সোমবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১২

জামাত-শিবিরের সরলপ্রাণ নেতা-কর্মী উদ্দেশে


“জামাত-শিবিরের সৎ, যোগ্য, মেধাবী, নীরিহ, নিষ্ঠাবান ও অকুতোভয় কর্মীরা মুতাওয়াজ্জাহ্ অধ্যাপক গোলাম আযমের দিকে, অধ্যাপক গোলাম আযম মুতাওয়াজ্জাহ্ সৌদী বাদশাহর দিকে, সৌদী বাদশাহ্ মুতাওয়াজ্জাহ্ হোয়াইট হাউজের দিকে, হোয়াইট হাউজ মুতাওয়াজ্জাহ তেলআবিবের দিকে আর তেলআবিব মুতাওয়াজ্জাহ জাহান্নামের দিকে। অতএব ওরা সবাই জাহান্নামের দিকেই দ্রুত ধাবমান” এভাবে ভয়ঙ্কর অভিযাত্রায় জামাত-শিবিরের করুণ পরিণতির আশঙ্কা ব্যক্ত করতেন মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুর রহীম।

        জামায়াতে ইসলামী পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক এই আমীর জামাত-শিবিরকেই তাঁর যৌবনের প্রারম্ভ হতে পরিণত বয়স পর্যন্ত জীবনের ধ্যান-জ্ঞান করেছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতাদেরও অন্যতম তিনি। জামাত-শিবিরের তাত্ত্বিক সাইয়্যেদ আবুল আ’লা মওদুদীর ‘তাফহীমূল কুরআন’ সহ অধিকাংশ গ্রন্থের সফল অনুবাদকও ছিলেন তিনি। তাঁেক বাংলাদেশে রাজনৈতিক ধারার প্রচলিত ইসলামী সাহিত্যের জনক বলা হয়। তাঁর লেখা রাজনৈতিক ধারার প্রচলিত ইসলামী সাহিত্যে পুরিপুষ্ট আজকের জামাত-শিবিরসহ চলমান ইসলামী  ঘরানার অধিকাংশ রাজনৈতিক দল, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। জামাত-শিবিরের বেশিরভাগ নেতা-কর্মীর রাজনীতিতে হাতে-খড়ি তাঁর লেখা বই-পুস্তক পাঠ করেই। এমনকি বরেণ্য দ্বীনদার আলেম ও বুজর্গ আল্লামা হাফেজ্জী হুজুর (রহঃ)ও তাঁর প্রভাবে জীবনসায়াহ্নে ইরান সফর করে ইরানের ইসলামী বিপ্লবের ঘোরসমর্থক হয়েছিলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত কামরাঙ্গিরচর মাদ্রাসা ইরানের ইসলামী বিপ্লবের নেতাদের পদচারণায় মুখরিত থাকতো তাঁর জীবদ্দশায়। অথচ তিনি মদীনার ইসলাম প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে রাজনীতিতে নেমে বটগাছ প্রতীক নিয়ে রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন এবং ‘খেলাফত আন্দেলন’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন। বাংলাদেশে ইসলামী ঐক্য প্রতিষ্ঠায় তাঁর “নেক হও-এক হও” শ্লোগানটি আলিয়া ও কওমি ধারার আলেম-উলামাদের এককাতারে সামিল করে ঐক্যের ভিত্তি দেয়। তখন সেক্টর কমান্ডার এবং জাসদ সভাপতি মেজর জলিলও ইসলামী ধারার রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন করেন। মাওলানা আব্দুর রহিম এবং হাফেজ্জী হুজুরসহ প্রতিথযশা দ্বীনদার আলেমগণ মিলে গঠন করেন “ইত্তেহাদুল উম্মাহ”। অবশ্য জামাায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ এর নানামুখী বিরোধিতা ও প্রতিবন্ধকতায় তা কাঙ্খিত মঞ্জিলে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়। তবে মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুর রহীম তাঁর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। তিনি তাঁর দল ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক লীগ (আই ডি এল) পূনর্গঠন করে নাম রাখেন ইসলামী ঐক্য আন্দোলন। এ সমস্ত বহুবিধ কারণে মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুর রহীমকে বাংলাদেশে প্রচলিত  ইসলামী ধারার রাজনীতির পথিকৃৎ বা প্রবর্তক ভাবা হয়।

    এমনই প্রাজ্ঞ এবং অভিজ্ঞ চিন্তানায়ক মুহাম্মদ আব্দুর রহীম প্রচলিত ইসলামী চিন্তায় ভাবান্তরিত হয়ে আত্মোপলব্ধি ও দায়িত্বসচেতনতার গভীর তাগিদ অনুভব  করেই তাঁর প্রাণপ্রিয় আবেগপ্রবণ নিষ্ঠাবান কর্মীদের সতর্ক করতেন প্রাগুক্ত সাবধান বাণীতে। তিনি ১৯৮১/৮২ সালে হতে শুরু করে তাঁর জীবনাবসান পর্যন্ত বিভিন্ন ঘরোয়া আলোচনায় প্রসঙ্গক্রমেই জামাত-শিবির সম্পর্কিত এই মূল্যায়নের অমূল্য বাণী  উচ্চারণ অব্যাহত রেখেছিলেন। যারা তা স্বকর্ণে শ্রবণ করেছেন, এমন বহু স্বাক্ষী এখনও জীবিত আছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যালে বিচারাধীন মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত মাওলানা আব্দুস সোবহান তাঁর মধ্যে অন্যতম। তখন তিনি ছিলেন আই ডি এল এর সেক্রেটারী জেনারেল।

        মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুর রহীম জামায়াতে ইসলামীর মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকা অপছন্দ করতেন। তবে এ সময়ে তিনি জামায়াতে ইসলামীর সাথে প্রকাশ্যে সম্পর্কও ছিন্ন করেননি। স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর কর্মকৌশল নিয়ে তাঁর মতবিরোধের খবর প্রকাশ্যে আসে। শোনা যায়, তিনি ৭১’ এ জামায়াতে ইসলামীর অনৈসলামিক ভূমিকার জন্য ক্ষমা চেয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে গোপনে চিঠিও লিখেছিলেন। প্রকাশ্যে ক্ষমাপ্রার্থনারও পক্ষপাতি ছিলেন তিনি- এমন কথাও প্রচলিত আছে।

        শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বিশেষ ঘোষণার সুযোগে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ মুসলিম লীগ পূনরুজ্জীবিত হলেও, মুহাম্মদ আব্দুর রহীম তখন তাঁর পুরানো সহযোগীদের নিয়ে  জামায়াতে ইসলামীকে পূনরুজ্জীবিত না করে ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক লীগ (আই ডি এল) নামে নতুন দল গঠন করেন। যা ছিলো একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। তাঁর এই দূরদর্শী এবং বাস্তবানুগ সিদ্ধান্ত জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি প্রত্যাখান করার সঠিক পদক্ষেপ। তিনি তখন রাজনৈতিক সঠিক সিদ্ধান্তে দক্ষতা প্রদর্শনে সক্ষম হলেও, দলের দার্শনিক ভিত্তির ব্যাপারে ছিলেন অস্পষ্ট। যে কারণে তিনি আল্লামা আজাদ সোবহানী, আবুল হুসেনের শিখাগোষ্ঠি, আল্লামা আবুল হাশিম প্রমুখদের রাজনৈতিক প্রতিচ্ছবি মওলানা ভাসানীর পক্ষভূক্ত হননি কখনও, তাদের ইসলামিক রাজনৈতিক দর্শনও গ্রহণ করেনি।  তিনি খান এ, সবুরের মুসলিম লীগের সাথে ইসলামী জোট গঠন করে ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশ নেন। এ নির্বাচনে তিনিসহ আইডিএল ৬টি এবং মুসলিম লীগ ১৪ টি আসন পায়। খান এ, সবুর একাই ৩টি আসনে জয়লাভ করেন। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী স্বঘোষিত রাজাকার খান এ, সবুরের এ বিজয় একটি বিরল শিক্ষণীয় ঘটনা।

        বাংলাদেশের (সাবেক পূর্ব পাকিস্তান) মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠির অন্যায়, জুলুম, বৈষম্য থেকে মুক্তি চেয়েছিলো। তারা বাক-স্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মানবাধিকার চেয়েছে। তারা যে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলো, তারা তার নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব চেয়েছিলো। আবুল হাশিম,  বঙ্গবন্ধু, খান এ সবুর, ফজলুল কাদের চৌধুরী, শাহ আজিজ প্রমুখ নেতারাই তো পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাঁরা কেনো পিন্ডিমুক্ত হয়ে দিল্লীর গোলাম হবেন?  আসলে পাকিস্তানী সামরিক একনায়কদের নিষ্ঠুর খামখেয়ালি, গোঁয়ার্তুমি ও জঘন্যতম হঠকারিতায় পূর্ব পাকিস্তানে হত্যা, লুন্ঠন, ধর্ষণসহ সীমাহীন ধ্বংশযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়, যা এখানাকার জনগণকে প্রতিবেশি ভারতে ঠেলে দেয়। তারা সেখানে তাদের জীবন ও ইজ্জত বাঁচাতে আশ্রয় নেয়। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাদেরকে মানবিক সাহায্য দিয়ে সে অপ্রত্যাশিত সুযোগেরই সদ্ব্যবহার করেন কড়ায়-গন্ডায়। পরবর্তীতে যা ভারতের রাজনৈতিক স্বার্থের অনুকুলে যায়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে; বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার মাধ্যমে লাহোর প্রস্তাবের আংশিক বাস্তবায়ন হয়। এ বিষয়টি বাংলাদেশের মানুষের উপলব্ধিতে আসতে বেশি সময় লাগেনি। মাত্র ৯ বছর পরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনেই তার প্রমাণ পাওয়া গেলো।
   
        তবে এর অর্থ এ নয় যে, বাংলাদেশের মানুষ আবার পাকিস্তানে ফেরৎ যাবে অথবা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা অর্থহীন। ৩০ লক্ষ শহীদ ও ৩ লাখ মা-বোনের  ইজ্জতের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশ। এ স্বাধীনতা অটুট রাখতে হবে সার্বভৌম ক্ষমতা অর্জন করে। যা দিল্লীতে গিট্টু বেঁধে আছে। এ গিট্টু খুলতে বাংলাদেশ পরিবেষ্টিত ভারতের অঞ্চলসমূহের  সাথে সুসম্পর্ক সৃষ্টি করে তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করাই সবচেয়ে জরুরী কাজ। এ সমস্ত অঞ্চলের জনগণের সাথে আমাদের নৃতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক এবং ভাষাগত সম্পর্ক বিদ্যমান। এক কথায় তাদের সাথে আমাদের নাড়ির সম্পর্ক। আমাদের পারস্পরিক আচার-আচরণ, আকার-আকৃতি, গঠন-প্রকৃতির মিল তো আছেইÑ শুধু যোগাযোগ বাড়ানোর কাজটাই সহজ করতে হবে। এভাবে নৃতাত্ত্বিক ঐক্য সুদৃঢ় ও অবাধ করার মাধ্যমে লাহোর প্রস্তাবের পূর্ণ বাস্তবায়নের মধ্যেই নিহিত রয়েছে বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা। আর তখনই বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্থবহ কার্যকর হবে। এক্ষেত্রে প্রধান বাঁধা জামাত-শিবিরের অপরাজনৈতিক সাম্প্রদায়িক চিন্তাধারা, যা জাতীয় অনৈক্য এবং বিভক্তির বিভিন্ন উপাদানে ভরপুর।

        সাইয়্যেদ আব্দুল আ’লা মওদুদী ১৯৪০ সালে ‘জামায়াতে ইসলামী হিন্দ’ প্রতিষ্ঠা করেন। তা-ই পরবর্তীতে পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশসহ উপমাহাদেশের অনেক দেশেই সক্রিয় রয়েছে। অবশ্য বাংলাদেশে এখন ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ নামে সংশোধিত হয়ে তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও কর্মসূচীরও পরিবর্তন করেছে। মওদুদীর ‘জাময়াতে ইসলামী হিন্দ’ অখন্ড ভারত রক্ষায় ও বৃটিশ শাসনের পক্ষে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধী 'িছলো। ১৯৪৮ সালে বৃটিশ পরামর্শেই মওদুদী পাকিস্তানে আগমন করেন। তাঁর কারণে পাকিস্তানে সম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। এতে বহু নীরিহ মানুষ হতাহত হয়। পাকিস্তানের সামরিক আদালত মওদুদীকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। কিন্তু আরব বিশ্ব ও পাশ্চাত্যের চাপে তা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।
    ১৯৭১ সালেও জামায়াতে ইসলামী অখন্ড পাকিস্তানের পক্ষে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করেছে। সে সময় আমেরিকা ও  চীন ছিলো পাকিস্তানের পক্ষে। চীন তার নিজের স্বার্থে তখন বাংলাদেশবিরোধী অবস্থানে ছিলো। চীনের ভেটো পাওয়ারসহ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভে আমেরিকার সহযোগিতাপ্রাপ্তি ছিলো যার অন্যতম কারণ। একই কারণে চীনাপন্থী রাজনীতিকরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ছিলেন অনুপস্থিত। জামাত-শিবিরের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকা সে সময়কার আন্তর্জাতিক  রাজনৈতিক সমীকরণ থেকেই অনুধাবন করতে হবে। জামাত পাকিস্তান চায়নি, অতএব অখন্ড পাকিস্তান রক্ষা করা তার এজন্ডা হওয়ার কথা নয়।

    বৃটিশ শাসকরা ইহুদী ও খ্রীষ্টানদের ধারাবাহিক কথিত লিবারেল মুসলমান বানাতে অনেকগুলো কর্মসূচী হাতে নেয়। ভারতবর্ষে আলিয়া মাদ্রাসা তৈরি যেমন সে কর্মসূচীরই অংশ, রাজনৈতিকভাবে জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠাও তার বাইরে নয়। ধর্মীয়ভাবে কাদিয়ানী সম্প্রদায়, তাবলীগ জামাত,ওহাবী মতবাদ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা সবই বৃটিশ পরিকল্পনার অবিচ্ছেদ্য অংশ। বৃটিশ গোয়েন্দা হামফ্রের স্বীকারোক্তিমূলক ডায়েরীটা তার উৎকৃষ্টতম দলিল। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কলোনী যুগের অবসান ঘটায় নতুন বিশ্বব্যবস্থার একচ্ছত্র অধিপতি এখন আমেরিকা। সেই ধারাবাহিকতায় আমেরিকাই এখন জামাত-শিবিরের সত্যিকারের মনিব। ইহুদীবাদী পুঁজিতন্ত্র তাদের আদর্শ। পূঁজিতন্ত্রের বিশ্বায়নে জামাত-শিবির পবিত্র ইসলামকে হাতিয়ার বানিয়ে  ধর্মভীরু নীরিহ মুসলমান তরুন ও যুবকদের বিভ্রান্ত করার কাজটিই করছে সুনিপুণভাবে। জামাত-শিবিরের রাজনৈতিক লক্ষ্য মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পরিবর্তে হোয়াইট হাউজকে খুশি করা এবং তাদের সাংগঠনিক শক্তি আমেরিকার স্বার্থের অনুূকুলে নিয়োজিত বিধায় মার্কিন আর্শিবাদও তাদের প্রতি অকৃপণ। যার ভুরি ভুরি নজির দৃষ্টির সীমানায়ই বিদ্যমানÑ ইচ্ছে করলেই যে কেউ তা অবলোকন করে যার যার সংশোধনের পথ খুঁজতে পারেন। জামাত-শিবিরের ডাকা সাম্প্রতিক হরতালে মার্কিন দূতাবাসের একটি গাড়ী ভাংচুর হওয়ায় জামাত-শিবির এর ক্ষয়-ক্ষতিতে দুঃখ প্রকাশ করে নিন্দা জানিয়েছে এবং ক্ষতিপূরণ দেওয়ারও ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। তার কিছু দিন পূর্বে মার্কিন দূতাবাস বাংলাদেশের সহিংস রাজনীতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে জামাত-শিবিরের পক্ষে এক বিবৃতিতে বলেছে- শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার। মার্কিন দূতাবাসের বিবৃতিতে বলা হয়- “ঢাকা ও অন্যান্য জেলায় সংঘটিত সাম্প্রতিক সহিংসতায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস উদ্বিগ্ন। এই সহিংসতার ফলে যারা আহত ও ব্যক্তিগতভাবে সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন, তাদের প্রতি রয়েছে আমাদের সহমর্মিতা। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে জড়িত হওয়া একটি মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার। সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। আমরা বিশ্বাস করি সংলাপই যেকোনো মতপার্থক্য দূরীকরণের উত্তম পন্থা।” অতএব চোখ-কান খোলা থাকলে কারো বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, নীতি ও দর্শনে জামাত-শিবিরের আদর্শ পূঁজিতান্ত্রিক ইহুদীবাদ এবং কৃষ্টি-কালচারে এরা আরব-পারস্য-পাকিস্তানের অনুসারী। বাংলার আলো, বাতাস, মাটি ও পানিতে লালিত-পালিত হয়ে এরা ঐ সমস্ত দেশের প্রেমে মশগুলÑ নিজদেশে পরবাসী। গ্রাম্য ভাষায়- এরা “খায় পড়ে ভাতারের, গুণ গায় লাঙ্গের।”
    জামাত-শিবির যেমন ইসলামভিত্তিক বা ধর্মভিত্তিক কোনো রাজনৈতিক দল নয়, তেমনি তা নিয়মতান্ত্রিক কোনো রাজনৈতিক দলও নয়। এটি বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত একটি আন্তর্জাতিক অশুভ নেটওয়ার্কের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যার মূল মিশনই তার পূর্বোল্লিখিত প্রভূর এজেন্ডাসমূহের নিঁখুত বাস্তবায়ন। এ মোজেজাটুকু অজ্ঞাত থাকলে জামাত-শিবিরের সাম্প্রতিক সহিংসরূপ বিশ্লেষণ করা অন্ধের হাতি দর্শনের মতো হবে। কারণ বহুরূপী জামাত-শিবির ঘোষিত অধিকাংশ কর্মকান্ড মূলত হাতির বাইরের দাঁত, যার  অন্তর্নিহিত তাৎপর্য সবসময়ই ভিন্নকিছু।

    বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবিরকে জামায়াতে ইসলামীর সাথে জোড়া লাগিয়ে আলোচনা করার মর্ম ব্যাখ্যা না করলে ভুল বোঝাবুঝির যথেষ্ট অবকাশ থাকে। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবিরের জন্ম ১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্র“য়ারী। এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন সাবেক ইসলামী ছাত্রসংঘ নেতা মীর কাশেম আলী। ছাত্রশিবির প্রতিষ্ঠাকালে স্বতন্ত্র ছাত্র সংগঠন দাবী করে কোনো রাজনৈতিক দলের অংগ সংগঠন না হওয়ার ঘোষণা দিলে ইসলামপ্রিয় তরুণ ছাত্র-ছাত্রীরা এর পতাকাতলে সমবেত হয় এবং অতিদ্রুত তা ব্যাপক জনপ্রিয় ছাত্র সংগঠনে পরিণত হয়ে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশের  মানুষও সংগঠনটিকে ভালবাসতে শুরু করে। কিন্তু ১৯৭৯ সালে অধ্যাপক গোলাম আযম বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করে পরবর্তীতে ‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ’ নামে দলকে পূনরুজ্জীবিত করলেই সবকিছু লেজেগোবরে হয়ে যায়। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবিরের মতো একটি আদর্শবাদী সুশৃঙ্খল ছাত্র সংগঠনও তার লক্ষ্যপথ হারিয়ে বিভিন্নমূখী ধারায় বিভক্ত হয়। মূল অংশ জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ এর সহযোগী সংগঠনে পরিণত হয়ে বিপথগামীতার চূড়ায় পৌঁছে। অনেকেই রাজনীতিতে নিস্ক্রিয় হয়ে ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন।  আর শিবিরের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি আহমদ আব্দুল কাদের গঠন করেন ‘বাংলাদেশ ইসলামী যুবশিবির’। পরবর্তীতে যা খেলাফত মজলিশে রূপান্তরিত হয়ে ১৮ দলীয় জোটে সম্পৃক্ত আছে।

    ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পর বাংলাদেশে চলমান ইসলামী ধারার রাজনীতি কার্যত দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। অধ্যাপক গোলাম আযমের নেতৃত্বে ‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ’ ছাড়া অন্য সবাই ইরানের ইসলামী বিপ্লবের সমর্থক হয়। সৌদী রাজতন্ত্রের সমর্থক ‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ’ আমেরিকা-ইসরাইল ও পূঁজিবাদের সহায়ক শক্তিরূপে ঘর গোছাতে মনোনিবেশ করে। তখন থেকে তাদের প্রতি সৌদি দূতাবাস ও রাবাতায়ে আলমসহ বহু আন্তজার্তিক সংস্থার সবধরনের অবারিত সাহায্য-সহযোগিতা জোরদার হয়ে অব্যাহত রয়েছে। বর্তমান জামাত-শিবির এ ধারারই ধারক-বাহক। এখানে উল্লেখ্য যে, ইরানবিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লা ইমাম খোমেনীই সর্বপ্রথম আমেরিকাকে বড় শয়তান এবং রাশিয়াকে ছোট শয়তান আখ্যা দেন। এর আগে মুসলিম বিশ্ব ইহুদী ও খ্রিষ্টধর্মের অনুসারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বন্ধু এবং কমিউনিষ্ট রাশিয়া ও চীনকে কাফের ও নাস্তিক গালি দিয়ে শত্র“ ভাবতো। আমেরিকাও মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ, ব্যক্তিত্ব, প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনসমূহকে তাদের ইচ্ছেমতো ব্যবহার করতো। এখনও সৌদী আরব, পাকিস্তান, আফগানিস্তান তাদের কব্জায় থেকে এর মাশুল গুনছে। তারা তালেবান এবং ওসামা বিন লাদেনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে তাদের স্বার্থেই তৈরি করেছিলো। লাদেন পরবর্তীতে তাদের আনুগত্য পরিত্যাগ করে রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন হওয়ার চেষ্টা করায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরাগভাজনই নয় শুধু, সন্ত্রাসী হিসেবে মূল্যবান জীবনটাও দিতে হয়েছে তাঁকে জঘন্যতম নিষ্ঠুর প্রক্রিয়ায়। আরব বংশোদ্ভুত হওয়ার পরও সৌদী রাজতন্ত্র তাঁর প্রতি সংবেদনশীল হয়নি। বর্তমানে হামিদ কারজাই ন্যাটো ও মার্কিন বাহিনীকে তার দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করলেও সম্পূর্ণ অসহায়। পাকিস্তানও সরকারের মার্কিন আনুগত্যের কারণে  তার নিজদেশের জনগণকে মার্কিন ড্রোন হামলা থেকে রক্ষা করতে অসহায় ও অপারগ। তাদের সামনে সাদ্দাম, গাদ্দাফী ও লাদেনের নিষ্ঠুর হত্যাকান্ড নির্মম উদাহরণ। রাজনৈতিকভাবে ভিন্নমতাবলম্বী এবং স্বাধীনচেতা হওয়ায় ইরাকের সাদ্দাম হোসেন এবং লিবীয় নেতা গাদ্দাফীকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাসার আল আসাদ একই ভাগ্যবরণের অপেক্ষায় দিন গুনছেন। তিনি রাশিয়া ও চীনের শেষ সময়ের বোধোদয় সম্বল করে বেঁচে আছেন। আমেরিকা সবদিক গুছিয়ে এনে সবশেষে ইরান আক্রমণের ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে আর সেটাই মূলত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি এবং নতুন দর্শনভিত্তিক নতুন রাজনৈতিক বিশ্বব্যবস্থার সূচনা।
        আমেরিকা ইরাক, আফগানিস্তান ও লিবিয়া আক্রমণ করে যে একতরফা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করেছে, বাংলাদেশকে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে তার অন্যতম যুদ্ধক্ষেত্র বানানোর পাঁয়তারা চলছে বলেই পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা। জামাত-শিবিরের সাম্প্রতিক সহিংস তান্ডব সে চক্রান্তেরই অংশ। জামাত-শিবিরের জোরালো ব্যাখ্যাÑ তারা নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত একটি আইনানুগ নিয়মতান্ত্রিক রাজ্ৈনতিক দল। তাদের রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করার অধিকার বাংলাদেশের সংবিধানে সংরক্ষিত। সে সুরক্ষিত অধিকারে তারা তাদের কারাবন্দি নেতাদের মুক্তির দাবীতে কর্মসূচী দেয় কিন্তু পুলিশ তাদের শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক কর্মসূচী পন্ড করছে। তবে পুলিশের ওপর যে চোরাগোপ্তা হামলা, তা ছাত্রলীগ-যুবলীগেরই অপকর্ম, এতে তাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। তারা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারকেও প্রহসন বলে দাবী করছে। তাদের যুক্তি, মানবতাবিরোধী  অপরাধে অভিযুক্ত তাদের নেতারা যুদ্ধাপরাধী ননÑ নির্দোষ। যুদ্ধাপরাধীরা ছিলো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্য  এবং স্বাধীনতা উত্তরকালে  ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর একটি তালিকাও প্রণয়ন করা হয়েছিলো। সিমলা চুক্তির ফলে তারা মুক্ত হয়ে পাকিস্তান ফিরে গেছে। অতএব মূল আসামীদের দায়মুক্তি দিয়ে তাদের সহযোগীদের বিচারের আওতায় আনা অগ্রহণযোগ্য এবং হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ১৮ দলীয় জোটের প্রধান শরীক বিএনপিরও অনুরূপ মত। তবে তাদের আশঙ্কা যে, সরকারই জামাত-শিবিরকে ‘সাইজ’ করছে যাতে তারা বিএনপিবিহীন নির্বাচনে অংশ নিতে বাধ্য হয়। তাই চলমান ধারাবাহিক সব নাশকতা সরকারের গোপন এজেন্ডা বাস্তবায়নের অংশ। সরকার এবং আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ একটি ভাঙ্গা রেকর্ড বিরামহীন বাজিয়ে জনগণকে প্রবোধ দিচ্ছে যে, বেগম খালেদা জিয়ার নির্দেশে এবং বিএনপির উস্কানীতেই জামাত-শিবির একের পর এক নাশকতা করছে। উদ্দেশ্যÑ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করে তাদের রক্ষা করা। তারা ঢাকায় গার্মেন্টস-এ আগুন লেগে এবং চট্টগ্রামে ফ্ল্যাইওভারের গার্ডার ভেঙ্গে শ্রমিক নিহত ও নীরিহ পথচারী হাতাহতের ঘটনাও জামাত শিবিরের নাশকতা বলে চালানোর চেষ্টা করছে।

    এভাবে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ক্ষমতার রাজনীতি ও দলাদলীর সুযোগে ধুরন্দর জামাত-শিবির বৃহত্তর দলদুটোর ‘ঝোলের লাউ আর অম্বলের কদু’ হয়ে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত থেকেছে। অর্থাৎ ইহুদিবাদী পূঁজিতান্ত্রিক ওহাবী মতাদর্শে সবাইকে দীক্ষিত করে তা অব্যাহত রাখছে। বাংলাদেশের সংবিধানসহ আওয়ামীলীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টীর জামাতীকরণই এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ। আওয়ামী লীগ নেতারা তো প্রকাশ্যেই স্বীকার করছেন যে, তাদের দলে জামাত-শিবির ঢুকে পড়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ প্রভাবশালী মন্ত্রীরা এবং সুশীল সমাজের পন্ডিতরাও অকপটে স্বীকারোক্তি দিচ্ছেন যে, বাংলাদেশের প্রশাসন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ জামাত-শিবিরের দখলে। বাংলাদেশ ইসলামী ফাউন্ডেশনে গেলে এর নজির মিলবে। আল্লামা আবুল হাশিম প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠানে তাঁর লেখা “ইসলামের মর্মকথা”, “সূরা ফাতেহা”, আল্লামা আজাদ সোবহানীর “বিপ্লবী নবী ” প্রভৃতি গ্রন্থসমূহ এবং তাঁর সময়ে অনুবাদকৃত “কুরআনুল করীম”এর  অস্তিত্বও খুঁজে পাওয়া যায় না। এ যেনো মুহাম্মদ (সঃ) এর ইসলাম পরবর্তী খেলাফত যুগে মশিউল ইসলাম আবুজার গিফারীকে নির্বাসন দেওয়ার মতো আবুল হাশিমের  ইসলামিক চিন্তাধারা বিতাড়িত করে ইহুদিবাদী পূঁজিতন্ত্রের ইসলামিকরণ। অথচ কি আশ্চর্য! এর সত্যিকার ও কার্যকর মোকাবেলা নেই কোথাও। আদর্শিক বা দার্শনিক মোকাবেলা তো নেই-ই, সামাজিক ও রাজনৈতিক মোকাবেলার লক্ষণও অনুপস্থিত। শুধু হুমকি-ধমকি, গালাগালি এবং প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রয়োগ-অপপ্রয়োগের ছড়াছড়ি সর্বত্র। ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ নিজেদেরকে মুক্তিযুদ্ধের সোলএজেন্ট ঘোষণা করে জামাত-শিবিরকে রাজাকার, আলবদর, আল শামস এবং সর্বোপরি স্বাধীনতাবিরোধী গালি দিয়ে তাদের রূখতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তিগুলোকে তাদের পেছনে কাতারবন্দি হওয়ার তাগিদ দেয়। তাহলেই নাকি কেল্লাফতে!


    মুক্তিযুদ্ধের আরেক দাবীদার বিএনপিতো জামাত-শিবির নিয়েই তাদের বাসর-হাশর সব সাজাতে উদগ্রীব। তারা শহীদ জিয়ার “ধর্মীয় মূল্যবোধ” বিদায় করে কথিত “ইসলামী মূল্যবোধ” প্রতিষ্ঠায় বেশি উৎসাহী। আর সুযোগসন্ধানী  এরশাদের জাতীয় পার্টী নিয়ে আলোচনা নিরর্থকই নয় শুধু, পন্ডশ্রমও বটে। তিনি না ঘরকা না ঘাটকা।  তবে “কামনিষ্ঠ” ও “কামিয়েনিস”  বামদের পিকিংপন্থীরা বিএনপির এবং মস্কোপন্থীরা আওয়ামী লীগের কোলে চড়ে  সাম্রাজ্যবাদী এজেন্ডা “মৌলবাদ” ঠেকাতে মরিয়া। তবে তারা  সবাই নাস্তিক্যবাদের দখলীস্বত্ব কব্জায় রাখতে ধর্মবিরোধীতায় উচ্চকণ্ঠ এবং সবকিছুতে ধর্ম সোজাকথায় ইসলাম নামের ভূত দেখে আতঙ্কিত। ইসলাম ফেবিয়া আরকি। এ ঘরানার সুশীল ও বুদ্ধিজীবিরা জামাত-শিবিরের বিরোধীতা করতে ’জামায়াত‘ ও ‘ইসলাম’ একাকার করে ইসলাম তথা ধর্মবিরোধী প্রচারণায় লিপ্ত। এরাও জামাত-শিবিরের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে জামাতেরই কৌশলে পরাস্ত খাঁচাবন্দী সুবোধ বাঘ।

        কিন্তু বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ নীরিহ সাধারণ মানুষ সবকিছরই পরিস্কার ধারণা রাখেন। তাঁরা লোকজ  ও দেশজ স্বকীয়তায় সত্য-মিথ্যার ফারাক বুঝে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সিদ্ধহস্ত। তাই তাঁরা নিজস্ব পথে সঠিক নেতৃত্ব নির্মাণ করে তা বরণ করার অপেক্ষায় আছেন। কারণ, তাঁরা জানেন- জামাত-শিবির ইসলামভিত্তিক  দল না হয়ে ইসলামের নামে স্রেফ পূঁজিবাদের পোষক একটি তথাকথিত রাজনৈতিক দল। ১৯৭১ সালে তারা ইসলামের সাইনবোর্ড ব্যবহার করে যা করেছে, তা সবদিক বিবেচনায় অত্যন্ত জঘন্যতম অপরাধ, ইসলামপরিপন্থী তো বটেই। প্রথমতঃ “জামায়াতে ইসলামী” নাম ব্যবহার করে ইসলামের সোলএজেন্ট সাজা। দ্বিতীয়তঃ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হত্যা ,ধর্ষণ, লুন্ঠন, প্রভৃতি মানবতাবিরোধী কর্মকান্ডকে জায়েজ ঘোষণা দিযে তা সমর্থন করে ইসলাম কলঙ্কিত করা। ওদের কারণে ইসলামের চেতনা কলঙ্কিত হয়েছে, রাজাকার , আলবদর, আলশামসের মতো সুন্দর পরিভাষাসমূহ ঘৃণিত হয়েছে, “আল্লাহু আকবার”  ধ্বনিটিও  মা-বোনদের হৃদয়ে আতঙ্কের কাঁপন ধরাতো। তারা “আল্লাহু আকবর” শুনলে ইজ্জত বাঁচানোর তাড়নায় দিকবিদিক ছুটাছুটি করে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতো। তখন “জয় বাংলা” শ্লোগানটিই ছিল মুক্তিকামীদের নিরাপদ আশ্রয়।

    অথচ একমাত্র ইসলামই সৎকাজের আদেশ এবং অন্যায় ও অসৎ কাজের নিষেধ করে। ইসলাম ন্যায় ও কল্যাণকর কাজে সহযোগিতা এবং অন্যায় ও অকল্যাণকর কাজে অসহযোগতিা করার নির্দেশ দেয়। ভালোকাজ করার প্রতিযোগিতা করার তাগিদ দেয়। কল্যাণকর বা ভালোকাজ বলতে রাসূল (সঃ) এর পরিস্কার ব্যাখ্যা- ‘যে কাজে প্রতিবেশীর মুখে হাসি ফোটে’।  শুধু তা-ই নয়, ইসলাম জুলুমের প্রতিরোধ করতে আদেশ দেয়, তাতে অক্ষম হলে প্রতিবাদ জানাতে বলে এবং তাতেও অক্ষম হলে মনে মনে ঘৃণা করার নির্দেশ দেয় আর তাহলো দুর্বল ঈমানের পরিচয়। জামাত-শিবির কর্মীরা এ দুর্বল ঈমানের পরিচয়টুকুও  দিতে ব্যর্থ হয়ে নিজেদেরকে মুসলিম ভাবে কীভাবে? মুসলিম তো সে, যার জিহ্বা ও হাত হতে অন্যরা নিরাপদ থাকে অর্থাৎ মুসলিমে কথা কাজে কারো অনিষ্ট হয় না।  পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বর অত্যাচার ও নারী নির্যাতনের করুণ দৃশ্য কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই  স্বচক্ষে দেখার লজ্জা  ভুলতে ক্ষোভে অপমানে মাথায় গুলি করে বাঙালী সেনা অফিসারের আত্মহত্যা করার সাহসী ও নিলোর্ভ নজির যেখানে ভুরি ভুরি, সেখানে জামাত-শিবির হানাদার বাহিনীর এ সমস্ত যুদ্ধাপরাধের সহযোগী ছিলো বলে নিজেদের নিরপরাধী দাবী  করার মস্কারা দেখায় কীভাবে? এ কেমন ইসলাম এবং কেমন মানবতা তাদের! তাদেরতো বিচার করতে হবে ইসলাম অবমাননার জন্য এবং মুসলমানদের ধিকৃত করার অপরাধে। পবিত্র কুরআনুল করীমে বর্ণিত সূরা হুজরাতের ৯নং আয়াতের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা “ মুমিনদের দুই দল যদি দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয় তবে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দিবে; যদি তাদের একদল অন্যদলের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি করে তবে তোমরা বাড়াবাড়ীকারী দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে, যদি তারা ফিরে আসে তবে তাদের মধ্যে ন্যায়ের সাথে ফয়সালা করবে এবং সুবিচার করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সুবিচারকারীদেরকে ভালোবাসেন’।

    জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের এ নিষ্ঠুর পৈশাচিক বর্বতার জন্য ধিক্কার জানানো, ঘৃণা প্রকাশ ও নিন্দা জ্ঞাপন করা অবশ্য কর্তব্য। জামাত-শিবিরের তরুন প্রজন্মকেও কঠিন আত্মসমলোচনায় আত্মোপলব্ধিতে পৌঁছতে হবে যে, ৭১ এর নর পিশাচদের নৃশংসতা ক্ষমার অযোগ্য এবং এর নিন্দা জ্ঞাপন করে জামাত-শিবির পরিত্যাগ করাই ঈমানের দায়িত্ব। তাদের এ বেধোদয়   না হলে এবং তারা এ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে বাংলার মাটি তাদের জন্য চিরহারাম। এরপর তাদের আশু করণীয় সম্পর্কে অভিজ্ঞমহলের সুচিন্তিত অভিমত-১) ৭১ এর নির্মোহ মূল্যায়ন করে স্বাধীন বাংলাদেশের বাস্তবতা মেনে নেয়া। ২) বাংলাদেশের লোকজ পরিবেশ-পরিস্থিতির লাগসই আত্মপ্রকাশ এবং ৩) মুক্তিযুদ্ধকালীন গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও ন্যায়বিচার দাবি করা। প্রয়োজনে এ ট্রাইবুন্যাল ভেঙ্গে নতুনভাবে সবকিছু শুরু করার দাবীও এক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য। কেননা দেশের শান্তি, ঐক্য, সংহতি ও অগ্রগতির জন্য গ্রহণযোগ্য বিচার প্রক্রিয়ায় এ কলঙ্ক-ক্ষত মুছে ফেলা অত্যন্ত জরুরী ও অপরিহার্য।

    বিদ্যমান ট্রাইবুন্যালে প্রশ্নবিদ্ধ বিচারপ্রক্রিয়া অশান্তি ও বিভক্তি সৃষ্টির সহায়ক হয়ে জামাতের হাত শক্তিশালী করবে। কিছু লোককে ফাঁসিয়ে গদী দখলের বলী বানালে জামাত জনগণের সহানুভূতি পাবে এবং  এতে জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় মূল্যবোধ চর্চার রাজনীতি নিঃশেষ করে বিদেশী শক্তির হস্তক্ষেপ ত্বরান্বিত করবেÑ এ লক্ষণ ক্রমেই সুষ্পষ্ট হয়ে উঠছে। জামাত-শিবিরের সহিংস পেশীশক্তি প্রদর্শন এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর যৌথ সশস্ত্র বলপ্রয়োগের পেছনে অদৃশ্য হাতের ইশারা রয়েছে বলেই অনেকের ধারণা। কেউ কেউ তো জামাত-শিবির ও আওয়ামী লীগের দীর্ঘ আতাঁতের গভীর রহস্য আবিস্কার করেন এতে। তাদের যুক্তি হচ্ছে জামাত-শিবির ও আওয়ামী লীগের সম্মিলিত চূড়ান্ত টার্গেট বিএনপিবিহীন বাংলাদেশ এবং আপতঃ টার্গেট বিএনপিবিহীন ভোটকেন্দ্র বা নিবার্চন। এজন্য জামাত-শিবির শক্তিশালী করা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ঝুলিয়ে রাখা তাদের অভিন্ন কৌশল হতে পারে। ভাষাগত স্বাতন্ত্রবোধ, মাতৃভূমিচেতনা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধে গড়া বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুটি দলই টিকবে না, একটা বিলুপ্ত হবেই। তবে তা স্বাভাবিক নিয়মে। দেশি-বিদেশী নেটওয়ার্ক ও এজেন্সীর যৌথ প্রযোজনার নাটকে জামাত চরিত্রে ‘হিরোইজম’ আরোপ করে বিএনপিকে তার ‘চার্লি’ রূপে উপস্থাপন করা এবং তা প্রতিষ্ঠিত করতে সরকারসমর্থক মিডিয়ার কোরাসগীত বিএনপিকে বিনাশ করার সুষ্পষ্ট ইঙ্গিতবহ। পুলিশের জামাত-শিবিরকে সমীহ করা ও বিএনপি কর্মীদের প্রতি মারমুখী হওয়া, বিএনপি মহাসচিবকে ময়লার গাড়ী পোড়ানোসহ  ৩৭টি মামলার আসামী করা এবং বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকেও গ্রেফতার করার হুমকি তারই আলামত। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ভারতের ঐক্য, সংহতি এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সহযোগিতায়  স্বদেশের স্বার্থ বিসর্জন দেয়া এবং নিজে ও নিজ পরিবারের সদস্যবৃন্দের সীমাহীন দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ায় চিরশত্র“ বিএনপির কাছে ক্ষমতা হারানোর ভয়ে ভীত। তাই তিনি জামাতকে প্রধান প্রতিপক্ষ নির্মাণ করে বিএনপিমুক্ত বাংলাদেশে নির্ভার ও নিরাপদ থাকতে চান। কিন্তু অস্বাভাবিক পথে বিএনপি নিঃশেষ করার তাদের এ আত্মঘাতি প্রক্রিয়ার সা¯প্রতিক কর্মকান্ড বুমেরাং হয়ে লাভের গুড় পিঁপড়ায় খাওয়ার আশঙ্কাই বেশি। সে লক্ষণও ক্রমেই দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। প্রথম লক্ষণ: একসময়ের জাতীয়তাবাদী শক্তির আশা-আকাঙ্খার ধারক-বাহক বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এখন পুরোপুরি মস্কো-দিল্লী বলয়ভূক্ত। দল ও সরকারে দিল্লীর স্বার্থের অনুকুলে মস্কোপন্থীদের জয়জয়কার। সর্বশেষ কাউন্সিলে তারাই মূলত চালকের আসনে। তোফায়েল আহমেদের মত বর্ষিয়ান নেতাকেও বলতে শোনা যায় ‘লেনিনের নের্তৃত্বে আমাদের দল করতে হবে’। বাংলাদেশের মানুষ আওয়ামী লীগকে ভারতপন্থী এবং বর্তমান সরকারকে ভারতবান্ধব বলেই বিবেচনা করে। দ্বিতীয় লক্ষণ: শেখ হাসিনার সরকার রাশিয়ার সাথে শতকোটি ডলারের সমরাস্ত্র চুক্তি করছে। এ ছাড়াও রূপপুরে একহাজার মেগাওয়াটের দুটি পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করতে প্রায় ২শত কোটি ডলারের ঋণচুক্তি হবে। তৃতীয় লক্ষণটি আরো ভয়াবহ উদ্বেগজনক। তাহলো- মস্কো-দিল্লীপন্থী মিডিয়া সিন্ডিকেট শেখ হাসিনার স্বেচ্ছাচারিতা জনমত জরীপের দোহাইতে আরো উস্কে দিয়ে তাঁকে স্বৈরাচারী  একনায়ক দানবে পরিণত করা। প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান এবং দপ্তরবিহীন মন্ত্রী বাবু সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত যে দানবকে হিংস্র বাঘের চেয়েও ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর আখ্যা দিয়েছেন। তিনি শেখ হাসিনা সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, “বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা কিন্তু শেখ হাসিনা ধরলে ছত্রিশ ঘা”। দলের সব কাঠামো বিতাড়িত আরেক তুখোড় নেতা ৬৯ এর গণঅভ্যূত্থানের পুরোধা তোফায়েল আহমদ অবশেষে পার্লামেন্টাটারি বোর্ড ও উপদেষ্টা মন্ডলীতে ঠাঁই পেয়ে খুবই হতাশ ও ক্ষীণকন্ঠে বলেছেন, “সভানেত্রী আমাকে এখানেও না রাখতে পারতেন, সে ক্ষমতা তার ছিলো”। এভাবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সম্পূর্ণ গিলতে মস্কো-দিল্লীপন্থীদের গলার কাঁটা শুধুমাত্র শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনা অধ্যায় অবসান হলেই তা মুসলিম লীগের ভাগ্যবরণ করবে। এ দলের প্রতিষ্ঠাতা মজলুম জননেতা মরহুম আব্দুল হামিদ খান ভাসানী (মওলানা ভাসানী) এখন বিস্মৃত ইতিহাস। জাতীয় জীবনের সব কিছু থেকে তাঁর নাম-নিশানা মুছে তাঁকে উধাও করা হয়েছে। জাতীয় পাঠ্যক্রম থেকেও তিনি বিতাড়িত। যাঁর দোহাই দিয়ে বা যাঁকে বড় করতে এ অপকর্ম করা হচ্ছে সেই বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে নিহত হওয়ার পরও বাঙালি হৃদয়ে নিভুনিভু জ্বলছিলেন, তাঁকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করে তাঁর অতি গুণকীর্তনে এখন তিনিও সত্যিকারে মৃত। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বঙ্গবন্ধু অধ্যায়ও নিঃশেষ প্রায়। তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ দলের নীতি নির্ধারকরা পড়া তো দুরের কথা ছুঁয়েও দেখেন না।

     চলমান সহিংসতা, রোহিঙ্গা ইস্যু এবং রামুর বৌদ্ধমন্দির ধ্বংস একসূত্রে গাঁথা। এ সবগুলো ইস্যুর পেছনে আমেরিকা ও সৌদি আরবের সুষ্পষ্ট মদদ রয়েছে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা। তাদের সুচিন্তিত বিশ্লেষণÑ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান চীনের বিরুদ্ধে নিজেদের সামরিক স্বার্থে ব্যবহার করতে আগ্রহী। এজন্য আমেরিকা বাংলাদেশকে তাদের সামরিক সহযোগী করতে চায় উন্নয়ন সহযোগীর আড়ালে। যে কারণে টিকফাসহ একগুচ্ছ প্যাকেজ গেলানোর দীর্ঘ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দৃশ্য-অদৃশ্য নানামুখী চাপও অব্যাহত রেখেছে তারা। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশী পোশাকপণ্যের জিএসপি সুবিধ বাতিলের চিঠি প্রধান তারই অংশ।

        মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই তার নৌশক্তির শতকরা ৬০ ভাগ এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে সমাবেশ করার প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হয়েই সর্বপ্রথম মায়ানমার সফর করেছেন। এ মায়ানমার ও বাংলাদেশের সমুদ্রাঞ্চল টার্গেট করেই মূলতঃ মার্কিন নৌঘাঁটি স্থাপনের মহাপরিকল্পনা। শুধু তা-ই নয় আমেরিকা ইহুদীবাদী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাংলাদেশের পার্বত্য তিন জেলা, ভারতের আসাম, ত্রিপুরা , মণিপুর, নাগাল্যান্ড এবং মায়ানমারের আরাকান নিয়ে পূর্ব তিমুরের আদলে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র বানানোর স্বপ্নেও বিভোর। জাতিসংঘের কল্পিত ‘আদিবাসী’ পরিভাষা প্রতিষ্ঠিত করার রহস্য  সে খোয়াবেরই মর্মকথা। তারা এশিয়ায় সাম্রাজ্যবাদীতা শক্তিশালী করতে এসব খোয়াবনামার রোডম্যাপ সাজিয়ে যেকোনো অজুহাতে এ অঞ্চলে সামরিক  নৌঘাঁটি স্থাপনের লক্ষ্য নিয়ে এগুচ্ছে। জনগণের কাছে দায়বদ্ধ কোন সরকার  এতে সায় দিবে না, তাও তাদের অজানা নয়। সে কারণে  আফগান স্টাইলে কারজাই মার্কা একটি সরকার গঠনপ্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে বিশ্বব্যাংকও স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। ঐ একই কারণে মধ্যপ্রাচ্যে সাম্রাজ্যবাদ রাজতন্ত্র ও শেখতন্ত্রকে পোষকতা করছে। বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের সামাজিক খাতে অধিক বিনিয়োগের সুপারিশ করে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনের তাগাদা দিচ্ছে। তাদের অভিমতÑ বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন নাকি একটি ধাঁধাঁ, এখানকার রাজনৈতিক সরকারগুলো দুর্নীতিতে নিমজ্জিত এবং তাদের মধ্যে সুশাসন নিশ্চিত করে সামাজিক উন্নয়ন অসম্ভব। এর সাথে ক্রমোবনতিশীল নাজুক মানবাধিকার পরিস্থিতি, ‘বিবদমান গোষ্ঠির অসন্তোষ ও প্রতিশোধ স্পৃহা’ এবং ‘প্রতিদ্বন্দ্বী সুবিধাভোগী গোষ্ঠির উত্থান’  যুক্ত হয়ে জাতিসংঘ ঘোষিত সামাজ্যবাদী লক্ষ্য বাস্তবায়নে ব্যর্থ রাষ্ট্রের ১২টি সূচক খুব দ্রুতই একে একে ধারণ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। পর্যবেক্ষকদের মতে, বিশ্বব্যাংকের অভিপ্রায়ও নাকি এমন। যার আলামত চতুর্দিকের ঘটনায় দিনদিনই পরিস্কার হচ্ছে। পদ্মাসেতুসহ বাংলাদেশের বিনিয়োগে এডিবি, আইডিবি, জাইকা, আই এম এফ কেউই বিশ্বব্যাংকের বাইরে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা রাখে না। জাতিসংঘও বিশ্বব্যাংকের অভিপ্রায় বাস্তবায়নে সক্রিয় তৎপর। আর বিশ্বলাঠিয়াল সর্দার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো ‘মানবাধিকার’ প্রতিষ্ঠায় একপায়ে খাঁড়া।
¬        এমন এক কঠিন সংকটকালে সাবেক প্রেসিডেন্ট বি. চৌধুরী  এবং সংবিধানপ্রণেতা খ্যাত ড. কামাল হোসেন গণতান্ত্রিক ঐক্যের ডাক দিয়েছেন। তাঁদের সাথে রয়েছেন প্রবীণ সাংবাদিক এ.বি এম মুসাসহ প্রগতিশীল নাগরিক সমাজের অধিকাংশ সুশীল ব্যক্তিবর্গ এবং ইলেকট্রণিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার কিছু প্রতিষ্ঠান। তাঁরা নোবেল লরেট অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে মধ্যমণি করে বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম, আসম রব, মাহমুদুর রহমান মান্না প্রমুখ ‘ক্লীনইমেজের’ রাজনীতিকদের জড়ো করে একটি তৃতীয়ধারা তৈরীতে তৎপর। এ প্রক্রিয়ায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পূঁজির বিশ্বায়নের নতুন বিশ্বব্যবস্থার মোড়ল বিশ্বব্যাংকের সম্পর্কিত হওয়া সময়ের ব্যাপারমাত্র। এ সম্পর্ক ক্ষমতার পালাবদল  ও নতুন বলয় সৃষ্টির অনুঘটক হলে তা এশিয়ার জন্য অশনিসংকেত। কিন্তু সে সন্দেহই দানা বেঁধে ক্রমেই জোরালো হচ্ছে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুকরণে তার প্রতিপক্ষ প্রতিযোগী সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ারও দিল্লীমুখী হওয়ায়। দিল্লীর প্রভূসুলভ মানসিকতা, অন্যায় আচরণ এবং অমানবিক হিংস্র কর্মকান্ডে অতিষ্ঠ নাভিশ্বাস ওঠা বাংলাদেশের জনগন এমনিতেই ভারতীয় সরকারসমূহের ওপর যারপর নাই বিক্ষুব্ধ, শেখ হাসিনার বর্তমান ভারতবান্ধব সরকারের আমলে এসে তা ভয়াবহ বিস্ফোরন্মোখ পর্যায় অতিক্রম করছে। ক্ষমতার মোহান্ধ রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতায় বাংলাদেশের কর্তৃত্ব পুরোপুরি ভারতের নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার আশংকা এ ধরনের পটপরিবর্তন সমর্থন করে তা স্বাগত জানানোর ন্যায্যতা  পাবে কি? এ আশঙ্কা মাত্রা ছাড়িয়ে জনগণের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙ্গার উপক্রম হয়েছে যখন ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার বলেন, “যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তি ভারত কোনোদিন তাদের সমর্থন দেবে না। এটা ভারতের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কথা, যা আমি আপনাদের জানিয়ে দিলাম। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান মহাজোট সরকার সফল। সামনের দিনগুলোতে এ সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবো আমরা”। তিনি গত ১৯ ডিসেম্বর, ২০১২ সোহরাওয়াদী উদ্যানের বিজয়মঞ্চে প্রকাশ্য বক্তৃতায় এ স্পর্শকাতর ঘোষণা প্রদান করে ভারতের অবস্থান পরিস্কার করার পর বিএনপিসহ ১৮ দলীয় জোটেরও মোহ এবং স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে নিশ্চয়। সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা লাভের আশা এখন তাদের কাছে কুহেলিকামাত্র। এ রকম অস্বাভাবিক অবস্থায় জনগণের ইচ্ছা ও সংকল্প ধারণ করে সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্র উচ্ছেদ করতে সশস্ত্র ক্ষমতা প্রয়োগই কি অনিবার্য হয়ে পড়েছে তাহলে? তবুও তা আরও আতঙ্ক ছড়ায় যখন দুনেত্রী জরুরীঅবস্থা ঘোষণার আশঙ্কা প্রকাশ করে পরস্পরকে দায়ী করেন। গণতন্ত্রের মানসকন্যা দাবীদার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশনেত্রী দাবীদার মাননীয় বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার অভিযোগের জবাবে পাল্টা অভিযোগ করে বলেছেন, তিনিই নাকি জরুরীঅবস্থা ঘোষণা করার পরিস্থিতি সৃষ্টির পাঁয়তারা করছেন।  অর্থাৎ জরুরী অবস্থার দায় কেউ না নিলেও, তাতেই সমাধান খুঁজছেন তাঁরাও। দুই নেত্রীর এমন ধনুকভাঙ্গা পণ ও জেদাজেদিতে মাহমুদুর রহমান মান্না স্বনামে এক মন্তব্য প্রতিবেদনে লিখেছেন-“ এই পরিস্থিতির কোনো নিস্পত্তি হওয়ার জায়গা খুঁজে পাচ্ছি না আমি। যেকোনোভাবেই হোক একটি হস্তক্ষেপ অবশ্যম্ভাবী, যেটা প্রকাশ্য কিংবা অপ্রকাশ্য, সামরিক কিংবা বেসামরিক, দেশী কিংবা বিদেশী তা বলতে পারবোনা। এই দুই প্রচন্ড জেদী নেত্রী যেরকম ‘ষাড়ের লড়াইয়ের’ প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তাতে কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়া নিস্পত্তির সম্ভাবনা আমি দেখি না”।
       
        বিরাজনীতিকরণের এ যজ্ঞে মানবমুক্তির দর্শনভিত্তিক রাজনীতি উপস্থাপিত হওয়া সময়ের দাবী। মন-মনন ও জীবনাচরণে মুক্তির ধর্মতত্ত্ব অনুধাবন চর্চা ও অনুশীলন ব্যতিত যা অসম্ভব। কোরআন মতে- মানুষ ‘নাস’, ‘ইনসান’, ‘আমানু’, ‘মুমিন’, ‘মুত্তাকীন’,‘মুহসিনিন’, ‘আদম’, ‘মুরসালিন’, ‘রব’ হয়ে ‘আল্লাহতে’ মিশে কীভাবে ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ অথবা ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান’ রূপে প্রকাশিত হয়, সে ‘সফর’ অবগত হলেই মানুষের রাজনৈতিক দর্শন সুস্থির হয়। এর মধ্যে নিহিত রয়েছে ঈশ্বর আছে কি নেই অথবা আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন নাকি ‘মানুষ’ আল্লাহ নির্মাণ করেছেÑÑ এ রকম বহুবিধও কঠিন ও জটিল প্রশ্নের সহজ ও সরল সমাধান।
       
        এজন্য এখন সময় এসেছে অধর্মের ময়লা আবরণ সরিয়ে ধর্ম আবিস্কারের। ধর্মের মসৃণ আভা ছড়ালে রাসূল (সঃ) প্রদর্শিত ইসলামও সবার দৃষ্টিগোচর হবে।  রাসূল (সঃ) আরবে জন্ম নিয়েছিলেন এবং আরব জাতীয়তাবাদের আওতার  মধ্যেই বিশ্বজনীন ‘ইসলাম’ ধারণ করায় নিজ বংশ কুরাইশদের  বন্ধু না হয়ে বরং শত্র“তে পরিণত হয়ে মক্কা ছেড়ে মদীনায় হিজরত করেছিলেন। তিনি ইহুদি, খ্রীষ্টান, মুসলমানসহ কমবেশী ১২টি সম্প্রদায় সমন্বয়ে একটি ‘উম্মাহ’ গঠনের দলিল মদিনাসনদ প্রণয়ন করেছিলেন।  তিনি  এ মদীনাসনদ “বিসমিল্লাহ”  দিয়ে শুরু করেননি এবং সেখানে বর্ণিত ৫৬টি ধারায় কোথাও ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা বা আল্লাহর আইন কায়েম  করার উল্লেখ নেই। রাসূলুল্লাহ (সঃ) এর সেই অনুসরণীয় প্রগতিশীল চিন্তার সফল ও সঠিক প্রতিফলন দেখা যায় আমেরিকার গঠনতন্ত্রে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে  কোথাও ‘গণতন্ত্র’ শব্দটি না থাকলেও, তারা তা চর্চা করে। আর বৃটেনে তো কোনো  লিখিত সংবিধানই নেই। গণতন্ত্র তাদের জীবনচর্চার অংশ। এগুলোর অনুপম শিক্ষাÑ যা চর্চায় ও চেতনায় থাকে তা বলা বা লেখার দরকার পড়ে না আর যার ছাপ জীবনাচরণে অনুপস্থিত, তা-ই কেবল বারবার মুখে উচ্চারণ করে অথবা লিখে স্মরণে আনতে হয়। যা অনর্থক।

রুহুল আমিন
সদস্যসচিব
মুক্তিআন্দোলন বাংলাদেশ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন