রবিবার, ১০ জুন, ২০১২

কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তির প্রতিক্রিয়া


যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেট হিলারি ক্লিনটন Foreign Policy পত্রিকায় এক মন্তব্যে বলেছেন, 'ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত সম্পর্ক নিশ্চিত' ('The US is making a strategic bet on India�s future')। তিনি আরও বলেন, 'এখনো কিছু সমস্যা রয়েছে যা দূর করতে হবে; কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক স্থাপনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, কেননা আমরা বিশ্বাস করি, বিশ্বের রঙ্গমঞ্চে ভারতের আরও সক্রিয় ভূমিকা বিশ্বে শান্তি ও নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে।' তার কথায়, 'ওবামা প্রশাসনের দূরদৃষ্টি (Vision) হলো- ভারতের নেতৃত্বে এবং ভারতকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিকভাবে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াকে ঐক্যবদ্ধকরণ এবং রাজনৈতিকভাবে আরও স্থিতিশীলকরণ (�Obama administration�s vision for a more economically integrated and politically stable South and Central Asia with India as a linchpin�)। কিছুদিন আগ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়াকে দেখেছে ভারত ও পাকিস্তানকে ব্র্যাকেট করে। বর্তমানে ভারতের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং চীনের অভাবনীয় উত্থান বুশ প্রশাসনকে প্রণোদনা জুগিয়েছে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সিভিল এবং পারমাণবিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা প্রতিষ্ঠার। ২০১০ সালে ওবামার ভারত সফরকালে তা আরও শক্তিশালী হয়। এমনকি ওবামা জাতিসংঘে একটি স্থায়ী আসনে ভারতকে নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান। এভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর হয়ে উঠেছে। US-India গ্রুপের মাধ্যমে উভয়ের মধ্যে নিয়মিত আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে। তা ছাড়াও ভারতকে Asia Pacific আঞ্চলিক কার্যক্রমের সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ভারত বোয়িং C-17 গ্লোবমাস্টারও লাভ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে। এসব ঘটছে চীন যেভাবে দৈত্যের মতো লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে আসছে সে প্রেক্ষাপটে। বর্তমানে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চীনের অবস্থান বিশ্বে শীর্ষস্থানীয়। অর্থনীতি শক্তিশালী হলে সামরিক পেশিও স্ফীত হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্র তা ভালো করে জানে। তাই আগেভাগে চীনকে সংযত রাখতে (Contain) যুক্তরাষ্ট্র, এমন সব ব্যবস্থা গ্রহণ করছে যেন চীন বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রকে স্থানচ্যুত করে তেমন অবস্থানে অত সহজে যেতে না পারে।
ভারতের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের এ আস্থার মূলে কাজ করছে দক্ষিণ এশিয়া, মধ্য এশিয়া ও এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রায় কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত ভারত। ভারত মস্ত বড়ও। দক্ষিণ এশিয়ার কেন্দ্রে অবস্থিত ভারতের জনসংখ্যাও বিরাট। প্রায় ১১০ কোটির মতো। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (SAARC) অন্য সাত সদস্য দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় তিনগুণ। বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা এবং মালদ্বীপের মোট জনসংখ্যা প্রায় ২২ কোটি। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে বসবাস করেন প্রায় ১৯ কোটি জনগণ। ভারত জনসংখ্যার নিরিখেই শুধু যে বিরাট তা নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার মোট উৎপাদনের (GDP) প্রায় ৮০ ভাগ ভারতের। বিশ্বব্যাংকের মতে, দক্ষিণ এশিয়া হলো বিশ্বের সবচেয়ে অসংহত (least integrated) অঞ্চল। ফলে এ অঞ্চলকে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে কাজে লাগানোও সহজ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, এ অঞ্চলে আন্তঃদেশীয় বাণিজ্যের পরিমাণ GDP-এর শতকরা ২ ভাগের মতো, অথচ একটু পূর্বে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এ পরিমাণ শতকরা ২০ ভাগ।

যুক্তরাষ্ট্র মস্তবড় বটে এবং এর অস্ত্রসজ্জাও সুনিপুণ। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক যে তত্ত্বটি 'String of Pearls (মুক্তার মালা) নামে খ্যাত সে সম্পর্কে তেমন ভেবেছে বলে মনে হয় না। বলছি এ জন্য যে, ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অংশীদারিত্বের প্রধান দুর্বলতা হলো সংকটকালে চীন ছোট ছোট রাষ্ট্রের মুক্তার মালায় ভারতকে পরিবেষ্টিত করে ফেলতে পারে। ইচ্ছা করলে চীন তার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক সহায়তার মাধ্যমে ভারত মহাসাগরের উপকণ্ঠে অবস্থিত মিয়ানমার, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কায় নৌঘাঁটি গড়ে তুলতে পারে। চীন ওই পথে অগ্রসর হচ্ছে তার কিছু নমুনাও দেখা যায়। ২০১১ সালে মালদ্বীপে অনুষ্ঠিত সার্ক (SAARC) শীর্ষ সম্মেলনের আগে চীন মালদ্বীপে দূতাবাস নির্মাণের ব্যবস্থা করে। তা ছাড়া এ শীর্ষ সম্মেলনে চীন সার্কের অন্যতম Dialogue Partner-এর মর্যাদা পাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে এবং আসিয়ানের ASEAN+। এর মতো SAARC+ পর্যায়ের মর্যাদা পেতে ইচ্ছা প্রকাশ করে। এরই মধ্যে চীন শ্রীলঙ্কার জন্য এক সমুদ্র বন্দর তৈরি করেছে। বাংলাদেশেও চীন এক সমুদ্র বন্দর নির্মাণের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এমনকি ভূমি পরিবেষ্টিত নেপালের সঙ্গেও অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে আগ্রহী চীন। এ লক্ষ্যে চীনের প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াবাও (Wen Jiabau) ২০১১ সালে নেপাল সফর করে। উত্তর-পশ্চিমে পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের সুসম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে। অবশ্য মাত্র ক'দিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেট হিলারি ক্লিনটন ৫ জুন বাংলাদেশ সফর করে গেলেন এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে যৌথ অংশীদারিত্বের একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে বছরে একবার সংলাপ হবে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তাদের সঙ্গে। এর প্রাতিষ্ঠানিক রূপটা তৈরি হলো। বাংলাদেশের পূর্বে অবস্থিত মিয়ানমারে গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে যে পরিবর্তনের সুবাতাস বইছে যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে তা লক্ষ্য করছে এবং এও লক্ষ্য করছে নতুন মিয়ানমারে চীনের প্রভাব কতটুকু বিদ্যমান থাকবে। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদারিত্বের চুক্তিটি অনেকের চোখে নির্দোষ (Innocusous) মনে হতে পারে। আমার মনে হয়েছে, ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের যে কৌশলগত চুক্তি বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের তেমনি চুক্তির অগ্রদূত এটি। এরপর TIFA (Trade and Investment Framework Agreement)-এর Precusor স্বরূপ। 'সমুদ্র বিজয়ের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে উষ্ণ সংবর্ধনা দেওয়া হলো। কিন্তু কেউ দেখলেন না যে, বাংলাদেশের একটি ইউনিয়ন সেন্টমার্টিনকে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের বাইরে রাখা হয়েছে ওই রায়ে। বাংলাদেশের নৌবাহিনীর একটি আস্তানা এটি। এ আস্তানাকে শক্তিশালী করার অজুহাতে TIFA অথবা TICFA চুক্তি স্বাক্ষর হলে যুক্তরাষ্ট্রের Marine-দের ঘাঁটিতে পরিণত হতে পারে এটি। এমনই একটি কথা এ অঞ্চলে খুব জনপ্রিয় বিশেষ করে পাকিস্তানে। যুক্তরাষ্ট্র যার বন্ধু, তার ধ্বংসের জন্য অন্য কোনো শত্রুর প্রয়োজন হয় না। আফগানিস্তান থেকে এত শক্তিসামর্থ্য নিয়েও যুক্তরাষ্ট্রকে ফিরে যেতে হচ্ছে ২০১৪ সাল নাগাদ খালি হাতে। উত্তর-পশ্চিমে ব্যর্থ হয়ে উত্তর-পূর্বে যেন ব্যর্থ হতে না হয় তার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সব অলিগলি বন্ধ করেই নামছে এ উদ্যোগে। অথচ ভারত মহাসাগরকে চীনমুক্ত রাখতে বদ্ধপরিকর। তার ব্যবসা-বাণিজ্য তথা আমদানি-রপ্তানির জন্য ভারত মহাসাগরে চীনের আধিপত্য জরুরি। চীন এ সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন। সচেতন দক্ষিণ এশিয়ার ছোট ছোট রাষ্ট্রগুলোও। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের কৌশলগত অংশীদারিত্ব ভারতকে তার ছোট ছোট প্রতিবেশী সম্পর্কে আরও আগ্রাসী, আরও উগ্র করে তুলতে পারে_ এ আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ। শ্রীলঙ্কার গবেষক Shelton Kodikara লিখেছেন : A perception of threat from India is currently common to all its neighbours and it is one of the dilemmas of South Asian Politics that while India perceives its neighbours as being integral to its own security the neighbours perceive India itself as the entity against which security is necessary.
ভারতের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের এ আস্থার মূলে কাজ করছে দক্ষিণ এশিয়া, মধ্য এশিয়া ও এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রায় কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত ভারত। ভারত মস্ত বড়ও। দক্ষিণ এশিয়ার কেন্দ্রে অবস্থিত ভারতের জনসংখ্যাও বিরাট। প্রায় ১১০ কোটির মতো। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (SAARC) অন্য সাত সদস্য দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় তিনগুণ। বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা এবং মালদ্বীপের মোট জনসংখ্যা প্রায় ২২ কোটি। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে বসবাস করেন প্রায় ১৯ কোটি জনগণ। ভারত জনসংখ্যার নিরিখেই শুধু যে বিরাট তা নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার মোট উৎপাদনের (GDP) প্রায় ৮০ ভাগ ভারতের। বিশ্বব্যাংকের মতে, দক্ষিণ এশিয়া হলো বিশ্বের সবচেয়ে অসংহত (least integrated) অঞ্চল। ফলে এ অঞ্চলকে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে কাজে লাগানোও সহজ। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, এ অঞ্চলে আন্তঃদেশীয় বাণিজ্যের পরিমাণ GDP-এর শতকরা ২ ভাগের মতো, অথচ একটু পূর্বে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এ পরিমাণ শতকরা ২০ ভাগ।

যুক্তরাষ্ট্র মস্তবড় বটে এবং এর অস্ত্রসজ্জাও সুনিপুণ। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক যে তত্ত্বটি 'String of Pearls (মুক্তার মালা) নামে খ্যাত সে সম্পর্কে তেমন ভেবেছে বলে মনে হয় না। বলছি এ জন্য যে, ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অংশীদারিত্বের প্রধান দুর্বলতা হলো সংকটকালে চীন ছোট ছোট রাষ্ট্রের মুক্তার মালায় ভারতকে পরিবেষ্টিত করে ফেলতে পারে। ইচ্ছা করলে চীন তার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক সহায়তার মাধ্যমে ভারত মহাসাগরের উপকণ্ঠে অবস্থিত মিয়ানমার, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কায় নৌঘাঁটি গড়ে তুলতে পারে। চীন ওই পথে অগ্রসর হচ্ছে তার কিছু নমুনাও দেখা যায়। ২০১১ সালে মালদ্বীপে অনুষ্ঠিত সার্ক (SAARC) শীর্ষ সম্মেলনের আগে চীন মালদ্বীপে দূতাবাস নির্মাণের ব্যবস্থা করে। তা ছাড়া এ শীর্ষ সম্মেলনে চীন সার্কের অন্যতম Dialogue Partner-এর মর্যাদা পাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে এবং আসিয়ানের ASEAN+। এর মতো SAARC+ পর্যায়ের মর্যাদা পেতে ইচ্ছা প্রকাশ করে। এরই মধ্যে চীন শ্রীলঙ্কার জন্য এক সমুদ্র বন্দর তৈরি করেছে। বাংলাদেশেও চীন এক সমুদ্র বন্দর নির্মাণের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এমনকি ভূমি পরিবেষ্টিত নেপালের সঙ্গেও অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে আগ্রহী চীন। এ লক্ষ্যে চীনের প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াবাও (Wen Jiabau) ২০১১ সালে নেপাল সফর করে। উত্তর-পশ্চিমে পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের সুসম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে। অবশ্য মাত্র ক'দিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব স্টেট হিলারি ক্লিনটন ৫ জুন বাংলাদেশ সফর করে গেলেন এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে যৌথ অংশীদারিত্বের একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে বছরে একবার সংলাপ হবে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তাদের সঙ্গে। এর প্রাতিষ্ঠানিক রূপটা তৈরি হলো। বাংলাদেশের পূর্বে অবস্থিত মিয়ানমারে গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে যে পরিবর্তনের সুবাতাস বইছে যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে তা লক্ষ্য করছে এবং এও লক্ষ্য করছে নতুন মিয়ানমারে চীনের প্রভাব কতটুকু বিদ্যমান থাকবে। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদারিত্বের চুক্তিটি অনেকের চোখে নির্দোষ (Innocusous) মনে হতে পারে। আমার মনে হয়েছে, ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের যে কৌশলগত চুক্তি বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের তেমনি চুক্তির অগ্রদূত এটি। এরপর TIFA (Trade and Investment Framework Agreement)-এর Precusor স্বরূপ। 'সমুদ্র বিজয়ের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে উষ্ণ সংবর্ধনা দেওয়া হলো। কিন্তু কেউ দেখলেন না যে, বাংলাদেশের একটি ইউনিয়ন সেন্টমার্টিনকে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের বাইরে রাখা হয়েছে ওই রায়ে। বাংলাদেশের নৌবাহিনীর একটি আস্তানা এটি। এ আস্তানাকে শক্তিশালী করার অজুহাতে TIFA অথবা TICFA চুক্তি স্বাক্ষর হলে যুক্তরাষ্ট্রের Marine-দের ঘাঁটিতে পরিণত হতে পারে এটি। এমনই একটি কথা এ অঞ্চলে খুব জনপ্রিয় বিশেষ করে পাকিস্তানে। যুক্তরাষ্ট্র যার বন্ধু, তার ধ্বংসের জন্য অন্য কোনো শত্রুর প্রয়োজন হয় না। আফগানিস্তান থেকে এত শক্তিসামর্থ্য নিয়েও যুক্তরাষ্ট্রকে ফিরে যেতে হচ্ছে ২০১৪ সাল নাগাদ খালি হাতে। উত্তর-পশ্চিমে ব্যর্থ হয়ে উত্তর-পূর্বে যেন ব্যর্থ হতে না হয় তার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সব অলিগলি বন্ধ করেই নামছে এ উদ্যোগে। অথচ ভারত মহাসাগরকে চীনমুক্ত রাখতে বদ্ধপরিকর। তার ব্যবসা-বাণিজ্য তথা আমদানি-রপ্তানির জন্য ভারত মহাসাগরে চীনের আধিপত্য জরুরি। চীন এ সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন। সচেতন দক্ষিণ এশিয়ার ছোট ছোট রাষ্ট্রগুলোও। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের কৌশলগত অংশীদারিত্ব ভারতকে তার ছোট ছোট প্রতিবেশী সম্পর্কে আরও আগ্রাসী, আরও উগ্র করে তুলতে পারে_ এ আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ। শ্রীলঙ্কার গবেষক Shelton Kodikara লিখেছেন : A perception of threat from India is currently common to all its neighbours and it is one of the dilemmas of South Asian Politics that while India perceives its neighbours as being integral to its own security the neighbours perceive India itself as the entity against which security is necessary.

তার কথায়, ভারতভীতি রয়েছে তার প্রত্যেক প্রতিবেশীর মনে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম উভয় সংকট হলো ভারত তার প্রত্যেক প্রতিবেশীকে মনে করে তার নিজস্ব নিরাপত্তার জন্য অবিচ্ছেদ্য অংশ রূপে। কিন্তু তার প্রতিবেশীরা ভারতকে মনে করে এমন এক জনপদ যা তাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ।

দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের কোনো প্রতিবেশী ভারতের আগ্রাসী থাবা থেকে নিরাপদ নয়। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে ছোট্ট লুক্সেমবার্গ যেমন নিরাপদ, নিকটবর্তী আসিয়ানে (ASEAN) ছোট্ট সিঙ্গাপুর যেমন নিরাপদ তেমনি নিরাপদ নয় শ্রীলঙ্কা ও নেপাল। পাকিস্তান তো জন্মলগ্ন থেকেই ভারতের সঙ্গে লড়াই করে টিকে রয়েছে। বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে যেসব চুক্তি হয়েছিল ১৯৭৪ সালে তার অনেকগুলোই বাস্তবায়িত হয়নি আজ পর্যন্ত। গঙ্গার মতো আন্তর্জাতিক নদীর ওপর ফারাক্কায় বাঁধ দিয়ে প্রমত্তা পদ্মাকে একটি ছোট্ট খালে পরিণত করা হয়েছে। তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি এখনো হয়নি। ফারাক্কা যেমন বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে মরুকরণের সূচনা করেছে, টিপাইমুখ বাঁধ তৈরি হলে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সুরমা এবং কুশিয়ারা নদীকে খালে পরিণত করবে এবং মেঘনা পর্যন্ত ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ১৯৯৩ সালে গঠিত Alliance for a Secular and Democratic South Asia যুক্তরাষ্ট্রের MIT বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংস্থার সাম্প্রতিক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে ভারতের River Linking Project বাস্তবায়িত হলে দক্ষিণ এশিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অপ্রতিরোধ্য ক্ষতিসাধিত হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের কৌশলগত অংশীদারিত্বের ফলে ভারত চীনের বিরুদ্ধে কতটুকু প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে তা ভবিষ্যতে দেখা যাবে। কিন্তু এ কৌশলগত অংশীদারিত্বের ফলে ছোট ছোট প্রতিবেশীর প্রতি ভারতের মোড়লি বৃদ্ধি পাবে শতগুণ। যুক্তরাষ্ট্র এসব দেশের সমস্যাকে ভারতের চোখ দিয়ে (Through Indian Prism) দেখে থাকে, কিন্তু দুই-এর সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হলে ভারতের প্রতিবেশীরা ভারতের আজ্ঞাবহ হতে বাধ্য হবে। এমনকি সুযোগ পেলে কোনো কোনোটি চীনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আত্দরক্ষা করবে। তাই বলি, এ প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র শুধু ভারতের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারিত্বের মধ্যে না গিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার আটটি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বের হাত বাড়ালে ভালো করবে। কেননা, কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে যেমন শ্রীলঙ্কা, তেমনি বাংলাদেশ এবং নেপাল ও পাকিস্তান। এক্ষেত্রে বন্ধুত্ব বলতে বুঝিয়েছি সমস্বার্থের ভিত্তিতে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা। এর বিকল্প নেই। ভারতকে দক্ষিণ এশিয়া বা মধ্য এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সংহতির Linchpin করা সম্ভব দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা এবং দীর্ঘদিনব্যাপী সব প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পরেই। SAARC-এর নেতৃস্থানীয় হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার সার্বিক অগ্রগতির পথ প্রশস্ত হওয়ার পরেই যুক্তরাষ্ট্র যদি শুধু বৃহত্তর ভারতের সঙ্গেই কৌশলগত অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্যোগে ব্যস্ত থাকে তাহলে ভারতের চারপাশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের মালা শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, ভারতেরও গলার কাঁটা হয়ে উঠতে পারে- যদি ভারত তার প্রতিবেশীদের সঙ্গে সমতাভিত্তিক সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম না হয়। বিশেষ করে সার্কের অভ্যন্তরে নদীর ব্যবস্থাপনায় অথবা সন্ত্রাস দমনে ভারত তার দ্বিপক্ষীয় নীতি পরিত্যাগ করে সবাই মিলে সমস্যা সমাধানে আগ্রহী না হলে।

লেখক : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন