে কয়েকবারই উল্লেখ করেছি, ইসলাম যখন ‘আল্লাহ’কে নিরন্তর ‘গায়েব’ কিম্বা বিশুদ্ধ অনুপস্থিতি হিসাবে দাবি করে, তখন মানবেতিহাসে চিন্তার পর্যায় আরেকটি স্তরে গিয়ে পৌঁছায়; বহুদূর সামনে এগিয়ে যায় এবং দর্শনের জন্য সম্পূর্ণ নতুন ধরণের প্রশ্ন ও নতুন ধরণের চিন্তার পদ্ধতি বা ব্যাকরণ দাবি করে। খেয়াল করতে হবে, দাবি করা হচ্ছে আল্লাহকে স্রেফ বুদ্ধির বা জ্ঞানের বিষয়ে পরিণত করাও শিরক। আগের লেখায় এ দিকটির প্রতি বিশেষভাবে নজর ফেরানোর চেষ্টা করেছি। 
বলাবাহুল্য, এ দিকটি বিস্তৃত ব্যাখ্যা করা দরকার। কিন্তু চিন্তার প্রাথমিক সিঁড়িগুলো না পেরিয়ে আমরা শূন্যে লাফ দিতে পারি না। সেই দরকারেই আলোচনার বর্তমান পর্যায় আমাদের নিষ্ঠার সঙ্গে অতিক্রম করতে হবে। বুঝতে হবে, আমরা এখনও প্রাক-ইসলামি যুগে পড়ে আছি। ইসলামের ভাষায় যা জাহেলিয়াত বা অজ্ঞানতার যুগ। অতি প্রাথমিক স্তরে বস্তুবাদ ও ভাববাদ নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রেই আমরা দেখি, বস্তুবাদী এবং একজন পরম বিশ্বাসী বা ঈমানদারের চিন্তার ব্যাকরণ এখনও একই রয়ে গিয়েছে। বিশ্বাস বা সিদ্ধান্তের দিক থেকে ভিন্ন মনে হলেও চিন্তার ব্যাকরণের দিক থেকে তাদের ফারাক নাই। এই অতি প্রাথমিক স্তর অতিক্রম করা না গেলে দর্শনের দিক থেকে ইসলামের বৈপ্লবিক প্রস্তাবনা ধরতে পারা দূরের কথা, শুরু করাও কঠিন। এবার মার্কস কিভাবে ফয়েরবাখকে পর্যালোচনা করেছেন, সেই প্রসঙ্গের গভীরে যাওয়া যাক। 
ফয়েরবাখ সম্পর্কে ‘এগারো থিসিস’ নামে তরুণ মার্কসের বিখ্যাত উক্তিগুলোর এক নম্বর থিসিসে মার্কস বলছেন, তাঁর সময়কাল অবধি যে ধরনের বস্তুবাদের সঙ্গে তাঁর পরিচিতি ঘটেছিল, তারা সকলেই বস্তু, বাস্তবতা, ইন্দ্রিয়পরায়ণতাকে ধারণা করেছে কেবল চিন্তার বাইরে হাজির ‘বিষয়’ হিসাবে। এর মধ্যে ফয়েরবাখ অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু ইন্দ্রিয়ের সংবেদনা তো একই সঙ্গে তৎপরতা, ক্রিয়া বা চর্চা। চিন্তার কর্তা হিসাবে মানুষের এই সক্রিয়তা ঘটে চিন্তার অন্তর্গত প্রক্রিয়া হিসাবে। ‘আল্লাহ’ যদি ভাবই হয়ে থাকেন, তাহলেও সেটা চিন্তার বা চিন্তাপ্রক্রিয়ারই একটি পরিণতি। কিন্তু বস্তুবাদ এই ক্রিয়াকে বুঝতে পারে না। অথচ এটাও নৈর্ব্যক্তিক প্রক্রিয়া, কিন্তু সেটা ঘটছে চিন্তার বাইরের ঘটনা হিসাবে নয়, চিন্তার নিজেরই তৎপরতা হিসাবে। এর ফলে চিন্তার নিজের অন্তর্গত নৈর্ব্যক্তিক প্রক্রিয়ার দিকটি ভাববাদের মধ্যেই বিকশিত হতে দেখা যায়। অর্থাৎ বস্তুবাদ যাকে নিন্দা করে মার্কস তাকেই সামনে নিয়ে আসছেন, তাকেই গুরুত্বপূর্ণ বলছেন। তাঁর প্রথম থিসিসেই এর উল্লেখ করেছেন। 
তবে মার্কসের আপত্তিও আছে। আপত্তি হচ্ছে, সেই বিকাশ এমন ভাবে ঘটে যাতে মনে হয়, চিন্তার প্রক্রিয়া কোনো কংক্রিট বা মূর্ত ব্যাপার নয়; নিছকই একটা বিমূর্ত প্রক্রিয়া। দ্বিতীয় অভিযোগ হচ্ছে, এই ভাববাদ আবার ইন্দ্রিয়শীলতা কি জিনিস, সেটা জানে না। এখানে ইঙ্গিত হচ্ছে, চিন্তাপ্রক্রিয়াও একটি ইন্দ্রিয়তৎপর বা ইন্দ্রিয়শীল নৈর্ব্যক্তিক প্রক্রিয়া, ভাববাদ সেটা বোঝে না। হেগেল তাঁর ‘লজিক’ বইতে সেটাই দেখাতে চেষ্টা করেছেন। রক্তমাংসের মানুষ হিসাবে আমরা কোন্ বিষয়কে কিভাবে উপলব্ধি করি, সেটাও ইন্দ্রিয়শীল তৎপরতারই অংশ। মার্কস স্বীকার করেন যে, ফয়েরবাখ চিন্তার বিষয় আর ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়ের মধ্যে ফারাক করেন এবং ভাবগত চিন্তার বিপরীতে রক্তমাংসের মানুষের ইন্দ্রিয়োপলব্ধির পার্থক্যের প্রতি মনোযোগী। কিন্তু মানুষের কর্মতৎপরতাকে নৈর্ব্যক্তিক তৎপরতা হিসাবে বুঝতে পারেন না। 
এর ফলে কী হয়েছে? মার্কস বলছেন, “খ্রিস্টীয় তত্ত্বের সারকথা (Essence of Christianity) বইতে তিনি তত্ত্বীয় দৃষ্টিভঙ্গিকেই মানুষের একমাত্র সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি বলে মেনেছেন, অথচ চর্চাকে বুঝেছেন ও নির্ণয় করেছেন নোংরা ইহুদি-ধর্মাচারের অভিব্যক্তি হিসাবে। ফলে তিনি ‘বিপ্লবী’, ‘ব্যবহারিক-পর্যালোচনা’র কারবারের তাৎপর্য বোঝেন নাই।’
ফয়েরবাখ সম্পর্কে পর্যালোচনামূলক যে সকল মন্তব্য মার্কস করছেন, তার শুরুটাই তাই আমাদের আলোচনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ খোরাক হয়ে রয়েছে। ফয়েরবাখ ধরে নিয়েছেন, তত্ত্বীয় দৃষ্টিভঙ্গিই হচ্ছে মানুষের একমাত্র সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি। কিন্তু মানুষ বাস্তবে যা চর্চা করে, এমনকি মানুষের ইন্দ্রিয়তৎপরতা ও চিন্তার চর্চাও যে নৈর্ব্যক্তিক ও বাস্তব, সেটা ফয়েরবাখ বোঝেন না। এটা ফয়েরবাখসহ সকল বস্তুবাদেরই সমস্যা। একই কারণে বাস্তব অবস্থার বৈপ্লবিক রূপান্তর কিম্বা দৈনন্দিনের পর্যালোচনামূলক ব্যবহারিক কাজকারবারের মধ্য দিয়ে বাস্তবের রূপান্তর কিভাবে ঘটে, ফয়েরবাখ সেটা বুঝতে পারেন না। কারণ তিনি জীবন্ত তৎপরতা বা চর্চার দিকটার প্রতি মনোযোগী নন। তিনি খ্রিস্টধর্মের সারকথায় বুঝিয়েছেন, খ্রিস্টীয় ঈশ্বর ও সংশ্লিষ্ট ধারণা সম্পর্কে মানুষের তত্ত্বীয় দৃষ্টিভঙ্গি আসলে তার নিজ চরিত্র সম্পর্কে তার নিজের তত্ত্বীয় ধারণার প্রক্ষেপণ মাত্র। এই প্রক্ষেপণ একটা বিভ্রান্তি, ইলিউশন কিম্বা বিচ্যুতি। ফয়েরবাখ ধরে নিয়েছিলেন, তত্ত্বগতভাবে এটাকে শুধরে দিলেই মানুষ নিজেকে নিজে খুঁজে পাবে, নিজের অর্থ নিজে বুঝবে। ধর্মের জগৎ ত্যাগ করে মানুষ বাস্তব মানুষের জগতে ফিরে আসবে। এটা স্পষ্ট যে, মার্কস তা মনে করতেন না। এটা শুধু ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে সত্য নয়, দর্শন কিম্বা যে কোন তত্ত্ব সম্পর্কেই সত্য। ফয়েরবাখের চিন্তার পর্যালোচনার সূত্র ধরেই তাই মার্কস বলেছিলেন, ‘দার্শনিকেরা কেবল দুনিয়াকে ব্যাখ্যা করেছেন বিভিন্নভাবে; কাজের কাজ আসলে একে বদলে দেওয়া।’ ফয়েরবাখের ধর্মের প্রতি তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি তাই মার্কসকে টানতে পারেনি, বরং দৈনন্দিন জীবনের বৈষয়িক তৎপরতা ও চর্চার মধ্য দিয়ে মানুষের চিন্তা ও বাস্তব জগৎ কিভাবে বদলায়, মার্কস সেই দিকেই আগ্রহী হয়েছিলেন। 
আমাদের আলোচনার জন্য মার্কসের পর্যালোচনার প্রাসঙ্গিকতা এরকম যে, মানুষ কেন ধর্ম পালন করে, মানুষ কেন আল্লাহতে বিশ্বাস করে এর একটা তত্ত্বগত ব্যাখ্যা দিতে পারলেই বুঝি ধর্মের সার পদার্থ বোঝা যায়; তখন ধর্মের তাত্ত্বিক পরিমণ্ডল ত্যাগ করে মানুষ বস্তুবাদী হয়ে ওঠে। ফয়েরবাখের সঙ্গে মার্কস এখানে একমত হননি। বিদ্যমান বাস্তবতাই যদি ধর্ম ও ধর্মচর্চা অপরিহার্য করে তোলে, তাহলে প্রথম কাজ হচ্ছে, বাস্তবকে বদলানো। তত্ত্বের পরিমণ্ডলে হেগেলের ভাববাদ পর্যালোচনা করতে গিয়ে ফয়েরবাখ মানুষের ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ জগতের গুরুত্ব ঠিকই ধরতে পেরেছিলেন, মার্কস ফয়েরবাখের এই অর্জন অকুণ্ঠচিত্তে মানেন ও স্বীকার করেন। তবে তার সীমাবদ্ধতা ধরিয়ে দিয়েছেন এভাবে যে, ফয়েরবাখ বিমূর্ত চিন্তায় সন্তুষ্ট নন বলে ইন্দ্রিয়মগ্নতা চান; কিন্তু তিনি ইন্দ্রিয়পরায়ণতাকে ব্যবহারিক নৈর্ব্যক্তিক প্রক্রিয়া হিসাবে, অর্থাৎ মানুষেরই ইন্দ্রিয়পরায়ণ তৎপরতা হিসাবে ধরতে পারেন না।
ব্যাপকার্থে ইন্দ্রিয় তৎপরতা কিম্বা চিন্তা বা চিন্তাপ্রক্রিয়াও যে বাস্তব মানুষের বাস্তব তৎপরতা, ফয়েরবাখ সেটা ধরতে পারেননি। এই দিক থেকে আগের সকল বস্তুবাদের যে ত্রুটি, সেই ত্রুটি ফয়েরবাখেও থেকে গেছে। চিন্তা, চিন্তাপ্রক্রিয়া, ভাবচর্চা বা ভাববাদের বিপরীতে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তু জগৎকে একমাত্র সত্য বললে সমস্যা মেটে না। মানুষের চিন্তা, চিন্তাপ্রক্রিয়া বা ভাব বাস্তবতারই অংশ। বস্তুবাদ ও ভাববাদের এই বিভাজন অতিক্রম করে মার্কস নতুনভাবে চিন্তা করবার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। সেই ইঙ্গিতে মানুষের বৈষয়িক জীবনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে যুগপৎ দৃশ্যমান জগৎ ও চিন্তার জগৎ বোঝার প্রতি অভিমুখ তৈরি হয়েছিল মার্কসের হাতেই। এখানেই মার্কস বস্তুবাদের পরিমণ্ডল থেকে বেরিয়ে গেলেন। বস্তুবাদ আর ভাববাদের খাপে ফেলে তাঁকে আর বিচার করা যায় না।
ফয়েরবাখের ত্রুটি ধরে মার্কস ধর্ম নিয়ে কোন তত্ত্বীয় আলোচনায় আগ্রহ বোধ করেননি, বরং মানুষের বাস্তব জীবন ব্যাখ্যা করবার জন্যই তিনি সারা জীবন ব্যয় করেছেন, যেখানে ধর্ম অন্তর্ভুক্ত, বিচ্ছিন্ন কোন ব্যাপার নয়। মানুষকে তার বৈষয়িক বা আর্থসামাজিক তৎপরতার জায়গা থেকে দেখলে তত্ত্বীয় জ্ঞান হিসাবে ধর্ম কী রূপ পরিগ্রহণ করছে কিম্বা বাস্তবে কি ভূমিকা রাখছে, সেটা বোঝা যাবে। বাস্তবের জীবন ও জগৎ থেকে বিচ্ছিন্নভাবে ধর্ম পর্যালোচনার পথ বা পদ্ধতি মার্কস গ্রহণ করেননি। মার্কসের বড় অবদান এখানে। 
মার্কস বলছেন, ফয়েরবাখ ধর্মীয় আত্মবিচ্যুতির বাস্তবতা থেকে শুরু করেন। ধর্ম হচ্ছে মানুষের আত্মবিচ্যুতি, নিজেকে নিজে হারিয়ে ফেলা, নিজের স্বভাবকে ঈশ্বরের স্বভাবের মধ্যে আবিষ্কার করা ইত্যাদি। দুনিয়া একটাই, কিন্তু তাকে ফয়েরবাখ দুইটা বানিয়ে ফেলেন। একটা ধর্মীয় বা নিজের স্বভাব প্রক্ষিপ্ত করা ধর্মীয় কল্পনার জগৎ আর অন্যটা প্রকৃত, বাস্তবের দুনিয়া। ফয়েরবাখ ধর্মীয় দুনিয়াকে ধর্মনিরপেক্ষ ভিত্তির মধ্যে বা ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তা দিয়ে মীমাংসা করতে চান। কিন্তু এতে একটা ধোঁয়াশা তৈরি হয়। তিনি খেয়াল করেন না, এই কাজ শেষ করার পরও ধর্ম ও মানুষের বাস্তব জীবনের সম্পর্ক বিচারের আসল কাজ বাকি থেকে যায়। 
ঘটনা হলো, ধর্মকে ধর্মনিরপেক্ষতার পাটাতনে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ফয়েরবাখ খোদ ধর্মনিরপেক্ষতার স্ববিরোধিতার মধ্যে খাবি খেতে থাকেন। খ্রিস্টীয় ট্রিনিটির ধারণা পরিবারের ধারণা থেকে উদ্ভূত, ফয়েরবাখ তা মনে করেন। তাহলে খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্বের ট্রিনিটির ধারণায় রূপান্তর ঘটাতে হলে বাস্তব জগতের পরিবারের মধ্যে রূপান্তর আনতে হবে। পার্থিব পরিবারই যদি খ্রিস্টীয় পবিত্র পরিবারের গোপন রহস্য বলে উন্মোচিত হয়ে থাকে তাহলে পার্থিব পরিবারের লয় বা রূপান্তর ঘটাতে না পারলে খ্রিস্টীয় পবিত্র পরিবারের ধারণা লয় পাবে কিভাবে? বাস্তবের এই রূপান্তরের কাজটি বাস্তবেরই কাজ, তত্ত্বের নয়। এখানেই ফয়েরবাখীয় বস্তুবাদ ও নাস্তিকতার সীমাবদ্ধতা। মার্কসের দাবি, বাস্তব জীবনের ব্যবহারিক-বৈপ্লবিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই বাস্তবের রূপান্তর ঘটাতে হবে, কিম্বা ঘটবে। তাত্ত্বিকভাবে খ্রিস্টীয় পরিবারতত্ত্ব ভুয়া, খ্রিস্টধর্ম ভুয়া, কিম্বা তার একটু সেকুলার ব্যাখ্যা খাড়া করার ক্ষেত্রে মার্কস আগ্রহী ছিলেন না। এই ধরণের ধর্মবিরোধী তৎপরতাতেও মার্কস আগ্রহী ছিলেন না। ধর্ম নিয়ে তিনি লেখালিখি করাও গুরুত্বপূর্ণ মনে করেননি, বরং বৈষয়িক জীবনের রূপান্তরের মধ্য দিয়ে শুধু পারিবারিক সম্পর্ক নয়, মানুষের সকল প্রকার বৈষয়িক সম্পর্কের রূপান্তর কিভাবে ঘটছে, মানবেতিহাসের রূপান্তরের সেই সকল গতিপ্রকৃতি ও ইতিহাস বুঝতেই তিনি জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। 
ধর্মে বা ধর্মতাত্ত্বিক পরিমণ্ডলে মানুষের যে সারাৎসার বা তাৎপর্য, ফয়েরবাখ তাকে মানবিক করে তোলেন, তাকে অ্যানথ্রপলজি বা মানববিদ্যার অন্তর্ভুক্ত করে মানুষসংক্রান্ত ধর্মীয় সারাৎসারকে মানুষের মানবিক সারসত্তায় নিরসন করেন। ধর্মের মানবিক দিকটি ফয়েরবাখ দেখান। কিন্তু মানুষের সারসত্তা সম্পর্কে যে তত্ত্ব তিনি বের করে আনেন তা এমন কোন বিমূর্ত ব্যাপার নয় যে, প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যেই তা সহজাত। আমরা বলতে পারি না, মানুষ মানেই ফয়েরবাখ খ্রিস্টধর্মের পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে মানুষের সারসত্তা বের করে এনেছেন কিম্বা যে ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন, মানুষ ঠিক সে রকম। 
মানুষ তাহলে কী? তরুণ মার্কস উত্তর দিচ্ছেন, ‘বাস্তবে মানুষ সামাজিক সম্পর্কের সম্মিলন।’ সমাজে বিভিন্ন বৈষয়িক ও বাস্তবিক সম্পর্কে জড়িত মানুষ হচ্ছে সেই সকল সম্পর্কেরই সামগ্রিক ফল। ফয়েরবাখের এই পর্যালোচনা মার্কসের হাত ধরে পরে ‘সামাজিক উৎপাদন’ বা উৎপাদন সম্পর্কের ধারণায় গিয়ে পৌঁছায়। কিন্তু ফয়েরবাখ মানুষের এই ‘প্রকৃত সারসত্তা’র পর্যালোচনা করতে সক্ষম হননি। ফলে ফয়েরবাখ দুটো সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন। 
১. মানুষকে তার বাস্তবিক বা বৈষয়িক ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে ‘বিমূর্ত’ সত্তা গণ্য করা। ইতিহাসবিচ্ছিন্ন এই বিমূর্ত মানুষের ধর্মীয় আবেগকে এমন ভাবে অনুমান করা বুঝি সেই আবেগ আপনাতেই আপনি হাজির হয় বা হাজির থাকে। অর্থাৎ ধর্মকে একজন বিচ্ছিন্ন ও বিমূর্ত মানুষের সেন্টিমেন্ট বা আবেগ হিসাবে ফয়েরবাখ বিচার করেছেন। তিনি ধর্মের সামাজিক কিম্বা ঐতিহাসিক তাৎপর্য বুঝতে পারেননি। ‘ধর্মীয় আবেগ’ নিজেই যে একটা সামাজিক ঐতিহাসিক ব্যাপার এবং দেশকাল পাত্রভেদে সেই আবেগেরও যে রকমফের আছে, ফয়েরবাখ তা বোঝেননি। যে কারণে ফয়েরবাখ যে বিমূর্ত মানুষকে ব্যাখ্যা করেছেন, বাস্তবে সেই মানুষটি যে বিশেষ ধরণের সমাজের অন্তর্গত, সেটা ফয়েরবাখের চোখে পড়ে না।
২. মানুষের সারসত্তাকে অতএব, ফয়েরবাখ কেবল ‘প্রজাতি’র স্বভাব হিসাবেই নির্ণয় করেছেন; যেন এই সারসত্তা মানুষের অন্তর্গত এক ধরণের নির্বোধ সামান্য বৈশিষ্ট্য। এই প্রজাতিগত নির্বোধ বৈশিষ্ট্যের অনুমান দিয়ে বিভিন্ন ও বিচিত্র মানুষকে ফয়েরবাখ প্রকৃতিগতভাবে এক বা অভিন্ন ভেবেছেন। 
আমাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আমরা (১) ফয়েরবাখের খ্রিস্টধর্মের পর্যালোচনা এবং (২) কার্ল মার্কসের খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে ফয়েরবাখের পর্যালোচনার পর্যালোচনা সংক্ষেপে এখানে তুলে ধরলাম। ধর্ম পর্যালোচনার ইতিহাস কিভাবে সমাজ ও ইতিহাস পর্যালোচনার ধারা হিসাবে গড়ে উঠল, আশা করি সে সম্পর্কে কিছু প্রাথমিক ধারণা আমরা এখানে দিতে পেরেছি। 
১১ অক্টোবর ২০১৫, ২৬ আশ্বিন ১৪২২, শ্যামলী 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন