রবিবার, ৮ জুন, ২০১৪

সংখ্যালঘুবিষয়ক মন্ত্রণালয় ভারতের ‘টোকেন’

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার সংখ্যালঘুবিষয়ক একজন মন্ত্রী নিয়োগ দিয়ে থাকে; কিন্তু এটা সংখ্যালঘুদের জন্য হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবার লোকসভা নির্বাচনের প্রচারণার সময়ে নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, আমি ভারতের সোয়া শ’ কোটি মানুষের সবার প্রধানমন্ত্রী হবো। অপর দিকে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতীয় মুসলমান সম্প্রদায় এত বেশি হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে যে, সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুদের সমান অধিকার দেয়ার শুধু আশ্বাসটাও তাদের কানে সঙ্গীতের মতো সুমধুর মনে হয়েছে।
কংগ্রেস স্বাধীনতার পর ছয় দশক ধরে মুসলমানদের জন্য কতটুকু করেছে, তা ২০০৬ সালে প্রকাশিত সাচার কমিটির রিপোর্টে স্পষ্ট। এ রিপোর্টে মুসলিম সম্প্রদায় দেখতে পেয়েছে নিজের ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন আর ক্ষয়ে যাওয়া চেহারা। পরিস্থিতির এতটাই অবনতি হয়েছিল যে, কংগ্রেস কিছু করার ভান-ভনিতার চেয়ে বেশি উদ্যোগ নেয়নি। দলটি ব্যাপক প্রচারণাসমেত রিলিফ ক্যাম্প বসিয়েছে মুসলমানদের দুর্ভোগ কিঞ্চিৎ কমাতে; অন্য দিকে গঠন করেছে সংখ্যালঘু কমিশন। আর যখন দেখেছে নির্বাচন সমাগত, তখন মুসলমানদের জন্য শ’খানেক দফার কর্মসূচি প্রচারে শহরে শহরে লোক নিয়োগ করেছে। নির্বাচনী কৌশলের চূড়ান্ত ধাপ হলো, দিল্লির শাহী মসজিদের ইমাম সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ, যিনি সমর্থন দিতে সদা প্রস্তুত।
ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওয়াহের লাল নেহরু পরতেন শেরওয়ানি; যার বোতাম-ছিদ্রে শোভা পেত গোলাপফুল। তিনি উর্দুতে কথা বলতেন। সপ্তাহে একবার হলেও যেতেন মাওলানা আবুল কালাম আজাদকে দেখতে। নেহরু বামপন্থী মনোভাবাপন্ন আরবদের বন্ধু বানিয়ে ফেলেছিলেন। এসব দেখে ভারতের মুসলমানেরা ভাবতেন, আমাদের খুবই আপনজনদের একজনই এখন দেশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
এর আগে মহাত্মা গান্ধী মুসলমানদের দক্ষিণপন্থী অংশটার আস্থা অর্জন করেছিলেন। তুরস্কের খলিফাকে রক্ষা করার জন্য মাওলানা মোহাম্মদ আলী আহ্বান জানালেন। আর সমর্থন দিলেন গান্ধী।
কংগ্রেস নেতাদের এ ধরনের ভূমিকার নজির অনেক। ফলে মুসলমানেরা খেয়ালই করেনি যে, ১৯৪৯ সালেই বাবরি মসজিদের প্রধান গম্বুজের নিচে রামলীলা মূর্তিগুলোকে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। তখন নেহরুই ছিলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। এরপর বাবরি মসজিদ হয়ে গেল ‘বিতর্কিত কাঠামো’। পরবর্তীকালে এ মসজিদটি ভূমিসাৎ করা হয়েছে।
কংগ্রেসি নেতারা সেখানে গড়ে তোলা রামমন্দিরের তালা খুলে দিলেন নিত্যদিন পূজা-অর্চনার জন্য। এভাবে তারা ভারতীয় জনতা পার্টিকে বিপুল প্রেরণা জোগালেন। ১৯৮৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে কংগ্রেস ওয়াদা করেছিল ‘রামরাজ্য’ প্রতিষ্ঠার।
অপর দিকে মুসলমানদের জন্য উপহার ছিল কী কী? সালমান রুশদির ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ নিষিদ্ধ হলো; শাহ বানু মামলায় দেয়া সুপ্রিম কোর্টের রায় দেয়া হলো উল্টে; ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক উন্নত করার প্রক্রিয়া করা হয়েছিল মন্থর। বাস্তবে মুসলমানেরা লাভবান হয়েছে কতটা? তারা ক্রমেই আরো বিচ্ছিন্ন হতে থাকে ভারতের মূলধারা থেকে।
নামমাত্র নেয়া এসব পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে সংখ্যালঘুবিষয়ক মন্ত্রণালয় স্থাপন করার বিষয়টিও। ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে কংগ্রেস যে আন্তরিকতাহীন তা স্পষ্ট।
কংগ্রেসের কাছ থেকে প্রত্যাশা ছিল প্রচুর; কিন্তু হতে হয়েছে হতাশ। আর এই হতাশার ক্রমবর্ধমান মাত্রার পরিণামে ১৯৮৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মুসলমানেরা ক্রমাগত কংগ্রেস ত্যাগ করেছেন। এ ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব নয়।
যা হোক, এবার লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল মুসলমানদের মাঝে মনস্তাত্ত্বিক দ্বিমুখিতা সৃষ্টি করেছে। নির্বাচনে কংগ্রেস বিধ্বস্ত হওয়ার ব্যাপারে মুসলমানদের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। তবে বিজয়ী পক্ষ থেকেও আশা করার কিছু নেই। কংগ্রেস মুসলমানদের ভোটব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করেছে। তবে দলটির বিপর্যয়ে সন্তুষ্ট হওয়ার বিপরীতে মোদির ঘটেছে মহাউত্থান।
‘কুইন’ নামের একটি বিখ্যাত চলচ্চিত্রে অপ্রত্যাশিতভাবে একটার পর একটা ঘটনা ঘটে যায় এবং রানীর ভিত্তি হতে থাকে নড়বড়ে। তবুও তিনি পিছু হটতে রাজি নন, বরং সাহসের সাথে সে পথেই এগিয়ে গেলেন যে পথ তিনি স্বাভাবিক অবস্থায় অনুসরণ করতেন। ফলে পরিস্থিতি রানীর অনুকূল হয়ে গেল শেষ পর্যন্ত। 
ভারতের মুসলমানেরা দ্রুতগতিতে প্রস্তুত হচ্ছিল সমান অধিকারের নতুন চুক্তি সম্পাদনের জন্য; কিন্তু সংখ্যালঘুবিষয়ক মন্ত্রণালয় কার্যত ‘টোকেন’ বা সামান্য হওয়ায় মুসলিম সম্প্রদায় নিদারুণ হতাশ হয়েছে।
এ ধরনের কোনো মন্ত্রণালয় থাকলেই ধরে নিতে হয় সংখ্যালঘুরা বিশেষ কিছু সুযোগ সুবিধা ভোগ করবে, যে জন্য ঝামেলা পোহাতে হবে না।
ভারতে ‘টোকেন’স্বরূপ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। যেমনÑ নয়া দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ‘হজ টার্মিনাল’ রয়েছে। হজ বছরে একবারই হয়। বাদবাকি সারা বছর এটা মুসলমানদের কোনো কাজে আসছে না। এ দিকে, অমুসলিমদের মনে ক্ষোভ ও উত্তেজনা জন্ম নিচ্ছে। 
বিদেশ মন্ত্রণালয়ের অলিখিত নিয়ম, সৌদি আরবে ভারতের রাষ্ট্রদূতকে অবশ্যই মুসলমান হতে হবে। একটি দেশের ক্ষেত্রে এই সংরক্ষণনীতি অনুসরণের অর্থ কী? এর নেই বিশেষ কোনো ফায়দা। ওয়াশিংটন, মস্কো, বেইজিং এবং দুই শ’ দেশের রাজধানীতে মুসলিম কেউ রাষ্ট্রদূত হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
ভারতের পররাষ্ট্র সার্ভিসের (আইএফএস) আট শ’ অফিসারের মধ্যে বড়জোর এক শতাংশ মুসলমান। সৌদি আরবের ব্যাপারে যে নিয়ম অনুসরণ করা হচ্ছে, এতে মুসলিম কর্মকর্তারা একের পর এক প্রধানত সৌদি রাজধানীতেই নিয়োগ পাচ্ছেন।
পররাষ্ট্র ক্যাডারের একজন সদস্য সৈয়দ আকবরউদ্দীন। এখন তিনি ভারতের বিদেশবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র। তাকে যখন রিয়াদে রাষ্ট্রদূত করা হলো, তিনি যেতে আপত্তি করেছিলেন। কারণ এর আগে দুই দফায় তিনি সৌদি আরবে নিযুক্ত হয়েছিলেন; সেখানে তার কার্যকাল বাড়ানো হয়েছিল। এ অবস্থায় রাষ্ট্রদূত হামিদ আলী রাওয়ের ভাগ্য খুলে যায়। অবসর না দিয়ে তাকে এক বছরের এক্সটেনশন দেয়া হয়েছে। 
লেখক : ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক ও টিভি ভাষ্যকার এবং দিল্লির অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ডিস্টিংগুইশড ফেলো 
ভাষান্তর : মীযানুল করীম

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন