বুধবার, ১৩ মে, ২০১৫

চিনের বিশ্ব ব্যাংক: বিশ্ব অর্থনীতির চৈনিক মোড়

দুনিয়ার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সাধারণত ‘গ্লোবাল ইকনমিক অর্ডার’ নামে আলোচনা করা হয়, সেই ব্যবস্থার মধ্যে রূপান্তরের চিহ্নগুলো বহুদিন ধরেই ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছিল। গত সাত বছর ধরে সেই ব্যবস্থার মধ্যে একটা ‘মোচড়’-এর কথা বলে আসছিলাম আমরা। এই মোচড়ানি বিদ্যমান বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ঠিক ভেঙ্গে পড়ার অভিমুখি নয় বরং কাঁধ বদল অথবা আরেক কাঁধে মাথা রেখে পুরা ব্যবস্থার পাশ ফিরে শোয়া বলা যায়। এই পাশ ফিরে শোয়ার পরিণতিও নানান দিক থেকে  বিরাট বদল ঘটাতে পারে। 

এক

চলতি শতকের শুরু থেকে চীনের প্রবল অর্থনৈতিক উত্থান সেই মোচড়ানি, চলতি ‘গ্লোবাল ইকনমিক অর্ডার’-এর মধ্যে আসন্ন বদলের আলামত ক্রমশ দৃশ্যমান করে তুলছিল। লক্ষণগুলো ক্রমান্বয়ে ফুটে উঠছিল, দেয়ালের লিখনের মতো পড়া যাচ্ছিল। সে ইঙ্গিত দেখে সম্ভাব্য বদলের চরিত্র আরও সুনির্দিষ্ট ভাবে জানতে আমেরিকান সরকারি সার্ভে, গবেষণা ষ্টাডি রিপোর্ট হয়েছে গত ২০০৮ সালে (Global Trends 2025: A Transformed World Final report 2008)। এই রিপোর্টটাকে বলা যেতে পারে ঘুর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস জানান দেওয়ার রিপোর্টের মতন। যেখানে আসন্ন ঘূর্ণিঝড়ের পুর্বাভাস মানে আমরা বুঝি এই তুফান আর আর পিছনে ফিরবে না, আঘাত হানবেই। আমরা তখন ঠেকানোর চিন্তা বাদ দিয়ে ক্ষয়ক্ষতি কত কি কম করা যায় করণীয় হিসাবে কেবল সেখানেই সব মনোযোগ নিবদ্ধ করি। এই রিপোর্টটাও ছিল তেমনি। আসন্ন ওলটপালট বদলের ঝাপ্টার অভিমুখ বিশ্লেষণ করে ঠিক করা হয়েছিল কি করলে এর ক্ষতি আমেরিকার উপর কমানোর চেষ্টা করা যায়, ঝড় আসার সময় কতোটা দেরি করিয়ে দেওয়া যায়, ইত্যাদি।

সেই মোতাবেক আমেরিকান বিদেশনীতিতে বদল  আনা হয়েছিল। আমেরিকার কাছে ভারতের গুরুত্ব বাড়তে শুরু করেছিল। তার ঠেলা বাংলাদেশের ঘাড়েও এসে পড়েছিল, কারণ ইন্দো-মার্কিন সম্পর্কের অলিখিত শর্ত হয়ে উঠেছিল দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের মুরুব্বিয়ানা ও আধিপত্যকে আমলে নেওয়া সেসব আমরা জানি। ঝড় আসন্ন বুঝা যাচ্ছিল ঠিকই কিন্তু আঘাত হানাটা কোনখান থেকে কেমন করে শুরু হবে তা স্পষ্ট হচ্ছিল না।

চলতি বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে আছে চারটা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে: (১) আইএমএফ বা আন্তর্জাতিক মূদ্রা তহবিল, (২) বিশ্বব্যাংক (৩) আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থা বা ডব্লিওটিও এবং (৪) জাতিসংঘ। ব্রেটন ঊডে গ্যাট হিসাবে জন্ম নিলেও আইএমএফ ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণাধীন বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এর সঙ্গে পরবর্তীতে আরও প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি নিয়ে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা আন্তর্জাতিক বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের জন্য যুক্ত হয়। , জাতিসংঘ তার জন্মের শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক রাজনীতি বা ক্ষমতা ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ করছিল। বিশ্ব ব্যবস্থায় ” আঘাত হানা বলতে বুঝতে হবে যখন এই চারটা প্রতিষ্ঠানের কোন এক বা একাধিক প্রতিষ্ঠানকে কার্যকরভাবে চ্যালঞ্জ করবার কোন ঘটনা ঘটবার উপক্রম ঘটছে। এতদিন আসন্ন বলতে আমরা বুঝেছি প্রধানত তত্ত্ব আর ফ্যাক্টস ও ফিগারের প্রজেকশন দিয়ে। বাস্তব আঘাত বা চ্যালেঞ্জকারি পালটা প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছে কিনা সেদিক থেকে নয়।

আমাদের অপেক্ষার পালা সম্ভবত শেষ। আগামি দিনের ইতিহাসে মার্চ ২০১৫ সম্ভবত চিহ্নিত হতে যাচ্ছে নতুন আন্তর্জাতিক বিশ্বব্যবস্থার শুরুর কাল হিসাবে।

দুই

পুরানা ব্যবস্থা আর সহ্য করতে না পেরে প্রথম গুলি ছোঁড়া বা ট্রিগার দাবানোর কাজটা করে বসলেন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরনের বৃটেন। গুলিটা তাক করলেন আমেরিকার দিকে। সেই আমেরিকা -বৃটেনসহ ইউরোপও যার নেতৃত্ব ও খবরদারি মেনে ১৯৪৪ সালে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক গড়ে তুলেছিল। যার মাধ্যমে বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার নবজন্ম শুরু হয়। এরপর বিগত ৭০ বছর ধরে দুনিয়াজুড়ে এই ব্যবস্থার রুস্তমিতে বৃটেন আমেরিকার ছোট পার্টনার হয়ে সাথে চলেছে। কিন্তু সম্ভবত আর নয়, এবার সেই তাল মিলিয়ে চলার ছন্দে পতনের সুর বেজে উঠতে শুরু করেছে। গত সত্তর বছরের ওস্তাদ-সাগরেদের আস্থার সম্পর্ক এই মুহুর্তে সবচেয়ে নাজুক অবস্থায়।

গত ১২ মার্চ ২০১৫ বৃটিশ সরকার আমাদের জানাচ্ছেন যে, বৃটেন চিন প্রস্তাবিত ও নিয়ন্ত্রিত নতুন এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (Asian Infrastructure Investment Bank বা সংক্ষেপে (AIIB) গড়ার উদ্যোগে সামিল হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অর্থাৎ এবার কাঁধ বদলিয়ে আমেরিকার বদলে চিনের কাঁধে মাথা রাখতে চায় ব্রিটেন। তাই চিনের সঙ্গে মিলে নতুন এক বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পত্তনের পথে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসাবে AIIB ব্যাংক গড়তে সম্মতি জানিয়ে দিল। মাত্র পাঁচ মাস আগে গত বছর অক্টোবর ২০১৪ চিন সাংহাই শহরে যারা AIIB এর উদ্যোক্তা সদস্য হতে ইচ্ছুক এমন রাষ্ট্রগুলোর এক সম্মেলন ডেকেছিল । ঐ সম্মেলন থেকেই মূলত প্রাথমিকভাবে একাই ৫০ বিলিয়ন ডলার পুঁজি ঢালার ঘোষণা দিয়েছিল চিন, যেটা পরে ১০০ বিলিয়ন ডলার হবে। সেই থেকে আগ্রহী উদ্যোক্তাদের স্বাক্ষর চলছে। উদ্যোক্তা-স্বাক্ষরের সুযোগ শেষ হবে এই মাসের শেষ দিন, ৩১ মার্চ ২০১৫ । তাই ব্রিটেনের সিদ্ধান্তের এই হুড়োহুড়ি ও আকস্মিকতা। বৃটেনের ১২ মার্চের এই সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে আমেরিকার দিক থেকে বিরাট এক আচমকা ঘুষি খেয়ে পড়ে যাবার মত অবস্থা। গত সত্তর বছর ধরে সারা ইউরোপকে আমেরিকা ভাগ দেবার সময় সবার চেয়ে বৃটেনকে আলাদা চোখে দেখেছে, ভাগবিতরণে মাছের মাথাটাই বৃটেনের পাতে দিয়ে গেছে। ওদিকে চিন যে এমন পালটা প্রাতিষ্ঠানিক আঘাত করবে সেটা আমেরিকা অনুমান করেছিল। তার জন্য কিছু প্রস্তুতি ও তৎপরতা থাকলেও সে আঘাতের ইউরোপীয় প্রতিক্রিয়ায় বিশেষ করে বৃটেন যে লীড নিয়ে পক্ষ বদল করতে পারে - এটা আমেরিকারও বিবেচনায় ছিল না। এটা বোঝা যায় এমন এমন কোন আলামত গ্লোবাল মিডিয়াতে কখনও চোখে পড়ে নাই। গত বছর প্রকাশ্যে চিনের AIIB উদ্যোগের আগে গত ২০০৯ সাল থেকেই ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, সাউথ আফ্রিকা আর তাকে সহ পাঁচ রাইজিং ইকোনমিকে নিয়ে BRICS ব্যাংক গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছিল চিন। এটা সবার জানা। কিন্তু এই উদ্যোগের প্রতি আমেরিকার মতই সারা ইউরোপের আগ্রহ বা প্রতিক্রিয়া শুরু থেকেই শীতল, যেন এটা তাদের চায়ের কাপ না, সেই প্রকার নিরুৎসাহ। চিনের প্রচেষ্টার প্রতি ইউরোপ টলে যেতে পারে এই দিকটা আমেরিকা খাটো করে দেখেছে। বৃটেনের সিদ্ধান্ত ঘোষণার চারদিন পরে জানা গেল যে এটা একা বৃটেনের সিদ্ধান্ত নয়। গত ১৭ মার্চ -জর্মন, ফ্রান্স ও ইটালীও বৃটেনের সিদ্ধান্তকে অনুসরণ করার ঘোষণা জানায়। অথচ গত বছর অক্টোবরে যখন সাংহাইয়ে AIIB সম্মেলন ডাকা হয় আমেরিকা তখন প্রকাশ্যেই তৎপরতা চালিয়েছিল যাতে এশিয়ার অষ্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া মত দেশ যারা এশিয়া নীতিতে আমেরিকাকে অনুসরণকারি ও আমেরিকার ষ্ট্রাটেজিক শেয়ার পার্টনার, এরা AIIB উদ্যোগে যেন যোগ না দেয়। তবু সেসময় বৃটেন প্রকাশ্যে AIIB উদ্যোগের পক্ষে বা বিপক্ষে কোন বক্তব্য দেয় নাই। এখন বৃটেনের যোগ দেবার সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর আমেরিকা প্রকাশ্যেই নিজের অখুশি, অস্বস্তি জানিয়েছে। বৃটিশ অর্থমন্ত্রী জবাবে মিডিয়াকে বলেছে, এটা বৃটেনের “জাতীয় স্বার্থে নেয়া সিদ্ধান্ত” এবং এমন সিদ্ধান্ত নেবার আগে এব্যাপারে তারা আমেরিকাকে জানিয়ে ও কথা বলে নিয়েছে। দুনিয়াজুড়ে রুস্তমিতে আমেরিকার নিজের একক নীতি সিদ্ধান্ত গুলোর মধ্যে প্রধানত অর্থনৈতিক বিষয়ক সিদ্ধান্তগুলো ইউরোপের সাথে সমন্বয় করতে সাত শীর্ষ রাষ্ট্রপ্রধানদের একটা ক্লাব আছে যার নাম জি৭ বা গ্রুপ সেভেন। ইউরোপের মধ্যে বৃটেন ওর একজন। জি৭ থেকেও কোন প্রকাশ্য বক্তব্য আসে নাই। ওদিকে সাংহাই উদ্যোক্তা প্রস্তুতি সম্মেলনেই ২০ রাষ্ট্র প্রতিনিধি সদস্য স্বাক্ষর করে ফেলেছিল। বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী মাল মুহিতও তাদের একজন -গিয়েছিলেন, স্বাক্ষর করেছেন। এখন বৃটেনের ঘোষণার আগেই ইতোমধ্যে উদ্যোক্তা সদস্য সংখ্যা ত্রিশে গত ৩১ মার্চ এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে কমপক্ষে ৪০) পৌচেছে। তবে এতদিন এরা সবাই ছিল কেবল এশিয়ার সদস্য। বৃটেনের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর এশিয়ার অষ্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া -যাদের আমেরিকা ধমকিয়ে বিরত রেখেছিল অথচ এসব প্রত্যেক দেশের ব্যবসায়ী, একাডেমিসিয়ান, পরামর্শক এবং এমনকি কোন কোন মন্ত্রীও AIIB তে যোগ দেবার পক্ষে প্রকাশ্যে মত দিয়েছিলেন এবং বিতর্কে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এখন এমন সব রাষ্ট্রেই সে তর্ক আবার জোরাল হয়েছে, এবং যোগ দিবার পক্ষের লোক ও যুক্তি উভয়ই বেড়েছে।

গত ২০ মার্চ রয়টারের খবর, অষ্ট্রেলিয়া যোগদানের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। জাপান দ্বিধাবিভক্ত। থিঙ্কটাংক এক্সপার্টরা বলছেন যদি জাপান যোগ দেয় তা হবে এশিয়ার সর্বশেষ দেশ, এবং বিশেষ শর্তে। দক্ষিণ কোরিয়াকে নিয়ে মিডিয়ায় ইঙ্গিতপুর্ণ খবর বেরিয়েছে যে তারা নাকি ৫% শেয়ার আর একটা ভাইস প্রেসিডেন্ট পদের জন্য দরাদরি করছে। যদিও এক ক্যাবিনেট মিটিংয়ের শেষে অর্থমন্ত্রী এই জল্পনাকল্পনা স্বীকার করতে চান নাই। ওদিকে ইউরোপের মধ্যে বৃটেনের সাথে জর্মন, ফ্রান্স ও ইটালীর যোগ দেবার কথা আগে বলেছি। ইতোমধ্যে তা অনুসরণ করে আরও এগিয়ে যোগদানের ঘোষণা করেছে লুক্সেমবার্গ এবং সুইজারল্যান্ড।

তবে বৃটেনের সাথে জর্মন, ফ্রান্স ও ইটালী – এরা ইউরোপের কারা? এটা জেনে রাখা দরকার। আমেরিকার নেতৃত্বে এতদিনের গ্লোবাল মাতবর প্রতিষ্ঠানে আমেরিকার ক্ষমতায় সুখের ভাগ নিবার ভুমিকায় ইউরোপের মধ্যে চার রাষ্ট্র ছিল সবচেয়ে বড় সাগরেদ - চার ইউরোপিয়ান: বৃটেন, জর্মন, ফ্রান্স ও ইটালী। আমেরিকান নীতির প্রতি চোখবন্ধ রেখে সমর্থনের মাত্রা দিয়ে তাদের নামের ধারাবাহিকতাগুলো লিখা হয়েছে। সমর্থনের মাত্রা যার সবচেয়ে বেশী তাকে দিয়ে শুরু। এই চারের বাইরে ইউরোপের বাকি রাষ্ট্রগুলোর মধ্যেও আর কেউই প্রভাবশালী নয়। ইউনিয়নের বর্তমান সদস্য সংখ্যা প্রায় ২৫। এখানে প্রভাবশালী কথার অর্থ বর্তমান বিশ্বব্যাংকে ইউরোপের টপ বড় মালিকানা শেয়ার হোল্ডার: এরাই সেই চার রাষ্ট্র। আবার যেমন, জি৭ – এই সাত রাষ্ট্রের গ্রুপের মধ্যে চার ইউরোপীয় সদস্য রাষ্ট্র হল - এই চার রাষ্ট্র। এই গ্রুপের সদস্য কে হতে পারে তা মানার ভিত্তি হল দুনিয়ায় সঞ্চিত সম্পদ কোন রাষ্ট্রের হাতে বেশি এমন তালিকার উপরের সারির প্রথম সাত রাষ্ট্র। এই সাত রাষ্ট্রের মোট সম্পদ দুনিয়ার মোট সম্পদের ৬৪ শতাংশ।

একটা ফুটনোট: যদিও এখানে জি৭ এর ক্রাইটিরিয়া বলার সময় শব্দটা ‘সম্পদ’ ব্যবহার করা হয়েছে কিন্তু এই শব্দের প্রকৃত অর্থ বিনিয়োগ ক্ষমতা অথবা বিশ্বব্যাংকের মত প্রতিষ্ঠানের শেয়ার হোন্ডিং বা দাতা-মালিক। এছাড়াও মনে রাখতে হবে চিন জি৭ এর সদস্য নয়ঃ; হতেও চায়নি, অফারও করা হয় নাই। ফলে এই তিন রথীর বৃটেনের সিদ্ধান্তকে অনুসরণ করার সারার্থ হল, ইউরোপের প্রধান চার মোড়ল আমেরিকাকে এতিম করে দিয়ে চিনের নেতৃত্বে AIIB উদ্যোগের পক্ষে চলে যাচ্ছে। এর ফলে সারা এশিয়া ও ইউরোপের মূল অর্থনীতিগুলো AIIB উদ্যোগের পক্ষে চলে যাচ্ছে বলা যায়। গত বছরের সাংহাই সম্মেলনের আগে আমেরিকান আমলা কুটনীতিকরা নিজেদের পিঠ চাপড়িয়েছিল এই বলে যে এই উদ্যোক্তা সম্মেলন মোট সদস্য সংখ্যা ২০ হয়েছে বটে, কিন্তু চিন ও ভারত বাদে এশিয়ার বড় অর্থনীতির কেউ এর সদস্য হতে আসেনি। ইউরোপ থেকেও কেউই আসেনি। এটা তাদের কূটনৈতিক লবির সাফল্য। অর্থাৎ চিন উদ্যোগের বিরুদ্ধে আমেরিকার কানপড়া দেয়া, ভাঙরি দেয়া, ভয় দেখানোর প্রচেষ্টাটা সফল। স্বভাবতই এই হিসাব এশিয়ার জাপানকে বাইরে রেখে বলা। কিন্তু মাত্র পাঁচ মাস পরে সে দৃশ্যপট একেবারেই বদলে গিয়েছে, আগামিতে আরও বদলে যাবে সে আলামত দেখা যাচ্ছে। দৃশ্যপট বদলে দিবার পিছনের ট্রিগার টানার মত কাজটা করেছে বৃটেন। নিজে একা শুধু নয় ইউরোপের বাকি তিন মুল মুরুব্বিদেরও সাথে আনার কাজ হয়ে গেছে সেটা। এটা এমন এক ঘটনা যা ১৯৪৪ সালের পর থেকে দুনিয়াতে ঘটতে দেখা এমনকি কল্পনা করাও খুব সহজ ছিল না।

ওদিকে অষ্ট্রেলিয়ার ঘনিষ্ঠ পড়শি, রাজনীতি-অর্থনীতিতে প্রায় সমনীতি অনুসরণকারি নিউজিল্যান্ডও আনুষ্ঠানিকভাবে AIIB তে যোগদান করেছে। তবে বৃটেনের পরের তিন ইউরোপীয় রাষ্ট্র ঠিক কী বলে তাদের যোগদানের আগ্রহের কথা জানিয়েছে সেটাও বেশ গুরুত্বপুর্ণ। বার্তা সংস্থা এসোশিয়েটেড প্রেস জর্মন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রচারিত তাদের তিন রাষ্ট্রের আগ্রহ-পত্রকে উধৃত করে জানাচ্ছে, “তিন ইউরোপীয় দেশ চলতি ডেভেলবমেন্ট ব্যাংকগুলোর অংশীদারির পাশাপাশি AIIB তে যোগদানের পরিকল্পনা করছে যাতে এশিয়ায় প্রচুর অবকাঠামো ঋণের চাহিদা মিটাতে AIIB তে ফান্ড সরবরাহ করে তাতে গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা রাখতে পারে”। “ফ্রান্স, ইটালি ও জর্মনি আন্তর্জাতিক ও ইউরোপীয় পার্টনারদের সাথে ঘনিষ্ঠ সমন্বয় রেখে AIIB এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হয়ে কাজ করতে আগ্রহী যাতে এমন এক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যায় যাতে তার পরিচালনা, সুরক্ষা, ঋণ বিতরণ ও সংগ্রহের ক্ষেত্রে ‘বেষ্ট ষ্টান্ডার্ড ও প্রাকটিস’ অনুসরণ করতে পারে”।

তিন

এখানে শুরুতে চলতি “গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থার” কথা বলছি মানে একটা সিস্টেমের কথা বলছি। যেমন সাধারণ মানুষ বলে “একটা সিস্টেম করে নিয়েছি” – আসলে ঠিক তাই-ই বুঝাচ্ছি। অর্থাৎ এটা একটা সিস্টেম – এই অর্থে অর্ডার। আইন-কানুন, নিয়ম প্রটোকল, প্রভিশন, ম্যান্ডেট, ট্রিটি-সম্মতিচুক্তি ইত্যাদি সব মিলিয়েই – একটা ব্যবস্থা। গত ১৯৪৪ সালে এই ব্যবস্থার জন্মটাকে বলা হয় দুই বিশ্বযুদ্ধের সার ফলাফল। যার মাখন হল আমেরিকার নেতৃত্বে ও কর্তৃত্বে জন্ম নেয়া এক বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। চারটা গ্লোবাল বা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান – আইএমএফ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, ডব্লিওটিও এবং জাতিসংঘের মাধ্যমে দুনিয়ায় তৎপর ও হাজির। এছাড়া আরও প্রতিষ্ঠান আছে যেগুলো মূলত আমাদের মত দেশগুলোর উপর ঐ গ্লোবাল চার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য আমেরিকার নেতৃত্বে বাকি প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থের সমন্বয় করে। অর্থাৎ সেগুলো সরাসরি আমাদের মত দেশের স্বার্থের বিপরীত প্রতিষ্ঠান এবং সেখানে আমাদের মত দেশের সদস্যপদ নাই। যেমন G7, OECD। চার গ্লোবাল প্রতিষ্ঠানের জন্মের কথা বলছিলাম। না, ১৯৪৪ সালে এটা ঠিক বন্দুকের মুখে ফেলে সই করিয়ে নেয়া ঘটনা নয়। আর আমরা তখন কলোনি মাস্টারের বৃটিশ-ইন্ডিয়ার অধীনস্ত। ফলে আমাদের কথা বলার কিছু নাই। সব কলোনি মাস্টারের সারা ইউরোপের কাছে রুজভেল্টের আমেরিকা তখন হয়ে উঠেছিল একমাত্র ত্রাতা। সে এক অবজেকটিভ বাস্তবতা, পরিস্থিতি যেটা একদিক থেকে সবাই উপায়হীন এক অন্ধকার ভবিষ্যতে, অন্যদিকে একমাত্র আশা ভরসা রুজভেল্ট ও তার আমেরিকা। এবং আক্ষরিক অর্থেই যুদ্ধোত্তর ইউরোপকে বিশেষত ইটালিকে ত্রাণ দিবার ক্ষমতা বাস্তবতা একমাত্র আমেরিকার ছিল এবং দিয়েছিল। আর বিগত ১৯৪১ সালে বৃটেনকে নাকে খত দিয়ে আটলান্টা চার্টারে স্বাক্ষর করিয়ে নেবার পর থেকে ১৯৪৫ সালে যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত আমেরিকা স্টালিনের সোভিয়েত ইউনিয়নসহ ইউরোপের সবার যুদ্ধের সিংহভাগ রসদ ও খরচ যুগিয়েছে। আবার, যুদ্ধশেষে এরপরেও আবার পুনর্বাসন, পুনর্গঠন এর জন্য ঋণ, বিনিয়োগ সবই এসেছে ঐ আমেরিকা, একই উৎস থেকে। ১৯৩৩ সাল থেকে সারা ইউরোপের তাগিদ আমেরিকা যেন একটা “গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা” গড়ার উদ্যোগ নেয়। কারণ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরু ১৯১৪ সালের পর থেকে ১৯৪৪ সালে পর্যন্ত এই ত্রিশ বছর ধরে কলোনি শাসনের হাত ধরে দুনিয়ায় খুবই সীমিত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পণ্য বিনিমইয়ের যে ব্যবস্থা চালু ছিল তা একেবারেই প্রায় অকার্যকর হয়ে গেছিল। এই বাস্তবতার মধ্যেই ঐ চার গ্লোবাল প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে “নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা” গড়ে উঠেছিল।

চারটি প্রতিষ্ঠানের যে বাস্তব বন্দীত্বে সারা দুনিয়াকে আমেরিকার হাতে এনে দিতে পারার মুল চাবিকাঠি হল, আমেরিকার অর্থনীতির প্রবল উত্থান; একমাত্র অর্থনীতি যার ভিতর বিশ্বযুদ্ধের মধ্যেও উদ্বৃত্ত্ব সম্পদ সঞ্চিত হয়েছিল। কারণ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আয়-ব্যয়ে টানাভাবে উদ্বৃত্ত্ব থাকছিল। যুদ্ধের আগে (১৯১৪) যার যত কলোনি দখলে আছে সে তত বড় সাম্রাজ্যের রাজা। আর যুদ্ধের পরে হল উলটা। ইউরোপের সব কলোনি বা পরদেশ দখলকারি খোদ মাস্টারেরা দেউলিয়া, আর সবাই আমেরিকার প্রজা, আমেরিকা একমাত্র দাতা। যেকথা বলছিলাম, আমেরিকার অর্থনীতির প্রবল উত্থান, একমাত্র উদ্বৃত্ত্ব অর্থনীতি - এটাই তার নেতৃত্বে যেকোন নতুন গ্লোবাল অর্ডার কায়েম হবার পিছনের শর্ত, অবজেকটিভ বাস্তবতা তৈরি করে। এই অর্থে চলতি একুশ শতকের শুরুর দ্বিতীয় দশক ১৯৪৪ সালের আশেপাশের সময়ের পরিস্থিতির সাথে তুলনীয়। নিশ্চয় সবটা হুবহু নয়, যেমন আমরা এখন কোন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে নাই। কিন্তু গুরুত্বপুর্ণ যে দুনিয়ায় একমাত্র অর্থনীতি চিনের, যেখানে সবচেয়ে দ্রুত এবং বেশি উদ্বৃত্ত্ব সম্পদ সঞ্চিত হচ্ছে। এর তুলনায় কাছাকাছিও কেউ নাই। উদ্বৃত্ত সম্পদ মানেই আবার বিনিয়োগের ক্ষমতা। গ্লোবাল অর্থনীতিতে অবকাঠামো খাতে সবচেয়ে প্রভাবশালী বিনিয়োগ ক্ষমতা। তাই AIIB শুধু বিশ্বব্যাংক বা এশিয়ার এডিবিকে চ্যালেঞ্জ করছে না। প্রকারান্তরে আইএমএফকেও চ্যালেঞ্জ করবে। এখন চিনের নেতৃত্বে নতুন বিশ্বব্যাবস্থা কায়েমের পথে প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক কাজ শুরু হবে।

গত ৩১ মার্চ উদ্যোক্তা স্বাক্ষরের সুযোগ শেষ হয়েছে, অর্থাৎ এর পরে যারা সদস্য হতে চাইবেন তারা AIIB এর গঠন, প্রকৃতি, ম্যান্ডেট বিষয়ক এখন এবছর ধরে যে নিগোশিয়েশন আলোচনা চলবে এমন টেবিলে বসবার যোগ্য বিবেচিত হবেন না। আগামি বছর থেকে AIIB কার্যকর হয়ে ততপরতা শুরু করতে চায়।

চলতি শতকের প্রথম দশক (২০০১-১০)থেকেই দুনিয়া জুড়ে নানান ঘটনায় বারবার আলামত ফুটে উঠছিল যে বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে এক মহা-ওলটপালট আসন্ন। দুনিয়া জুড়ে পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের বিস্তৃতি ও পুঁজির পুঞ্জিভবন ভবন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যে বিশ্বযজ্ঞ চলেছে তাকে এক কথায় আন্তর্জাতিক পুঁজির তৎপরতার বলা হয়। সেই তৎপরতা পুঁজির নিজস্ব স্বভাবের অধীন। তার কার্যকারণ নৈর্ব্যক্তিক -- মানুষের ইচ্ছাধীন নয় – একথা অনেক রথী মহারথী বলে গিয়েছেন। এদের মধ্যে কার্ল মার্কস অন্যতম। তাঁর লেখালিখির মধ্য দিয়ে মানুষের ইচ্ছার বাইরের পুঁজির এই বিশ্ব ব্যাপী চলন ও বিচলনের কার্যকারণকে ‘পুঁজির লজিক’ নামেও অভিহিত করা হয়। পুঁজি তার নৈর্ব্যক্তিক চরিত্রের কারনে যা করে তা ওয়াশিংটন, লন্ডন, ব্রাসেলস বা পিকিং-এ বসে ষড়যন্ত্র করে করা যায় না। পুঁজির নিজস্ব লজিকের কারণেই ঘটে – এই ধারণা পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে বোঝার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। পূঁজির চলন বা বিচলন কোন ব্যক্তি বা গ্রুপের ষড়যন্ত্র নয় বলার অর্থ এমন নয় যে পুঁজির লজিকের ইচ্ছার সামনে মানুষ অসহায়, বরং উল্টাটা। পুঁজির লজিক যে জানে বা বোঝে সে যেমন মানুষ, তেমনি তা জেনে ও বুঝে এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ইতিহাসের নির্ধারক শক্তিও হতে পারে একমাত্র মানুষই, অন্য কেউ নয়। মানুষের বিপ্লবী কর্তাসত্তার নির্মাণ ও কর্তব্য নির্ণয় পুঁজির নৈর্ব্যক্তিক চলন বা বিচলন চলন বোঝার ওপর নির্ভরশীল। এটাকেই আমরা বিপ্লব, র্যা ডিক্যালিজম ইত্যাদি নানান নামে ডাকি। বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে এই ধারণা মাথায় রেখেই আমরা এর সাম্প্রতিক পরিবর্তন বা বিবর্তন নিয়ে কথা বলছি, যেখানে প্রসঙ্গ: চিনের নেতৃত্বে গঠিত এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক।

পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক বা পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার নৈতিক সমালোচনা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। নীতিবাদিতা পুঁজির লজিক বা চলন বুঝতে আমাদের কোন সহায়তা করে না। তাছাড়া বিশ্ব পরিস্থিতির বর্তমান পর্যায়ে কী সম্ভব আর কী সম্ভব না সেই কর্তব্য নির্ণয়ের ক্ষেত্রেও পুঁজির স্বভাব সম্পর্কে বুঝের অভাব থাকলে আমরা কোন রাজনৈতিক দিশা খুঁজে পাব না। রাজনৈতিক কর্তব্য নির্ণয়ের জন্য নৈতিকতার প্রয়োজন আছে, কিন্তু বিশ্ব পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে যে পরিবর্তন ঘটছে সেটা জানা, বোঝা ও বিশ্লেষণ ছাড়া নৈতিক ভালমন্দ বিচার বিশ্ব ব্যবস্থার এই তীব্র প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে সঠিক কর্তব্য নির্ণয়ে সহায়ক হয় না। বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভাল না খারাপ, চাই নাকি চাই না – এই সকল নীতিবাদি বিচার সেই বাস্তব সত্যকে অস্বীকার করতে অক্ষম যে এই ব্যবস্থার মধ্যেই আমাদের বসবাস করতে হচ্ছে এবং আরও দীর্ঘদিন বসবাস করতে হবে। ফলে বাংলাদেশে আমাদের সুনির্দিষ্ট করণীয় কি হবে সেই লক্ষ্যে ব্যবস্থাটাকে বোঝা প্রথম ও প্রধান কাজ। এই গ্লোবাল বিশ্ব ব্যবস্থার ভেতরে যে বদল বা ওলটপালট হচ্ছে তার ফলে আমাদের ওপর তার প্রভাব কোথায় কিভাবে পড়তে পারে বা পড়বে তা অনুমান করা আমাদের উদ্দেশ্য। নিজেদের দিক থেকে কম্পিটিটিভ এডভ্যানটেজ বা তুলনামূলক সুবিধার দিক কি, কি সুযোগ আমাদের জন্য উন্মোচিত হচ্ছে, কিম্বা নতুন প্রতিবন্ধকতা -- এসব মিলিয়ে একটা সম্ভাব্য কৌশল নির্ণয়ে পৌছানো এখন দরকার। দূরে দাঁড়িয়ে বা গ্যালারিতে বসে মজা দেখা না, ভাল খারাপ বলে রায় দেয়া না। আমরা সংশ্লিষ্ট হয়েই আছি, থাকতে হবে এই উপলব্ধি জাগিয়ে রেখে একে মোকাবিলার কৌশল নির্ণয়। সেই উদ্দেশ্যে নিজেদের নিবদ্ধ রেখে প্রথম কিস্তির (এক), (দুই), (তিন) অধ্যায় পড়ুন; এখানে দ্বিতীয় কিস্তি। (প্রথম কিস্তির লিঙ্ক) ।

চার

চলতি গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটা আজীবন দুনিয়াতে এমনই ছিল ব্যাপারটা তেমন নয়। ব্যবস্থাটা গড়ে উঠেছিল ১৯৪৪ সালের সময়কালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির পটভুমিতে। পুঁজির নিজের লজিক বা তাগিদ হিসাবে যদি এই সময়কালকে বুঝি তাহলে বলতে হয় পুঁজি যেন নিজেই নিজেকে নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা হিসাবে এই প্রথম এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের রূপ নিজেকে সাজাতে পেরেছিল।

এই হিসাবে গত ৭০ বছর ধরে মার্কিন নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এই বিশ্বব্যবস্থার রুস্তমি কায়েম আছে। পুঁজির যে ধ্বংসাত্মক ভূমিকা বিশ্বব্যাপী সেই বিনাশ প্রক্রিয়া আরো ব্যাপ্ত হয়েছে। কিন্তু একে শুধুমাত্র নেতিবাচক দিক থেকে বিচার করলে ভুল হবে। প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক হাজিরার কথা বলেছি। সেই প্রাতিষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে অর্থনীতির দিক থেকে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক , রাজনৈতিক বা পরাশক্তিগত দিকটা জাতিসংঘ আর ব্যবসা বাণিজ্য বা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের দিকটা ডব্লিউটিওর মাধ্যমে এভাবে এক বিশ্বব্যবস্থাকে সাজানো হয়েছিল যাতে সামগ্রিক ভাবে আন্তর্জাতিক পুঁজির নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা যায়। ‘সাজানো ও নিয়ন্ত্রণ’ বলাতে এসবের নেতির দিকটাই শুধু তুলে ধরা হল। কিন্তু আমাদের উপর এসব প্রতিষ্ঠানের ভুমিকা কেবলই নেতিবাচক এমন ধারণা ও এপ্রোচ ভুল । যে কোন স্থানীয় অর্থনীতির জায়গায় দাঁড়িয়ে দেখলে বিশ্ববাজার বা বিশ্ব অর্থনীতি গড়ে ওঠার অর্থ একটি গতিশীল বিশ্ব অর্থনীতি গড়ে উঠা। শেষ বিচারে এর ইতিবাচক দিকটা হল একটা বিশ্ব ব্যবস্থা সচল করে তোলা। দুনিয়া কোন ব্যবস্থার দ্বারাই চালিত বা পরিচালিত নয়, কোন ব্যবস্থা চালু নাই -এই ধরণের সিনারিও বাংলাদেশে আমাদের জন্য কোন সুখকর দৃশ্যপট নয়।

বিশ্ব ব্যবস্থা নাই কথার সাধারণ অর্থ নিজ নিজ রাষ্ট্রসীমার বাইরে কোন কমিউনিকেশন লেনদেন, পণ্য বিনিময় বাণিজ্য, বিনিময় মুদ্রা, ভাব বিনিময় দেয়া নেয়া ইত্যাদি কিচ্ছু নাই। এমন দৃশ্যপটটা বাংলাদেশের শ্রম ও জীবন যাপনের ব্যবস্থার জন্য বর্তমানের চেয়ে আরও দুঃসহ হতে পারত।। বিশ্ব ব্যবস্থার যে পুঁজিতান্ত্রিক রূপ তার পর্যালোচনা হতে হবে, সন্দেহ নাই। সেই রূপের মধ্যে জনগোষ্ঠি হিসাবে আমাদের অর্থনৈতিক ও অন্যান্য স্বার্থ রক্ষা করা যাচ্ছে কিনা সেটাই বিতর্কের মুল জায়গা। বিশ্বব্যবস্থাটাকেই নাকচ করা নয়। প্রশ্ন হচ্ছে কি ধরণের বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আমাদের স্বার্থের অনুকুল। আমাদের স্বার্থ, উৎকন্ঠা, দাবি ও প্রত্যাশা জানাবার ও শোনাবার উপযুক্ত ব্যবস্থাও চাই। শুধু বাংলাদেশী হিসাবে নয় – পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার কারণে সারা দুনিয়ার বিপুল জনগোষ্ঠি যেভাবে ধুঁকছে তাদের সকলের স্বার্থের কথা ভেবে বিশ্ব প্রতিষ্ঠানগুলোর কোন সংস্কার কিম্বা নতুন ধরণের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যায় কিনা সেটাই প্রধান বিবেচ্য বিষয়। তার মানে বিশ্বব্যংক নিপাত যাক ধরনের শ্লোগানের ভিতর সুনির্দিষ্ট ভাবে আমাদের দাবি বা প্রত্যাশা হাজির না করতে পারলে কোন ফল দেবে না। এটা স্রেফ কোন প্রতিষ্ঠানের নিপাত যাকের মামলা নয়।

মুদ্রার ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ

আইএমএফ জন্মের আগে মুদ্রার উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ছিল ন।যেমন ১৯৪৪ সালের আগের দুনিয়াটা দেখতে কেমন ছিল তা যদি আমরা খুজি তাহলে দেখব চলতি “গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থা” ধরণের বা এর কাছাকাছি তুল্য সেখানে কিছু নাই, ছিল না। ছিল কলোনি সম্পর্কের অধীন খুবই সীমিত ও অপুষ্ট বিনিময় ব্যবস্থা। লেনদেনের গ্রহণযোগ্য কোন আন্তর্জাতিক মুদ্রা বলে কিছু ছিল না। মুদ্রা মানে ছিল কোন না কোন প্রাইভেট ব্যাংকের নোট। ঐ নোট দেখালে সেই ব্যাংক নোটের বদলে গচ্ছিত রাখা সমতুল্য পরিমান সোনা ফিরিয়ে দিত। এটাকে গোল্ড ব্যাকড নোট – বলা হয়। এই সময়ে চালু ঔপনিবেশক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য লক্ষণ চিহ্ন হল, কোন দেশের মুদ্রার মান ও বিনিময় হার কি হবে সেটা ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলো নির্ধারণ করে দিতনা। মূদ্রার মান বা বিনিময় হার নির্ণয়ের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কোন হস্তক্ষেপ (অবমুল্যায়ন বা অতিমুল্যায়ন) ছিল না। মুদ্রার মান ও বিনিময় হার নির্ধারিত হত বাজার দিয়ে – শেষ বিচারে প্রাইভেট বা পারিবারিক ব্যাংকের হাতে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের হাতের বাইরে। এককথায়, কলোনি ঔপনিবেশিক আমলে মুদ্রা ও রাষ্ট্রের মধ্যে কোন সম্পর্ক ছিল না।

কিন্তু এতে সবচেয়ে বড় অসুবিধা বা সীমাবদ্ধতার দিকটা ছিল। কলোনির সঙ্গে কলোনির ম বিনিময়ও ছিল অপুষ্ট ও সীমিত। যেমন বৃটিশের সাথে ফরাসী বিনিময়। আমরাতখনকার বৃটিশ-ইন্ডিয়ার অন্তর্ভূক্ত। গোনায় ধরিনা, বাইরে। তবে একমুখি উদ্বৃত্ব পাচার চলছিল। বৃটিশ-ইন্ডিয়া থেকে বৃটেনমুখি। এটাকে পণ্য বিনিময় বলা কষ্টকর। একথা নিসন্দেহে নিঃসন্দেহে সত্যি যে আমরা কলোনি ধরণের বিনিময় ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে ১৯৪৪ সাল থেকে আমেরিকার ওয়াল ষ্ট্রিটের অধীনস্থ বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে পড়েছি। তবু তুল্য বিচারে এটা ভাল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে মেলা গালগল্প আমরা শুনি। বীরত্বের, সিনেমা সাহিত্য ইত্যাদিতে নতুন মূল্যবোধের বয়ান, বিভিন্ন জাতির জয়গাথা আমাদের চারিদিকে ছড়ানো আছে। পশ্চিমের সেসব আমরা গোগ্রাসে গিলি। কিন্তু এগুলো একটাও যুদ্ধের মুল তাৎপর্যের হদিস দেয় না। সম্ভবত এর একটি তাৎপর্য হচ্ছে কলোনিয়াল দুনিয়ায়া খুবই সীমিত কমিউনিকেশন লেনদেন, পণ্য বিনিময় বাণিজ্য, বিনিময় মুদ্রা, ভাব বিনিময় দেয়া নেয়ার যে সংকীর্ণ জগত ছিল তা ভেঙে যাওয়া। তার বদলে যুদ্ধ শেষের দুনিয়াটা হল বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে একটা প্রাতিষ্ঠানিক শৃংখলার অধীনে নিয়ে আসা। সব ধরণের বিনিময় লেনদেন, মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কে বদল এককথায়, কলোনী সম্পর্ক থেকে বের হয়ে বিশ্বব্যস্পী সম্পর্কের প্রবেশের দুয়ার খোলা।

অন্যদিকে অন্য রাষ্ট্রের কলোনি হওয়ার হাত থেকে মুক্ত হয়ে আমরা এবার গিয়ে পড়লাম আমেরিকান ওয়াল ষ্ট্রিটের অধীনে। প্রত্যেক রাষ্ট্রের অর্থনীতি উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হল আন্তর্জাতিক পুঁজির কেন্দ্র ওয়াল ষ্ট্রিটের। এমনকি আমেরিকান রাষ্ট্রও এর নিয়ন্ত্রণের বাইরে রইল না। । এই যুদ্ধের পর থেকে আমেরিকা দুনিয়ার নতুন এমপায়ার বা নতুন ধরণের সাম্রাজ্য রাষ্ট্র হয়ে হাজির হয়েছে হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেও ঐ ওয়াল ষ্ট্রীটের অধীনে। এটা লেনিনের ১৯১৬ সালে বসে দেখা “লগ্নিপুঁজি” ধারণারও পরের বিস্তার । সেই থেকে পরের সত্তর বছর ধরে আমেরিকান এমপায়ারও ওয়াল ষ্ট্রিটের ক্রীড়নক। আর চীনের উত্থানের একালে ওয়াল ষ্ট্রীটের প্রভাবশালী Goldman Sachs কোম্পানি আমেরিকা ছেড়ে রাইজিং চীনের উপর প্রভাব ফেলার চেষ্টা করছে। এতে একটা জিনিষ পরিস্কার। ওয়াল ষ্ট্রীট এবার আসন্ন তৃতীয় গ্লোবাল অর্থব্যবস্থায় আমেরিকার জায়গায় চীনকে মেনে নিতে উদারভাবে প্রস্তুত।

১৯৪৪ সালের প্রথম বিশ্ব অর্থব্যবস্থা অসাম্যের হলেও অন্তত পণ্য, মুদ্রা, টেকনোলজি, ভাব ইত্যাদির বিনিময়ের দিক থেকে আগের কলোনী সম্পর্কের তুলনায় অনেকানেক বিস্তৃত। অন্যদিকে সুনির্দিষ্ট ভাবে ওয়াল ষ্ট্রিটের অধীনস্থ গ্লোবাল অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সবচেয়ে খারাপ দিক হল, এর প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনায় আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক গড়তে ও একে কার্যকর করতে গিয়ে সাধারণভাবে “রাষ্ট্র ও মুদ্রাকে” গভীরভাবে সম্পর্কিত করেছে তো বটেই, নিজ মুদ্রার মান ও বিনিময়ের হারকেও বাজারের বদলে রাষ্ট্রের তুলে দিয়েছে বা সেটা রাষ্ট্রের হাতে চলে গিয়েছে। “সমাজতন্ত্রী মনের” বিচারে অনেকের মনে হতে পারে এটা ভালই তো, বাজারের প্রাইভেট ব্যাংকের বদলে মুদ্রার উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ কায়েম হয়েছে। কিন্তু এই বুঝ মিথ্যা, ফাঁকি আর পারাডক্সে বিভ্রান্ত।

আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণে বিশ্ব অর্থনৈতিক অবস্থাকে আগের কলোনি যুগের সঙ্গে তুলনা করলে বলা যায় আগে কার্যত কোন ব্যবস্থাই জারি ছিল না। ১৯৪৪ সালের এই ব্যবস্থার সুচনা ঘটলেও কলোনি যুগ মানে ১৯৪৪ সালের আগে শুধু নয়, বুঝতে হবে ১৯১৪ সালের আগের অবস্থা হিসাবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরু ১৯১৪ সালে। এই ত্রিশ বছর (১৯১৪-১৯৪৪) সময়কালকে তুলনায় বলা যায় “নো সিষ্টেমের” যুগ। এমনকি অন্তর্বর্তিকালীন সময়ও সেটা নয় যে কোন নতুন ব্যবস্থা সেখানে তৈরি হতে শুরু করেছে। বলা যায় ঐ সময়টা পুরান কলোনি ব্যবস্থা কেবল ভাঙ্গছে আর ভাঙ্গছে অথচ নতুন ব্যবস্থা জন্মানোর আলামত নাই, ফলে যে যেভাবে পারে কোন মতে , সংকটের দিন পার করবার কাল। এসবের মূল কারণ যুদ্ধ, আর চেপে বসা ক্রমবর্ধ্মান যুদ্ধের খরচ –সবার আগে এটাই চলতি মুদ্রার বাজার ব্যবস্থাকে নন-ফাংশনাল করে দিয়েছিল। ঐ ব্যবস্থার বৈশিষ্ট ছিল, প্রাইভেট ব্যাংক হলেও সোনা মজুদ রাখার বিনিময়ে সম-পরিমাণ মুদ্রা ছাপানো আর প্রতিদিন যে পরিমাণ সোনা বা ভিন্ন প্রাইভেট ব্যাংক মুদ্রা ফেরত আসল আর যে পরিমাণ বের হলে গেল এদুইয়ের সাম্য প্রতিষ্ঠা করার ভিত্তিতে পরের দিন সকালের মুদ্রা বিনিময় হার নির্ধারণ করে দেয়া।

যুদ্ধের কারণে এই দুই গুরুত্বপুর্ণ ভিত্তির উপর বাজারের আস্থা নষ্ট হয়ে পড়ায় ব্যবস্থাটাই নন-ফাংশনাল হয়ে যায়। এর উপর আবার – যেমন, ব্যাংক অফ ইংল্যান্ড তখনও প্রাইভেট ব্যাংক -- তবে মুদ্রা ছাপানোর একমাত্র সরকারি লাইসেন্সধারি। এবং সেই সাথে ব্যক্তি একাউন্টধারি খাতকের মতই বৃটিশ রাষ্ট্রও তার একাউন্টধারি গ্রাহক মাত্র। এই বিশেষ গ্রাহককে যুদ্ধের খরচে মিটাতে ব্যাংককে বেধড়ক ধার দিতে হয়েছে, আবার কবে ধার শোধ করতে পারবে সে আলামত নাই। এই পরিস্থিতিটা হল, ব্যাংক থেকে সোনা বেরিয়ে গেছে যার ফেরার আলামত নাই। এই ক্ষতির ফলাফল সব খাতকের উপর পড়েছিল। দেশে বিদেশে পাউন্ড মুদ্রার উপর কারও আস্থা নাই। আন্তর্জাতিক সীমিত বাণিজ্যও এতে রুদ্ধ হয়ে পড়ে। আমেরিকান (প্রাইভেট) ব্যাংকগুলোর বৃটেনের কোন ব্যাংক বা সরকারকে ঋণ দিতেও অস্বীকার করে। কারণ পাউন্ডের মুদ্রামানের ঠিক নাই, ভরসা নাই। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট প্রথম নির্বাচিত হন ১৯৩২ সালের নভেম্বরে। জানুয়ারি ১৯৩৩ সালে তাঁর শপথ নিবার আগেই সারা ইউরোপের সব রাষ্ট্র প্রত্যেকেই নিজ নিজ মুদ্রার অবমুল্যায়ন ঘটিয়ে এবং সবাই ঘটানোতে ফলাফল শুণ্য অবস্থায় সমস্ত আন্তর্জাতিক বাণিজ্য একেবারে স্থবির হয়ে যায়। মূল কারণ কারও মুদ্রামানের উপর কারও আস্থা নাই। দুনিয়াতে মুদ্রা ব্যবস্থা বলতে কিছু অবশিষ্ট নাই। তবে ১৯৩৩ সালের পর থেকে, একমাত্র নগদ সোনার বিনিময়েই আমেরিকার সাথে বৃটেনের এক ধরণের সীমিত বিনিময় ঘটেছিল। তবে ১৯৩৩ বলছি এজন্য যে, রুজভেল্ট ক্ষমতায় এসেই নিজ ডলারের অবমুল্যায়ন ঘটান। এর আগে এক আউন্স সোনা= পঁচিশ ডলার। তিনি এটাকে পঁয়ত্রিশ ডলার করেন। যুক্তি ছিল সারা ইউরোপ অবমুল্যায়ন করে ফেলেছে আমি বাকি ছিলাম। তাই তাদের সাথে সমতা বিধানের স্বার্থে। একমাত্র এরপরেই বৃটেনের সাথে এই পয়ত্রিশ ডলার হিসাবে এক ধরণের সীমিত বিনিময় ঘটেছিল। তাও আবার সেটা ঠিক বাণিজ্য নয় একমুখি বিনিময় বলা যেতে পারে। আমেরিকান ব্যবসায়ীর অস্ত্র বা যুদ্ধের রসদ নামিয়ে বিনিময়ে কোন মুদ্রা নোট নয়, নগদ সোনা নিয়ে ভেগে পড়া ধরণের। আমেরিকার “ক্যাশ এন্ড ক্যারি আইন” ১৯৩৫, ১৯৩৭ এসবের সাক্ষ্য। ফুটনোট আকারে বলে রাখি, আইএমএফের জন্মের সময়, এই এক আউন্স সোনা= পঁয়ত্রিশ ডলার এবং এটা একেবারে উঠানামাহীন স্থির মান (কারণ তখনও ডলার নোট মানে এটা গোল্ড ব্যাকড কারেন্সি) এই ভিত্তিতেই আইএমএফ গড়ে উঠেছিল। প্রত্যেক হবু সদস্য রাষ্ট্রের সদস্যপদ পাবার পুর্বশর্ত হিসাবে প্রদেয় চাঁদা হিসাব করা হয়েছিল।

এখনকার দুনিয়ায় সব রাষ্ট্রেই একটা কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা রিজার্ভ ব্যাংক নামে প্রতিষ্ঠান থাকা স্বাভাবিক ফেনোমেনা হয়ে গেছে। সেন্ট্রাল ব্যাংক - মানে মুদ্রা, মুদ্রার মান, বাজারে মুদ্রা সরবরাহ এসবের উপর নিয়ন্ত্রণের প্রতিষ্ঠা করার এক প্রতিষ্ঠান থাকাটা এখন জরুরী মনে করা হয়। কিন্তু এর ইতিহাস বেশি দিনের নয়। ব্যাপারটা ১৯৪৪ সালের আশেপাশের সময়ের। তবে ১৯৪৪ সালের আগের ত্রিশ বছরে সময়ের ভিতর। ব্যতিক্রম যেমন আমেরিকার ফেডারল রিজার্ভ ব্যাংক; প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯১৩ সালে। কারণও ভিন্ন। এর পিছনের কারণ ঠিক ডলারের উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ নয়। বরং তার আগে আলাদা আলাদা প্রাইভেট ব্যাংকের আলাদা সিলের নোট তো বটেই –আমেরিকান এক রাজ্যের নোট আরেক রাজ্যে গৃহীত হত না, চালু ছিল না। অর্থাৎ প্রত্যেক রাজ্য তার অর্থনীতির উদ্বৃত্ত নিজ রাজ্যেই পুনর্বিনিয়োগ করবার সুযোগ ধরে রাখতে চাইত। ১৭৭৬ সালে আমেরিকার জন্মের পর থেকেই এই রক্ষণশীল ব্যবস্থা চালু ছিল। মুল বিষয় ছিল ফেডারেল ব্যবস্থার নামে এক রাজ্য যেন অন্য রাজ্যের উপর বাড়তি সুবিধা না নিতে পারে। সম্ভবত পরবর্তিতে পুঁজির সঞ্চয় বেড়ে যাওয়া বা নিজ রাজ্যে পুনবিনিয়োগের সুযোগ সীমিত হয়ে আসায় অপর রাজ্যে বিনিয়োগ সন্ধানে বের হওয়া বাস্তব কারনেই জরুরি হয়ে পড়েছিল। এছাড়া রাজ্যগুলোর মধ্যে সমন্বয়, একসাথে পরিকল্পনা, ইন্টিগ্রেশান ও ফেডারেল ব্যবস্থা কার্যকর থাকার সুবিধা ও বাড়তি শক্তির দিক চিন্তা করে ফেডারেল রিজার্ভ নামে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবস্থা চালু করা হয়। আর ওদিকে ইউরোপে প্রায় সব দেশে এমন কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৩০-১৯৪৬ সালের মধ্যে। এর মূল কারণ, এককথায় বললে, ১৯৩০ এর মহামন্দা। প্রত্যেক রাষ্ট্রের মুদ্রার অবমুল্যায়ন ঘটিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য রাষ্ট্রের উপর রপ্তানি বাণিজ্যের সুবিধা পাওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। । যদিও এসবের মিলিত ফলাফল শেষ পর্যন্ত শূন্য । কারণ সবাই নিজ নিজ মূদ্রার মান কমালে কেউ কারো উপর সুবিধা হাসিল করতে পারা সম্ভব না। সেটা আলাদা কথা। কিন্তু মুদ্রার অবমুল্যায়ন তখনই করা সম্ভব যখন মুদ্রার উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক ধরণের কিছু আছে। মুদ্রা যদি বাজার আর প্রাইভেট ব্যাংকের হাতে পরিচালিত হয় তবে রাষ্টের অবমুল্যায়নের খায়েসে তারা সাড়া দিবে না। ওদিকে ১৯১৪ সালের পর থেকেই রাষ্ট্র নিজেই প্রাইভেট ব্যাংকের খাতক হিসাবে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশির ঘাটতিতে, সেই ঘাটতি পুরণে ঋণ নেয়া আর ঋণশোধের ব্যর্থতায় দেউলিয়া – এই দশা থেকে একটা আপাত সুরাহা চাচ্ছিল রাষ্ট্র। যেমন, মুদ্রার অবমুল্যায়ন বা মুদ্রাস্ফীতি আগে নেয়া ঋণের প্রকৃত মূল্যের ক্ষয় ঘটায় বা কমিয়ে দেয়। রাষ্ট্র নিজের পুরানা দেউলিয়াত্ব কাটানোর উদ্দেশ্যে ১৯৪৪ সালের আগেই মুদ্রা নিয়ন্ত্রণকারি প্রাইভেট ব্যাংককে অধিগ্রহণ করে রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলে ঘোষণা করে। এছাড়া আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক এর আইডিয়ার বাস্তবায়ন ও এর কার্যকরি প্রতিষ্ঠান হওয়া একমাত্র সম্ভব সদ্স্য রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে, সব স্থানীয় মুদ্রার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। অর্থাৎ প্রত্যেক রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক থাকা আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক অস্তিত্ত্ব থাকার পুর্বশর্ত। তাই বাস্তবে দেখা যায়, কোন রাষ্ট্রের আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক এর সদস্যলাভ করতে চাইলে ঐ রাষ্ট্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলে কিছু আছে কি না, ঐ রাষ্ট্রের স্থানীয় মুদ্রা তা ঐ ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করে কি না এবং আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক এর যে কমন ফরম্যাটে অনুসারে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অর্থনৈতিক ততপরতার বিষয়ক বেস ডাটা সংগ্রহ ও সরবরাহের উপযোগী কি না ইত্যাদি সদস্যপদ লাভের টেকনিক্যাল পুর্বশর্ত।

এসব ঘটনাবলির ভিতর দিয়ে মুদ্রা সরবরাহের উপর অবমূল্যায়নসহ সব ধরণের নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রের মাধ্যমে আইএমএফ হাতে নিয়ে ফেলেছে। কিন্তু বাজার ব্যবস্থা ভেঙ্গে নিজ নিজ স্থানীয় মুদ্রার উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রথম ঘটনাটা ঘটার শুরু এখান থেকে। সব স্থানীয় মুদ্রার উপর আইএমএফের মাতব্বরির দিক থেকে আর এক নির্ধারক ঘটনা ঘটেছে ১৯৭৩ সাল থেকে। আইএমএফের জন্মের সময়ের ১৯৪৪ সালে আমেরিকান ডলার ছিল গোল্ড ব্যাকড কারেন্সি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিনিময়ে স্বীকৃত একমাত্র আন্তর্জাতিক মুদ্রা। আমেরিকান রাষ্ট্র রিজার্ভে সমতুল্য সোনা না রেখে বাড়তি নোট ছাপানো বাজারে ছাড়ার কারণে (যেটা প্রকাশিত হয় ১৯৫৮ সালে) দুনিয়ার কোন মুদ্রানোট আর গোল্ড ব্যাকড কারেন্সি থাকেনি। ফলাফলে নতুন করে আইএমএফের ম্যান্ডেট লিখতে হয়। হাকাও ও ভুয়া কাগুজে নোটের ভিত্তিতে নতুন আইএমএফ চালু হয় ১৯৭৩ সাল থেকে। ফলে এরপর থেকে আইএমএফের অন্য রাষ্ট্রের মুদ্রামান বিনিময় হার নির্ধারণ করে দেয়াটাও এক ভুয়া কারবারের মাতব্বরি হয়ে পড়ে আছে।

AIIB এর উদ্যোক্তা-সদস্য হবার সুযোগ এই মাসেই শেষ, এরপর এই বছর শেষ হবার আগে মালিকানা শেয়ারসহ ম্যান্ডেট চার্টার আইন কানুন শেষ করে আগামি বছরের শুরু থেকে এই ব্যাংক কার্যকর হতে চায়। একটা জিনিষ নিশ্চিত থাকা যায় যে ডলারের বদলে র চিনের মুদ্রা ইউয়ানে আন্তর্জাতিক পণ্য বিনিময়ের মুল্য শোধের ব্যবস্থা হিসাবে খাড়া করা নতুন আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ ব্যাংকের একটা মূল উদ্দেশ্য হবে। সব দ্বিধা ছেড়ে আগেভাগে বৃটেনের এগিয়ে আসার পিছনের বড় কারণ এটা। ইংলন্ড ইতোমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছে, হংকংয়ের বাইরে ইউয়ানে পণ্য বিনিময়ে দ্বিতীয় ক্লিয়ারিং হাউস হতে চায় লন্ডন। অর্থাৎ গ্লোবাল অর্থনীতিতে কার্যকর বড় বড় প্রভাব আমরা দেখতে শুরু করব আগামি বছর থেকে।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন