শনিবার, ২৩ মে, ২০১৫

শিলংয়ে সালাহউদ্দিন আহমদ

সালাহউদ্দিন আহমদ বিএনপির একজন নামকরা নেতা। তিনি এক সময় মন্ত্রীও ছিলেন। তিনি একজন হেজিপেজি লোক নন। তিনি ছিলেন পুলিশের কড়া নজরদারিতে। পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে, আমাদের বর্ডার গার্ডের চোখে ধুলো দিয়ে তিনি কী করে ভারতে যেতে পারলেন, সেটা নিয়ে তাই মনে জাগছে বিভিন্ন প্রশ্ন। রাজশাহী একটি সীমান্ত শহর। আমি যেখানে থাকি, তার দুই কিলোমিটারের মধ্যেই ভারতের সীমান্ত। রাজশাহী থেকে কেউ ভারতে এখন গরু আনতে যেতে সাহস পাচ্ছে না। কেননা, ভারত সীমান্তে বিএসএফের নজরদারি হয়ে উঠেছে আগের তুলনায় অনেক বেশি কড়া। বেআইনিভাবে ভারতে ঢুকতে গেলে বেড়েছে বিএসএফের গুলিতে অনুপ্রবেশকারীর মৃত্যুর সম্ভাবনা। মেঘালয় ও বাংলাদেশের মধ্যে সীমান্ত হলো প্রায় ৪৪০ কিলোমিটার। বিএসএফের চোখে ধুলো দিয়ে কী করে সালাহউদ্দিন ভারতের মেঘালয় প্রদেশে ঢুকতে পারলেন, মারা গেলেন না বিএসএফের গুলিতে, সেটা নিয়ে তাই জাগছে আমার মতো আরো অনেকের মনে প্রশ্ন। কেবল তা নয়, শিলং শহর ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এই দীর্ঘ পথ নিশ্চয় সালাহউদ্দিন সাহেব হেঁটে যাননি। তার শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় যেসব রিপোর্ট বেরিয়েছে, তাতে করে বলতে হয়, ৮০ কিলোমিটার হেঁটে শিলং যাওয়া তার পক্ষে সম্ভবই নয়। এ ছাড়া পথে যেতে তার ওপর পুলিশের নজর পড়া অসম্ভব ছিল না। কিন্তু তা হয়নি। তাই তার শিলং যাওয়া নিয়ে অনেকের মতো আমার মনেও জাগছে বহুবিধ প্রশ্ন।
২০ মে বাংলাদেশের একটি দৈনিক পত্রিকায় বলা হয়েছে, ‘সালাহউদ্দিনের ভারত কানেকশন খুঁজছেন গোয়েন্দারা’। পত্রিকাটির মতে, (পত্রিকাটি পড়ে আমার যা মনে হচ্ছে, তা হলো,) সালাহউদ্দিন সাহেবের ব্যবসায়িক যোগাযোগ ছিল ভারতীয় ব্যবসায়ীদের সাথে। তারা তাকে নিয়ে গিয়েছেন শিলংয়ে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ভারতীয় ব্যবসায়ীরা তাকে ঢাকা থেকে শিলংয়ে নিয়ে গেলেন কিভাবে? আর এই নিয়ে যাওয়াতে তারা কিভাবে হতে পারছেন লাভবান? ব্যবসায়ীরা সব কিছুই করে লাভ ক্ষতির হিসাব কষে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে লাভ ক্ষতির হিসাব মেলানো কঠিন। ভারতীয় ব্যবসাদারেরা কি এতই কৌশলী যে, বাংলাদেশের পুলিশ ও বর্ডার গার্ডকে ফাঁকি দিয়ে খুব সহজেই ভারতে নিয়ে যেতে পারেন সালাহউদ্দিনের মতো একজন ব্যক্তিকে? অন্য দিকে, ভারত সীমান্তে কী করেই বা তারা পারবেন বিএসএফের চোখে ধুলো দিতে? পত্রিকায় এ লেখাটি ছাপা হতে হতে এ বিষয়ে অনেক কিছু অবগত হওয়া যাবে।

শিলং শহর ইংরেজ শাসনামলে সৃষ্টি হয় ১৮৬৪ সালে, আসাম প্রদেশের রাজধানী হিসেবে, মেঘালয় প্রদেশের রাজধানী হিসেবে নয়। সাবেক আসাম ভেঙে মেঘালয় প্রদেশ গঠিত হয়েছে ১৯৭২ সালের ২১ জানুয়ারি। সাবেক আসাম প্রদেশে ছিল আমাদের বর্তমান সিলেট বিভাগ। শিলং ছিল তারও রাজধানী। সিলেট থেকে বহু মানুষ নানা কাজে গিয়েছেন শিলংয়ে। সেখানে এখনো বাস করেন অনেক বাংলাভাষী মানুষ। এক সময়, ব্রিটিশ শাসনামলে তখনকার বাংলাদেশ থেকে শিলংয়ে বহু মানুষ গিয়েছেন হাওয়া বদল করতে, তাদের হৃতস্বাস্থ্য ফিরে পাওয়ার লক্ষ্যে। ব্রিটিশ শাসনামলে শিলংয়ে স্থাপিত হয়েছিল পাস্তুর ইনস্টিটিউট, যেখানে বহু মানুষ গিয়েছেন ক্ষ্যাপা কুকুর কামড়ালে চিকিৎসার জন্য। ঘটনা চক্রে সালাহউদ্দিন ধরা পড়েছেন পাস্তুর পুলিশ ফাঁড়িতে, যা পাস্তুর ইনস্টিটিউটের খুব কাছে অবস্থিত এবং যথেষ্ট পরিচিত জায়গা। শিলংয়ে গিয়েছেন অনেকে ছুটির আনন্দ উপভোগের লক্ষ্যে। শিলংয়ের প্রাকৃতিক দৃশ্য খুবই মনোরম। শিলং বাংলা সাহিত্যে স্থান করে নিতে পেরেছে রবীন্দ্রনাথের লেখা কাব্যিক উপন্যাস ‘শেষের কবিতা’র জন্য। এ উপন্যাসের নাট্যরূপ ঘটনাচক্রে মাত্র কিছু দিন আগে ঢাকায় অভিনীত হতে পেরেছে মহাসমারোহে। ঢাকায় শিলং এখন যে পরিমাণে আদ্রিত শহর, পশ্চিম বাংলার কাছে তা নয়। কেননা, পশ্চিম বাংলার মানুষকে মেঘালয় খুব সমাদরে গ্রহণ করতে চাচ্ছে না। মেঘালয়ের রাজধানী শিলংয়ে সালাহউদ্দিন সাহেবকে যেভাবে হাসপাতালে যতœ করা হচ্ছে, তাতে আমরা বাংলাদেশের মানুষ মেঘালয়কে কৃতজ্ঞতা না জানিয়ে পারি না। আমাদের পত্রিকায় বলা হচ্ছে, সালাহউদ্দিন মোটেও অসুস্থ নন। তিনি একজন সুস্থ ব্যক্তি। তার মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ি নেই রুগ্ণ মানুষের মতো। কিন্তু মানুষ হাসপাতালেও দাড়ি কামাতে পারে। আর মেঘালয়ের ডাক্তারেরা বলছেন, সালাহউদ্দিন আহমদ অসুুস্থ। তিনি ভুগছেন কিডনি ও হার্টের অসুস্থতায়। আমাদের পত্রপত্রিকার সংবাদ মিলছে না শিলংয়ের চিকিৎসকদের বক্তব্যের সাথে। শিলংয়ে ঢাকার তুলনায় অনেক ভালো চিকিৎসক আছে বলেই মনে হয়। সংবাদে প্রকাশ, সালাহউদ্দিন সাহেবকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারতের আরেকটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অর্থাৎ তাকে অসুস্থ হিসাবেই ধরতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশের কিছু পত্রিকা, যে কারণেই হোক সেটা স্বীকার করতে রাজি হচ্ছে না। রাজি হচ্ছেন না আওয়ামী লীগ নেতা ও মন্ত্রীরাও। একটি জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পেরেছে বলেই মনে হচ্ছে আমাদের কাছে। অবশ্য আমরা যা বলছি, সেটা বলছি বাইরে থেকে দেখে। ভেতরের কোনো কথা আমরা জানি না।

আমরা জানি, ১৯৭১-এর পর থেকে সাবেক আসাম অঞ্চলে শুরু হয়েছে উলফা (টখঋঅ-টহরঃবফ খরনবৎধঃরড়হ ঋৎড়হঃ ড়ভ অংড়স) আন্দোলন। এর লক্ষ্য হচ্ছে সাবেক আসাম প্রদেশ ভেঙে যে পাঁচটি প্রদেশ (আসাম, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, অরুণাচল) করা হয়েছে, সেগুলোকে একত্র করে একটি পৃথক ফেডারেশন গড়া। এই ফেডারেশনে তারা মনিপুর ও ত্রিপুরাকে নিতে ইচ্ছুক, যদি তারা আসতে চায়। উলফাদের আন্দোলন কয়েক বছর আগে খুব জোরালো হয়ে উঠেছিল। বেশ কিছু উলফা নেতা এসে আশ্রয় পেয়েছিলেন বাংলাদেশেও। উলফারা দল হিসেবে বিএনপিকে পছন্দ করে, কিন্তু আওয়ামী লীগকে করে না। কেননা আওয়ামী লীগ একাধিক উলফা নেতাকে (যারা বাংলাদেশে অবস্থান করছিলেন) গ্রেফতার করে তুলে দিয়েছে ভারত সরকারের হাতে। হতে পারে মেঘালয়ের ব্যবসাদাররা নন, উলফা মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিরাই সালাহউদ্দিনকে দিতে চাচ্ছেন বেশি সাহায্য-সহযোগিতা। অবশ্য এখানে লক্ষ করার বিষয় হচ্ছে, ভারতের মোদি সরকারও করছেন সালাহউদ্দিনের প্রতি খুবই মানবিক ব্যবহার। সম্ভবত তারা ভাবছেন সালাহউদ্দিন সাহেবের সাথে মানবিক ব্যবহার করলে মোদি সরকারের সাথে গড়ে উঠবে বিএনপির সুসম্পর্ক। ভারত সরকার ভাবছে, বিএনপি নিকট ভবিষ্যতে নির্বাচন হলে ক্ষমতায় এসে যেতে পারে।

উত্তর-পূর্ব ভারতের সাথে ভারতের মূল ভূভাগের যোগাযোগ শিলিগুড়ি করিডোরের মাধ্যমে। ভারত চাচ্ছে উত্তর-পূর্ব ভারতের সাথে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে যাতায়াতের সুবিধা। তাই মোদি সরকার হয়তো বিশেষ মানবিক সহায়তা দিচ্ছে সালাহউদ্দিন আহমদকে। আমরা অবশ্য ভেতরের কিছু জানি না। তবে ভারতকে উত্তর-পূর্ব ভারতের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে হলে বাংলাদেশ সরকারের সাহায্য-সহযোগিতা হবে বিশেষভাবেই কাম্য।

ভারতের সাথে চীনের সীমান্তবিরোধ এখনো মেটেনি। অরুণাচলের একটা বিরাট অংশ চীন দাবি করছে তার নিজের এলাকা হিসেবে। ১৯৬২ সালের মতো চীন-ভারত সঙ্ঘাত দেখা দিলে ভারত বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে সৈন্য ও রসদ পাঠানোর চেষ্টা করতে পারে। এশিয়াতে চীন ও ভারত দু’টি বিরাট সমরশক্তি হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশকে চলতে হবে যথেষ্ট হিসাব করে। না হলে, বাংলাদেশকে পড়তে হবে এই দুই পরাশক্তির চাপে।

আসামে বহু বাংলাভাষী মুসলমানের বাস। ধুবড়ি জেলার লোক আগাগোড়াই বাংলা ভাষায় কথা বলেন। ধুবড়ি জেলাকে ব্রিটিশ শাসনামলে আসামের সাথে যুক্ত করা হয়েছিল। আসামের সাথে যুক্ত করা হয়েছিল বর্তমান বাংলাদেশের সিলেট বিভাগকে। সিলেট বাংলাদেশের সাথে যুক্ত হয় ১৯৪৭ সালে গণভোটের মাধ্যমে। আসামের কাছাড় জেলার মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন। ব্রিটিশ শাসনামলে তখনকার ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, রংপুর থেকে অনেক লোক গিয়ে বসতি গড়েছেন আসামে। এরা আসামে বন কেটে করেছেন আবাদি ক্ষেত। উত্তর-পূর্ব ভারতের সাথে তাই আমাদের আছে বিশেষ সম্পর্ক। এই সম্পর্কের কথা বিবেচনায় রেখে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারিত হতে হবে।

আমরা জানি, কোনো দেশের কাছে সমুদ্রে যদি কোনো জাহাজডুবি হয়, তবে ওই জাহাজ থেকে যেসব মানুষ সাঁতরিয়ে ওই দেশে গিয়ে ওঠে, তাদের বিবেচনা করা হয় না অপরাধী হিসেবে। একইভাবে কোনো দেশে ওপর দিয়ে কোনো বিমান উড়ে যাওয়ার সময় কোনো বিপর্যয়ে পড়লে ওই বিমান থেকে যেসব মানুষ প্যারাস্যুটে করে ওই দেশে অবতরণ করে, তাদের করা হয় না গ্রেফতার। কেননা, তারা ইচ্ছা করে ওই দেশে প্রবেশ করেননি। অবস্থার বিপাকে পড়ে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছেন। সালাহউদ্দিন আহমদকে ভারতের পুলিশ গ্রেফতার করেছে। কিন্তু যদি আদালতে প্রমাণিত হয় যে, তিনি নিজের ইচ্ছায় ভারতে প্রবেশ করেননি, তবে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে তাকে ছেড়ে দিতেই হবে। সালাহউদ্দিন সাহেবের উকিলেরা এই কথাই বলবেন বলেই মনে হয়।


এবনে গোলাম সামাদ
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট


-

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন