সোমবার, ১ জুন, ২০১৫

কংগ্রেসের জুতা পায়ে আসছেন মোদি

ভারতীয় কংগ্রেসের ১০০ বছরের ইতিহাসে তাদের সবচেয়ে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে বর্তমানে সেখানে ক্ষমতাসীন হয়েছে নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদির নেতৃত্বাধীন কট্টরপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপি। তাও ১৩ মাস পার হয়ে গেছে। সেই বিজেপি প্রধান, বর্তমানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আগামী ৬ জুন বাংলাদেশে ৩৬ ঘণ্টার সফরে আসছেন। এ সফর নিয়ে বাংলাদেশের সরকারি দল ও বিরোধী দলের মধ্যে চরম উত্তেজনা ও তৎপরতা বিরাজ করছে। সরকার মোদির সফর নিয়ে এমন একটা শোরগোল তুলেছে যে, মনে হচ্ছে, সরকার যেন মঙ্গলগ্রহ বিজয় করে ফেলেছেন। 


ভারতীয় কংগ্রেসের ট্র্যাডিশনাল মিত্র আওয়ামী লীগের বক্তব্য থেকে এখন আর মনেই হচ্ছে না, তারা কোনো কালে কংগ্রেসের মিত্র ছিল। আর সে মৈত্রী বাংলাদেশের জনগণের সাথে যে ছিল না, ছিল শেখ হাসিনার সাথে, সে ব্যাপারে কংগ্রেস কোনো দিনই কোনো লুকোছাপা করেনি। বরং ধারাবাহিকভাবে এ কথা প্রচার করে গেছে যে, তারা বাংলাদেশের জনগণের পাশে নয়, শেখ হাসিনার যেকোনো বিপদ-আপদে তার পাশে থাকবে। এমনকি নরেন্দ্র মোদির কাছে শোচনীয় পরাজয়ের মাত্র মাস চারেক আগে বাংলাদেশের জনগণ ও সমগ্র বিশ্বের জনমত উপেক্ষা করে শেখ হাসিনার একদলীয় নির্বাচনের প্রতি তারা দৃঢ়তার সাথে সমর্থন জানিয়ে গেছে। তখনো তারা আঁচ করতে পারেনি যে, চার মাস পরই ভারতের নির্বাচনে তাদের এমন ভয়াবহ ভরাডুবি হবে।



গত বছরের নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদি ভারতের গুজরাট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। সেখানে দাঙ্গায় হাজার হাজার মুসলমানকে হত্যা ও বাস্তুচ্যুত করার ঘটনায় জড়িত ছিলেন এই মোদিরা। ফলে পৃথিবীর বহু দেশে তিনি ছিলেন অনাকাক্সিক্ষত ব্যক্তি। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র তাকে ভিসা দেয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে করেছিল। সোয়া কোটি মানুষের দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগ পর্যন্ত সে নিষেধাজ্ঞা বহাল ছিল। 



তবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়ার দিন থেকেই মোদি এক ম্যাজিকের আয়োজন করেন। তার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে তিনি সার্কভুক্ত সব দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানদের আমন্ত্রণ জানান। একমাত্র বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে অনুষ্ঠানে হাজির থাকতে পারেননি। তিনি তখন পূর্বনির্ধারিত জাপান সফরে ব্যস্ত ছিলেন। বিজেপি ২০১৪ সালের এপ্রিলের নির্বাচনে কংগ্রেসকে একেবারে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, সংসদে বিরোধী দল হিসেবে স্বীকৃতি পেতে যে ৫৪টি আসনের দরকার ছিল, তাও পায়নি কংগ্রেস। তারা লোকসভার ৫৬০ আসনের মধ্যে মাত্র ৪৩টি আসন লাভ করেছে।



এমন পরিস্থিতিতে একেবারে থমকে যায় শেখ হাসিনার সরকার। ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে তাদের দরকার কংগ্রেসের মতোই মোদি সরকারের পূর্ণ সমর্থন। সে সমর্থন পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী ঘোর সংশয়ের মধ্যে পড়ে যায়। কিন্তু ভারত সরকারের এজেন্ডা ভিন্ন। তাদের দরকার ভারতানুকূল আঞ্চলিক স্বার্থ নিশ্চিত করা। সে স্বার্থ হাসিলের জন্য বাংলাদেশে যে সরকারই আসীন থাক না কেন, তাতে ভারতের কিছু আসে যায় না। সে সময় অনেকেই এ রকম অসঙ্গত আশা করেছিল যে, গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত ভারতের মোদি সরকার শেখ হাসিনা সরকারের ওপর একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করার জন্য চাপ সৃষ্টি করবে। সেটি মোদি সরকার করতে যাবে কেন? তার দরকার বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ট্রানজিট করিডোর, দরকার অবাধে বাংলাদেশের নৌপথ ব্যবহার, বাংলাদেশের নৌবন্দরগুলো নির্বিঘেœ ব্যবহারের অধিকার। তদুপরি, বাংলাদেশের সাথে চীনের সম্পর্ক শীতল করে তোলা, চীনের সাথে সামরিক সহযোগিতা ও বাণিজ্য হ্রাস করে আনা এবং ভারতের স্বাধীনতাকামী উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যে অবাধে পণ্য ও সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করা। তা ছাড়া অরুণাচল প্রদেশ নিয়ে চীনের সাথে যদি কখনো সংঘর্ষ বাধে, তাহলে অবাধে বাংলাদেশের জল ও স্থল সীমান্ত ব্যবহার করতে পারা। তা যে সরকার দেবে, তারাই ভারতের কাছে ‘সোনা-মানিক’।



ভারতের এই নীতির ক্ষেত্রে কংগ্রেস-বিজেপি কোনো ভেদ নেই। আর সে কারণেই বাংলাদেশ সফরের আগে নরেন্দ্র মোদি ভারতের সাবেক কংগ্রেস সরকারের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। তিনি সম্ভবত মি. সিংকে এই বলে আশ্বস্ত করেছেন যে, বাংলাদেশ প্রশ্নে তার সরকার কংগ্রেসের অভিন্ন নীতিই গ্রহণ করতে যাচ্ছে।
খবর বেরিয়েছে, নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরকালে তার সাথে ঢাকা আসছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি; আসাম, মেঘালয়, মিজোরাম ও ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীরাও। এখানে পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া বাকি চার রাজ্যেই ৫০ বছর ধরে সেখানকার ‘স্বাধীনতাকামী’রা ভারতীয় শক্তিশালী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। ওদের দমন করা তো যায়নি, বরং তাতে শত শত ভারতীয় সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। এখনো প্রতিনিয়তই তারা হামলার শিকার হচ্ছে। এসব রাজ্য সরকার প্রধানেরা সম্ভবত বাংলাদেশকে এ রকম আশার বাণী শুনিয়ে যাবেন যে, তারা শিগগিরই বিপুল পরিমাণ বাংলাদেশী পণ্য কিনে ঢাকা-দিল্লির বাণিজ্যিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে উদ্যোগ নেবেন। 



কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমাদের অভিজ্ঞতা মোটেও সুখকর নয়। ভারত বাংলাদেশকে কথা দিয়েছে এবং সে কথা রেখেছেÑ এমন নজির খুব কমই। অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন, সীমান্তে পাখি শিকারের মতো বাংলাদেশের মানুষকে হত্যা কিংবা সাহায্য সহযোগিতার অন্যান্য ক্ষেত্রের কথা, যে ব্যাপারেই বলি কোনোটাই বাংলাদেশের স্বার্থানুকূল হয়নি। ফলে সবই বাংলাদেশকে ধোঁকা দেয়ার কৌশল হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। 



ভারত বাংলাদেশকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। তার মধ্যে ৭০-৮০ কোটি ডলার কেবল ব্যয় বেশি দেখিয়েই নিয়ে যাওয়া হবে। ভারতের অর্থায়নে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ার কথা, তার সবটাই ভারতীয় স্বার্থের অনুকূল এবং বাংলাদেশের জন্য সর্বনেশে বা অলাভজনক। ভারতীয় অর্থায়নে ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসে খুলনা থেকে মংলা পর্যন্ত রেল সংযোগ প্রতিষ্ঠার কাজ হাতে নেয়া হয়, যার জন্য ব্যয় ধরা হয়েছিল এক হাজার ৭২০ কোটি টাকা। এর সব কিছুই আবার এমন শর্তে আবদ্ধ যে, ইট, কাঠ, রড, প্রকৌশলী, তত্ত্বাবধায়ক, সিমেন্ট-বালুর সব কিছুই কিনতে হবে ভারত থেকে কোনো প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে নয়, ভারত যা নির্ধারণ করে দেবে, সে মূল্যেই। অর্থাৎ আমরা এক ব্যাগ সিমেন্ট যদি কিনি ৫০০ টাকায় আর ভারত যদি তাদের সিমেন্টের মূল্য ধরে দুই হাজার টাকা; তাহলে আমরা দুই হাজার টাকা দিতে বাধ্য। নির্ধারিত সময়ে খুলনা-মংলা রেল প্রকল্পটি শেষ করেনি ভারত। এখন বলছে, সে কাজ শেষ করবে ২০১৬ সালে। ব্যয় বাড়িয়ে করা হয়েছে তিন হাজার ৮০১ কোটি টাকা। মোদি সরকার ক্ষমতায় আসায় এই পরোক্ষ লুণ্ঠনপ্রক্রিয়ার কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। 



ভারতে নরেন্দ্র মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর ধুয়া তোলা হয়েছিল যে, এবার তিস্তায় পানিবণ্টন চুক্তি সম্পন্ন হয়ে যাবে। কংগ্রেস সরকার যুক্তি দেখাচ্ছিল, তারা তো রাজিই, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মমতা ব্যানার্জি সরকার কিছুতেই পানি দিতে চাচ্ছে না। ফলে তিস্তায় তাদের পক্ষে পানি দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এরপর মমতা বাংলাদেশ সফর করেছেন। তিস্তায় পানির ব্যাপারে তার ওপর আস্থা রাখতে বলেছেন। তা সত্ত্বেও কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না যে, বাংলাদেশ তিস্তার পানি পাবে। এ দিকে ভারতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং এই বলে বাংলাদেশীদের বোকা বানানোর চেষ্টা করছেন যে, শিগগিরই তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সম্পাদিত হবে। কিন্তু গত ২৫ মে আনন্দবাজার পত্রিকা লিখেছে, তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। 



তিস্তার পানির জন্য উত্তরাঞ্চলজুড়ে যখন হাহাকার, তখন রাজনাথ সিংয়ের এই আশার বাণী একেবারেই অর্থহীন। বাংলাদেশের জনগণকে তিনি আশার বাণী শুনিয়ে হাসিনা সরকারের প্রতি জনগণকে অনুগত রাখার একটি কৌশল অবলম্বন করেছেন। আর ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের সাথেই তাদের সম্পর্ক সবচেয়ে ভালো। মোদির বাংলাদেশে আগমন উপলক্ষে অনেক কাণ্ডই ঘটছে, যার বেশির ভাগ ধোঁকা ও চালাকি। মোদি সরকার যদি ভেবে থাকে যে, বাংলাদেশের জনগণ এর কিছুই বোঝে না, তাহলে তারা আহাম্মকের স্বর্গেই বাস করছেন।



মংলা-খুলনা রেললাইন চালু করা গেলে ভারত অবাধে ব্যবহার করবে মংলাবন্দর। হয়তো বিনা শুল্কে। মংলাবন্দর থেকে ভারতের পণ্য পশ্চিমে যাবে কলকাতা হয়ে দূর-দূরান্তে। পূর্বে যাবে আগরতলা হয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্যে। তার জন্য বাংলাদেশকে কোনো মাশুলই দিতে হবে না। এমন সুবিধা ভারত তার নিজস্ব কোনো প্রদেশেও পাবে না। তাই মনে হতে পারে, বাংলাদেশের মর্যাদা ভারতের একটি প্রদেশের মর্যাদার চেয়েও নিচে নামিয়ে আনা হয়েছে। 
সরকারের ভারত তোষণনীতির অংশ হিসেবে পরীক্ষামূলক চালু করা হয়েছে কলকাতা, শিলং ও আগরতলার সাথে বাস সার্ভিস। ভাবখানা এমন, ভবিষ্যতে ট্রাক সার্ভিসও চালু হবে এবং বাংলাদেশ কলকাতা বা সাতরাজ্যে পণ্য রফতানির সুযোগ পাবে। এটিও একটি ধোঁকা। কার্যত এ পথ চালু হলে বাংলাদেশ সাত রাজ্যে যে সামান্য পণ্য রফতানি করে তাও সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যাবে। কলকাতা থেকে ভারতীয় পণ্যই পৌঁছবে আগরতলা দিয়ে সাত রাজ্যে। বাংলাদেশের লাভের খাতায় শূন্য পড়বে। আর এসব সড়ক মেরামতের জন্য অকারণেই বাংলাদেশকে গুনতে হবে হাজার হাজার কোটি টাকা। 



একইভাবে, ভারতের সাথে চালু আছে নৌ-ট্রানজিট প্রটোকল। মূল প্রটোকল যখন সই হয়েছে তখন তাতে উল্লেখ ছিল, এই প্রটোকলের মাধ্যমে বাংলাদেশ তৃতীয় দেশ অর্থাৎ নেপাল-ভুটানেও পণ্য রফতানি করতে পারবে। সে ক্ষেত্রে ভারত তার স্থলপথ ব্যবহারের সুবিধা দেবে। কিন্তু সম্প্রতি এ প্রস্তাবে আপত্তি তুলে ভারত নতুন প্রস্তাব দিয়েছে। তৃতীয় দেশে পণ্য রফতানির প্রটোকলটি বাংলাদেশের মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছে। তারপর ভারতের তরফ থেকে এলো এই আপত্তি। তারা নদীপথে ট্রানজিটের আওতায় তৃতীয় দেশের পণ্য চলাচলের বিধানটি বাতিলের সুপারিশ করেছে। তা ছাড়া অপারেশনাল মূল্য বৃদ্ধির সাথে সঙ্গতি রেখে রক্ষণাবেক্ষণ চার্জ বাড়ানোর বিধানও বাদ দিয়ে ভারত নতুন খসড়া পাঠিয়েছে। অথচ আগের চুক্তি অনুযায়ী নৌপথের নাব্যতা সাপেক্ষে নেপাল ও ভুটান থেকে পাথর ও কাঠসহ বিভিন্ন পণ্য কম খরচে পরিবহনের সুবিধা পাওয়া কথা রয়েছে। এই নতুন প্রস্তাব বাংলাদেশের স্বার্থের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। শুধু তাই নয়, পদ্মা সেতু নির্মাণের কন্ট্রাক্ট চীনকে দেয়ায় ভারত বাংলাদেশে সেতু নির্মাণের গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ পাথর ও নুড়িপাথর রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে। মোদির বন্ধুত্বের এটাও এক আজব নমুনা। 



এদিকে, ভারতে বাংলাদেশী পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে অশুল্ক বাধা ও আধা শুল্ক বাধা সম্পর্কে মোদির বাংলাদেশ সফরকালে চুক্তি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এ ক্ষেত্রে ভারতের অনুকূল সাড়া পাওয়া যায়নি। তা ছাড়া ভারত বাংলাদেশের মান নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বিএসটিআইয়ের সার্টিফিকেটকে গ্রহণ করতে রাজি নয়। আবার ভারতীয় পণ্য আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে ১২টি স্থলবন্দরই ব্যবহারের বাংলাদেশের দাবি ভারত প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, বেশ কিছু পণ্য আমদানি করতে হবে শুধু বেনাপোল ও আগরতলা স্থলবন্দর দিয়ে। ফলে বাণিজ্যে অযথা বিলম্বের সৃষ্টি হবে। 



বাস্তবতা হলো, ত্রিপুরায় বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ভারী যন্ত্রপাতি বিনা শুল্কে বাংলাদেশ পরিবহনের সুযোগ করে দিয়েছে। একই সাথে সাত রাজ্যে তারা বিনা মাশুলে চাল এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য রফতানি করতে শুরু করেছে। আসলে বাংলাদেশে সংক্ষিপ্ত সফরকালে নরেন্দ্র মোদি সংযোগ স্থাপনের (কানেকটিভিটি) নামে তাদের ট্রানজিট সুবিধা বাড়িয়ে নিতে চাইবেন, আর আওয়ামী লীগ সরকার যেন সেটা দেয়ার জন্য মুখিয়েই রয়েছে। কানেকটিভিটিই বলি আর ট্রানজিট-করিডোরই বলি দরিদ্র বাংলাদেশ ভারতের জন্য এসব সুবিধা দিতে গিয়ে কোটি কোটি ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হবে। এতে ভারতের সাথে বাণিজ্য ঘাটতি আরো বাড়বে।



এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পাকিস্তান সরকার ভারতের কাছে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে ট্রানজিট সুবিধা চেয়েছিল। ভারত সে প্রস্তাব সাথে সাথেই প্রত্যাখ্যান করেছিল। তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার মাত্র ছয় মাসের জন্য কলকাতা বন্দর ব্যবহারের সুবিধা চেয়েছিল। কারণ তারা ধরে নিয়েছিল, এই ছয় মাসের মধ্যেই চট্টগ্রাম বন্দরকে ব্যবহারোপযোগী করা সম্ভব হবে। কিন্তু তৎকালীন ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, ছয় মাস তো দূরের কথা, ছয় ঘণ্টার জন্যও কলকাতা বন্দর ব্যবহার করতে দেয়া হবে না। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ভারতের স্থলপথ ব্যবহার করে নেপালে দ্বিপক্ষীয় একটি বাণিজ্যচুক্তি করেছিলেন। কিন্তু ভারত ট্রানজিট সুবিধা না দেয়ায় সে চুক্তি কোনো দিন আলোর মুখ দেখেনি। এরপর শেখ হাসিনার সময় মনমোহন সিংয়ের সাথে যে চুক্তি হয়েছিল, তাতে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশী পণ্যের ওপর শুল্ক কমানো হবে আর অশুল্ক বাধা দূর করা হবে। তারও কোনো কিনারা হয়নি। 



ভারত যদিও বলছে, দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধি ও পারস্পরিক সহযোগিতা তারা চায়, কিন্তু নরেন্দ্র মোদির সফরকালে এর বদলে তারা নতুন নৌ-ট্রানজিট প্রটোকলের ওপরেই অধিক জোর দেবে বলে মনে হয়। বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ট্রানজিট-করিডোর ভারতের আরো বেশি দরকার চীনের কারণে। কারণ সম্প্রতি নরেন্দ্র মোদির চীন সফরকালে চীনের যে মানচিত্র চীন উপস্থাপন করেছে তাতে অরুণাচল প্রদেশকে চীনের তিব্বতের অংশ হিসেবে দেখায়। তাতে উদ্বিগ্ন মোদি সরকার। তদুপরি আসাম, নাগাল্যান্ড, মনিপুর, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ের স্বাধীনতাকামীরা গত মাসে এক বৈঠক করে একযোগে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো দাবি করেছে, এই ঐক্যের পেছনে চীনের হাত রয়েছে। 



এ ছাড়া ভারত-মিয়ানমার সীমান্তে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান পরিচালনা করার ভারতীয় প্রস্তাব মিয়ানমার বরাবরই প্রত্যাখ্যান করে আসছে। ভারতের সাত রাজ্যে স্বাধীনতাকামীদের দমনের জন্য সেখানে নিয়োজিত আছে ভারতের দুই লাখ সৈন্য ও আধা সামরিক বাহিনী। কিন্তু গত প্রায় ৫০ বছরেও তাদের দমন করা যায়নি। এই স্বাধীনতাকামীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও রসদ সরবরাহের জন্য যদি বাংলাদেশ ট্রানজিট-করিডোর দেয়, তাহলেও ওই যুদ্ধের অবসান তো হবেই না, বরং তা স্থান পরিবর্তন করে নতুন মাত্রা সংযোজন করবে। এর ফলে স্বাধীনতাকামীদের দৃষ্টিতে বাংলাদেশ হবে ভারতের সহযোগী। এ জন্য বাংলাদেশকে চড়া মূল্য দিতে হতে পারে। 



তিস্তার পানি প্রত্যাহার করে পশ্চিমবঙ্গ ৯২ লাখ ২০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দিচ্ছে এবং ৭৬৭.৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। তিস্তা পশ্চিম বাংলায় প্রবেশের আগে আরো ১০টি জলবিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। মোদি সরকার বোঝে যে, তাদের এসব প্রকল্প বহাল রেখে বাংলাদেশকে তিস্তায় পানি দেয়া সম্ভব নয়। ফলে তিস্তার পানি আপাতত সুদূর পরাহতই থেকে যাবে বাংলাদেশের জন্য। 



ভারতের পররাষ্ট্রবিষয়ক নীতি বিশ্লেষক রূপক ভট্টাচার্য লিখেছেন, ঢাকা ও দিল্লির মধ্যকার পানি বণ্টন সমস্যা ক্রমেই জটিল হচ্ছে। তিস্তার পানি সঙ্কট দু’দেশের মধ্যে অবিশ্বাস বহু গুণ বাড়িয়ে তুলবে। তার এই আশঙ্কা সম্ভবত সঠিক প্রমাণিত হবে।


 
বাংলাদেশে রাজনীতিবিদ ও কূটনীতিকদের কিছু বিষয়ের ওপর দৃষ্টি দেয়া দরকার। সম্প্রতি ভারত নেপালে যা করেছে, তাও বিবেচনার দাবি রাখে। একই সাথে শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপে তাদের কার্যক্রম বিশ্লেষণযোগ্য। নেপালে ভয়াবহতম ভূমিকম্পের পর সেখানে সাহায্যের নামে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো গিয়ে হাজির হয়। তারা শিগগিরই চীনের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে। আর প্রায় সাথে সাথেই নেপাল বিদেশী সামরিক বাহিনীর উদ্ধার ও সাহায্য অভিযান বন্ধ করে দেয়। এমনকি, সেখানে নরেন্দ্র মোদির কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়। নরেন্দ্র মোদি মালদ্বীপে তার নির্ধারিত সফর বাতিল করে দেন। কারণ মালদ্বীপে নতুন সরকার ভারতের বংশবদ বলে পরিচিত সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদের বিচার শুরু করেছে। এর প্রতিবাদেই তিনি সেখানে যাননি। 



আবার শ্রীলঙ্কায় গত ৮ জানুয়ারির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অপ্রত্যাশিতভাবেই হেরে যান মাহিন্দ রাজাপাকসে, যার সাথে চীনের ঘনিষ্ঠ বন্ধত্ব ছিল। অভিযোগ আছে, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রাজাপাকসেকে হারিয়ে দেয়ার জন্য বহুমুখী পদ্ধতিতে কাজ করে গেছে। নরেন্দ্র মোদির এসব নীতি কংগ্রেসের নীতির হুবহু অনুকরণ। সে কারণেই বলা হচ্ছে, কংগ্রেসের জুতা পায়েই বাংলাদেশ সফরে আসছেন মোদি। অতএব, এখানে বাংলাদেশের স্বার্থানুকূল কোনো কিছুই ঘটার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। 



ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন