বৃহস্পতিবার, ২৮ জুন, ২০১২

আফগান যুদ্ধ কি ভারতের দিকে মোড় নেবে


ওসামা-পরবর্তী সংঘটিত সন্ত্রাসমূলক কার্যক্রম যথা পাকিস্তানি নৌ বন্দরে বিদ্রোহীদের (Militant) আক্রমণ, আফগান সীমানা পার করে পাকিস্তানে প্রবেশ করে ৫০০ বিদ্রোহী দ্বারা ২২ মে পাকিস্তানের ওপর আক্রমণ এবং পরবর্তী সময়ে ১৬ জুন বাজাউর এজেন্সির ওপর বিধ্বংসী তত্পরতা পরিচালনা এবং পাইলটবিহীন বিমান (ড্রোন) দ্বারা পাকিস্তানের ওপর আক্রমণ পরিচালনা—এসব বিষয় বিবেচনা করে বিশিষ্ট রাজনীতিবিদরা একমত হয়েছেন যে, আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার আগে মার্কিনিরা আফগান যুদ্ধকে পাকিস্তানে নিয়ে আসবে।
লক্ষণীয় যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নিশ্চিত করেছেন আমেরিকান সেনাবাহিনী আফগানিস্তান থেকে প্রত্যাহার শুরু হবে এই জুলাই মাস থেকে এবং ২০১৪ সালে এ কাজ সম্পন্ন হবে। ইসলামাবাদ প্রসঙ্গে বলার সময় ওবামা বলেন, ‘আমরা পাকিস্তানি সরকারের সঙ্গে একযোগে কাজ করব, যাতে মৌলবাদী সন্ত্রাসীদের মূল কোথায় তা বেরিয়ে আসে। উগ্রবাদী এসব সন্ত্রাসীর সন্ত্রাস থেকে কোনো দেশ নিরাপদ নয়।’ সংসদে সমস্যা সমাধানের বিষয়ে আলোচনার সময়, পাকিস্তান একটি স্বাধীন রাষ্ট্র এটা জেনেও ‘তিনি সন্ত্রাসীদের আশ্রয়স্থলে আরও আক্রমণ চালানোর কথা ব্যক্ত করেন’ যেসব আশ্রয়স্থল কিনা তাদের মতে পাকিস্তানে অবস্থিত।
প্রকৃত অর্থে তালেবানরা পাকিস্তানে অরাজকতা সৃষ্টি, আত্মঘাতী বোমা হামলা, বোমা বিস্ফোরণ, নিরাপত্তারক্ষীদের চেকপোস্টে হামলা, বাজোর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাহায্য এবং বিভিন্ন ধরনের সুনির্দিষ্ট হত্যার পেছনে আসলে আছে আমেরিকার সিআইএ, ভারতের ‘র’ এবং ইসরাইলের মোশাদ। আমেরিকা পাকিস্তানবিরোধী বিভিন্ন শক্তি, যেমন ভারত এবং ইসরাইলকে সাহায্য করছে পাকিস্তানকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র বানানোর জন্য। এসবের মাধ্যমে আমেরিকা পাকিস্তানের কাছ থেকে পারমাণবিক অস্ত্র তুলে নেয়ার মঞ্চ তৈরি করছে। আমেরিকা বিশ্বের কাছে প্রজ্ঞাপন করবে যে পাকিস্তানের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র নিরাপদ নয়। এসব করার জন্যই প্রস্তুতি নিচ্ছে আমেরিকা।
পাকিস্তানবিরোধী এসব তত্পরতা চলাকালীন, ইরানের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদ ৭ জুন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পান—‘সঠিক এসব তথ্যের মধ্যে উল্লেখ্য যে আমেরিকা পাকিস্তানি পারমাণবিক শক্তিকে নষ্ট করে পাকিস্তানের ওপর আধিপত্য পেতে চায়।’ তিনি আরও উল্লেখ করেন, ইহুদি রাষ্ট্রপন্থীরাও এসব চক্রান্তের পেছনে রয়েছে। তিনি বলেন, এসব চক্রান্তে সফল হওয়ার জন্য আমেরিকা ‘জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকেও পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টিকারী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। পাকিস্তানকে অসম্মানিত এবং দুর্বল করাই তাদের লক্ষ্য।’
এ অবস্থায় সাধারণ মানুষের ওপর যেসব নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে তা চিন্তা না করেই আমেরিকান ক্ষমতাসীনরা ইসলামাবাদের ওপর চাপ দিচ্ছে বিদ্রোহীদের বিপক্ষে আরও কিছু করার জন্য এবং তারা বলছে যেন উত্তর ওয়াজিরিস্তানের হাক্কানি নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানো হয়।
বর্তমান জটিল এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল আশফাক কায়ানি ৯ জুন বলেন, ‘একটি পরিকল্পিত ও সুষ্ঠু সামরিক অভিযান জোরপূর্বক নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে হতে পারে না... ভবিষ্যতেও পারবে না। যখন সামরিক অভিযান চালানো হবে তা রাজনৈতিকভাবে বিবেচনা করেই চালানো হবে।’ জাতীয় একতার ওপর জোর দিয়ে কায়ানি আরও বলেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ কোনো প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিচ্ছেদ সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা জাতীয় স্বার্থের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত নয়। পাকিস্তানে জনগণ সব সময়ই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার মনে করেছে।’ বর্তমানে ইসলামাবাদ ও ওয়াশিংটনের মধ্যে সম্পর্কের অবনতির কথা চিন্তা করে অতীতের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, সামরিক ও বেসামরিক শাসনামলে পাকিস্তান সবসময় আমেরিকার অযৌক্তিক দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে। আমেরিকার দ্বিমুখী চালের কথা জানার পর এবং আফগান যুদ্ধকে পাকিস্তানে নিয়ে আসার পরিকল্পনার কথা মাথায় রেখে, ইসলামাবাদ যুক্তরাষ্ট্রের ১২০ সামরিক প্রশিক্ষককে ফেরত পাঠিয়ে দেয়।
সত্য এই যে, আফগান যুদ্ধ পাকিস্তানে ঠেলে নিয়ে এলে এর সঙ্গে ভারতও জড়িয়ে যাবে। যাদের সঙ্গে কিনা যুক্তরাষ্ট্র ২০০৮ সালে একটি অসামরিক পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষর করে চীনের বিরুদ্ধে পাল্টা শক্তি দাঁড় করানোর জন্য। ভারতকে এশিয়ার সুপার পাওয়ার বানানো হলো তাদের লক্ষ্য। এছাড়াও আমেরিকা এবং কিছু পাশ্চাত্য দেশ নয়াদিল্লিকে তাদের ব্যবসায়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ মনে করে। যেখানে পাকিস্তানই হলো তাদের দুষ্ট চক্রান্তের পথের একমাত্র বাধা।
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কথাই চিন্তা করা যাক। যারা কিনা তাদের সামরিক শক্তি দ্বারা তাদের মতবাদ প্রচার করত এবং তাদের সামরিক শক্তি বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে দিয়েছিল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ে। তাদের পারমাণবিক অস্ত্র পর্যন্ত এই পতন থামাতে পারেনি। এটা ভেঙে পড়ার আরেকটা মূল কারণ এই ছিল যে, দেশটির সর্বোচ্চ প্রতিরক্ষা ক্ষমতাসীমা পার হয়ে গিয়েছিল, যার ফলে দেশের ভেতর আর্থিক সঙ্কট দেখা দিয়েছিল। আফগানিস্তানের সঙ্গে দীর্ঘ যুদ্ধের কথা মাথায় রেখে সাবেক সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট গর্বাচেভ এটিকে একটি ‘রক্তক্ষরিত ক্ষত’ হিসেবে ঘোষণা দেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক বাহিনী বিভিন্ন রাষ্ট্রের স্বাধীনতা সংগ্রামকে থামাতে ব্যর্থ হয়। অন্যদিকে তাদের আগের এই বন্ধুরাষ্ট্রের ভুল থেকে ভারত কোনো শিক্ষাই গ্রহণ করেনি। ভরত একদিক থেকে না হলেও অন্যদিক থেকে সোভিয়েত নীতিমালাই অনুসরণ করছে।
এটা ব্যক্ত করা জরুরি যে, ভারত গণতন্ত্রের মুখোশ পরিধান করে হিন্দু জাতীয়তাবাদকে হৃদয়ে রেখে পাশবিকভাবে দমন করে চলেছে আসাম, খালিস্তান, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, তামিলনাড়ু এবং ত্রিপুরার জনগণ পরিচালিত বিভিন্ন ধরনের স্বাধীনতা সংগ্রাম। নিকট অতীতে মাওবাদীরা আরও সংগ্রামী হয়ে উঠেছিল। সরকারি বিভিন্ন স্থানে তারা হামলা চালিয়েছিল। এসব বিবেচনায় ভারতীয় মিডিয়াও স্বীকার করেছে, মাওবাদীরা অন্ধ্রপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড় এবং উড়িষ্যার মতো বিভিন্ন রাজ্যে ঢুকে পড়েছে এবং ভারতবিরোধী বিভিন্ন কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি করেছে।
ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের ক্ষেত্রেও ভারতীয় সেনাবাহিনী সেখানকার স্বাধীনতা সংগ্রামকে বিপর্যস্ত করতে সক্ষম হয়নি। যদিও তারা সেনাবাহিনী পরিচালিত কোনো ধরনের সন্ত্রাসমূলক কাজ থেকেই বিরত থাকেনি, কারফিউ, ম্যাসাকার, ক্র্যাকডাউন, হত্যা সবই তারা প্রয়োগ করেছে তাদের শাসন বজায় রাখার জন্য।
নেপোলিয়ন-পরবর্তী ইউরোপ প্রমাণ করে যে সেনাবাহিনী দিয়ে জোরপূর্বক স্বাধীনতা সংগ্রাম দমিয়ে রাখা যায় না। এরই মতো রাজপুত্র মেটারনিক, যিনি কিনা অষ্ট্রো-হাঙ্গেরির সম্রাট ছিলেন, তিনি ভিনদেশিদের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সব রকম সন্ত্রাসমূলক কর্মই করেছিলেন। ভারতীয় একজন ইতিহাসবিদ, মাহাজীন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘মেটারনিক স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন, তিনি একটি অনর্থক কারণের জন্য যুদ্ধ করছিলেন। তার সাম্রাজ্য ভেঙে গিয়েছিল। যার ফলে স্বাধীন হয়েছিল ইটালি, বুলগেরিয়া এবং অন্য দেশগুলো, যাদের মধ্যে গোপনে স্বাধীনতা উদ্ধারের কার্যক্রম পরিচারিত হচ্ছিল।’
সাম্প্রতিক অতীতে যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মিলোসিভিচের চেষ্টা ও সীমাহীন নৃশংসতার পরেও যুগোস্লাভিয়ার পতন ঘটে।
এটা বলা জরুরি যে, দক্ষিণ এশিয়া এ ব্যাপারে সচেতন, যদিও ভারতের বর্তমান সরকার কংগ্রেস নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ একটি দল হিসেবে দাবি করে, তবু বিভিন্ন মৌলবাদী দল যেমন বিজেপি, আরএসএস, ভিএইচপি, শিবসেনা এবং বজরং দল জাতীয় রাজনীতির মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা প্রকাশের কোনো সুযোগই হাতছাড়া করেনি।
যদিও অন্যান্য সমাজের মানুষের বিরুদ্ধে উত্পীড়ন, দেশ ভাগের পর হিন্দু মৌলবাদীদের জন্য খুবই স্বাভাবিক, কিন্তু বিগত সময়ে মুসলিম ও খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে তাদের অত্যাচার ও রক্তপাত আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়াও বিগত মুসলিম গণহত্যা, বাবরি মসজিদ ধ্বংস, আড়াই হাজারেরও বেশি মুসলমানের বেপরোয়া হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় বিজেপি শাসিত ভারতের রাজ্যগুলোতে। ২০০৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বরের রায়টে উত্তর প্রদেশে ২শ’র বেশি মুসলমানকে হত্যা করা হয়। তাদের পরিচালিত সবচেয়ে বর্বরতার ঘটনার মধ্যে রয়েছে ৬ সদস্যের একটি মুসলিম পরিবারের সবাইকে জীবন্ত জ্বালিয়ে মেরে ফেলা। অনুরূপ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী এবং তাদের সম্পত্তির ওপরও হিন্দু দাঙ্গাবাজরা আক্রমণ চালায় উড়িষ্যা, আসাম, কেরালা এবং অন্ধ্রপ্রদেশে। যার ফলে কিছু নিরীহ খ্রিস্টানকে প্রাণ দিতে হয়। এরকম অন্য সংখ্যালঘুরাও হিন্দু সন্ত্রাসীদের টার্গেট।
এসব ছাড়াও বিভিন্ন প্রদেশ এবং অঞ্চলের অসমতা বেড়েই চলেছে এবং ভারতের অধিকসংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে এবং তারা বেঁচে থাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা যেমন পরিষ্কার কাপড় ও খাবার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এসবের মধ্যেও পাকিস্তানকে দুর্বল করার তত্পরতা চালিয়েই যাচ্ছে তাদের অপরিপূরণকৃত এজেন্ডা হিসেবে। যুক্তরাষ্ট্রের অনুসরণকারী দিল্লির বোঝা উচিত, রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে শক্তিশালী দলগুলো যাদের সংগ্রামী বলে আখ্যা দেয়া হয় তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বজায় রাখছে—আফগানিস্তান থেকে ভারত ও ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর এবং সেখান থেকে প্রজাতান্ত্রিক মধ্য এশিয়ার মধ্যে।
ইতিহাস প্রমাণ করে, কোনো অঞ্চলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলে তার প্রভাব আশপাশের দেশগুলোর ওপর পড়ে। বলকানের অতীত এবং বর্তমান ইতিহাসের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, একটি রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্রদ্রোহিতা এবং রাষ্ট্রের মধ্যে ভাগ সৃষ্টি করলে আশপাশের প্রতিবেশী দেশগুলো এর দ্বারা প্রভাবিত হয়। উদাহরণস্বরূপ আমরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দিকেই তাকাতে পারি। প্রথমে এটি ছোট দুটি দেশের স্থানীয় সমস্যা ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এটি ইউরোপসহ আমেরিকা, জাপান এবং তুরস্কে ছড়িয়ে পড়ে। একইভাবে সুদান এবং সোমালিয়ার মধ্যে গৃহযুদ্ধ ও অশান্তি-অরাজকতা আশপাশের অঞ্চলের দেশগুলোকে প্রভাবিত করেছে, যার সহিংসতার শিকার তিউনিস, মিসর, সিরিয়া, লিবিয়া ইত্যাদি দেশ। মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশও এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে।
তবু আমেরিকার বোঝা উচিত, তারা যদি তালেবান এবং আল কায়দার বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ শক্তি নিয়ে যুদ্ধে নেমে পড়ে এবং পাকিস্তানকেও এর মধ্যে জড়িয়ে ফেলে, তাহলে আফগান যুদ্ধ ভারতে চলে আসবে, যা কিনা আমেরিকার আঞ্চলিক এবং বিশ্বব্যাপী স্বার্থে আঘাত হানবে। সুতরাং একটি স্থিতিশীল পাকিস্তান ভারত, আমেরিকা এবং ইউরোপের জন্যই ভালো।
সাজ্জাদ শওকত
লেখক : দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ, কলামিস্ট
অনুবাদ : পরম ওয়াজেদ শিকদার

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন