শনিবার, ১৮ অক্টোবর, ২০১৪

চান্দ্রমাসের হিসাব নিয়ে বিভ্রান্তি


সৌদি আরবে ঈদুল আজহা ও পশু কোরবানি হয়েছে ৪ অক্টোবর। বাংলাদেশে ঈদুল আজহা পালন ও পশু কোরবানি হয়েছে ৬ অক্টোবর। চান্দ্রমাসের একই তারিখ নির্ধারণে দু’টি দেশের মধ্যে দুই দিনের তফাৎ হবে কেন? আমার কাছে বিষয়টি বিদঘুটে ঠেকছে। বিশ্বের সব ক’টি মুসলিমপ্রধান দেশ পৃথিবী নামের গ্রহটির চতুর্দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এই গ্রহের বাইরে আমরা কেউ নই। এই গ্রহটিকে চার দিক থেকে একবার প্রদণি করে চাঁদ আমাদের সামনে একই আকাশে হাজির হয়। এ জন্য চব্বিশ ঘণ্টার কিছু কম সময় লাগে। নতুন চাঁদটাকে দেখতে ভুল বা মিস হলে, অবশ্যই পর দিন সেটি দেখা যাবে। এতে চান্দ্রমাসের তারিখ গণনায় হেরফের হতে পারে মাত্র এক দিনের; দুই বা তিন দিনের তো কোনোভাবেই নয়! 

দিন-তারিখ হিসাব করার দু’টি পদ্ধতি গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হয়ে আসছে বহুকাল ধরে। ঘণ্টা-মিনিট-সেকেন্ড এর মাধ্যমে দিন-তারিখ, মাস ও বছর হিসাব করার জন্য সূর্যকেন্দ্রিক গণনার পদ্ধতি। অন্যটি হলো : শুধু দিন-তারিখ, মাস ও বছর হিসাব করার জন্য চন্দ্রকেন্দ্রিক গণনার পদ্ধতি। গ্রেগরিয়ান বা ইংলিশ ক্যালেন্ডারের হিসাব করা হয় সূর্যকেন্দ্রিক গণনার পদ্ধতিতেই। মুসলমানদের সাথে সম্পৃক্ত বিষয়গুলোর কিছু পালন করতে সূর্যকেন্দ্রিক গণনার পদ্ধতির সময় ব্যবহার হয়। যেমন : নামাজ, রোজা, হজ এগুলো পালনের জন্য স¤পূর্ণ চাঁদের ওপর নির্ভর করতে হয়। চান্দ্রমাসের গণনার কাজটি তাই নিখুঁত ও নির্ভুল হওয়া প্রয়োজন। বিকশিত বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের বর্তমান সময়ে চন্দ্রোদয় কখন হলো তা নিশ্চিত হতে আকাশে চোখ রাখার প্রয়োজন নেই। হিসাব করে নিখুঁতভাবে বের করা যায়, পৃথিবী নামে গ্রহটির কোন এলাকার আকাশে কখন চাঁদ উদিত হবে এবং কখন অস্ত যাবে। একালে কি আমরা কেউ কখনো ‘সুবহে-কাযেব’ শেষ হয়ে কখন ‘সুবহে-সাদেক’ শুরু হলো তা যাচাই করার জন্য আকাশ পরীা করে দেখার চেষ্টা করি? এ জন্য আমরা কি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রণীত সময়-তালিকাকেই মেনে চলি না? তারপরও যদি কেউ নবউদিত চাঁদটি চর্মচুতে দেখার বিষয়কে গুরুত্ব দেন এবং এ কাজ করতে গিয়ে কেউ যদি ভুলও করে ফেলেন অর্থাৎ চাঁদ উদিত হলো আর তা খুবই স্বল্পস্থায়ী হওয়ার কারণে তিনি দেখতে পেলেন না এবং দাবি করলেন, চাঁদ উদিত হয়নি; তাহলেও পরদিন তো তিনি অতি অবশ্যই চাঁদ দেখতে পাবেন। এর মানে দাঁড়ায়, চাঁদ দেখার কাজে ভুল হলেও পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় দুই দলের মধ্যে তফাৎ হবে মাত্র এক দিনের, এর বেশি তো কোনো যুক্তিতেই নয়!

বিষয়টিকে আরো খোলাসা করার জন্য আসুন আমরা কিছু তথ্যকে যাচাই করে দেখি। ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪, সোমবার। এই দিনটিতে উদযাপিত হলো ‘মধু পূর্ণিমা’। চিরাচরিতভাবে চাঁদের অবস্থা বিচারে এই দিনটি পালিত হলো বাংলাদেশের বৌদ্ধদের ধর্মীয় উৎসব হিসেবে। চান্দ্র মাসের হিসাব মতে, ওই দিন পূর্ণিমা ছিল বলেই ধর্মীয় এই অনুষ্ঠান পালন করেছে এতদঞ্চলের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা; কিন্তু দেখা গেল, বাংলাদেশের সব ক’টি পত্রিকাতেই ওই দিনটিতে চান্দ্রমাসের হিসাব লেখা আছে ‘১২ই জিলকদ’। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বাংলা ও ইংরেজি মাসের তারিখ গণনা করা হয়ে থাকে সৌর পদ্ধতিতে অর্থাৎ সূর্যের উদয়-অস্তকে হিসাবে রেখে এবং কেবলমাত্র আরবি মাসটাই গণনা করা হয় চান্দ্র মাসের হিসাবে অর্থাৎ চাঁদের উদয়-অস্তকে হিসাবে রেখে। অন্য দিকে, পূর্ণিমা ও অমাবস্যা দিয়েই চান্দ্রমাসের হিসাব নির্দেশিত হতে হবে, কারণ পূর্ণিমা হলো চান্দ্রমাসের ঠিক মধ্যবর্তী সময় আর অমাবস্যা হলো চান্দ্রমাসের ঠিক শেষ সময়। চাঁদের জীবনচক্ররে পরিসীমা মাত্র ৩০ দিন। দিগন্তরেখার ঠিক ওপরে অত্যন্ত ীণভাবে দৃশ্যমান কাস্তের মতো সরু ও বাঁকা চাঁদের মাধ্যমে চান্দ্র মাসের সূচনা হয়। প্রতিদিন সে চাঁদ বড় হতে হতে ১৪ দিন পর, ১৫ দিন পূর্ণ হওয়ার কাছাকাছি সময়ে গোলাকৃতির পূর্ণাঙ্গ চাঁদ আকাশে উদ্ভাসিত হয় পূর্ণিমার রাতে। এরপর প্রতিদিন এই চাঁদ ছোট হতে থাকে এবং চন্দ্রোদয়ের ২৯ দিন পর, আরো সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে ৩০ দিন পূর্ণ হওয়ার কিছু সময় আগে চাঁদ পুরোপুরি ডুবে যায়। সেই নিকষ কালো অন্ধকার রাতকেই আমরা বলি অমাবস্যা। চাঁদের জীবনচক্র যে পুরোপুরি ৩০ দিন শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগেই শেষ হয় সেই বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্যই কোনো চান্দ্রমাস হিসাব করা হয় ২৯ দিনে এবং কোনো চান্দ্রমাস হিসাব করা হয় ৩০ দিনে। এ েেত্র কেউ যদি খালি চোখে চাঁদ দেখতে গিয়ে ভুলও করে ফেলে তাতেও তারিখের হেরফের হবে মাত্র এক দিনের। তাহলে একদল বাংলাদেশী যখন হিসাব করে বলল : ‘আজ পূর্ণিমা’ অর্থাৎ আজ চাঁদের বয়স প্রায় ১৫ দিন এবং অবশ্যই ১৪ দিনের বেশি। সেই একই দিন অন্য একদল বাংলাদেশী, একই ভূখণ্ডে বসবাস করে এবং একই আকাশে চোখ রেখে, কিভাবে বলে,  ‘নাহ্, আজ চাঁদের মাত্র ১২ তারিখ। এই হিসাবেই আমরা সিয়াম শুরু ও শেষ করি এবং এই হিসাবেই আমরা কোরবানি দিই। আমাদের হিসাবটাই সঠিক।’ 

তাহলে ভুলটা কোথায়? কারা এই ভুল করল? ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪, সোমবার দিনটিতে কি তাহলে পূর্ণিমা হয়নি? বৌদ্ধদের পঞ্জিকার হিসাব তাহলে কি ভুল? নাকি দিনটি আসলেই ১২ই জিলকদ নয় এবং পঞ্জিকার হিসাবে মুসলমানেরা বিভ্রান্তিকর একটি ভুলের মধ্যে বসবাস করছে? ভুল যারই হোক সেটাকে শুধরানো প্রয়োজন রয়েছে। এ নিয়ে আমাদের বিজ্ঞজনদের একটি দল এখনই বসে যাওয়া উচিত। একই বাড়িতে থেকে একজন বলবে, ‘আজ চাঁদের ১২ তারিখ’ আর অন্যজন বলবে, ‘না! না! আজ অতি অবশ্যই চাঁদের পনের তারিখ’, এমনটা তো হতে পারে না। বাস্তবতা হচ্ছে, এই কাজটাই আমাদের বাংলাদেশে হচ্ছে। মুসলমানদের ‘চাঁদের হিসাবে’র সাথে বৌদ্ধ বা হিন্দুদের ‘চাঁদের হিসাব’ মিলছে না। ‘মুসলমানদের চাঁদ বৌদ্ধ বা হিন্দুদের চাঁদ থেকে আলাদা’ এমন হাস্যকর দাবি কেউ করেওনি বা করার উপায়ও নেই। অথচ আমরা যেভাবে চলছি তাতে পরোভাবে এই ‘হাস্যকর দাবি’কেই সমর্থন দিয়ে যাচ্ছি। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ অথচ আমরা যেন এই বিভ্রান্তিকে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করতেই ব্যর্থ হচ্ছি। ইসলাম ধর্মে চান্দ্রমাসের তারিখ নির্ধারণে সঠিকতার বিষয়টি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা বিশুদ্ধতার সাথে স¤পৃক্ত। তাই এই বিভ্রান্তির অপনোদন এুনি করা দরকার। তবে বৈজ্ঞানিক সত্য এই যে, সমগ্র পৃথিবীর জন্য চাঁদ উদিত হয় একবারই। পৃথিবীর যেখানেই প্রথম চাঁদ দেখা যাক না কেন, তা দিয়েই আমরা ওই চান্দ্র দিবসের (চান্দ্রমাসের প্রথম দিন) শুরু হয়ে গেছে ধরে নিতে পারি। সৌর দিবসের েেত্র আমরা এ কাজটাই করে থাকি। 

আজকাল পর্যবেণযন্ত্রের এত উন্নতির পর  চাঁদ দেখার কাজে আমরা সিরিয়াস হলে ‘চাঁদ দেখায় ভুল’ হওয়ার কোনো কারণ নেই। তা হলে সারা বিশ্বের সব মুসলমান একই দিনে রোজা শুরু করবে, ঈদ পালন করবে আর ‘আরাফার দিন’ ধার্য করবে। সহিহ হাদিসে এর সুস্পষ্ট সমর্থন রয়েছে বলে আলেমরা দাবি করেন। আলেমরা আরো দাবি করেন যে, ‘তিন ইমাম তথা ইমাম আবু হানিফা রহ:, ইমাম মালেক রহ: এবং ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ:-এর মত হলো, সমগ্র মুসলিম জাহান একই দিনে রোজা শুরু করবে এবং একই দিনে ঈদ করবে। এমনকি যদি কোনো জনপদ চাঁদ দেখার ভিত্তিতে রোজা শুরু করার পর ২৯ রোজার শেষে ঈদের চাঁদ দেখতে পেল এবং শরিয়তসম্মতভাবে খবর পেল যে, অন্য কোনো জনপদে বা দেশে মুসলমানেরা চাঁদ দেখার ভিত্তিতে রোজা শুরু করার পর ৩০ রোজা পূর্ণ করেছে, তবে এই জনপদের লোকেরাও একই দিন ঈদ পালন করবে কিন্তু একটি রোজার কাজা আদায় করবে।’ একই মত পোষণ করেছেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত ওলেমায়ে কেরাম। এ ধরনের সিদ্ধান্তই হয়েছিল ওআইসির আম্মান সম্মেলনে ১৯৮৬ সালে। ওআইসির ফিকহ অ্যাকাডেমি জর্ডানের রাজধানীতে শতাধিক ফিকহ ও শরিয়াহ বিশেষজ্ঞের সর্বসম্মতিতে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সব মুসলমান দেশের সাথে বাংলাদেশও সেই সনদে স্বার করেছিল। সেই থেকে বিশ্বের সব মুসলমান দেশ বিশ্বের যেকোনো স্থানে চাঁদ দেখতে পাওয়ার খবর শরিয়তসম্মতভাবে পেলে রোজা রাখা ফরজ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। প্রাচ্যের দেশ হিসেবে সৌদি আরব ও এর আশপাশের দেশগুলোতেই সর্বপ্রথম উদিত চাঁদ দৃশ্যমান হওয়ার কথা। তাই সৌদি সরকারের ঘোষণা পেলে তার ভিত্তিতে চাঁদের উদয়কে নিশ্চিত ধরে নিয়ে সমগ্র মুসলিম জাহান একই দিনে রোজা-ঈদ পালন করে আসছে। আল্লাহ পৃথিবীর কেন্দ্রস্থলেই পবিত্র ঘর কাবা নির্মাণ করিয়েছেন। ওআইসির সিদ্ধান্তের ব্যাপারেও কেবল পাক-ভারত উপমহাদেশের (বাংলাদেশসহ) অনেক আলেমে দ্বীন একমত না হওয়ায় বাংলাদেশ-পাকিস্তান-ভারতের মুসলমাদের সমাজে ইতোমধ্যে নানা দলের সৃষ্টি হয়েছে। একেক দল একেক দিন রোজা শুরু ও শেষ করে। ফলে একদল যেদিন ঈদ পালন করছে সেদিন অন্য দল রোজা পালন করে। ভিন্নমতের মাত্রা এমন পর্যায়ে গেছে যে, ২০০৩ সালে আমি লন্ডনে দেখেছি ব্রিটেনে প্রবাসী তিন গ্র“প ভারতীয় তিন ভিন্ন প্রেেিত পৃথকভাবে ঈদ পালন করছে। তিনটি গ্র“প লন্ডনে বসবাস করে অথচ এক গ্র“প ঈদ পালন করল যেদিন সৌদি আরবে ঈদ উদযাপিত হলো সেদিন। আরেক গ্র“প করল যেদিন তাদের মাতৃভূমি ভারতের গুজরাটে ঈদ উদযাপিত হলো সেদিন। অন্য গ্র“প ঈদ করল লন্ডনে যেদিন চাঁদ দেখা গেল সেদিন। তারা সবাই ধর্মপ্রাণ মুসলমান! এই অনৈক্য ও তামাশা দেখে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মুসলমানেরা অসহায় তাকিয়ে থাকে আর বিদেশীদের অনেকে মুখ টিপে হাসে। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ বাংলাদেশেও রোজা ও ঈদ পালনের েেত্র মুসলমানেরা নানা দলে বিভক্ত হয়ে আছেন আজ বহু বছর ধরে; কোনো ঐক্য নেই। 

প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে চান্দ্রমাসের তারিখ নির্ধারণে অযৌক্তিক ভুল হলো এই ভুল সংশোধনের কাজ কে করবে? সরকার এই সমস্যার সমাধান করবে ‘জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটি’র মাধ্যমে নাকি বেসরকারি পর্যায়ে জনগণই নিজেদের উদ্যোগে এ কাজ করবে।  ‘সর্বধর্মীয় সমন্বয় কমিটি’র মাধ্যমে তা করা যায় কি না। আমার বিশ্বাস, এই ভুলের সংশোধন হওয়া প্রয়োজন এবং তা হওয়া উচিত বাড়তি কোনো সময় পেণ না করেই। একজন সাধারণ মুসলমান হিসেবে অবশ্যই আমার এ অধিকার আছে যে, আমি ধর্ম পালন করব বিশুদ্ধ নিয়মে, গোঁজামিলের হিসাবে নয়। সেই দাবিই আমি করছি। আমি কেবল সমস্যার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছি মাত্র। হিসাবে যে সমস্যা বা গোঁজামিল আছে তা স্পষ্ট। এ ব্যাপারে সমাধান দাবি করা আমার ধর্মীয় স্বাধীনতার অংশ। সমাধানের ব্যবস্থা করবেন ধর্মীয় নেতারা ও সমাজপতিরা সবাই মিলে। 
এবার সর্বশেষ ঘটনাটি তুলে ধরছি। ৪ অক্টোবর ২০১৪, শনিবারের চান্দ্রমাসের হিসাবের দিকে ল করুন। বাংলাদেশের হিন্দু পণ্ডিতেরা বলছেন, এই দিনটি দশমী এবং দশমী উপলে তাদের যেসব বিশেষ ধর্মাচার রয়েছে তা তারা এদিন পালন করেছেন। অন্য দিকে বাংলাদেশের বৌদ্ধরাও বলছেন, এ দিনটি ছিল চান্দ্রমাসের দশম তারিখ। কেবল বাংলাদেশের মুসলমানদের হিসাব অনুযায়ী দিনটিকে বলা হচ্ছে ৮ জিলজ বা চান্দ্রমাসের আট তারিখ। দুই পরেই ভুল হতে পারে না, আবার দুই পই সঠিক এ কথাও বলার উপায় নেই। যদি বলা হয় যে, মুসলমানদের শুধু চাঁদের তিথি গণনা করলে চলে না বরং মাস গণনা শুরু করার জন্য দিকচক্রাবলের ওপরে নবউদিত চাঁদ দৃশমান হতে হয়, যে বাধ্যবাধকতা অন্য ধর্মে নেই। তারপরও দুই পরে হিসাবে পার্থক্য হতে পারে বড়জোর এক দিন। এরপরও দেখুন, আরবি মাস গণনায় আরবিরা নিশ্চয় ভুল করেনি এবং তারা বলেছে ‘শনিবার হলো ১০ জিলজ’ এবং সে অনুযায়ী সমগ্র আরবে শনিবারেই ঈদুল আজহা পালিত হলো। তাদের সাথে আমাদের সময়ের ব্যবধান মাত্র তিন ঘণ্টার। তাই ঈদও হওয়ার কথা হয়তো একই দিন অথবা এক দিন পর। যখন আমাদের হিসাব বলছে ব্যবধান দুই দিনের, তখন বুঝতে বাকি থাকে না ‘নিশ্চয়ই হিসাবে কোনো সমস্যা আছে’। আরবে শুক্রবার ছিল ৯ জিলহজ, পবিত্র আরাফার দিন। আমরা টিভিতে দেখছি সম্মানিত হাজী সাহেবানরা আরাফার ময়দানে সমবেত হয়েছেন; কিন্তু শুক্রবারকে আমরা আরাফার দিন বলছি না, নানা যুক্তিতে। তাই বলে শনিবারকেও আমরা আরাফার দিন বলতে পারব না কেন? আরাফার দিবসের সম্মানে আমরা রোজা রাখব দুই দিন পর? কেন? ঈদ পালনের ঠিক দুই দিন পরই আকাশে দেখা গেল পূর্ণিমার চাঁদ। পাশের দেশ মিয়ানমারেও পূর্ণিমা উপলে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান হলো। অথচ বাংলাদেশে আমরা চাঁদকে উপো করে, অন্যদের চান্দ্র হিসাবকে উপো করে, মসজিদে বসে ১২ জিলহজের তাকবির পাঠ করছি। 

এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনার জন্য অনেক চিন্তক-গবেষক আমাদের সমাজেই আছেন। আবার ব্যাপারটা যে বিজ্ঞানের অতি সূক্ষ্ম কোনো বিষয় বা আধ্যাত্মিক উচ্চ মার্গের কোনো পাঠ তাও নয়। তবু কেন আমরা এমন একটি বিভ্রান্তি লালন করব? একই চাঁদকে কেউ বলবে ‘আজ হলো পূর্ণিমা তিথি’ অর্থাৎ আজ চাঁদের বয়স পনের দিন আর অন্যরা বলবে ‘ওই দেখো! এটা দ্বাদশীর চাঁদ’ অর্থাৎ আজ চাঁদের বয়স বারো দিন মাত্র, এটা তো হতে পারে না! আমাদের ঐকমত্যে পৌঁছাতেই হবে। এখন প্রয়োজন জ্ঞানভিত্তিক আলোচনার, তথ্য-উপাত্ত নিয়ে যুক্তি-তর্ক ও তর্ক-বিতর্কের এবং পরিশেষে একটি সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর। এটি আমাদের পে অবশ্যই সম্ভব।

পূর্ণাঙ্গ একটি চন্দ্র-পরিক্রমার সময়কাল কখনো ত্রিশ দিনের বেশি নয়, বরং কয়েক ঘণ্টা কম। ফলে পনের দিন পূর্ণ হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগেই চাঁদ তার পূর্ণ পরিক্রমার মধ্য গগনে অবস্থান করে এবং পরিপূর্ণরূপে প্রকাশ পায়। ওই অবস্থাকেই আমরা বলি ‘পূর্ণিমা’। এই অবস্থাটা এক দিন আগেও সম্ভব নয়, এক দিন পরেও নয়। বারো বা তেরো তারিখের চাঁদকে তো অবশ্যই ‘পূর্ণিমার চাঁদ’ বলা যাবে না। এই সূত্র ধরে এগোলেই আশা করি আমরা সমাধানের পথ পেয়ে যাবো ইনশাআল্লাহ্। তখন আর কেউ আমাদের বলতে পারবে না, আমরা ভুল করেই ঈদের দিনে রোজা রাখার মতো হারাম কাজ করছি বা সঠিক ‘আরাফার দিন’কে চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হচ্ছি।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা ও গবেষক 
প্রিন্সিপাল, আর্ক ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ধানমন্ডি। 
ই- মেইল : ashr54@gmail.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন