রবিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

মানুষের নিজের কাছ থেকে নিজের বিযুক্তি ধর্মের পর্যালোচনা ও বাংলাদেশে ইসলাম-৯


‘ধর্মের পর্যালোচনা’ সকল পর্যালোচনার পূর্বশর্ত, ভিত্তি বা আরম্ভ- তরুণ মার্কসের তরফ থেকে আসা এই প্রকার বহুল প্রচারিত ভাবনার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে আমরা লিখছি। এরপর মার্কস বলেছিলেন, জার্মানিতে ধর্মের পর্যালোচনা মোটামুটি শেষ হয়েছে। তাই তিনি ধর্ম ও দর্শনের বিষয় থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে মনোযোগ দিলেন অর্থশাস্ত্রে। তথাকথিত ‘আধুনিকতা’ ও ‘প্রগতিশীলতা’র যুগে এটা রীতিমতো বিশ্বাস হিসাবেই বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল যে ধর্মের যুগ শেষ। গড ইজ ডেড। রিলিজিয়ন বা ধর্মের জগৎ আমরা পশ্চাতে ফেলে এসেছি। রিলিজিয়ন বা ধর্ম আর ফিরে আসবে না। আধুনিকতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে রিলিজিয়ন বা ধর্মেরও অবলুপ্তি ঘটবে। 
কিন্তু ইতিহাস বড়ই মনোরম। সেটা হয় নি। ধর্ম লুপ্ত হওয়া দূরে থাক বরং প্রত্যাবর্তন করেছে প্রবল বেগে। কিন্তু কী আসলে প্রত্যাবর্তন করেছে এবং কেন এই প্রত্যাবর্তন অনিবার্য ছিল সে সম্পর্কে দুনিয়াব্যাপী তর্কবিতর্কের শেষ নাই। আমরা ধর্মের প্রত্যাবর্তনের অর্থ বোঝার জন্যই ধর্মের পর্যালোচনা কথাটা জার্মান দার্শনিকেরা কিভাবে বুঝেছিলেন সেটা বোঝার চেষ্টা করছি। সেটা করছি বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামকে আমাদের মুখ্য আগ্রহের বিষয় হিসাবে নজরে রেখে। ইসলাম নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আমরা যেন প্রাক-ইসলামি চিন্তা বা দর্শনের মধ্যে ফিরে না যাই তার প্রস্তুতি হিসাবে। আমরা দাবি করেছি। ইসলামের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির বদল ও তার রাজনৈতিক-দার্শনিক প্রস্তাবনা সঠিকভাবে উপলব্ধি ও বোঝার ওপর বাংলাদেশের জনগণের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। 
ধর্মের পর্যালোচনা শেষ হয়েছে কথাটা জার্মান দর্শন- বিশেষত হেগেল, ফয়েরবাখ ও ইয়ং হেগেলিয়ানদের লেখালিখির পরিপ্রেক্ষিতেই কার্ল মার্কস বলেছিলেন। আলোচনার এই সুনির্দিষ্ট সীমার কথা আমরা যেন আবার ভুলে না যাই। মনে রাখা দরকার মার্কস, এঙ্গেলস, ফয়েরবাখ এমনকি হেগেলেরও ইসলাম সম্পর্কে কোন সম্যক ধারণা ছিল না। তবে ইসলামের দার্শনিক প্রস্তাবনার বৈপ্লবিক সম্ভাবনা হেগেলের নজর এড়ায় নি, সেটা তাঁর ইতিহাসসংক্রান্ত দর্শনে আমরা দেখি। তবে ‘ধর্ম’ বলতে তাঁরা সকলেই মূলত খ্রিষ্টধর্মই বুঝেছেন এবং খ্রিষ্টধর্মের আলোকেই অন্যান্য ধর্মকে বোঝার চেষ্টা করেছেন। আমাদের আগ্রহ হচ্ছে খ্রিষ্টধর্মের পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে যে ধারা পাশ্চাত্যে গড়ে উঠেছে তা আমাদের জন্য কোথায় এবং কেন প্রাসঙ্গিক এবং কোন দিকগুলো একদমই অপ্রাসঙ্গিক সেই ফারাক যথাসম্ভব স্পষ্ট করা। 
জার্মান দর্শন ধর্মের প্রশ্ন মীমাংসা করতে পারে নি, কিন্তু ধর্মের তাৎপর্য বিচারের জটিল গিঁট ও সেই গিঁট খুলবার সম্ভাব্য পদ্ধতি যারপরনাই স্পষ্ট করেছে। ধর্ম নিয়ে নতুনভাবে আলোচনা ও পর্যালোচনা শুরুর জন্য সেটা জরুরি। তারা কী ধরনের তর্কবিতর্ক করেছেন যদি তার খোঁজ আমরা না রাখি কিংবা তাদের বিশ্বাস বা দর্শন আমাদের চেয়ে ভিন্ন বলে এড়িয়ে যাই তাহলে পুরা তর্কই আমাদের আবার নতুন করে আবিষ্কার করতে হবে। করে ভাবব, আমরা বুঝি আসলেই নতুন কিছু আবিষ্কার করেছি। হেগেল, ফয়েরবাখ ও মার্কসের ওপর আমাদের আগ্রহ বিশেষত এ কারণেই। তাদের মধ্য দিয়ে চিন্তার প্রান্তসীমা কোথায় এসে থেমেছে, সেটা নতুন করে চিহ্নিত করা দরকার, যাতে আমরা আবার চলতে শুরু করতে পারি। আমরা পুরানা চাকা নতুন করে বানাতে চাই না, সেটা মোটরগাড়ির চাকা হলেও- কারণ চিন্তা, ডিজাইন ও ব্যবহারের দিক থেকে গরুর গাড়ির চাকা আর মোটরগাড়ির চাকার মধ্যে কোনো ফারাক নাই। উভয়ে গোল এবং মাটিতে গড়ায়। এমনকি মাটিতে যখন চলে তখন এরোপ্লেনের চাকার ক্ষেত্রেও একই কথা সত্য। ডানাটা অবশ্য উড়োজাহাজে নতুন। অতএব মিল ও ফারাক চিহ্নিত করা দর্শনের দরকারি কাজ। এই কাণ্ডজ্ঞানটুকু আশা করি আমাদের আছে। 
ফয়েরবাখের ‘খ্রিষ্টধর্মের সারকথা’ বইটির শুরুর প্রথম বাক্যটি হচ্ছে : ‘ধর্ম হচ্ছে মানুষের নিজের সঙ্গে নিজের বিচ্ছেদ’। ধর্ম ভুয়া, প্রতারকদের কাণ্ড, ধর্মগুরুরা ব্যক্তি হিসাবে খুব খারাপ প্রাণী, আমি আল্লাহ বা ধর্মে বিশ্বাস করি না- এই ধরনের বালখিল্য, নাস্তিক্যবাদী বিরক্তিকর অহং কিংবা উসকানিমূলক কোনো বক্তব্য দিয়ে ফয়েরবাখ আলোচনা শুরু করেননি। অথচ তিনি ‘ফাদার অব মডার্ন এথেইজম’ বা ‘আধুনিক নাস্তিক্যবাদের পিতা’ হিসাবে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। এই খ্যাতি এখনো বহাল। আধুনিক নাস্তিক্যবাদের বাবার সঙ্গেই তাই আমরা আমাদের হিসাবনিকাশ চুকিয়ে নিতে চাই। 
হেগেল থেকে শুরু করে ফয়েরবাখ ও মার্কস অবধি পাশ্চাত্যে নাস্তিক্যবাদের যে ধারাকে আমরা চিনি তার গোড়ায় রয়েছে ধর্ম ব্যাপারটা আসলে কী, সেটা ব্যক্তিমানুষের উপলব্ধি বা তার জানার আকুতির দিক থেকে বোঝার আন্তরিক চেষ্টা। তার ফল হচ্ছে ধর্মের মানবিকীকরণ। অর্থাৎ ধর্মের মানবিক মর্মের দিকটা বোঝার ওপর গুরুত্বারোপ। নাস্তিক্যবাদ বলতে খেয়ে-না-খেয়ে ধর্ম বিরোধিতা বলতে বাংলাদেশে আমরা যা বুঝি, এই আকুতির মধ্যে তার ছিটেফোঁটাও নাই। মানুষই ধর্ম করে। মানুষেরই ধর্ম আছে। অতএব মানুষকে বোঝা গেলে ধর্মকেও বোঝা যাবে। হেগেল থেকে ফয়েরবাখ আর ফয়েরবাখ থেকে মার্কস অবধি অনুসরণ করলে আমরা দেখব ধর্মের পর্যালোচনা বলতে মানুষ ধর্মের মধ্য দিয়ে কী বলতে চায়, কিভাবে বলতে চায়, জ্ঞানতত্ত্বের পরিমণ্ডলে সেই সত্যটাই সকলে বুঝতে চাইছেন। তাঁদের দর্শনের ভারকেন্দ্র মানুষ। আর এই মানুষ এমন এক বিচিত্র সত্তা যে ইহলোকে বসেই যুগপৎ ‘ইহ’ ও ‘পর’- অর্থাৎ ইহকাল ও পরকাল নিয়ে ভাবে। পরকালের কথা বললে মানুষের কথাই আসে, কারণ পরকাল নিয়ে মানুষই তো ভাবে। ভাবতে সক্ষম। ভাবাটা তার স্বভাব। মানুষ এমনই এক সত্তা যে নিজেই ‘ইহ’ বা ‘এই’- সে এখানেই- বিশেষ দেশকালেই আছে। কিন্তু আছে পরকালকে সঙ্গী করে। 
এটা বলছি বাংলাদেশের তরুণদের জন্য। একই প্রকার আকুতি যাদের অনেকের মধ্যেই প্রবল। এটা শুভলক্ষণ। একদিন তারা বড় চিন্তাবিদ হিসাবে নিজের চিন্তাশীলতার ক্ষমতা প্রদর্শন করবেন, এই বিশ্বাস অমূলক বা অতি প্রত্যাশা নয়। তাই ‘নাস্তিক্যবাদ’ নামে যে সকল কুৎসিত প্রচার মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে বাংলাদেশে জারি রয়েছে, তার সঙ্গে দার্শনিক নাস্তিকতার কোনো সম্পর্ক নাই সে সম্পর্কে হুঁশিয়ার থাকা জরুরি। জার্মান দর্শনে ‘এথেইজম’-এর চরিত্রে ইহলৌকিক ও মানবিক সংবেদনার ছাপ স্পষ্ট। যে কারণে জার্মান দর্শনে ধর্মের পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে ধর্মের ‘মানবিকীকরণ’-প্রক্রিয়া কিভাবে অনায়াসে রূপ লাভ করে সেটাই অনায়াসে আমরা প্রত্যক্ষ করি। ইসলামের দিক থেকে যেকোনো মানবিক সংবেদনা গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান। কিন্তু ধর্ম বা দীনের ধারণা ধর্মকে ‘মানবতাবাদ’-এ পর্যবসিত করা নয়। 
ফয়েরবাখ এই অর্থে নাস্তিক যে তিনি ধর্মকে স্রেফ ইমান আকিদা বিশ্বাস বা আচার হিসাবে দেখেছেন। দেখেছেন জীবন ও জগৎ সম্পর্কে মানুষের তত্ত্ব হিসাবে। ঠিক একইভাবে হেগেলের দর্শনকেও না। দুটোই তাঁর কাছে মানুষের আত্মবিচ্যুতির লক্ষণ। ধর্ম হচ্ছে মানুষ যখন নিজের মধ্যে নিজে বিভক্ত হয়ে যায়, নিজেকে নিজেই হারিয়ে ফেলে। ধর্ম সেই বিভক্তির চিহ্ন। ধর্ম ফয়েরবাখের কাছে মানুষের নিজের কাছ থেকে নিজের হারিয়ে যাবার কেচ্ছা। মানুষ নিজের কাছে নিজে আবার কিভাবে ফিরে আসতে পারবে সেই পথটাই ফয়েরবাখ আমাদের বাতলাতে চান। সেই পথ বাতলাতে গিয়ে তিনি বুদ্ধি আর হৃদয়ের মধ্যে পার্থক্যের প্রসঙ্গ তোলেন। বুদ্ধিসর্বস্বতার সমালোচনা করেন। বুদ্ধি দিয়ে সব কিছু নির্ণয় করা আর ইন্দ্রিয়পরায়ণতার পার্থক্যের প্রসঙ্গ আনেন। বাস্তব জীবনের দুঃখকষ্টের দিকে দর্শনের নজর ফেরাতে চান। দেখান যে মানুষ শুধু চিন্তা করে না। খ্রিষ্টীয় অর্থে ইহলৌকিক জগতে যাতনাও বোধ করে। খ্রিষ্টীয় অর্থেই মানুষের ‘সাফারিং’ আছে। কষ্ট আছে মানুষের। মানুষ ভোগে। বুদ্ধি মানুষ সম্পর্কে শেষ কথা নয়। মানুষ শরীরসম্পন্ন; রক্তমাংসে মানুষ। কিন্তু দর্শন সেটা মনে রাখে না। ফয়েরবাখের ধর্ম পর্যালোচনা ছিল একই সঙ্গে জার্মান ভাবাদর্শের পর্যালোচনা, কিংবা আরো সরলভাবে চিন্তা বা দর্শনের সেই বিকৃতির পর্যালোচনা যেখানে ইন্দ্রিয়পরায়ণ বাস্তব জগৎ নয়, মানুষকে বুদ্ধিসর্বস্ব প্রাণী হিসাবে অনুমান করা হয়। যেন সঠিক চিন্তাই মানুষের ভবলীলার সকল সঙ্কট ও সমস্যার সমাধান করতে সম্ভব। ফয়েরবাখ বলছেন, “ধর্ম হচ্ছে মানুষের নিজের সঙ্গে নিজের বিচ্ছেদ; সে তার নিজের বিপরীতে আল্লাহকে বসায়। মানুষ যা আল্লাহ তা নন, আর আল্লাহ যা মানুষ সেটাও নয়। আল্লাহ অসীম, মানুষ সসীম; আল্লাহর কোনো খুঁত নাই, কিন্তু মানুষে খুঁত আছে; আল্লাহ কালাতীত কিন্তু মানুষ কালের অধীন; আল্লাহ সর্বশক্তিমান, মানুষ দুর্বল; আল্লাহ পবিত্র, মানুষ পাপী। আল্লাহ আর মানুষে চরম ফারাক : আল্লাহ একদমই যথার্থ, সকল ইহলৌকিক বাস্তবতার যোগফল; মানুষ একদমই নিরর্থক, নিজের অর্থহীনতা নিয়েই তার চিন্তা। কিন্তু ধর্মে মানুষ তার সুপ্ত স্বভাবেরই ধ্যান করে”। 
ধর্ম মানুষের নিজের স্বভাব থেকে মানুষের নিজের বিচ্ছেদের লক্ষণ। মানুষের স্বভাবের মধ্যেই মানুষের দিব্য চরিত্র নিহিত, সেই স্বভাব নিয়ে ধ্যান করতে গিয়ে মানুষ নিজেকে তার নিজেরই স্বভাব থেকে আলাদা করে ভাবে। নিজের স্বভাব মানুষের কাছ থেকে বিচ্যুত হয়ে তার কাছ থেকে ভিন্ন হয়ে আলাদা সত্তা হয়ে ওঠে। তাহলে ধর্ম পর্যালোচনার কর্তব্য কী? ফয়েরবাখ বলছেন, ‘তাহলে দেখাতে হবে মানুষের বিপরীতে আল্লাহর উপস্থিতি, আল্লাহ আর মানুষের মধ্যে এই ফারাক ঘটার কাণ্ডটা- যে পার্থক্য থেকে ধর্মের আরম্ভ- মানুষের নিজের স্বভাবের সঙ্গে নিজের দূরত্ব রচনা মাত্র।’ কিন্তু আমরা কী করে বুঝব আমরা ঠিক বলছি? আর মানুষের এই বিভক্ত অস্তিত্বযাপনের প্রয়োজনীয়তাই বা কী? 
ফয়েরবাখের উত্তর হচ্ছে, ‘এর আন্তরিক প্রয়োজনীয়তার প্রমাণ ধরা পড়ে যখন বুঝি যেখান থেকে ধর্মের শুরু যদি মানুষের সেই দিব্য স্বভাব ধর্মের বিষয় না হোত- তাহলে এই বিযুক্তি এই বিভাজন ঘটা কখনোই সম্ভব হোত না। আল্লাহ যদি আমার স্বভাব থেকে আসলেই আলাদা কোনো সত্তা হোত, তাহলে তাঁর নিখুঁত পূর্ণতা আমার অস্বস্তির কারণ হবে কেন?’। অর্থাৎ আল্লাহ নিয়ে আমাদের এত ভাবনাচিন্তার দরকার কী? আমরা তো এই চিন্তা বাদ দিয়ে অনায়াসেই ইহলৌকিক জীবন হেসেখেলে কাটিয়ে দিতে পারি। ফয়েরবাখের যুক্তি অনুসারে সেটা সম্ভব নয়। যদি মানুষের দিব্যস্বভাব তার নিজের কাছ থেকে অপর বা আলাদা হয়ে থাকবার কারণে ধর্মের উৎপত্তি ঘটে, তাহলে সেই বিযুক্তির মীমাংসা না করে মানুষের পক্ষে হেসেখেলে জীবন কাটিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। মানুষ তার নিজের স্বভাবের কারণেই তার দিব্যস্বভাবকে তার চিন্তার বা বুদ্ধির বিচারের বিষয় করবেই। ধর্ম ও দর্শন উভয়ের উৎপত্তিকাণ্ড এখানে।
“কোনো কিছুর মধ্যে বিযুক্তি তখনই ঘটে যখন দুইয়ের এক হওয়া উচিত হলেও তারা আলাদা, উভয়েই এক হবার কথা থাকলেও, এক হতে পারার কথা থাকলেও, তারা পৃথক, আর আসলে তাদের স্বভাব বা সত্যই হচ্ছে এই যে তারা এক। এই সাধারণ ভিত্তি থেকেই বোঝা যায় যে- স্বভাবের কারণে মানুষের মধ্যে এই বিযুক্তির উপলব্ধি ঘটে সেটা তার জন্মগত, তার অন্তর্গত প্রকৃতি, কিন্তু একই সঙ্গে যে শক্তি এই উপলব্ধি প্রদান করে, উভয়ের মিলন ঘটাবার সংবেদনা জাগ্রত করে, আল্লাহর সঙ্গে ঐক্যের তাগিদ দেয়- যা আসলে তার নিজের সঙ্গের নিজের একীভূত হবারই আকাঙ্ক্ষা- সেই শক্তির চরিত্র আলাদা।” 
এখানে দুটো প্রসঙ্গ আমরা পাচ্ছি। মানুষ নিজের দিব্যস্বভাব থেকে বিযুক্ত হয়ে যায়, এটা জন্মগত। অন্য দিকে নিজের কাছ থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া সেই দিব্যসত্তার সঙ্গে একীভূত হবার আকাক্সক্ষার শক্তির চরিত্র আর বিযুক্তির চরিত্র আলাদা। এই শক্তিটা তাহলে কী?
ফয়েরবাখ বলছেন, সেটা হচ্ছে মানুষের বুদ্ধি, মানুষের যুক্তি কিংবা সাধারণভাবে মানুষের চিন্তা। ফয়েরবাখ বলছেন, ‘এই চরিত্র আর কিছুই নয় মানুষের বুদ্ধি, মানুষের যুক্তি, যাতে মানুষ বুঝতে পারে আল্লাহ হচ্ছেন মানুষের অ্যান্টিথিসিস মাত্র যিনি মানুষ নন; অর্থাৎ যিনি নিজে মানুষ নন, কিন্তু বুদ্ধিরই নৈর্ব্যক্তিক রূপ। বিশুদ্ধ, নিখুঁত দিব্যস্বভাব হচ্ছে বুদ্ধিরই আত্মসচেতনতা, সেই চৈতন্য যার দ্বারা বুদ্ধি নিজের খুঁত (perfection) সম্পর্কে ধারণা করতে পারে।’ 
আল্লাহকে বুদ্ধি বা আত্মসচেতন চিন্তারই নৈর্ব্যক্তিক রূপ বলার মধ্যে আমরা এখানে হেগেলের নৈর্ব্যক্তিক স্পিরিট বা পরমের ধারণাকেই আসলে পাচ্ছি। এ ক্ষেত্রে ফয়েরবাখ হেগেলকে অতিক্রম করে যেতে পারেন নি। মানুষের চিন্তার স্বভব সম্পর্কে দার্শনিক নয়, একটা নৃতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা তিনি খাড়া করছেন। সারকথা দাঁড়ায় এ রকম যে আল্লাহ আর কিছুই নন মানুষ নিজের সম্পর্কে যা ভাবে নিজেকে নিয়ে যেভাবে ভাবতে চায় তারই বুদ্ধিবৃত্তিক প্রক্ষেপণ মাত্র। এটা ফয়েরবাখের ‘প্রক্ষেপণ তত্ত্ব’ হিসাবে দর্শনে পরিচিত। তবে এর গুরুত্ব দর্শনের চেয়েও নৃতত্ত্ব ও মনস্তত্ত্বেই অধিক। নৃতত্ত্ব এ কারণে যে ফয়েরবাখের আলোচনার বিষয় মানুষের জন্মগত স্বভাব। কিন্তু লক্ষ করবার বিষয় যে তার নাস্তিকতায় আল্লাহকে অস্বীকার নাই, আল্লাহর ধারণার উৎপত্তির অনিবার্য নৃতাত্ত্বিক শর্ত তিনি আলোচনা করছেন। দ্বিতীয়ত তিনি দর্শনের উৎপত্তি কারণকেও নৃতত্ত্বের জায়গা থেকেই বিচার করছেন। আল্লাহ হচ্ছে মানুষের কাছ থেকে বিযুক্ত হয়ে যাওয়া একটি নৈর্ব্যক্তিক ধারণা, বুদ্ধি যার সঙ্গে আবার বুদ্ধির পরিমণ্ডলে একীভূত হবার সাধনা করে। বুদ্ধি বা দর্শনের এই চেষ্টার বিরুদ্ধে ফয়েরবাখের বিরাগ স্পষ্ট। তিনি বলছেন, “হৃদয়ের কষ্টের কথা বুদ্ধি কিচ্ছু জানে না; বুদ্ধির কোনো আকাক্সক্ষা নাই, কোনো আবেগ নাই, কোনো অভাব নাই, সে কারণে কোনো অপূর্ণতা বা দুর্বলতাও নাই। যে মানুষের মধ্যে এই বুদ্ধিসর্বস্বতাই অধিপতি তিনি একদেশদর্শী অথচ যেন তিনি নিশ্চিত সেইভাবে আমাদের বুদ্ধিকে রূপে ও কর্তাগুণে হাজির করে আমাদের দেখাতে চান যে বুদ্ধির চরিত্র হৃদয়ের যন্ত্রণা, সংবেদনা, মানুষের আবেগের আতিশয্য থেকে মুক্ত; বুদ্ধি কোনো দেশকালে সীমিত অর্থাৎ কোনো বিশেষ বস্তু বা বিষয়ের বিষয়ের প্রতি সংবেদনা বোধ করে না। কোনো কিছুতেই বুদ্ধির অঙ্গীকার নাই, বুদ্ধি মাত্রই স্বাধীন- কিছুই আকাক্সক্ষা না করা এবং সকল প্রকার অভাব থেকে মুক্ত বুদ্ধি নিজেকে অমর দেবতায় পরিণত করতে চায়।”
এটা হেগেলের দর্শনের সমালোচনা। চিন্তা স্বাধীন ও সার্বভৌম- এই ধারণাকে সমালোচনা করছেন ফয়েরবাখ। অর্থাৎ হেগেলের দর্শনকে ফয়েরবাখ যেভাবে বুঝেছেন তার সমালোচনা। যদিও হেগেলের পরমের ধারণা বুদ্ধিসর্বস্বতায় পর্যবসিত হয়েছে গণ্য করা দর্শনে বিতর্কিত। আমাদের জন্য এখানে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এই যে দর্শন যখন বুদ্ধিকেই সত্য নির্ণয়ের পরাকাষ্ঠা গণ্য করে এবং হৃদয়ের কথা বা রক্তমাংসের মানুষের কথা ভুলে যায়- ফয়েরবাখ তার বিরোধিতা করছেন। দর্শন যখন মানুষের ইতিহাসকে নির্বিশেষ বা বিমূর্ত ইতিহাস করে তোলে ফয়েরবাখ তা মানছেন না। সবিশেষ বা সুনির্দিষ্ট মানুষকে দর্শনের মনে না রাখার বিরোধিতা করছেন তিনি। এই ফয়েরবাখ আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এটা আমরা বুঝতে পারি জার্মান দর্শনকে বুদ্ধিসর্বস্ব দর্শনের সীমাবদ্ধতা ধরিয়ে না দিলে কার্ল মার্কসের জন্ম হোত না। অর্থাৎ সত্যিকারের রক্তমাংসের মানুষ ও রক্তমাংসের মানুষের ইতিহাস দর্শনের বিষয় হয়ে উঠত না- যে দর্শনকে আমরা মার্কসের অর্থশাস্ত্র হিসাবে এখন বুঝি। 
তবে ইসলামের দিক থেকে ওপরের আলোচনা থেকে শিক্ষণীয় কী? আমরা বুঝতে পারি কেন ইসলাম আল্লাহকে দর্শন, নৃতত্ত্ব বা কোনো প্রকার তত্ত্বের বিষয়ে পরিণত করার ঘোরবিরোধী। যে কারণে আমি এর আগে উল্লেখ করেছি আল্লাহকে শুধু বস্তু বা দেশকালের অধীন সত্তার সঙ্গে তুলনা করা ইসলামের চোখে শেরেকি- একইভাবে কোনো দার্শনিক, নৃতাত্ত্বিক, মনস্তাত্ত্বিক সত্তার সঙ্গে তুলনাও শেরেকি। ‘শিরক’ বা ‘শেরেকি’ ইসলাম সম্পর্কে আলোচনা করবার নির্ধারক চাবিকাঠি। শেরেকির প্রশ্ন বাদ দিয়ে আল্লাহ সম্পর্কে কোনো আলোচনা ইসলামের জন্য আদৌ সরাসরি প্রাসঙ্গিক নয়। জার্মান দর্শনকে নজির হিসাবে রেখে আলোচনার উদ্দেশ্য হচ্ছে খ্রিষ্টীয় চিন্তার মধ্যে খ্রিষ্টীয় আল্লাহর ব্যাখ্যা মানবেতিহাসে চিন্তার বিকাশে কোথায় কিভাবে ভূমিকা রেখেছে সেটা বোঝা। এটাও উপলব্ধি করা তারপরও সেটা ঘটছে ইসলামের দিক থেকে একান্তই প্রাক-ইসলামি চিন্তার পরিমণ্ডলে। খ্রিষ্টীয় বা ইহুদি ধর্মের মধ্যে আল্লাহর ধারণা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হতে পারে কিন্তু ইসলাম যে গায়েবকে উপাস্য মনে করে সেই গায়েবের আলোচনা এটা নয়। কিন্তু ইসলামি দর্শন নিয়ে আমরা যা আলোচনা করি তা অধিকাংশ সময়ই ইহুদি বা খ্রিষ্টীয় চিন্তারই নামান্তর। চিন্তার বিষয় হিসাবে পর্যবসিত ‘আল্লাহ’-সংক্রান্ত আলোচনার সীমা স্পষ্ট না হলে মানুষের জন্য একমাত্র গায়েবই উপাস্য- ইসলামের এ ঘোষণার দার্শনিক তাৎপর্য আমাদের কাছে স্পষ্ট হবে না। কারণ এই ‘গায়েব’ কথাটার অর্থ শুধু অদৃশ্য নয়, মানুষের বুদ্ধি বা চিন্তার পরিমণ্ডলেও যাকে দৃশ্যমান করা যায় না। দৃশ্যমান করা সম্ভব এই অনুমান যারা করেন তারা ইসলামের ‘গায়েব’ নিয়ে আলোচনা করেন না। আসলে করেন প্রাক-ইসলামি চিন্তার বিষয় হিসাবে ‘আল্লাহ’ নামক নামচিহ্ন নিয়ে। 
এই দিকটা আমরা মনে রাখব। যাতে আগামী আলোচনার সূত্র বুঝতে পারি। শেষে মনে করিয়ে দিচ্ছি ইসলাম মানুষকে জন্মসূত্রে পাপী- এ ধরনের কোনো অনুমান করে না। খ্রিষ্টীয় চিন্তার পরিমণ্ডলে মানুষের দিব্যসত্তার নৃতাত্ত্বিক বিচার ইসলামের দিক থেকে ভিন্ন হবে, বলাই বাহুল্য। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ মাত্রই দিব্যগুণসম্পন্ন, কারণ মানুষ আল্লাহর খলিফা। তার দিব্যগুণের নিশ্চয়তা সে খোদ আল্লাহর কাছ থেকেই পেয়ে এসেছে। ফলে ইসলামে নিজের দিব্যসত্তাকে নিজের কাছ থেকে বিযুক্তির তর্ক ইন্টারেস্টিং কিন্তু সরাসরি প্রাসঙ্গিক ততটুকুও যতটুকু পাশ্চাত্য দর্শন বুঝতে আমাদের সুবিধা হয়। 
২০ সেপ্টেম্বর ২০১৫, ৫ আশ্বিন ১৪২২। শ্যামলী। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন