রবিবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১২

দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অস্থিরতা

 বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব কোণ ও এর আশপাশের এলাকা নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক ঘটনা ঘটে চলেছে। সমুদ্রে দৃশ্যমান বরফখণ্ডের মতো এসব ঘটনার খুব সামান্য অংশই আমরা দেখতে পাই। এর গভীরের বিষয়ে দৃষ্টি দেয়ার প্রয়াস মাঝে মধ্যে দেখা যায়। এর পরও অনেক ঘটনা থেকে যায় অন্তরালে । এতে ঘটনার ভেতরের নানা রহস্যই থেকে যাচ্ছে আমাদের অজানা। ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের মতো একটি ুদ্র দেশের আন্তর্জাতিক গুরুত্ব কতখানি এ নিয়ে বিস্তর বিতর্ক দেখেছি আমরা একসময়। বলা হতো, বাংলাদেশ বিশ্ব পরাশক্তির কাছে গুরুত্বের বিচারে এতই অনুল্লেখযোগ্য যে এ নিয়ে আঞ্চলিক শক্তি ভারত, যা ভাববে তেমন সিদ্ধান্তই নেবে যুক্তরাষ্ট্র। হঠাৎ করে সেই উপেক্ষার বিষয়টি যেন উবে গেছে। এখন বাংলাদেশ নিয়ে ভাবছে অনেকেই। ভাবছে বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন নিয়ে। অর্ধেক সাগরবেষ্টিত পূর্ব-দক্ষিণের জেলায় ঘাঁটি করতে চায় আমেরিকাÑ এমন কথাও শোনা যাচ্ছে। অংশীদারিত্ব সংলাপÑ এর চুক্তিও হয়েছে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে।  সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নিয়েও টানাপড়েনের অন্ত নেই। মিয়ানমারের ঠেলে দেয়া রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুরা এখন বিশ্ব মিডিয়ার বিষয়। এর মধ্যে রামুর সাম্প্রদায়িক সঙ্ঘাতের ঘটনা যুক্ত করেছে নতুন মাত্রা। পাহাড়ি তিন জেলায়ও অস্থিরতা নতুন নতুন রূপ পাচ্ছে।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতার পাশাপাশি দক্ষিণ-পূর্বের এসব ঘটনাবলির কোনো তাৎপর্য কি রয়েছে? এ প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এর সাথে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্ক যেমন প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে তেমনি এর সাথে যুক্ত হচ্ছে চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের স্বার্থের বিষয়ও। এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একটি লেখা বেশ আলোচিত হচ্ছে। নাইল বাউয়ে (Nile Bowe) এর লেখাটির শিরোনাম হলো ‘চীনকে ঠেকানোর জন্যই কি মিয়ানমারের সম্প্রদায়গত সহিংসতা?’ (Myanmar’s Ethno-Sectarian Clashes: Containing China?) গ্লোবাল রিচার্সে এ লেখাটি প্রকাশ হওয়ার পর অনেক মিডিয়া এটি পুনর্মুদ্রণ করেছে। লেখাটির সাথে বাংলাদেশ-উত্তর-পূর্ব ভারত-মিয়ানমারের একটি মানচিত্রও প্রকাশ করা হয়েছে। বিস্ময়ের বিষয় হলো এ মানচিত্রে বাংলাদেশের ছবির সাথে বৃহত্তর চট্টগ্রাম সংযুক্ত নেই। এটাকে দেখানো হয়েছে মিয়ানমারের সাথে। গবেষণাসমৃদ্ধ অ্যাকাডেমিক মানের এই লেখার কোথায়ও এই মানচিত্রের তাৎপর্য সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। কিন্তু যারা লেখাটি ছেপেছেন সবাই একই সাথে মুদ্রণ করেছেন চট্টগ্রামহীন বাংলাদেশের ছবিও।
মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। ব্যবসায়-বাণিজ্য বা অন্য কোনো কাজে একসময় মিয়ানমার যায়নি এমন পরিবার চট্টগ্রামে কমই পাওয়া যায়। ব্যক্তিগতভাবে আমার দাদা নানা এবং দুই চাচা মৃত্যুবরণ করেছেন মিয়ানমারে। কেউ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কেউ বা আরো পরে।  বাংলা ও বার্মার মধ্যে বাণিজ্য এবং অভিবাসন দুটোই বেশ পুরনো। আজ যারা রোহিঙ্গা মুসলিম তারা আরাকানে বসবাস শুরু করেন সপ্তম শতকের শেষার্ধ থেকে। ব্রিটিশ আমলের প্রতিটি আদমশুমারিতে মিয়ানমারের মুসলিম জনসংখ্যার কথা বলা হয়েছে। সেই জনসংখ্যা থেকে আজকের জনসংখ্যা বৃদ্ধির অনুপাতের মধ্যেও কোনো গরমিল নেই। কিন্তু মিয়ানমার সরকার ১৯৮২ সালে এক নাগরিক আইন করে। সে আইনে  রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে অস্বীকার করা হয়েছে।  বিস্ময়ের ব্যাপার হলো বার্মার সরকার ও বিরোধীপক্ষের মধ্যে এ নিয়ে কোনো বিরোধ যেন নেই। দেশটির প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন বলেছেন, তার সরকার কোনোভাবেই রোহিঙ্গাদের স্বাগত জানাবে না। মিয়ানমারের অভিবাসন মন্ত্রী খিন য়ি উল্লেখ করেন, তার দেশে রোহিঙ্গা নামে কোনো জনগোষ্ঠী নেই। বিরোধী নেত্রী অং সান সু কিকে ইউরোপ সফরকালে যখন প্রশ্ন করা হয়েছিল, তখন তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন ‘রোহিঙ্গা কারা?’ আর তার দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসির মুখপাত্র নিয়ান উইন বলেছেন, রোহিঙ্গারা তার দেশের নাগরিক নন। রোহিঙ্গাদের এই নাগরিক হিসেবে স্বীকার না করার বিষয়টি তাদেরকে আঞ্চলিক খেলার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহারের বিরাট এক সুযোগ এনে দিয়েছে।
বাংলাদেশকে ১৯৭১ সালের একেবারে শুরুতে যে ক’টি দেশ স্বীকৃতি দিয়েছিল তার মধ্যে একটি ছিল মিয়ানমার। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে অস্বীকৃতি জানিয়ে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়াকে কেন্দ্র করে প্রথম দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কে টানাপড়েন শুরু হয়। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পরিসংখ্যান অনুসারে ক্যাম্পের ভেতরে বাইরে দুই লাখ ৭০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে বাস করছে। নতুন করে এবারের দাঙ্গার পর যাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া হয়েছে তারা এ হিসাবের মধ্যে নেই। রোহিঙ্গারা আরাকানের ১৪০০ বছরের পুরনো অধিবাসী এবং একসময় স্বাধীন আরাকান রাজ্যের ক্ষমতার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হওয়ার পরও তাদের নাগরিকত্বকে অস্বীকার করার ব্যাপারে মিয়ানমারের সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে হঠকারী। এ সিদ্ধান্তের সুযোগ কোনো কোনো আন্তর্জাতিক শক্তি নিয়ে থাকতে পারে।  রোহিঙ্গাদের রাজনৈতিক সংগঠনগুলো আরাকান অঞ্চলের জন্য প্রাথমিকভাবে স্বায়ত্তশাসন দাবি করেছিল। এর সাড়া সরকার দিয়েছে তাদের নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে। একাধিকবার তাদের দাঙ্গা ও নিপীড়নপ্রক্রিয়ায় বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।
রোহিঙ্গা ইস্যুর বাইরে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ ছিল দুই দেশের মধ্যে আরেকটি অমীমাংসিত ইস্যু। গত মার্চে ‘ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল ফর ল অ্যান্ড সিজ’-এর রায়ে এ বিরোধ নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। বাংলাদেশ বরাবরই রোহিঙ্গা ইস্যুটি নিষ্পত্তি করে পূর্বমুখী যোগাযোগ স্থাপনে আগ্রহ প্রকাশ করে এসেছে। চীন এবং আসিয়ান দেশগুলোর সাথে সড়ক যোগাযোগের জন্য চট্টগ্রাম-মান্দালয়-কুনমিন মহাসড়কের প্রস্তাব দেয় ঢাকা। এর বাইরে রাখাইন স্টেটে একটি যৌথ পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং চাষাবাদের জমি লিজের আলোচনাও একসময় শুরু হয়েছিল। এসব উদ্যোগ বেশি দূর এগোয়নি অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতার জন্য। এ অবিশ্বাসকে উসকে দিয়ে দুই দেশের কোনো পক্ষেরই লাভ হচ্ছে না।  কিন্তু এর পেছনে কলকাঠি নাড়ছে অন্যরা।  এর সাথে যুক্ত রয়েছে তাদের স্বার্থ। এই স্বার্থবাদী চক্র সম্পর্কে নাইল বাউয়ে বিস্তারিত লিখেছেন ।
আনুষ্ঠানিকভাবে মিয়ানমারের সাথে আস্থার সম্পর্ক নির্মাণের ব্যাপারে চীন ও আসিয়ান দেশগুলোর সাথে স্থল যোগাযোগের বিষয়টি যুক্ত থাকলেও এ প্রসঙ্গে সরকারের নীতি সব সময় ইতিবাচক ছিল না। ফখরুদ্দীন-মইন উদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় মিয়ানমারের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ভিুদের আন্দোলনে তদানীন্তন সরকারের বিশেষ ভূমিকা থাকার অভিযোগ ছিল নাইপিডোর। এ সময় সমুদ্রসীমা বিরোধকে কেন্দ্র করে যুদ্ধপরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কাও দেখা দিয়েছিল। বর্তমান সরকারের সময় অবশ্য বিষয়টি আন্তর্জাতিক আদালতে নিয়ে যাওয়ার পর একটি যুক্তিসঙ্গত মীমাংসা হয়। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার পর তাদের নির্মমভাবে ফিরিয়ে দেয়া এবং হতভাগা অনেকের সলিল সমাধি ঘটার বিষয়টি দেশে-বিদেশে বেশ সমালোচনার সৃষ্টি করেছে। তবে পররাষ্ট্র সম্পর্কের গভীর বিশ্লেষণে সরকারের এই নীতিকে যুক্তিহীন হিসেবে মূল্যায়ন করা কঠিন।
মিয়ানমারের সরকার বিশ্বাস করে একতরফা মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা শুরু হওয়ার পর মংডু ও অন্য কয়েকটি স্থানে এর পাল্টা ঘটনায় আরনোর (ARNO) মতো কট্টরপন্থী গোষ্ঠীগুলোর হাত রয়েছে। এই গোষ্ঠীর সাথে আফগানিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার কট্টরপন্থী সংগঠনগুলোর যোগাযোগ রয়েছে। আরাকানে মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা ও হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে তালেবান হুঁশিয়ারিকে এ ক্ষেত্রে যুক্তি হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে।
নাইল বাউয়ে মিয়ানমারের সৃষ্ট বর্তমান অবস্থার পেছনে ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার সম্পর্ক রয়েছে বলে মনে করেন। আরাকান উপকূলের বঙ্গোপসাগর এলাকায় পাঁচ ট্রিলিয়ন ঘনফুটের মতো গ্যাসের মজুদ পাওয়া গেছে। এর দাম হবে বেশ কয়েক শত কোটি ডলার। মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় তেল গ্যাস কোম্পানির সাথে যৌথভাবে এ গ্যাসক্ষেত্রে কাজ করছে চীনা কোম্পানিগুলো। চীনের ইউনান প্রদেশে এ গ্যাস নিয়ে যেতে আরাকান থেকে ইউনান পর্যন্ত পাইপলাইন নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। রাখাইন প্রদেশের রাজধানী সিটওয়ে চীনা বিনিয়োগ কার্যক্রমের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্য। নাইলের ধারণা, চীনা বিনিয়োগ বাস্তবায়নে প্রক্রিয়াধীন বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্পে স্থানীয়দের উসকে দিয়ে যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে আরাকানের দাঙ্গার পেছনে সে রকম একটি স্বার্থ রয়েছে। মার্কিন-সৌদি আনুকূল্য এর পেছনে থাকতে পারে বলে তার ধারণা।
নাইলের বিশ্লেষণ অনুসারে চীন তার নিজস্ব স্বার্থে বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে আমেরিকান প্রভাবকে বাড়তে দিতে চায় না। দেশটি আঞ্চলিক পানিসীমায় চীনা প্রভাব বজায় রাখতে পাকিস্তানের গোয়াধরে সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে। সেখানে একটি চীনা নৌঘাঁটি গড়ার কাজও চলছে। শ্রীলঙ্কায়ও একই ধরনের প্রকল্প নিয়েছে বেইজিং। সিটওয়েতে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে চীন। বাংলাদেশের সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের ব্যাপারেও আগ্রহ প্রকাশ করছে বেইজিং। এভাবে চীন বঙ্গোপসাগর অঞ্চলেও তার উপস্থিতি জোরদার করতে চাচ্ছে। এর পাল্টা ব্যবস্থাও নানা ক্ষেত্রে নজরে আসছে। পশ্চিমা অর্থসহায়তাপুষ্ট এনজিও  ও অং সান সু কির দলের সমর্থকদের মাধ্যমে তৈরি জোরদার আন্দোলনে মিয়ানমারের বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়, এশিয়া ওয়ার্ল্ড কোম্পানি ও চীনা পাওয়ার ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানির একটি বৃহৎ যৌথ প্রকল্পের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্য কাচিনের মিয়িতসোন ড্যাম প্রকল্পটি ছিল বিশ্বের ১৫তম বৃহৎ ড্যাম প্রকল্প, যেটি ইরাবতী নদীতে বাঁধ দেয়ার মাধ্যমে তৈরির পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল। এখানে উৎপাদিত বিদ্যুতের একটি বড় অংশ চীনের ইউনান প্রদেশে রফতানির পরিকল্পনা ছিল। মিয়ানমারে যে পরিবর্তনপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছে সেটিকে নির্দিষ্ট গন্তব্যে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো গোপন কার্যক্রমের সাথে এসব বিষয় সম্পৃক্ত থাকতে পারে।
আরাকানে মুসলিমবিরোধী দাঙ্গার পর ইন্টারনেটে একটি ছবি ডাউনলোডকে কেন্দ্র করে রামুর বৌদ্ধপল্লী ও বৌদ্ধমন্দিরে যে আকস্মিক কাণ্ড ঘটে গেল, সে বিষয়টিও বেশ রহস্যপূর্ণ থেকে যাচ্ছে। এই ইস্যুতে সরকার ও বিরোধীপক্ষ একে অপরকে দায়ী করছে। বিরোধী দলের পাশাপাশি সরকার এ জন্য দায়ী করছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদেরও। বিষয়টিকে রাজনৈতিক রঙ দেয়ার জন্য মিছিলের অগ্রভাগে থাকা আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাদের বাদ দিয়ে বিরোধী দলের সাথে সংশ্লিষ্টদের গ্রেফতার এবং তাদের জড়িয়ে ঘটনাটি সাজানো হচ্ছে। কিন্তু যারা ওয়েবসাইটে কুরআন অবমাননামূলক ছবি ডাউনলোড করেছে, সেটিকে নিয়ে যারা উত্তেজনা ছড়িয়েছে, মধ্যরাতে বৌদ্ধপল্লীতে কারা আগুন দিয়েছে আর সবশেষে কেন প্রশাসনের এক ধরনের নীরব ভূমিকা দেখা গেছেÑ এসব বিষয় সে অর্থে তলিয়ে দেখা হচ্ছে না। এ ঘটনার সাথে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর গোপন কার্যক্রমের বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এ ধরনের ঘটনার রহস্য উন্মোচনের প্রচেষ্টা সাধারণভাবে নিতে দেখা যায় না। রামুর ঘটনার ক্ষেত্রেও এর বড় রকমের ব্যতিক্রম নেই। ১৯৭৫-এর ঘটনার সাথে দৃশ্যপটে যারা ছিল কেবল তাদেরই বিচার হয়েছে, এর গভীরে যাওয়ার চেষ্টা আর করা হয়নি। ১৯৮১ সালে জিয়া হত্যার ঘটনার নিষ্পত্তিও করা হয়েছে একইভাবে। নাইল বাউয়ে তার লেখায় বঙ্গোপসাগরের এই ডেল্টা উপকূলের সম্পদ আহরণ ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় বৃহৎ শক্তির যে প্রতিযোগিতাÑ  সে বিষয় উল্লেখ করেছেন। এর সাথে আরাকানের ঘটনার সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে বলেও তিনি অভিমত দিয়েছেন। রামু প্রসঙ্গে অবশ্য তার কোনো মত পাওয়া যায়নি।
নাইল বাউয়ে চট্টগ্রামবিহীন বাংলাদেশের যে মানচিত্র প্রকাশ করেছেন, তার ব্যাখ্যা তিনি না দিলেও এর সাথে এই অঞ্চলে প্রতিবেশীদের মধ্যে একটি অবিশ্বাস সৃষ্টির প্রচেষ্টার বিষয় যুক্ত থাকতে পারে। মিয়ানমারের জনসংখ্যা বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ হলেও সামরিক শক্তির বিবেচনায় দৃশ্যত দেশটি বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। প্রতিপক্ষের হামলার সুবিধাজনক অবস্থান বিবেচনায় সিটওয়েতে মিয়ানমারের যে নৌঘাঁটি রয়েছে, তা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে নিরাপদ।
মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা বিরোধের শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তি হলেও দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা জিইয়ে রাখার একটি প্রচেষ্টা অন্তরালে লক্ষ করা যায়। এ অঞ্চলের অস্থিরতার সাথে এর সম্পর্ক থাকতে পারে। মিয়ানমারে চীন ও আমেরিকার বিনিয়োগ ও কর্তৃত্ব বাড়ানোর যে লড়াই শুরু হয়েছে তা আগামী কয়েক বছরের মধ্যে অনেক পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে মিয়ানমার সফরে আসছেন। বড় রকমের কোনো ব্যত্যয় না ঘটলে ২০১৫ সালের নির্বাচনে অং সান সু কির দল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি জয়ী হবে। যদিও বিদ্যমান সাংবিধানিক ব্যবস্থা অনুযায়ী সেনাবাহিনীর একটি ভূমিকা থাকবে সরকার পরিচালনায়। প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনের ভূমিকা চলমান পরিবর্তনের পক্ষেই মনে হয়। তিনি মিয়ানমারে পশ্চিমা বিনিয়োগের জন্য আইনি কাঠামোয় ব্যাপক সংস্কার আনছেন। এসব কাজে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক ভূমিকা রাখছে।
মিয়ানমারের এ পরিবর্তন বাংলাদেশে বিশেষত চট্টগ্রামে প্রভাব ফেলতে পারে। পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য নানা তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের যেকোনো ধরনের বিচ্ছিন্ন তৎপরতাকে অতীত বা বর্তমান বাংলাদেশের কোনো সরকারই যেমন সমর্থন করেনি, তেমনি প্রতিবেশী ভারত ও চীনও সমর্থন দিচ্ছে না এ ধরনের কর্মকাণ্ডে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে পশ্চিমের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দেশের ভূমিকা রহস্যপূর্ণ। সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, ভূমি ও উন্নয়ন ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর যেকোনো যৌক্তিক দাবিকে সরকারের সহানুভূতির সাথে বিবেচনা করা উচিত। কিন্তু তা কোনোভাবেই সার্বভৌমত্বের বিনিময়ে হতে পারে না। এ কৌশলগত মৌলিক বিষয়ে সরকারের অনেক কার্যক্রম দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বলে মনে হয় না। সরকার একটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে চাইছে নাÑ সেটি হলো বাংলাদেশের মতো দেশে যেকোনো পশ্চিমা হস্তক্ষেপ জঙ্গিবাদের বাহানা নিয়েই আসার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশে আলকায়েদা বা জঙ্গিবাদের প্রভাব বাড়ছে বলে সরকারিভাবে কোনো প্রচারণা যদি চালানো হয় তার প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে তা নিয়ে ভাবা হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে অন্য কোনো অ্যাজেন্ডা ব্যাক অব দ্য মাইন্ডে রেখে জঙ্গিবাদ দমনে সামরিক হস্তক্ষেপের মতো সুযোগ তৈরি হতে পারে পশ্চিমাদের জন্য। সেই অ্যাজেন্ডাটি যদি পূর্ব তিমুর বা দক্ষিণ সুদানের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়ে থাকে, তাহলে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। রামুর ঘটনায় জঙ্গিবাদের সম্পৃক্ততা, দেশের মধ্যপন্থী-গণতান্ত্রিক ধারার বৃহৎ একটি ইসলামি দলকে জঙ্গিবাদের সাথে সম্পৃক্ত করে প্রচারণা চালানো এবং এ দলটির সাথে সরকারের জঙ্গি সংগঠনের মতো আচরণÑ অদূরভবিষ্যতে কতটা আত্মঘাতী হতে পারে বিষয়টি গভীরভাবে রাষ্ট্রের শীর্ষব্যক্তিরা হয়তো বিশ্লেষণের প্রয়োজন মনে করছেন না। যুক্তরাষ্ট্রে একের পর এক বাংলাদেশী বংশোদ্ভূতকে এফবিআই স্টিং অপারেশন চালিয়ে জঙ্গি হিসেবে প্রতিপন্ন করে দীর্ঘমেয়াদি জেল দেয়া হচ্ছে। এ বিষয়টিকে একেবারে সাদামাটাভাবে দেখা উচিত হবে না। বাংলাদেশ সরকার সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে নিজের তৈরি ফাঁদে নিজেই পড়তে যাচ্ছে কি না গভীরভাবে ভেবে দেখা দরকার। বাংলাদেশের মতো একটি আন্তর্জাতিক বিশ্বনির্ভর দেশকে অতি সতর্কভাবে ভারসাম্য রক্ষা করে পররাষ্ট্রনীতির কৌশল সাজাতে হবে। এ কৌশলে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশের সাথে ভালো সম্পর্ক থাকবে। কূটনৈতিক-অর্থনৈতিক জোরালো সম্পর্ক থাকবে চীনের সাথে। একই সাথে মুসলিম বিশ্বের সাথেও ভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্কের ওপর জোর দিতে হবে। আস্থার সম্পর্ক নির্মাণ করতে হবে প্রতিবেশী দেশ ভারত-মিয়ানমারের সাথেও। এ নীতিতে যেকোনো ভুল-ভ্রান্তি দেশের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বকে বিপন্ন করতে পারে। এর ছোটখাটো কিছু লক্ষণ দেশের সংঘাতময় অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং এ অঞ্চলে বৃহৎ শক্তিগুলোর আনাগোনায় দেখা যাচ্ছে। এর প্রতি সুতিè নজর রাখা না হলে বিপদ যখন সমাগত হয়ে দাঁড়াবে তখন কিছু করার থাকবে না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন