মঙ্গলবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০১২

সেই সব দিনের স্মৃতি ও বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতি



আমি ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাস থেকে ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত কলকাতায় ছিলাম। রাজশাহী ছেড়ে কলকাতায় যাওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলাম ৩০ মার্চ। এর কয়েক দিন আগে পড়েছিলাম এক ভয়াবহ বিপদে। আমাকে নাকি দেখে মনে হয়, আমি বাঙালি নই। আমি নাকি দেখতে বিহারিদের মতো। আমার রাজশাহী শহরের কাছে একটি গ্রামের নাম হলো সোনাইকান্দি। সেখানে আমাকে একদল লোক ধরে বলে, ‘এই বেটা বিহারি। একে মেরে ফেল।’ আমি বেঁচে গিয়েছিলাম আশ্চর্যজনকভাবে। ওই গ্রামের একজন ব্যক্তি আমাকে চিনতে পারেন। তিনি বলেন যে, ‘উনি বিহারি নন’। আমি বেঁচে যাই প্রাণে। দেশে থাকা আমার জন্য নানা কারণেই নিরাপদ ছিল না। আমার এক ভাই চাকরি করতেন কলকাতায়। মোটামুটি ভালো চাকরিই তিনি করতেন। আমি সিদ্ধান্ত নিই তার কাছে চলে যাওয়ার। একজন কনিষ্ঠভ্রাতা জ্যেষ্ঠভ্রাতার আশ্রয়ে যাওয়া ছিল খুবই স্বাভাবিক। ভারত সীমান্তে আমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় এক সীমান্তচৌকিতে। সীমান্তরক্ষীরা অবশ্য আমার সাথে কোনো প্রকার অশিষ্ট আচরণ করেননি। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শুনে আমার সাথে তারা করেছিলেন খুবই শিষ্ট আচরণ। তাদের একজন কর্মকর্তা বিশুদ্ধ বাংলায় আমাকে জিজ্ঞাসা করেনÑ আপনার কি মনে হয়, শেখ মুজিব পাকিস্তানি-কর্তৃপক্ষের হাতে ধরা পড়েছেন? আমি তার প্রশ্নের উত্তরে বলি, আসছি রাজশাহী শহর থেকে। ঢাকায় ঠিক কী ঘটেছে অথবা ঘটছে তা ঠাহর করতে পারছি না। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কলকাতায় আমি কোথায় থাকব। তাকে বলি, কলকাতায় আমার এক ভাই সরকারি চাকরি করেন। আমি তার কাছেই থাকব। ওই কর্মকর্তা আমাকে চা খাওয়ান ও ভারতে প্রবেশ করতে অনুমতি দেন। তিনি আমার কাছে যে পাকিস্তানি মুদ্রা ছিল, তা বদল করে প্রদান করেন ভারতীয় রুপি। কলকাতায় পৌঁছানোর দু’দিন পর, আমাকে কলকাতার একজন খুব বড় পুলিশ কর্মকর্তা ডেকে পাঠান। আমি যাই তার অফিসে। তিনি আমার সাথে করেন খুবই সৌজন্যমূলক ব্যবহার। আমার সাথে তার ব্যবহারে ছিল না কোনো উঁচু পুলিশ কর্মকর্তার রূঢ়তা। তিনিও আমাকে করেন একই প্রশ্নÑ আপনি কি মনে করেন, শেখ মুজিব পাক-কর্তৃপক্ষের হাতে ধরা পড়ে গিয়েছেন? জানি না, কেন জানি, এবার হঠাৎ আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, সম্ভবত গিয়েছেন। তিনি আমাকে প্রশ্ন করেনÑ কেন আমি এ রকম ভাবছি। আমি কথার মোড় ফেরানোর জন্য বলিÑ শেখ মুজিব আসলে হলেন গান্ধীবাদী। মহাত্মা গান্ধী ১৯৪২ সালে বলেছিলেনÑ ‘করেঙ্গে, ইয়া মরেঙ্গে’। কিন্তু শেষে তিনি ধরা দেন ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের হাতে। আমার মনে হলো, ওই পুলিশ কর্মকর্তা আমার উত্তর শুনে খুশি হলেন। পুলিশের খাতায় সম্ভবত আমাকে চিহ্নিত করলেন গান্ধীবাদী হিসেবে। ভারতে আমি যত দিন ছিলাম, পুলিশ আমাকে কখনো হয়রানি করেনি। আমার কাছে যেটা বিস্ময়কর ঠেকেছিল, তা হলো, পুলিশ কেন আমার কাছে জানতে চেয়েছিল শেখ মুজিব পাক-কর্তৃপক্ষের হাতে ধরা পড়েছেন কি না। কারণ তারা সেটা অন্য সূত্রে অবাধেই জানতে পারতেন। অনেক পরে আওয়ামী লীগের সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো এক ব্যক্তির মুখে শুনেছিলাম, শেখ মুজিবের আসার কথা ছিল ভারতে। কিন্তু তিনি যে কারণেই হোক, তার মত পরিবর্তন করেন। আর ভারত সরকার এ জন্য পড়ে যায় ধাঁধার মধ্যে। জানি না, কথাটা কত দূর সত্যি। তবে এ রকম কথা আরো দু-একজনকে বলতে শুনেছিলাম। তবে এ সম্পর্কে আমি সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলতে পারি না। সে সময় পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে চলছিল নকশাল আন্দোলন। একটি জিনিস দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম, তা হলো, কলকাতা পুলিশের রাইফেল তার কোমরের বেল্টের সাথে বিশেষভাবে বাঁধা থাকত। আমি আমার ভাইকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, পুলিশের কোমরের সাথে রাইফেল শিকল দিয়ে বাঁধা কেন? আমার ভাই আমাকে বলেছিলেন, এভাবে শিকল দিয়ে বাঁধার কারণ। নকশালরা যাতে পুলিশকে ধরে তাদের রাইফেল সহজে ছিনতাই করতে না পারে। আমি ভাইয়ের কাছে যে বাড়িতে থাকতাম সেখানে প্রাচীরের প্লাস্টারে ছিল বুলেটের চিহ্ন। নকশালরা একসময় সেখান দিয়ে কোনোখানে অপারেশন করে পালাচ্ছিল। আর পুলিশ ছুড়েছিল গুলি। নকশালরা চাচ্ছিল না ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ করুক। এক দিন আমি পড়েছিলাম কিছু নকশালপন্থীর হাতে। তারা চেয়েছিল আমাকে মেরে ফেলতে। কারণ তারা ধরে নিয়েছিল, আমি একজন আওয়ামী লীগপন্থী। কিন্তু আমি বেঁচে যাই একজন অধ্যাপকের হস্তক্ষেপের জন্য। তিনি বলেন, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। কিন্তু যারাই বাংলাদেশ থেকে আসছে, তারা সবাই রাজনীতির সাথে জড়িত নয়। যা-ই হোক, এ যাত্রায় আমি বেঁচে যাই। দেশে আমাকে লোকে ধরেছিল বিহারি হিসেবে মেরে ফেলার জন্য। কলকাতায় মারা যেতে পারতাম নকশালপন্থীদের হাতে ‘শ্রেণিশত্রু’ হিসেবে।
আজকাল অনেকেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক কিছু লিখছেন। যাদের লেখা পড়ে মনে হয়, মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটা খুবই সহজ ব্যাপার। কিন্তু সে দিনের পরিস্থিতি ছিল অনেক জটিল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার আত্মজীবনীমূলক লেখা অর্ধেক জীবন বইতে বলেছেন, তিনি একবার রাতে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো এক ঘাঁটিতে। সেখানে তিনি দেখতে পান, হ্যাজাক বাতি জ্বলছে। মুক্তিযোদ্ধারা খাচ্ছেন মুড়ি ও কাঁচালঙ্কা। পাশেই এক জায়গায় জড়ো করে রাখা হয়েছে একগাদা লাইট মেশিনগান (এলএমজি) আর হ্যান্ডগ্রেনেড। মুক্তিযোদ্ধারা কেউ অবহেলার সাথে সামনে ফেলে রাখছেন রিভলভার। গলায় ঝুলছে তাদের বুলেটের মালা। দূরে হঠাৎ হঠাৎ শোনা যাচ্ছে কামানের গর্জন। ১৯৭১ সালে আমার অভিজ্ঞতা হতে পেরেছিল সম্পূর্ণ ভিন্নরকম। ভারত সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে কোনো সাংবাদিক বা বাইরের লোককে দেখা করতে দিতেন না। গুলিগোলা, অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে দেয়া হতো যথেষ্ট হিসাব করে। মুক্তিযোদ্ধাদের কখনো তদানীন্তন পূর্ব পাবিস্তানে অস্ত্র হাতে পাঠানো হতো না। তাদের সাথে সবসময় থাকত ভারতীয় কমান্ড বাহিনীর লোক। তাদের কাছ থেকে অস্ত্র ও গুলি নিয়ে ছুড়তে হতো তাদের। গুলি, হ্যান্ডগ্রেনেড, এলএমজি সব কিছুরই থাকত হিসাব। কারণ অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ সহজেই নকশালদের হাতে চলে যেতে পারে। এ রকমই মনে করত ভারত সরকার। জানি না, কী করে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার বইয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ওরকম বিবরণ দিতে পেরেছেন। মুক্তিযোদ্ধারা কখনোই সীমান্তে রাতের বেলা হ্যাজাক বাতি জ্বালিয়ে খাওয়াদাওয়া করতেন না। কারণ কামানের গোলা সহজেই এসে পড়তে পারত তাদের ওপর। মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযান পরিচালিত হতো যথেষ্ট গোপনীয়তার সাথে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মুক্তিযোদ্ধাদের তুলনা করেছেন অন্য দেশের গেরিলাদের সাথে। কিন্তু ১৯৭১ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে যেসব গেরিলা অভিযান হয়েছে তাতে অংশ নিয়েছেন ভারতের কমান্ড বাহিনীর লোক। আর গেরিলাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া হয়েছে যথেষ্ট সাবধানতার সাথে। এসব জানতে পেরেছিলাম আমার কয়েকজন ছাত্রের কাছ থেকে। তারা কিছুটা জড়িয়ে পড়েছিল গেরিলা অভিযানে। তারা আমাকে বলেছিল এসব কথা। তারা আমাকে বলেছিল, আসলে মুক্তিযুদ্ধে তাদের কোনো স্বাধীন ভূমিকা নেই। সব কিছু নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে ভারতীয় সেনাবাহিনীর লোকদের তত্ত্বাবধানে।
১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বরে শুরু হয় পাক-ভারত যুদ্ধ। ৪ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে আনে এই যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব। কিন্তু ৫ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন এই প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট প্রদান করে। ফলে প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যায়। ৭ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিয়ে যায় জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে। সাধারণ পরিষদে মার্কিন প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। কিন্তু ভারত এই প্রস্তাব মানতে সম্মত হয়নি। ১৩ ডিসেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন সপ্তম নৌবহরকে ভিয়েতনাম থেকে বঙ্গোপসাগরে যাত্রা করতে নির্দেশ দেন। ১৪ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র আবার একটি যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব ওঠায় নিরাপত্তা পরিষদে। কিন্তু এবারো সেই প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায় সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটো দেয়ার কারণে। সপ্তম নৌবহর এগিয়ে আসতে থাকে বাংলাদেশের তীরভূমির দিকে। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকায় রমনা ময়দানে আত্মসমর্পণ করে। এখন বলা হচ্ছে, ওদের এই আত্মসমর্পণ ছিল নিঃশর্ত। কিন্তু বাস্তবে তা ছিল না। পাক বাহিনী বলে, তারা কেবল ভারতীয় বাহিনীর কাছেই আত্মসমর্পণ করবে, বাংলাদেশের মুক্তি বাহিনীর কাছে নয়। ১৬ ডিসেম্বরে যা ঘটেছে তার নেপথ্যে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ চাপ। যে সম্পর্কে আমরা এখনো যথেষ্ট অবগত নই। কিন্তু এই আত্মসমর্পণ ব্যাপারটি অত নিঃশর্ত ছিল না। মুক্তি বাহিনীর প্রধান সেনাপতি মুহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানী রমনার রেসকোর্স মাঠে উপস্থিত থাকতে চেয়েছিলেন, আত্মসমর্পণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার সময়। কিন্তু তাকে আটকে রাখা হয় কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে। আত্মসমর্পণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ভারতীয় উপসেনাপতি জগজিৎ সিং অরোরা এবং পাকিস্তানের উপসেনাপতি এ এ কে নিয়াজীর মধ্যে। এভাবে ঘটে ১৯৭১-এর পাক-ভারত যুদ্ধের অবসান। নিয়াজির আত্মসমর্পণের পর ১৭ তারিখে ভারত পশ্চিম রণাঙ্গনে এককভাবে ঘোষণা করে যুদ্ধবিরতি। সে যদি ইচ্ছা করত, তবে পশ্চিম রণাঙ্গনে যুদ্ধ চালিয়ে যেতেই পারত। কিন্তু মার্কিন চাপে তাকে পশ্চিম রণাঙ্গনে বাধ্য হতে হয় যুদ্ধ স্থগিত করতে। এসব কথা শুনেছিলাম কলকাতায় নানা সূত্র থেকে। সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে আসার পর সারা ভারতে সৃষ্টি হয়েছিল মারাত্মক প্রতিক্রিয়া। ভারতের সাধারণ মানুষ চাচ্ছিল না, ভারত জড়িয়ে পড়–ক একটা বড় রকমের যুদ্ধে। অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে, নিক্সন কেন বঙ্গোপসাগরে পাঠিয়েছিলেন সপ্তম নৌবহর। এর দু’টি কারণ ছিল। একটি কারণ হলো, তাজউদ্দীন সরকার সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল চট্টগ্রাম বন্দরে সোভিয়েত সাবমেরিন ঘাঁটি গড়তে দেয়ার জন্য। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সেটা মোটেও গ্রহণযোগ্য ছিল না। দ্বিতীয়ত, ১৯৫৪ সালে ১৯ মে পাকিস্তানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের হয়েছিল Mutual Defence Assistance Agreement। এই চুক্তিতে ছিল, পাকিস্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তার প্রতিরক্ষার ব্যাপারে সহায়তা করবে। আর যুক্তরাষ্ট্র প্রয়োজনে পাকিস্তানকে প্রতিরক্ষার ব্যাপারে সাহায্যে এগিয়ে আসবে। পাকিস্তান এই চুক্তির ওপর ভিত্তি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সাহায্য চেয়েছিল। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে এসেছিল পাকিস্তানকে সাহায্য করতে। পাকিস্তান ভারতীয় উপসেনাপতি জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। এর ফলে যুদ্ধটা হয়ে যায় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। এতে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর ভূমিকা কোনো স্বীকৃতি পেতে পারেনি। এর ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। ১৯৭২ সালের ৩ জুলাই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে হয় সিমলা চুক্তি। যেহেতু যুদ্ধটা হয়ে দাঁড়ায় ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ, তাই সিমলা সম্মেলনে বাংলাদেশকে ডাকা হয়নি। এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় কেবল ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে। সিমলা চুক্তিতে সই করেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। শোনা যায় ইন্দিরা গান্ধী ভুট্টোর কাছে ওঠান যুদ্ধাপরাধীর বিচার প্রসঙ্গ। জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, যুদ্ধাপরাধ ঘটে থাকলে তা ঘটেছে বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও। যেমন বাংলাদেশ রাইফেলসের লোকেরা পাকিস্তানের অফিসারদের ধরে মেরে ফেলেছে। এভাবে অফিসারদের ধরে বন্দী করে মারা জেনেভা কনভেনশন অনুসারে বিবেচিত হতে বাধ্য যুদ্ধাপরাধ হিসেবে। কারণ জেনেভা কনভেনশন অনুসারে যুদ্ধবন্দী নিধন, যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য। অন্য দিকে ১৯৭১-এ বহু নিরপরাধ বিহারিকে হত্যা করা হয়েছে। এই হত্যারও হতে হবে বিচার।’ ইন্দিরা গান্ধী দেখেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে হলে দেখা দেবে গুরুতর আইনি জটিলতা। তিনি তাই যুদ্ধাপরাধী প্রসঙ্গটি বাদ দেন। পাকিস্তানের সাথে স্বাক্ষরিত হয় ভারতের শান্তিচুক্তি। আর ১৯৪৯ সালের জেনেভা কনভেনশনের ১১৮ ধারা অনুসারে ৯০ হাজার পাক যুদ্ধবন্দীর সবাইকে দেন মুক্তি। পাক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতে পারেনি। এখানে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে, যা ঘটেছিল অনেক পরে। নিয়াজী আত্মসমর্পণ করেছিলেন অরোরার কাছে। নিয়াজী ও অরোরা ইংরেজ আমলে একই সামরিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষিত হয়েছিলেন। উভয় উভয়কে আগে থেকেই চিনতেন। তারা ছিলেন পরস্পরের বন্ধু। অরোরা হিন্দু ছিলেন না। ছিলেন শিখ। তিনি সমর্থন করতেন স্বাধীন শিখ রাষ্ট্রের দাবি। অরোরা চাননি বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি করতে। তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীকে পরিচালনা করেছিলেন খুবই সাবধানে, যাতে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অনেক কয়েক বছর পর আরম্ভ হয় শিখদের খালিস্তান আন্দোলন। শিখরা চান স্বাধীন হতে। ইন্দিরা গান্ধী শিখদের এই আন্দোলনকে দমন করেন কঠোরহস্তে ও সেনাবাহিনীর সাহায্যে। এতে অনেক শিখ নিহত হন। শিখরা এর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যা করে। জগজিৎ সিং অরোরা ছিলেন খালিস্তান আন্দোলনের সমর্থক। ভারত এখন তাই ১৯৭১-এর যুদ্ধের বিষয় আলোচনা করার সময় সেনাপতি অরোরার কথা আর বেশি আলোচনা করতে চায় না। ভারতের সেনাবাহিনীতে একসময় শতকরা ৩০ ভাগ ছিল শিখ সৈন্য। এখন আছে শতকরা মাত্র ১০ ভাগের কম। এর কারণ, ভারতের সেনাবাহিনীতে এখন শিখদের আর আগের মতো গ্রহণ করা হচ্ছে না। বিশ্বাস করা হচ্ছে না শিখদের। বাংলাদেশ হওয়ার পর, বাংলাদেশের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে শিখরা বিশেষভাবে চেয়েছিল স্বাধীন হতে। শিখরা স্বাধীন হতে পারেনি কিন্তু সেই সম্ভাবনা এখনো রয়েছে। একইভাবে বাংলাদেশের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলাদেশের লাগোয়া ভারতের আসাম অঙ্গরাজ্য হতে চাচ্ছে স্বাধীন। ভারতের জাতিসত্তার সমস্যা এখনো সমাধান পেতে পারেনি। ভারতের রাজনৈতিক মানচিত্র ভবিষ্যতে কী দাঁড়াবে তা বলা যায় না। সাবেক পাকিস্তান ভেঙে পড়েছে। ভারতের কিছু অংশ ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতেই পারে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ফলে, ভারতের জাতিসত্তার সমস্যা হয়ে উঠেছে আগের তুলনায় আরো অনেক জটিল। আমার মনে পড়ে, ১৯৭১ সালে কলকাতার বহু বাঙালি সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সভা সমিতিতে বিবৃতি দিয়েছিলেন। লিখেছিলেন অনেক কিছু। খ্যাতনামা সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু বাংলাদেশের পক্ষ নিয়ে কিছু লিখতে অথবা বলতে রাজি হননি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ যেভাবে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে স্বাধীন রাষ্ট্র গড়তে চাচ্ছে, তা বাস্তবায়িত হলে ভারতের অনেক অঞ্চলেও একই রকম দাবি উঠবে। আর ভেঙে পড়বে ভারত। যেটা তিনি চান না। এ সময় কলকাতায় বুদ্ধদেব বসুকে বাংলাদেশের দাবিকে সমর্থন না করার জন্য যথেষ্ট নিন্দা কুড়াতে হয়েছিল।
১৯৭১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন এগিয়ে এসেছিল ভারতের সাহায্যে। ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছিল ২৫ বছরের মৈত্রী চুক্তি। তখন কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি, বিরাট শক্তিধর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়তে যাচ্ছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার মূলে অনেক কারণ আছে। এর মধ্যে একটি কারণ হলো, জাতিসত্তার সমস্যার সমাধান না করতে পারা। অনেক কিছুই ঘটেছে ১৯৭১ সালের পর। পৃথিবীর রাজনৈতিক অবস্থা এখন বিশেষভাবেই বদলে গিয়েছে। ১৯৭১-এ চলেছিল ঠাণ্ডা লড়াই। কিন্তু এখন আর সেই পরিস্থিতি নেই। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবে, ভারত এ কথা ভাবতে পারেনি। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর ভারত ঝুঁকে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। তার এই ঝুঁকে পড়ার একটি কারণ হচ্ছে মার্কিন সহায়তায় চীনকে পাল্লা দেয়া। কিন্তু বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একমত হতে পারছে না। ভারত বলছে, বাংলাদেশে গজিয়ে উঠছে জঙ্গি ইসলাম। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলছে, বাংলাদেশের ইসলামি চেতনা হলো অনেক উদার। বাংলাদেশের ইসলামি চেতনা মোটেও জঙ্গি নয়। তা হলো, মডারেট ইসলাম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাই বলছে, বাংলাদেশে ইসলামি শক্তির বিরুদ্ধে তৎপরতা না চালিয়ে তাদের সাথে আপস রফা করে চলতে। কিন্তু আওয়ামী লীগ জঙ্গি ইসলামের কথা বলে পেতে চাচ্ছে ভারতের বিশেষ সমর্থন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে বাংলাদেশ থাকুক তার প্রভাব বলয়ে। বাংলাদেশের মাধ্যমে সে পারবে অন্যান্য মুসলিম দেশকেও প্রভাবিত করতে। বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারত-মার্কিন মতানৈক্য এখন বেশ প্রকট হয়েই উঠছে।
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকার করতে চাচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। আওয়ামী লীগের অনেক নেতা বলছেন স্ববিরোধী কথা। এক দিকে তারা বলছেন, বাংলাদেশে জামায়াত থাকতে পারবে না। কারণ জামায়াত ১৯৭১ সালে চায়নি বাংলাদেশের স্বাধীনতা। করেছে পাক বাহিনীর সাথে সহযোগিতা। আবার একই সাথে তাদের বলতে শোনা যাচ্ছে, তারা জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পক্ষে নন। তাদের মুখে একই সাথে শোনা যাচ্ছে দু’রকম কথা। তারা সব জামায়াত নেতাকে এখন দাঁড় করাচ্ছেন বিচারের কাঠগড়ায়। কিন্তু এই বিচার নিয়ে দেশ-বিদেশে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন। গঠন করা হয়েছে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু এতে নেই কোনো আন্তর্জাতিক আদালতের বিচারক। এই ট্রাইব্যুনাল কোনো আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতে গঠিত হয়নি। গঠিত হয়েছে বাংলাদেশের নিজস্ব আইনের ভিত্তিতে। তাই এই ট্রাইব্যুনাল নিয়ে দেখা দিয়েছে আন্তর্জাতিক মহলে একাধিক জিজ্ঞাসা। আমরা আইনের লোক নই। কিন্তু বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় দেখতে পাচ্ছি এই বিচার সম্পর্কে নানা বিরূপ মন্তব্য। জানি না এত দিন পরে এই বিচারের সার্থকতা কোথায়? এখানে কিছু কথা উল্লেখ করা যেতে পারে, জামায়াতে ইসলামী নেতাদের ফাঁসি দিলেই কি দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী বিলুপ্ত হয়ে যাবে?
মিসরের শাসকেরা একসময় হাসান আল-বান্নাকে খুন করে (১৯৪৯; ১২ ফেব্রুয়ারি) ভেবেছিল, ইসলামি ভ্রাতৃসঙ্ঘকে (ইখওয়ান-আল-মুসলিমিন) বিলুপ্ত করা যাবে। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। কারণ ভ্রাতৃসঙ্ঘ কেবল ক্ষমতার রাজনীতি করেনি। তারা মানুষের সাথে থাকতে চেয়েছে তাদের বিপদে-আপদে। করেছে সমাজসেবা ও শিক্ষাবিস্তার। গড়েছে ব্যাংক ও বীমা কোম্পানি, যার মাধ্যমে দরিদ্র জনসাধারণ পেতে পেরেছে তাদের রুজি-রোজগারের জন্য দোকান পসরা গড়ার লক্ষ্যে আর্থিক সহায়তা। এসব কারণে ইসলামি ভ্রাতৃসঙ্ঘকে বিলুপ্ত করা যায়নি। বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামও ভ্রাতৃসঙ্ঘের মতো একটি দল। তাদেরও কর্মনীতি ইসলামি ভ্রাতৃসঙ্ঘেরই মতো। আসলে জামায়াতে ইসলামীকে বলতে হয় একটি আন্তর্জাতিক দল, যার ওপর রয়েছে মুসলিম উম্মাহর সাধারণ সহানুভূতি। জামায়াতকে তাই অত সহজে খতম করা যাবে না। ভারত যদি আওয়ামী লীগকে এই কাজে সহায়তা প্রদান করে চলে, তাহলে সারা মুসলিম বিশ্বে সৃষ্টি হবে ভারতবিরোধী প্রতিক্রিয়া। ভারত শেষ পর্ষন্ত সেটা চাইবে বলে মনে হয় না। ভারত কী করবে, সেটা ভারতের ব্যাপার। তবে বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে ভারতকে ভাবতে হচ্ছে নানা কথা। সে যদি বাংলাদেশের ঘরোয়া রাজনীতিতে বেশি নাক গলাতে চায়, তবে সেটা পছন্দ হবে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। পছন্দ হবে না চীনের। ১৯৭১ সালে চীন পাকিস্তানকে সরাসরি সেনা-সমর্থন দিতে পারেনি। কারণ সোভিয়েত ইউনিয়ন চীন সীমান্তে ঘটিয়েছিল বিরাট সেনাসমাবেশ। রাশিয়া এখনো একটি বিরাট সামরিক শক্তি। কিন্তু এখন সে ভারতের হয়ে চীনের সাথে বিবাদে লিপ্ত হতে চাইবে বলে মনে করার আর আগের কারণ নেই। পৃথিবীর রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশেষভাবেই বদলে গেছে। রাশিয়া এখনো ভারতের কাছে সামরিক অস্ত্র বিক্রি করতে পারে। কিন্তু সামরিক অস্ত্র বিক্রি আর ভারতের হয়ে চীনের সাথে যুদ্ধ করা সমার্থক নয়।
অনেক কিছুই আমার হিসাবে মেলে না। মুক্তিযুদ্ধের অনেক ইতিহাস পড়ছি, যা পড়ে আমার মনে জাগছে বহু জিজ্ঞাসা। বলা হচ্ছে, ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশে করা হয়েছিল বুদ্ধিজীবী হত্যা। বুদ্ধিজীবী হত্যা কে বা কারা করেছিল, আমার জানা নেই। কিন্তু মুনীর চৌধুরীর মতো ব্যক্তিকেও তারা খুন করেছিল। মুনীর চৌধুরী ছিলেন চীনপন্থী কমিউনিস্ট। চীনপন্থী কমিউনিস্টরা ১৯৭১ সালে চাননি, সাবেক পাকিস্তান ভেঙে যাক। তারা কার্যত সহযোগিতা করেছিলেন পাক কর্তৃপক্ষের সাথে। বলা হচ্ছে, আলবদর, রাজাকার মুনীর চৌধুরীকে খুন করেছে। কিন্তু আলবদর, রাজাকারেরা ১৯৭১ সালে কোনো চীনপন্থী কমিউনিস্টকে শত্রু ভাবেনি। বরং ভেবেছে মিত্র। তারা কেন মুনীর চৌধুরীকে খুন করতে যাবে সেটা আমার হিসাবে মেলে না। মুনীর চৌধুরীর মৃত্যু হয়ে আছে রহস্যঘেরা। কিন্তু তার এই মৃত্যুকে নিয়ে কোনো অনুসন্ধান হচ্ছে বলে আমার জানা নেই। জহির রায়হান ছিলেন একজন চীনপন্থী কমিউনিস্ট। তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে যুদ্ধ শেষে কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরে। কারা তাকে কী কারণে হত্যা করেছে, আমরা তা জানি না। তবে যখন তিনি নিহত হন, তখন সারা দেশ ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে, পাকিস্তানি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে নয়। জহির রায়হানের সাথে আমার কোনো ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না। প্রথম পরিচয় ঘটে কলকাতায় ১৯৭১ সালে কোনো এক ঘরোয়া সভায়। সভাটা হচ্ছিল সম্ভবত খ্যাতনামা লেখিকা মৈত্রেয়ী দেবীর বাড়িতে। সেখানে রায়হানও উপস্থিত ছিলেন। রায়হানকে খুব উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল। আমি তার কাছে উপবিষ্ট ছিলাম। আমাকে তিনি বলেন, কলকাতায় তিনি বিনা প্রস্তুতিতেই এসে পড়েছেন। আমি কি তাকে কোনো আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দিতে পারি? তাকে কয়েক সপ্তাহের জন্য একটা সুন্দর ফ্যাট বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পেরেছিলাম। এরপর অবশ্য তার সাথে সাাতের কোনো সুযোগ পাইনি। রায়হান পরে তার নিজের আবাসনব্যবস্থা ভালোভাবেই করে নিতে পেরেছিলেন। জহির রায়হানের মৃত্যুতে দুঃখিত হয়েছিলাম। যতদূর জানি জহির রায়হানের মৃত্যু নিয়েও কেউ অনুসন্ধান করতে চাচ্ছে না। মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট বলে পরিচিত কোনো সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীর মৃত্যু ঘটেনি মুনীর চৌধুরী ও জহির রায়হানের মতো। তাই বিষয়টি নিয়ে আমার মনে মাঝে মাঝে জাগে বেশ কিছু জিজ্ঞাসা। আমি কোনো গবেষক নই। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে ছিলাম কলকাতায়। সে সময় ট্রামে বাসে অনেক কথা শুনেছি। মানুষ ভাবত, বাংলাদেশে যদি যুদ্ধ প্রলম্বিত হয়, তবে চীনপন্থী কমিউনিস্টরা এসে যেতে পারে ক্ষমতায়। কারণ আওয়ামী লীগের তেমন কোনো সংগঠন নেই। দুর্বল হওয়া পাক বাহিনী পারবে না চীনপন্থী কমিউনিস্টদের মুক্ত অঞ্চল গঠনের চেষ্টাকে ঠেকাতে। আর সে উদ্দেশ্যেই চীনপন্থীরা বাংলাদেশে কাজ করছে। বাংলাদেশে চীনপন্থীরা সাফল্য পেলে পশ্চিম বাংলায় নকশালরা হয়ে উঠবে প্রচণ্ড শক্তিশালী। যতগুলো কারণে ইন্দিরা গান্ধী চেয়েছিলেন বাংলাদেশের যুদ্ধের দ্রুত সমাপ্তি, তার মধ্যে এই নকশালভীতি ছিল অন্যতম। ১৯৭১ সালে কেউ জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে মাথা ঘামায়নি; চিন্তিত হয়েছে চীনপন্থী কমিউনিস্টদের নিয়ে। কিন্তু আজ কেবল বলা হচ্ছে, জামায়াতে ইসলামী ছিল পাক কর্তৃপক্ষের সহযোগী। আর তাদের কারণেই ১৯৭১-এর যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে প্রায় ৩০ লাখ লোক। এই হিসাবটা কত দূর সত্যি, সেটা নিয়েও উঠছে অনেক প্রশ্ন। কারণ এই হিসাব অনুসারে সেই সময়ের বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রতি ২০ জনের মধ্যে একজনের মৃত্যু ঘটেছে যুদ্ধের ফলে। যেটাকে মনে হচ্ছে না অনেক ঐতিহাসিকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য বলে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, বাংলাদেশে শিশুদের পাক বাহিনী হত্যা করেছে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে। কিন্তু পাক বাহিনী ১৯৭১ সালে যেসব অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেছে, তাতে বেয়নেট থাকত না। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে শিশু মারার কাহিনীকে তাই যথার্থ বলে গ্রহণ করার কোনো কারণ আছে বলে অনেকেই মনে করেন না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন একজন নামকরা সাহিত্যিক। তিনি তার বইতে লিখেছেনÑ তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য চাঁদা তুলেছেন, ওষুধপত্র জোগাড় করে সরবরাহ করেছেন। কিন্তু এটা সে দিন সম্ভব ছিল না। কারণ ভারত সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে উঠাবসা করতে দেয়নি বাইরের লোকদের। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে গিয়ে লিখেছেন বেশ কিছু গালগল্প।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করা হচ্ছে বলে আমরা অনেক কিছু শুনছি। আমরা চাই মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস লেখা হোক; আমরা যাতে জানতে সমর্থ হই, ১৯৭১ সালে আসলে কী ঘটেছিল। কলকাতায় ছিলাম ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত। শেখ মুজিব পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পান ১৯৭২ সলের ৩ জানুয়ারিতে। তিনি পাকিস্তান থেকে ভারত হয়ে বাংলাদেশে না এসে ৮ জানুয়ারি পাকিস্তান থেকে যাত্রা করেন লন্ডনে। সারা ভারতে তখন গুজব রটে যে, শেখ মুজিব জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে করেছেন বিশেষ ধরনের এক চুক্তি; যার ফলে সাবেক পাকিস্তান, ভারতের পরিকল্পনা অনুসারে যাচ্ছে না ভেঙে পড়তে। অনেককে ওই সময় বলতে শুনেছি, পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরু সৃষ্টি করেছিলেন একটি পাকিস্তান; আর তার কন্যা শ্রীমতী গান্ধী সেটাকে ভেঙে দিয়ে সৃষ্টি করলেন ভারতের পশ্চিম ও পুবে কার্যত দু’টি পাকিস্তান। ভারত এতে লাভবান হতে পারল না।’
এবার ভারতের হাইকমিশনারকে ক’দিন আগে বলতে শোনা গেল, ভারত কখনোই বাংলাদেশে কোনো স্বাধীনতাবিরোধী, শক্তির অভ্যুত্থান ঘটুক, তা চায় না। ভারত বাংলাদেশে কোনো স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে সহায়তা দেবে না। ভারতের হাইকমিশনার বাংলাদেশের কোনো জনসভায় এসে এভাবে বক্তৃতা করতে পারেন কি না, সেটা নিয়ে উঠানো যায় প্রশ্ন। কিন্তু ভারত যদি বাংলাদেশের ঘরোয়া রাজনীতিতে খুব বেশি হাত খেলাতে চায়, তবে বাংলাদেশের মানুষ হয়ে উঠবে ভারতবৈরী। বাংলাদেশের মানুষ ভাববে, ভারত হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় স্বাধীনতাবিরোধী। ‘১৯৭১ সালে ভারতীয় সৈন্য ভারতের সীমান্ত থেকে ঢাকায় পৌঁছতে পেরেছিল মাত্র ১৪ দিনে। অনেকে ভারতীয় সৈন্যের এই সাফল্যকে তুলনা করতে চান, ১৯৪০ সালে হিটলারের ফৌজের ফরাসি দেশের রাজধানী পারি দখলের সাথে। হিটলারের সৈন্য মাত্র ১৪ দিনে ফ্রান্সে ঢুকে পারি দখল করতে পেরেছিল। কিন্তু ভারতীয় সৈন্যের দ্রুতগতিকে হিটলারের ঝটিকা বাহিনীর দ্রুতগতির সাথে সম্ভবত এক করে দেখা যায় না। ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার আর এন মিশ্র বলেছিলেন,  ভারতীয় বাহিনী দ্রুত বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে যেতে পারার কারণ, বাংলাদেশের মানুষের সহযোগিতা পাওয়া। বাংলাদেশের মানুষ ভারতের সৈন্যদের খাদ্য দিয়ে সাহায্য করেছে। নৌকা দিয়ে সাহায্য করেছে নদী ও জলাভূমি পার হতে। খবর এনে দিয়েছে পাক বাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে, পাক বাহিনী কোথায় কোথায় স্থলমাইন পেতে রেখেছে, সে সম্বন্ধে। ফলে বেঁচে যেতে পেরেছে বহু ভারতীয় সৈন্যের জীবন। ব্রিগেডিয়ার মিশ্র তার সৈন্য নিয়ে প্রথম ঢাকায় প্রবেশ করেন। তার আগে ভারতের কোনো সৈন্য অন্য কোনো ব্রিগেডিয়ারের নেতৃত্বে ঢাকায় প্রবেশ করেনি। ব্রিগেডিয়ার মিশ্রের বক্তব্য তাই যথেষ্ট গুরুত্ববহ। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের ইতিহাস রচনা করার সময় মিশ্রের উক্তি মনে রাখা প্রয়োজন। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হতে পেরেছিল কেবল পশ্চিম রণাঙ্গনে। পূর্ব রণাঙ্গনে ভারত চায়নি যুদ্ধ করতে। কারণ এ সময় ভারতের প্রতি বাংলাদেশ অর্থাৎ তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ ছিল না সহানুভূতিশীল। ভারত তাই সেই সময় চায়নি দুই ফ্রন্টে যুদ্ধে জড়াতে। ভারতের সেনাবাহিনী খুব রণনিপুণ নয়। ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধে ভারতকে চীনের হাতে শোচনীয় পরাজয় বরণ করতে হয়েছিল। যুদ্ধ শেষে চীনারা ভারতকে ফেরত দেয় ভারতের যেসব অস্ত্র ভারতীয় সৈন্যদের কাছে থেকে তারা কেড়ে নিয়েছিল। চীনের একজন সামরিক কর্মকর্তা এ সময় ভারতের সেনাবাহিনীর লোকদের বলেছিলেন, আপনাদের যুদ্ধাস্ত্রগুলো আমাদের যুদ্ধাস্ত্রের চেয়ে অনেক ভালো। কিন্তু ভালো অস্ত্র নিয়েও আপনারা আমাদের পরাজিত করতে পারেননি। এর কারণ, আপনাদের সাহস, শৃঙ্খলা, মনোবলের অভাব। যা হোক, আপনারা আপনাদের অস্ত্র ফেরত নিন। এগুলো আমাদের না হলেও চলবে।’ ১৯৬২ সালের ৯ বছর পর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে হতে পেরেছিল পাক-ভারত যুদ্ধ। এ যুদ্ধে ভারত জিতেছিল, কারণ পাক বাহিনী পায়নি যুদ্ধে জনসমর্থন। কিন্তু ভারত পেতে পেরেছিল বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের সাহায্য সহযোগিতা। তথাপি, ভারত বাংলাদেশের মুক্তি বাহিনীর প্রধান সেনাপতিকে বাদ দিয়েই পাকিস্তান বাহিনীর সাথে করেছিল যুদ্ধবিরতি চুক্তি। হিটলারের বাহিনী যখন ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হেরে যায়, তখন জার্মানিকে পৃথক পৃথকভাবে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছিল ব্রিটেন, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে। আবার জাপান দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে হেরে যাওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, চীন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও নেদারল্যান্ডের কাছে করেছিল পৃথক পৃথকভাবে আত্মসমর্পণ। একইভাবে উচিত ছিল পাকিস্তান বাহিনীর জেনারেল ওসমানীর কাছে আত্মসমর্পণ করা। কিন্তু সেটা করা হয়নি। এর পিছে ভারতের একটা পূর্বপরিকল্পনা ছিল বলে অনেক ঐতিহাসিকের কাছে মনে হতে পারে। ভারত চেয়েছিল ১৯৭১-এর সব কৃতিত্বকে তার নিজের বলে দাবি করতে। সে সরকারিভাবে মেনে নিতে চায়নি, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষের ভূমিকাকে।  (সমাপ্ত)
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন