শুক্রবার, ৭ আগস্ট, ২০১৫

ক্ষুব্ধ কাশ্মির, সন্ধিক্ষণে ভারত

যতটুকু অনুভব করা যায়, কাশ্মির বদলে গেছে তার চেয়ে অনেক বেশি। এর আগে শেষবারের মতো কাশ্মিরে আমি এসেছিলাম প্রায় পাঁচ বছর আগে। এর মধ্যে উপত্যকাটি স্পষ্টভাবে ভারতবিরোধী হয়ে পড়েছে। এর মানে এই নয়, স্থানটি পাকিস্তানপন্থী হয়ে পড়েছে, যদিও শ্রীনগরের ভেতরের অংশগুলোতে অনেক সবুজ পতাকা উড়ছিল। যা আসলে বোঝাতে চাওয়া হচ্ছে, তা হলো বিরোধিতা (যা এমনকি আগেও বোঝা যেত) এখন ক্ষোভে পরিণত হয়েছে। অবশ্য, ডাল লেক এবং এর তীরের চকচকে রোদ অন্য সময় যেমন থাকে, তেমনই স্বাভাবিক। পর্যটকেরা বিমানবন্দর থেকে গাড়ি করে সরাসরি স্পটগুলোতে চলে যান, তারা জানেনও না যে, নগরীর অভ্যন্তরে থাকা জঙ্গিরা এখনো গ্রেনেড ছোড়ে। যখন শ্রীনগর ছিলাম, তখন সহিংসতা দেখা দিয়েছিল, নগরীর ভেতরের দিকে কয়েকটি গ্রেনেড ছোড়া হয়েছিল। কাশ্মিরি সাংবাদিকদের একটি সংগঠনের আমন্ত্রণে আমি শ্রীনগর গিয়েছিলাম। আমন্ত্রিতদের মধ্যে দিল্লির আরো কয়েকজন সাংবাদিক ছিলেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, জম্মুর কোনো সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন না। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, তাদের কাউকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। কমবেশি শান্তিপূর্ণ কাশ্মিরি বিক্ষোভ ধ্বনি ও বিষয়বস্তুতে ইসলামি। তবে মনে হয়, বিষয়বস্তুর চেয়ে অভিব্যক্তি প্রকাশের পন্থা বুঝি এটাই। বিষয়বস্তু হলো, কাশ্মিরিরা তাদের নিজেদের জন্য একটি দেশ চায়। 

ভারতে বেশির ভাগ মানুষই সন্দেহ করে যে, ‘স্বাধীন কাশ্মির স্রেফ একটা কথার কথা। কাশ্মিরিদের প্রকৃত ইচ্ছা পাকিস্তানে যোগদান করা।’ কিন্তু আমি এই অনুমানের সাথে একমত নই। স্বাধীনতার মূল আদর্শ স্বপ্নের মতো দেখা যায়। এটা কাশ্মিরিদের পায়ের তলা থেকে সরে গেছে। এটা যদি কখনো বাস্তবতা হয় (যা অসম্ভব), তবে এমনকি পাকিস্তানের সাথে মিশে যাওয়ার কট্টর সমর্থকও তাদের এজেন্ডা ছুড়ে ফেলে স্বাধীনতাকামীদের সাথে যোগ দেবে। ঘটনাপরম্পরা আমাকে কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর চিন্তাধারার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। তিনি প্রবলভাবে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটিতে মুসলমানদের জন্য সর্বোচ্চ ছাড় পেতে দরকষাকষির জন্য পাকিস্তান দাবি উত্থাপন করেছিলেন। কিন্তু তিনি যখন মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া দেখতে পেলেন, তখন মুসলমানদের আবাসভূমি হিসেবে পাকিস্তান দাবিকে আঁকড়ে ধরলেন। শুরুতে তার বিশ্বাসের প্রতি নড়বড়ে থাকলেও তিনি এর একমাত্র মুখপাত্রে পরিণত হন। কাজেই, কাশ্মিরিদের প্রকৃত আকাক্সক্ষা নিয়ে কোনো সংশয় থাকা উচিত নয়। 

আমি যখন আমার বক্তৃতায় বললাম, স্বাধীন কাশ্মিরের দাবি যদি কখনো গতি লাভ করে, তবে মুসলমানদের জন্য কঠিন সময় উপস্থিত হবে, তখন আমি চেহারায় ক্রোধ দেখতে পেয়েছিলাম। হিন্দুরা প্রশ্ন করতে থাকবে যে, ভারতের অংশ হিসেবে থাকার ৭০ বছর পরও কাশ্মিরি মুসলমানেরা যদি স্বাধীনতা চায়, তবে ভারতের প্রায় ১৬ কোটি মুসলমানের আনুগত্যের নিশ্চয়তা কী? কাশ্মিরকে (যেখানকার ৯৮ শতাংশই মুসলমান) আলাদা দেশ হিসেবে তৈরি করে ভারত তার সেকুলার-ব্যবস্থা নস্যাৎ করে দিতে পারে না, এই মন্তব্য এমনকি সম্মেলনে ইতিবাচকভাবে গ্রহণযোগ্য ছিল না। পাল্টা যুক্তি কমবেশি যা ছিল তা হলো, ‘তোমাদের মুসলমানেরা তোমাদের সমস্যা।’ একই ধরনের একটি প্রতিক্রিয়ার কথা স্মরণ করছি, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর আমি দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল সাত্তারকে বলেছিলাম, ভারতের মুসলমানেরা (ওই সময় তাদের মোট সংখ্যা পাকিস্তানের চেয়ে বেশি ছিল) পাকিস্তান সৃষ্টির মূল্য দিচ্ছে। তিনি বলেছিলেন, পাকিস্তান নামের মুসলিম দেশ গঠনের জন্য তাদেরকে ‘আত্মত্যাগ’ করতেই হবে। আমাকে যেটা সবচেয়ে বেশি হতাশ করেছে, তা হলো, কাশ্মিরে পারস্পরিকভাবে মিশে যাওয়া এলাকার অন্তর্ধান। অথচ কয়েক বছর আগেও এটা দৃশ্যমান ছিল। মোকাবেলা করার কঠোরতার কারণে এমনকি হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগও গুঁড়িয়ে গেছে। একটি ব্যক্তিগত উদাহরণ টেনে আনছি বলে আগেই দুঃখ প্রকাশ করে নিচ্ছি। 

অতীতে ইয়াসিন মালিক আমাকে তার বাড়িতে ডিনারের দাওয়াত করতেন; নানা রাস্তা ঘুরিয়ে তিনি তার বাড়িতে আমাকে নিয়ে যেতেন। সত্যিই, তিনি কথিত ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’তে পরিণত হয়েছেন। কিন্তু তার কাছ থেকে একটা কথার জন্য নিষ্ফলভাবে অপেক্ষা করেছিলাম। আমি বিশ্বাস করি না যে, শ্রীনগরে আমার উপস্থিতি সম্পর্কে তিনি অবগত নন। বিমানবন্দরে মোতায়েন, তার নেতৃত্বাধীন জম্মু ও কাশ্মিরি লিবারেশন ফ্রন্টের সদস্যরা জানেÑ ভারত থেকে কারা আসছে কখন আসছে। ইয়াসিন মালিক ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’র তকমা পেয়েছেন। আমি ইয়াসিনের আমৃত্যু অনশন ভাঙিয়েছিলাম এই শর্তে যে, ভারতীয় নিরাপত্তাবাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ব্যক্তিগতভাবে তদন্ত করব। তিনি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বদলে আমার তদারকিতে সম্মত হয়েছিলেন। আমরা একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিলাম, তাতে ইয়াসিনের অভিযোগগুলোর সত্যতা পাওয়া গিয়েছিল। ভারত সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলার জন্য প্রতিবেদনটি পাকিস্তান ব্যাপকভাবে উদ্ধৃত করেছিল। সত্যি বটে, ইয়াসিন বলতেন যে তিনি ভারতীয় নন। কিন্তু আমাদের সম্পর্ক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ছিল না। তিক্ততা কি ব্যক্তিগত বন্ধনকেও ছিন্ন করতে পারে? কিছু বিষয়ে ভুলভাবে অনুমান করেছিলাম এবং রাজনৈতিক প্রয়োজনই কাশ্মিরকে আমাদের পেছনে রাখবে, এতে ব্যক্তিগত সম্পর্কের কোনো মূল্য নেই বলে ধরে নেয়া কি আমার উচিত হবে? রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কিভাবে ব্যক্তিগত সম্পর্ককে পেছনে ঠেলে দেয়, তার আরেকটি উদাহরণ হলো আরেক কাশ্মিরি নেতা শাবির শাহ এখন বদলে যাওয়া এক ব্যক্তি।

তিনি ছিলেন আমার শিষ্যের মতো। তিনি ছিলেন ভারতপন্থী। তিনি কট্টর বিরোধীতে পরিণত হয়েছেন। যদিও আমি জানি না, কেন ব্যক্তিগত সম্পর্ক মরে যাবে। শাবিরের আদর্শে পরিবর্তনের জন্য কি আমাকে এই দাম চুকাতে হবে? সন্দেহ নেই যে, বিশেষ করে যারা সেকুলার ও গণতান্ত্রিক ভারতে বিশ্বাস করেন, তাদেরকে কাশ্মিরের দিকে মনোযোগ দেয়া দরকার। যত বিরোধিতাই আসুক না কেন, সেটা তাদের প্রতিশ্রুতি থেকে সরাতে পারা উচিত নয়। তারা যদি বদলে যান, এর মানে হবে, আগের অবস্থানটি ছিল স্রেফ মুখোশ। এটা সমগ্র ভারতের জন্য কল্যাণকর। আমাদের জন্য স্বাধীনতা এনে দেয়া মহাত্মা গান্ধী ও জওয়াহেরলাল নেহরুর ঘোষিত মূল আদর্শকেই চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে, এমন এক অবস্থার মধ্যে আমরা রয়েছি। এটা দেখে আমার ব্যথা লাগে যে, মহাত্মাকে হত্যাকারী নাথুরাম গডসের আদর্শকে প্রশংসা করে কোনো কোনো কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। ভারত কি তার বিবেকের কাছে প্রশ্ন করবে, কেন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মির নিরাপত্তাহীন মনে করে? কাশ্মিরি এক মুসলিম ইঞ্জিনিয়ার (তিনিই আমাকে বিমানবন্দরে নামিয়ে দিয়েছেন) বলেছেন, ব্যাঙ্গালুরুর মতো উদার স্থানেও পুলিশ তাকে কিভাবে সন্দেহের চোখে দেখে। দলগুলো বর্ণ আর ধর্মের ভিত্তিতে চিহ্নিতকরণের রাজনীতির কারণে ছোট হয়ে গেছে। 

জনগণের উচিত উদার সংস্থা আর নেতাদের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান ঘোষণা করা; ধর্ম আর বর্ণের বিষ যাতে ছড়াতে না পারে তা নিশ্চিত করা। জাতি ব্যর্থ হলে কাশ্মির এবং ভারতের আরো কয়েকটি অংশ হয়তো ধর্মের পানি-কাদার চোরাবালিতে আটকে যাবে। দেশ এখন পরীক্ষার মুখে। 

 লেখক : ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক 

অনুবাদ : মোহাম্মদ হাসান শরীফ 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন