বুধবার, ২৯ জুলাই, ২০১৫

দলের বৃত্ত থেকে মুজিবকে মুক্তি দিন

জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে বিয়োগান্ত অধ্যায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ৪০তম বার্ষিকী সমাগত। জাতীয় শোক দিবসের এই কর্মসূচিতে বিএনপিরও অংশগ্রহণ থাকা উচিত। এটা তাকে পারতেই হবে। একান্ত যদি সেটা না করা সম্ভব হয়, তাহলে তাদের উচিত হবে বঙ্গবন্ধুর প্রতি অমর্যাদাকর কোনো কিছু বলা থেকে বিরত থাকা। অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় খালেদা জিয়ার কাছে ব্যক্তিগতভাবেও এই আগস্ট বেদনাবহ। কারণ, আরাফাত রহমানের জন্মদিন ১২ আগস্ট, ১৯৭০। তাই এবারের আগস্টে অকালপ্রয়াত সন্তান কোকোর জন্য বেদনাবিধুর পরিবেশে কোনো কর্মসূচি পালনের তিন দিন পরেই মায়ের পক্ষে তাঁর নিজের জন্মদিনে কেক কাটার কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া সহজ হবে না। বিএনপির চেয়ারপারসন চাইলে ১৫ আগস্টে জন্মদিন পালনের ধারাবাহিকতা থেকে স্থায়ীভাবে বেরিয়ে আসতে পারেন। দলের মধ্যে যাঁরা এই জন্মদিনে কেক কাটার ব্যাপারে বিএনপির চেয়ারপারসনকে উৎসাহ জুগিয়ে থাকেন, তাঁরাও কোকোর মৃত্যুকে যুক্তি হিসেবে দেখিয়ে নিজেদের এবারে বিরত রাখার সুযোগ নিতে পারেন। 

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সর্বজনীন শ্রদ্ধাভাজন হিসেবে স্মরণ করার ক্ষেত্রে মিডিয়ার সহায়তা কামনা করেছেন। কেন তাঁর মনে হলো যে বঙ্গবন্ধু সর্বজনীন নন, তার ব্যাখ্যা অবশ্য তিনি দেননি। ২৩ জুলাই বাসস পরিবেশিত খবরে বলা হয়েছে, জনপ্রশাসনমন্ত্রী জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘আমরা আপনাদের ওপর কোনো কর্মসূচি বা অনুষ্ঠান চাপিয়ে দিতে চাই না। কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া প্রকৃত কাজের ভিত্তি হতে পারে না। আমরা আপনাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বঙ্গবন্ধুর ওপরে সৃজনশীল স্বতন্ত্র কর্মসূচি আশা করি।’ ওই অনুষ্ঠানে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকেরা উপস্থিত ছিলেন এবং তাঁরা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে বঙ্গবন্ধু যেহেতু জাতীয় সম্পদ, তাই তাঁকে কোনো একটি দলের বৃত্তে আটকে রাখলে চলবে না। আর সে জন্য তাঁর জন্ম ও মৃত্যু দিবসে একটি সর্বদলীয় কমিটি গঠনের ব্যাপারেও তাঁরা প্রস্তাব দেন। এ প্রসঙ্গে আমরা সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যের চেতনার সঙ্গে সহমত পোষণ করছি, আর একই সঙ্গে তাঁর ‘চাপিয়ে দেওয়া’ প্রসঙ্গে কয়েকটি বিষয়ের অবতারণা করছি। 

১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়নের সময় বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে কোনো ব্যক্তির নাম সংবিধানে লেখার প্রয়োজনীয়তা কেউ অনুভব করেননি, যদিও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিটির উল্লেখ ছিল। কিন্তু ২০১১ সালে সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে জাতির পিতার প্রতিকৃতি শিরোনামে ৪ক অনুচ্ছেদ নামে একটি নতুন বিধান যুক্ত করা হলো। এতে বলা আছে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি সব সরকারি ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রদর্শন করতে হবে। এর মধ্যে নির্দিষ্টভাবে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘জাতির পিতার প্রতিকৃতি’ টাঙানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। পঁচাত্তরের পরে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যথেষ্ট অসতর্ক, বেপরোয়া ও বিদ্বেষপ্রসূত বিতর্ক হয়েছে, তারেক রহমানের সাম্প্রতিক অসতর্কতা আবারও প্রমাণ করেছে যে সেই ধারা বন্ধ হয়নি। তার মানে ৪ক অনুচ্ছেদ কার্যকর ওষুধ নয়। 

রাষ্ট্র কোনো নাগরিকের নামের আগে বা পরে কোনো খেতাব চাপাতে পারে না। ছাত্র–জনতা ভালোবেসে তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ খেতাবে ভূষিত করেছিল। সুতরাং বঙ্গবন্ধু একটি খেতাব। এই খেতাব কিংবা এ ধরনের কোনো খেতাব যাতে কোনো অবস্থাতেই রাষ্ট্র কোনো নাগরিককে না দিতে পারে, সে জন্য ১৯৭২ সালের সংবিধানপ্রণেতারা বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। এমনকি নির্দিষ্টভাবে রাষ্ট্রের তরফে খেতাবদানকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কেন যে এত দিনেও বাহাত্তরের মূল সংবিধানের ৩টি উপদফা-সংবলিত ৩০ অনুচ্ছেদটির বৃত্তান্ত নিয়ে লেখা হয়নি, তা ভেবে আক্ষেপ হচ্ছে। জেনারেল এরশাদের বিতর্কিত অষ্টম সংশোধনী সুপ্রিম কোর্ট খণ্ডিতকরণ ও রাষ্ট্রধর্ম চাপানো ছাড়াও বাহাত্তরের মূল সংবিধানে থাকা ৩০ অনুচ্ছেদটি চিরকালের জন্য বিলোপ করেছে। বড় অনুশোচনার বিষয়, কখনো এই অনুচ্ছেদটি নিয়ে কোথাও কোনো আলোচনা চোখে পড়ল না। বাহাত্তরের সংবিধানের পুনরুজ্জীবন নিয়ে কত ঝড় বয়ে গেল, কিন্তু এরশাদের বেয়নেটের খোঁচায় ৩০ অনুচ্ছেদের রক্তাক্ত হওয়ার কাহিনি প্রকাশ পেল না। 

বাহাত্তরের সংবিধানে ৩০ অনুচ্ছেদটি ছিল এ রকম: ‘১) রাষ্ট্র কোন উপাধি, সম্মান, বা ভূষণ প্রদান করিবেন না। ২) রাষ্ট্রপতির পূর্বানুমোদন ব্যতীত কোন নাগরিক কোন বিদেশি রাষ্ট্রের নিকট হইতে কোন উপাধি, সম্মান, পুরস্কার বা ভূষণ গ্রহণ করিবেন না। ৩) সাহসিকতার জন্য পুরস্কার কিংবা আকাদেমীর বিশিষ্টতা-দান হইতে এই অনুচ্ছেদেও কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।’ এর শিরোনাম ছিল: ‘উপাধি, সম্মান ও ভূষণের বিলোপসাধন।’ ১৯৮৮ সালে অষ্টম সংশোধনীতে ওই অনুচ্ছেদটি ফেলে দিয়ে যা লেখা হলো তা কোনো রদবদল ছাড়াই এখনো টিকে আছে। বাহাত্তরের শিরোনাম আমূল পাল্টে নতুন শিরোনাম দেওয়া হয়েছে: ‘বিদেশি, খেতাব, প্রভৃতি গ্রহণ নিষিদ্ধকরণ।’ আর ৩০ অনুচ্ছেদ কেবল বলছে, ‘রাষ্ট্রপতির পূর্বানুমোদন ব্যতীত কোন নাগরিক কোন বিদেশি রাষ্ট্রের নিকট হইতে কোন উপাধি, খেতাব, সম্মান, পুরস্কার বা ভূষণ গ্রহণ করিবেন না।’ এই এরশাদীয় অনুচ্ছেদটি স্মরণ করিয়ে আমরা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও ফজলে হাসান আবেদের কাছে রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে চিঠি যাওয়ার কথা শুনেছি। কিন্তু এরশাদ যে তাঁর খেয়ালখুশিমতো মৌলিক অধিকার ভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদেও এভাবে বিকৃতিসাধন করলেন, সে জন্য কোনো বাহাত্তরের সংবিধান পুনরুজ্জীবনবাদীকে কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করতে দেখিনি। 

সৈয়দ আশরাফের জবানিতে মুজিবকে সর্বজনীন করে তোলা এবং ‘চাপিয়ে দেওয়া’ কথাটি নিয়ে লেখার সূত্রে এই অনুচ্ছেদটির দিকে তাকানোর সুযোগ হলো এবং মনে হয়েছে, এই অনুচ্ছেদটির পূর্ব বৃত্তান্ত যদি আমরা মনে রাখি, তাহলে আওয়ামী লীগ সত্যিই ‘চাপিয়ে দেওয়ার’ অনাবশ্যক ও ভ্রান্ত রাজনীতি থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে পারবে। আর সেটা খুব জরুরি। 

বাহাত্তরের সংবিধানের ওই ৩০ অনুচ্ছেদের পুনরুজ্জীবন দরকার মনে করি। আমরা যদি এর ভারতীয় প্রেক্ষাপট মনে রাখি, তাহলে বিষয়টি বোঝা আরও পরিষ্কার হবে। ২০১২ সালের অক্টোবর। মনমোহন সিং তখন প্রধানমন্ত্রী। তথ্য অধিকার আইনের আওতায় ভারতীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি বিবৃতি প্রধান সংবাদপত্রগুলোতে বিশেষ গুরুত্বে ছাপা হলো। পিটিআই জানায়, লেক্ষ্ণৗর এক স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী ঐশ্বরিয়া জানতে চেয়েছিল মহাত্মা গান্ধীকে কবে জাতির জনকের খেতাবে ভূষিত করা হয়েছিল? কারণ, ভারতের সংবিধানের ১৮ (১) অনুচ্ছেদ রাষ্ট্র কর্তৃক কাউকে খেতাব দেওয়া নিষিদ্ধ করেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ওই ছাত্রীকে ১০ বছর সময় নিয়ে জানিয়েছে, গান্ধীকে এই খেতাব কখনো দেওয়া হয়নি, কাউকে জাতির পিতার উপাধি দেওয়া সংবিধান সমর্থন করে না। অবাক ঐশ্বরিয়া বলেছে, কী আশ্চর্য, ইতিহাসের বইয়ের পয়লা বাক্যই তো জাতির জনক গান্ধী দিয়ে শুরু হয়েছে। ২০০৪ সালে ড. আম্বেদকারকে ভারতের সংবিধানের জনক খেতাব দিতে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী দাবি তুলেছিলেন। তৎকালীন উপপ্রধানমন্ত্রী এল কে আদভানি এক চিঠিতে তাঁকে বলেছিলেন, সংবিধানে বাধা থাকার কারণে এটা সম্ভব নয়। মহাত্মা গান্ধী যদিও জাতির জনক হিসেবে পরিচিত কিন্তু তাই বলে রাষ্ট্র তাঁকে এই খেতাব দেয়নি। 

১৯৯৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর বালাজি রাঘবন বনাম রাষ্ট্র মামলায় প্রধান বিচারপতি এ এম আহামদির নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ মত দেন যে ‘পদ্মভূষণের মতো খেতাব সংবিধান নিষিদ্ধ করেনি। সংবিধানপ্রণেতারা এ নিয়ে দীর্ঘ বাদানুবাদ করেছেন। ব্রিটিশরা তাঁবেদার সৃষ্টির জন্য খেতাব প্রদানের যে ধারা চালু করেছিল, সেই ধারা বন্ধ করা ছিল ওই অনুচ্ছেদের আশু লক্ষ্য।’ 

১৭৮৭ সালের মার্কিন সংবিধানের প্রথম অনুচ্ছেদে, ১৯১৯ সালের জার্মানির ভাইমার সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদে, ১৯৩৫ সালের ফিলিপিনস সংবিধানের তৃতীয় অনুচ্ছেদে, ১৯৩৭ সালের আয়ারল্যান্ড সংবিধানের ৪০ অনুচ্ছেদে, ১৯৪৪ সালের আইসল্যান্ডের সংবিধানের ৭৮ অনুচ্ছেদে এভাবে রাষ্ট্রের দ্বারা খেতাব প্রদানে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। এর লক্ষ্য— নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্যবোধ জাগ্রত হতে না দেওয়া। 

গান্ধী নিহত হলে জওহরলাল নেহরু রেডিও ঘোষণায় বলেছিলেন, জাতির পিতা আর বেঁচে নেই। আর আমাদের জাতির জনক নিহত হলে খোন্দকার মোশতাকরা কী বলেছিলেন, তা সবারই জানা। সুতরাং এটা ঠিক যে ভারত যা পারে, আমরা আপাতত তা হয়তো পারি না কিংবা পারাটা দুরূহ। কিন্তু আমাদের মানতে হবে, দ্রুত বাহাত্তরেই ফিরতে হবে, কারণ ওই বিধান সর্বজনীন। ভারতরত্ন, পদ্মবিভূষণ, পদ্মভূষণ ইত্যাদি রাষ্ট্রীয় খেতাবের বৈধতা ভারতের সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের এই রায়টি আওয়ামী লীগ ও তাদের বুদ্ধিজীবীদের পাঠ করতে অনুরোধ জানাই। অন্যথায় তাঁরা বুঝবেন না, কেন আমরা ১৯৭২ সালে ভারতের সংবিধানের ১৮ অনুচ্ছেদটিই কার্যত অবিকল ধারণ করেছিলাম। মুজিব বেঁচে থাকবেন, অমরত্ব পাবেন তাঁর কর্মে। কখনো সমালোচিত হতে পারেন তা-ও তাঁর কর্মের কারণে, মিডিয়ার এখানে কোনো করণীয় নেই। নাগরিক জীবনে গান্ধী নন্দিত কখনো নিন্দিত। কিন্তু তিনি কোনো দলের বৃত্তে বন্দী নেই। জীবিত মুজিব পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। কিন্তু মরহুম মুজিব আওয়ামী লীগের দলীয় বৃত্তে বন্দী আছেন। 

২৫ জুলাই কসবা থেকে ডা. ময়না মিঞা সড়ক দিয়ে ঢাকা ফিরছি। পথে একটি অতিকায় ডিজিটাল কিন্তু স্থুল ব্যানার দেখে ছবি তুললাম। স্থানীয় সাংসদ গ্রামবাসীকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। একপাশে মুজিবসহ তিনজন, অন্যপাশে একজন মন্ত্রী, তাঁর নিচে সাংসদ, সবশেষে স্থানীয় ১২ নেতা–কর্মীর ছবি। বঙ্গবন্ধু মুজিবসহ তিনজনের ছবি আকারের দিক দিয়ে সবচেয়ে ছোট। দলের প্রতিপক্ষ শিবিরের একজনকে ব্যক্তিগতভাবে ঘায়েল করে প্রকাশ করা একটি গেয়ো লিফলেটেও দেখি মুজিবের মুখ। সারা দেশে এভাবে সবার সামনে বঙ্গবন্ধুর ভয়াবহ অবমাননা ঘটে চলেছে। সৈয়দ আশরাফের উচিত এই বৃত্ত ভাঙতে উদ্যোগী হওয়া। 

সুশাসন ও গণতন্ত্র দিতে না পারার অপারগতার ঢাল হিসেবে মুজিবকে ব্যবহার করা সমীচীন নয়, এটা বঙ্গবন্ধু মুজিবকে সর্বজনীন করার পথে সবচেয়ে বড় বাধা।

মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন