শনিবার, ১৩ জুন, ২০১৫

নরেন্দ্র মোদির ইচ্ছা পূরণ না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি


কারো ইচ্ছা পূরণ কতটা হবে তা নির্ভর করে ইচ্ছাটা কতটা বাস্তবধর্মী, তার ওপর। বাস্তবতার সাথে ইচ্ছার সঙ্গতি না থাকলে ইচ্ছা পূরণ সহজ হয় না। জওয়াহেরলাল নেহরু বলেছিলেন, হিন্দি-চীনি ভাই ভাই। কিন্তু ভারত-চীন মৈত্রী বজায় থাকেনি। চীন ও ভারতের মধ্যে সৃষ্টি হতে পেরেছে সীমান্ত বিরোধ, যা যুদ্ধে রূপ নেয় ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। ভারত চীনের সাথে এই যুদ্ধে পরাজিত হয় অত্যন্ত করুণভাবে। নেহরুর ইচ্ছা পূরণ হতে পারেনি। কারণ তার ইচ্ছা ছিল বাস্তবতার সাথে খুবই অসঙ্গতিপূর্ণ। কোনো চীন সরকার ম্যাকমাহন সীমান্তরেখাকে (গপগধযড়হ খরহব) স্বীকার করছিল না। জওয়াহেরলাল ভেবেছিলেন চীন ম্যাকমাহন সীমারেখাকে মেনে নেবে ভারত-চীন সীমান্ত বলে। কিন্তু চীন তা মানতে রাজি হয়নি। জওয়াহেরলাল ছিলেন খুবই অদ্ভুত প্রকৃতির নেতা। তিনি ভাবতেন তার ইচ্ছাই হবে সবার ইচ্ছা। কিন্তু সেটা ছিল তার অবাস্তব চিন্তাধারারই প্রতিফলন। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে গণভোট হয়েছিল। গণভোট হয়েছিল সে পাকিস্তানে যোগ দেবে কি না, তা নিয়ে। ইংরেজ আমলের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মানুষ এই গণভোটে পাকিস্তানে যোগ দেবার অভিমত দেয়। তাদের গণঅভিমতের মাধ্যমেই ব্রিটিশ আমলের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ (যার বর্তমান নাম পাখতুনিয়া) যোগ দেয় পাকিস্তানে। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মধ্যে সীমান্তরেখাকে বলা হয় ‘ডুরান্ড লাইন’ (উঁৎধহফ খরহব)। আফগানিস্তান এই সীমান্তরেখাকে মানতে চায় না। জওয়াহেরলাল সমর্থন করেন আফগানিস্তানের দাবিকে। জওয়াহেরলাল ইংরেজদের রচিত ম্যাকমাহন লাইনকে মনে করেন ন্যায্য। কিন্তু ইংরেজদের রচিত ডুরান্ড লাইনকে মনে করে অন্যায্য। জওয়াহেরলাল চেয়েছিলেন বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে। কিন্তু তিনি বিশ্বনেতা হতে পারেননি। চীনের কাছে ধাক্কা খেয়ে তার ভাবমর্যাদা বিশেষভাবে বিবর্ণ হয়ে পড়ে। নরেন্দ্র মোদি সম্ভবত চীনের কাছে ধাক্কা খেয়ে একইভাবে হতে যাচ্ছেন বিশ্বনেতা হওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত। নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশে আসার আগে গিয়েছিলেন চীনে। কিন্তু চীনকে তিনি প্রভাবিত করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। অন্য দিকে বাংলাদেশে নরেন্দ্র মোদি আসার আগে এসেছিলেন চীনের উপ-প্রধানমন্ত্রী। ভারত চীনের মধ্যে কোনো সঙ্ঘাত বাধলে বাংলাদেশ কী করবে সেটা অনুমান করা কঠিন। বাংলাদেশ যে ভারতের পক্ষ নেবে এমন বলা যায় না। কারণ ভারতের সাথে আমাদের আছে ঐতিহাসিক বিরোধ। কিন্তু চীনের সাথে তা নেই। এ ছাড়া সারা উত্তর-পূর্ব ভারতে মানুষ চাচ্ছে দিল্লির শাসন থেকে মুক্ত হতে। বাংলাদেশের মানুষ তাদের এই ইচ্ছার প্রতি শ্রদ্ধাশীল।

নরেন্দ্র মোদি বিশ্বাস করেন ভারতের ঐক্যের ভিত্তি হলো হিন্দুত্ব। কিন্তু পূর্ব ভারতে গারো, খাসিয়া, নাগা ও মিজোরা গ্রহণ করেছেন খ্রিষ্ট ধর্ম। তারা হিন্দুত্বের ওপর কোনো আবেগ অনুভব করেন না। তারা তাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে পেতে পারেন খ্রিষ্টান বিশ্বের বিশেষ সমর্থন। সে সম্ভাবনাও যথেষ্ট দেখা দিতে শুরু করেছে। নরেন্দ্র মোদির হিন্দুত্ববাদ ভারতের মূল ভূখণ্ডে সাড়া জাগাতে পারলেও পূর্ব ভারতে তা ধর্মীয় কারণে কখনোই সাড়া জাগাতে পারে না। নরেন্দ্র মোদি উত্তর-পূর্ব ভারতের মানুষের কাছে একজন নেতা হিসেবে পেতে পারছেন না গ্রহণযোগ্যতা। ভারতের জাতীয় সঙ্গীতে বলা হয়েছে :
জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!
পাঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মারাঠা দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ
বিন্ধ্যা হিমাচল যমুনা গঙ্গা উচ্ছলজলধিতরঙ্গ
তব শুভ নামে জাগে, তব শুভ আশিস মাগে,
গাহে তব জয়গাথা।
জনগণমঙ্গলদায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয়, জয় হে।

রবীন্দ্রনাথের এই ভাগ্যবিধাতার ধারণা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে। আমরা সেই বিতর্কের মধ্যে আপাতত যেতে চাচ্ছি না। কিন্তু এখানে বিশেষভাবে লক্ষ করার বিষয় হলো, ভারতের এই জাতীয় সঙ্গীতের মধ্যে কোথাও নেই আসামের নাম। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের ভারত চিন্তায় আসাম থেকেছে অনুপস্থিত। আসাম আগাগোড়াই ভারতের রাষ্ট্রচিন্তায় স্থান করে নিতে পারেনি। থেকেছে অবহেলিত। সাবেক আসাম ভেঙে এখন সৃষ্টি হয়েছে অনেক প্রদেশ। এসব প্রদেশের মানুষ কোনোভাবেই নিজেদের ভাবতে পারছেন না ভারতের ইতিহাসের অংশ হিসেবে। নরেন্দ্র মোদি চেষ্টা করলেই যে এরা সবাই ইতিহাসকে টপকে হঠাৎ করে পরম ভারতীয় হয়ে উঠতে পারবেন, এরকম আশা করা দুরাশা। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি এরকম দুরাশাকেই সম্ভব করে তুলতে চাচ্ছেন। আমার মনে পড়ে, ১৯৭৯ সালের ২৬ এপ্রিল ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই এসেছিলেন ঢাকায়। এ সময় দেশাই সরকারের পানিসম্পদমন্ত্রী ছিলেন অটল বিহারি বাজপেয়ি। তিনি আমাদের দিয়ে ছিলেন গঙ্গার পানির ন্যায্য ভাগ, যা পরে ইন্দিরা গান্ধী করেন বাতিল। নরেন্দ্র মোদি আমাদের সাথে তিস্তার পানি নিয়ে কোনো চুক্তিতে আসতে পারলেন না। নরেন্দ্র মোদি আর অটল বিহারি বাজপেয়ির মধ্যে চলে না কোনো সুদূর তুলনা। নরেন্দ্র মোদি অনুসরণ করতে চাচ্ছেন ইন্দিরা গান্ধীর পররাষ্ট্রনীতিকেই। ভারতের সাথে আমাদের সম্পর্ক মসৃণ হতে পারবে না, যদি না নদীর পানি বণ্টন নিয়ে একটা সমঝোতা সৃষ্টি না হতে পারে। নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন কেবল সারা ভারতের মোট ভোট সংখ্যার ৩৩ শতাংশ লাভ করে। অর্থাৎ অধিকাংশ ভারতীয়ই মনে করেন না, তিনি তাদের নেতা হওয়ার উপযুক্ত। আগামী নির্বাচনে অর্থাৎ চার বছর পরে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী থাকবেন কি না, সেটা একটা জল্পনারই বিষয়। কিন্তু আমাদের দেশের পত্রপত্রিকা এবং টেলিভিশনে তাকে প্রচার করা হলো একজন বিশ্বনেতা হিসেবে। সেটাকে বলতে হয় খুবই বাড়াবাড়ি। একটি পত্রিকায় বলা হয়েছে, তিনি এলেন, দেখলেন, জয় করলেন। কিন্তু তিনি আসলে কী জয় করলেন? জুলিয়াস সিজার ব্রিটেন জয় করে নাকি বলেছিলেন, ভিনি ভিডি ভিসি অর্থাৎ এলাম, দেখলাম, জয় করলাম। মোদি কি বাংলাদেশকে সেভাবে জয় করতে পারলেন? বাংলাদেশ হয়ে যায়নি ভারতের অঙ্গরাজ্য। জানি না, কতটা নিচে নামতে পারেন আমাদের সাংবাদিকেরা।

মনে হচ্ছে এবং অনেক বিদেশী পত্রপত্রিকাতেও বলা হচ্ছে মোদি বাংলাদেশে ছুটে এসেছিলেন বাংলাদেশকে চীনের সাহায্য গ্রহণে বিরত রাখার ইচ্ছায়। কিন্তু বাংলাদেশ তাতে রাজি হয়নি। বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে দু’টি সাবমেরিন ও প্রয়োজনীয় রণসম্ভার ক্রয় করতে যাচ্ছে। শেখ হাসিনা এ ক্ষেত্রে তার মত পাল্টে ফেলেননি। যদিও তিনি যথেষ্ট ভারতীয় মনোভাবাপন্ন বলে অনেকেরই বিশ্বাস। মোদি খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করেছেন। খালেদা জিয়া মোদিকে কী বলেছেন, আমরা তা জানি না। তবে পত্রিকার খবরে প্রকাশ, তিনি মোদিকে বলেছেন বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতির কথা। আমার মনে হয় এরকম কথা না বলাই ছিল ভালো। কেননা, বাংলাদেশে গণতন্ত্র বাংলাদেশের মানুষকেই প্রতিষ্ঠা করতে হবে; ভারতের কোনো নেতা নিশ্চয় সেটা করে দিতে পারেন না। আর করে দিতে চাইলেও সেটা বাংলাদেশের গণতন্ত্র হবে না, হবে ভারতেরই গণতন্ত্র। সম্ভবত বিএনপির রাজনীতিতে দেখা দিয়েছে বিশেষ বিভ্রান্তি। বিএনপির বিরাট জনসমর্থন আছে কিন্তু এই জনসমর্থনকে কাজে লাগানোর মতো তার কোনো সংগঠন নেই। বিএনপি যদি সংগঠন গড়ে তুলতে না পারে, তবে বিরাট জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও সে আসতে পারবে না ক্ষমতায়। কেননা, গণতন্ত্রে ক্ষমতায় আসতে হলে একটি রাজনৈতিক দলকে হতে হয় রাজনৈতিকভাবে সুগঠিত, যা বিএনপি হতে পারেনি। গণতন্ত্রের সাফল্য নির্ভর করে জনমত, রজনৈতিক দল এবং অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের ওপর। ভারতে গণতন্ত্র সাফল্য লাভ করেছে, তার একটি কারণ দল হিসেবে কংগ্রেস ছিল খুবই সুগঠিত। কিন্তু সাবেক পাকিস্তানে গণতন্ত্র সাফল্য লাভ না করতে পারার একটি কারণ ছিল মুসলিম লীগ কংগ্রেসের মতো একটি সুসংগঠিত দল ছিল না। এ ছাড়া সাবেক পাকিস্তান ছিল ভৌগোলিকভাবে বিভক্ত। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সাফল্য নির্ভর করবে রাজনৈতিক দলের ওপর। কোনো বিদেশী শক্তির সাহায্য-সহযোগিতার ওপর নয়।

নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশে ছুটে এসেছিলেন বাংলাদেশকে পক্ষে পাওয়ার লক্ষ্যে। কিন্তু চীন-ভারত দ্বন্দ্বে বাংলাদেশ ভারতের পক্ষ নিতে পারে না। আর কোনো কারণে না হলেও চীন যদি সাংপো নদীর পানি আটকায়, তবে বাংলাদেশ পড়বে পানি সঙ্কটে। তিস্তার পানির সঙ্কটের চেয়ে যা হতে পারে আরো ক্ষতিকর। যতদূর জানি চীন এখনো সিকিমের ওপর ভারতের কর্তৃত্ব পুরোপুরি মেনে নেয়নি। তিস্তার উদ্ভব হয়েছে (তিস্তার আসল নাম দিস্তাং) সিকিম থেকে। চীন ইচ্ছা করলে তিস্তার পানি পেতে আমাদের সাহায্য করতে পারে। আমরা আমাদের বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থেই চীনকে কোনোভাবেই বৈরী করে তুলতে পারি না। ভারত যদি সে চেষ্টা করে, তবে সে সাফল্য পেতে পারবে না, এটাই বাস্তব যুক্তি। প্রত্যেক রাষ্ট্রেরই আপন স্বার্থ থাকে। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশেরও আছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি রচিত হবে তার রাষ্ট্রিক স্বার্থের ওপরই নির্ভর করে, সেটাই স্বাভাবিক। নরেন্দ্র মোদি এটা বদলে দিতে পারেন না, যদি বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে তার নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করে চলতে হয়।

পত্রিকার খবরে প্রকাশ, (প্রথম আলো, ১১ জুন ২০১৫) মনিপুরের বিদ্রোহীরা আশ্রয় নিয়েছিল মিয়ানমারে। মিয়ানমার মনিপুরের একদম লাগোয়া। মনিপুর ব্রিটিশ শাসনামলে ছিল একটি করোদমিত্র রাজ্য। মনিপুরের একটি নিজস্ব লিখিত ভাষা আছে। যাকে বলা হয় মেথেই। ভাষাটি বৃহৎ চীনা পরিবারভুক্ত। কিন্তু লিখিত হয় বাংলা অক্ষরে। মনিপুরীরা ধর্মে অধিকাংশই হলেন বৈষ্ণব। তারা ইচ্ছা করে ভারতের সাথে যোগ দেননি। ভারত হায়দরাবাদের মতো বল প্রয়োগ করে মনিপুরকে দখল করে নেয়। মনিপুরীরা এখন চাচ্ছেন একটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র গড়তে। কিছু সংখ্যক বিদ্রোহী মনিপুরী আশ্রয় নিয়েছিলেন পার্শ্ববর্তী মিয়ানমার রাষ্ট্রে। ভারত এখানে আন্তর্জাতিক নিয়ম লঙ্ঘন করে চালিয়েছে আক্রমণ। মিয়ানমার অবশ্য বলেছে, এই আক্রমণ মিয়ানমারের সীমান্ত লঙ্ঘন করে করা হয়নি। করা হয়েছে ভারতেরই সীমান্তের মধ্যে, তার সীমান্তের খুব লাগোয়া অংশে। ভারত যদি এরকম আক্রমণ করে চলতে থাকে, তবে মনে হয় মিয়ানমার তার বৈরী হয়েই উঠবে। যত দূর শুনেছি, চীন উলফাদের সাহায্য দিচ্ছে মিয়ানমারের উত্তরাংশের মধ্য দিয়ে। ভারত যদি এরকম আক্রমণ মিয়ানমারের উত্তরাংশে করে, তবে সে ক্ষেত্রে চীনের সাথে তার সঙ্ঘাত আবার ১৯৬২ সালের মতো বেধে যেতে পারে। আমরা বাংলাদেশের মানুষ কোনো সঙ্ঘাতে জড়াতে চাই না। কিন্তু ভারতের আচরণ আমাদেরও উৎকণ্ঠিত করছে।



লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন