মঙ্গলবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১২

ইলিয়াস গুমে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য বেমানান


ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং বর্তমানে দলের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য বর্ষীয়ান রাজনীতিক আবদুল জলিল এমপি বলেছেন, বর্তমান সরকারের অনেক অর্জন থাকলেও কিছু ঘটনা সেসব অর্জনকে মøান করে দিচ্ছে, প্রশ্নবিদ্ধ করছে। সরকার সংযমী না হলে জনগণ সরকারকে ভুল বুঝবে, যার পরিণতি হবে করুণ। তিনি বলেন, ইলিয়াস আলীর পর্যায়ের একজন নেতা গুম হওয়া প্রত্যাশিত নয়। আর এ ঘটনায় শেখ হাসিনার মন্তব্যকে তিনি প্রধানমন্ত্রী পদমর্যাদার সাথে মানানসই হয়নি বলে অভিমত ব্যক্ত করেন।
গত শনিবার রাতে দেশের অন্যতম জনপ্রিয় বেসরকারি চ্যানেল দিগন্ত টেলিভিশনের ‘সবার উপরে দেশ’ টকশোতে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এ অভিমত ব্যক্ত করেন। টকশোর সঞ্চালক বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরোত্তমের সাথে আলাপচারিতায় তিনি আরো বলেন, সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পদত্যাগের পর তাকে আবার দফতরবিহীন মন্ত্রী বানানোর ঘটনা রাজনীতির জন্য হতাশাজনক। এ জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দায়ী করেন। তবে তিনি বলেন, অর্থ কেলেঙ্কারিতে জড়িত না বলে দাবি করেও রেলমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে সুরঞ্জিত প্রশংসনীয় কাজ করলেও পরে দফরতবিহীন মন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ তার উচিত হয়নি। প্রবীণ এই নেতা এক-এগারোর খলনায়কদের হাতে তার নাজেহাল হওয়ার বর্ণনা দিয়ে বলেন, তাদের শাস্তির জন্য তিনি যে সংসদীয় কমিটি গঠনের দাবি তুলেছিলেন দেশের মানুষ তাকে স্বাগত জানালেও তার দলের সরকারের কাছে সে দাবি গ্রহণযোগ্য হয়নি।
আবদুল জলিলের এই সাক্ষাৎকারটি নানা কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে নয়া দিগন্তের পাঠকদের জন্য সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করা হলো :
কাদের সিদ্দিকী : আমি আপনার কাছে জানাতে চাই ওয়ান- ইলিভেনের সময় বাংলাদেশের আর কোনো রাজনৈতিক নেতা আপনার মতো কষ্ট ভোগ করেননি। বাংলাদেশ প্রতিদিনে আপনার একটি লেখা দেখলাম খুবই কষ্ট হয়েছে আমার এটা পড়ে যে, জন্মদাতা পিতাও আমাকে কখনো শারীরিকভাবে কোনো কষ্ট দেননি, কিন্তু আমি ওয়ান-ইলিভেনে কষ্ট পেয়েছি। তো ওয়ান- ইলিভেন সম্পর্কে যদি বলতেন, যারা রাজনৈতিক নেতাদের এভাবে নাজেহাল করল। যেখান আপনি ছিলেন, শেখ সেলিম সাহ্বে ছিলেন, নাসিম সাহেব ছিলেন, জননেত্রী শেখ হাসিনা ছিলেন, বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন।
জলিল : এ কথাটি উত্থাপন করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আমি গতকাল একটি সভায় এ কথাটি বলেছি যে, আমার জন্মদাতা পিতা আমার গায়ে কখনো হাত দেননি। কিন্তু তারা আমার গায়ে হাত দিতেও সাহস পেয়েছে। নির্যাতনের কথা আমি আজ উল্লেখ করব না। ওয়ান-ইলিভেনের এই হোতাদের সম্পর্কে একটা তদন্ত করার প্রস্তাব আমি পার্লামেন্টে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম যারা রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিধ, ব্যবসায়ী, সমাজের সম্মানিত শ্রেণীর মানুষকে যে নিগৃহীত করে এবং তারা যাকে ইচ্ছে তাকে যেমন নাজেহাল করে এ সম্পর্কে একটা তদন্ত হওয়া দরকার এবং সেই তদন্তের জন্য একটি সংসদীয় কমিটি হওয়া দরকার। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমার সেই প্রস্তাব গৃহীত হয়নি। এবং এই প্রস্তাব দেশবাসী গ্রহণ করলেও আমার দল গ্রহণ করেনি। এটি আমার জন্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক একটি ঘটনা। এখানে একটা কথা বলব, আমি ওয়ান-ইলিভেনে যে নিগৃহীত হয়েছি আমি কিন্তু এটা অ্যাভয়েট করতে পারতাম। যখন ওয়ান-ইলিভেনের হোতারা ডিজিএফআই থেকে প্রস্তাব দিলো,‘সংস্কারের মধ্য দিয়ে দুই নেত্রীকে বাদ দিয়ে সেখানে নতুন নেতৃত্ব তারা নিয়ে আসবে’। সেখানে আমাদের অনেক নেতা তাদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে তাদের পক্ষে মত দিলো। আমার কাছে যখন প্রস্তাবটা এলো আমি বললাম যে, এটা ইমপসিবল। কারণ আমি রাজনীতি করি এবং আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বিশ্বাস নিয়েই আমি রাজনীতি করি এবং বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা হলো মানুষকে ভালোবাসতে হবে। মানুষের ভালোবাসার মধ্য দিয়ে রাজনীতির বিকাশ সম্ভব এবং একটি রাজনৈতিক কর্মীও সেই বিকাশে বিকশিত হতে পারে। আমি সেই বিশ্বাস দিয়ে এসে আজকে আমি সেই সংস্কারের একজন প্রতিষ্ঠিত নেত্রী যিনি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হয়েছেন, দলের কর্মীদের দ্বারা নেতৃত্বের আসনে আসীন হয়েছেন তাকে তার বিকল্প ব্যবস্থা ষড়যন্ত্রের মধ্যে আমি করতে রাজি নই। আমি এটা রিফিউজ করেছি। এবং আমি বঙ্গবন্ধু কন্যা আমার নেত্রীর পক্ষে অবস্থান নিয়ে বলেছি, মাইনাস শেখ হাসিনা হবে না। আপনার যদি দলের নিয়মকানুুন বা বিধিবিধানের কোনো পরিবর্তন করতে হয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই সে সংস্কারটা হতে হবে। এর বিকল্প কোনো ব্যবস্থা হতে পারে না। এই বক্তব্য তিন-চার দিন দেয়ার পর তখনকার মেজর জেনারেল মাসুদ চৌধুরী (বর্তমানে অস্ট্র্রেলিয়ায় হাইকমিশনার হিসেবে কর্মরত) আমাকে টেলিফোন করলেন, স্যার কথাটা এভাবে বললে হবে না, একটু সংযতভাবে আপনি বলুন। আমি বললাম জেনারেল মাসুদ কথা বলা তোমার কাছে আমাকে শিখতে হবে না। আমি যেটা বিশ্বাস করি আমি সেটা বলব। এবং তোমার যা করণীয় তুমি সেটা করতে পার। আনফরচুনেটলি পরদিনই দুপুর বেলা আমার ব্যাংকে বসে কাজ করছিলাম (বোর্ড মিটিং ছিল)। এমন সময় আমার পিএস এসে বলল আর্মির কয়েকজন অফিসার আসছে আপনার সাথে দেখা করতে চায়। আমি বললাম ঠিক আছে পাঠিয়ে দাও। ভেতরে এসে বলল, স্যার আপনাকে আমাদের সাথে যেতে হবে। আমি বললাম তোমাদের সাথে যেতে হবে, অবশ্যই যাবো তবে কেন যেতে হচ্ছে সেটা আমাকে বলতে হবে। তারা বলল, স্যার সেই উত্তর আমরা দিতে পারব না। আপনাকে নিয়ে যেতে বলা হয়েছে আপনাকে নিয়ে যেতে হবে সে জন্যই এসেছি। আশা করি আপনি আমাদেরকে কো-অপারেট করবেন। আমি বললাম অবশ্যই আমি কো-অপারেট করব। তোমরা বসো আমি বাথরুম থেকে আসি। যখন বাথরুমের দিকে যাচ্ছিলাম তখন দেখলাম একজন আমাকে ফলো করে আসছে। তখন আমি একটু ধমকের সুরে বলাম এটা আমার রেস্টরুম এখান থেকে পালানোর কোনো জায়গা নেই। এ কথায় সেই অফিসার অন্য দিকে চলে গেল। আমি বাথরুম থেকে এসে সহকর্মীদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তাদের সাথে নিচে নামলাম। সেখান থেকে আমাকে একটি গাড়িতে উঠাল এবং চোখ বেঁধে ফেলল আমার অফিসের সামনেই। একটু পর বলল আপনি একটু নামেন এই গাড়িতে এসি নেই। আমরা একটি এসি গাড়ি দিয়ে আপনাক নিয়ে যাবো। এসি গাড়িতে উঠিয়ে কোথায় নিয়ে গেল সেটা জানি না। অজ্ঞাত ওই স্থানে আমি সাত দিন ছিলাম। ওখান থেকে আমাকে জেলখানায় শিফট করল। প্রথম পাঁচ দিন আমার সাথে যে ব্যবহার করল। আমি এই দেশ যারা সৃষ্টি করেছে তাদের সাথের একজন মুক্তিযোদ্ধা তাদের কথাবার্তা, আচার-আচরণ এটা কোনো সভ্য জগতে সহনীয় নয়। একপর্যায়ে আমি বলেছিলাম আপনি আমার চোখ খুলে দিন দেখি আপনি আমার ছেলের বড় নাকি ছেলের ছোট। আর আমি যে ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে এখানে এসেছি এই ব্যাকগ্রাউন্ডের ইতিহাসের সাথে আপনার জন্ম হয়েছিল কি না সেটা একটু দেখা দরকার। আমার চোখটা খুলে দিন। তখন সে একটি অশ্রাব্য গালি দিয়ে বলল আপনার আকাক্সা তো অনেক বেশি। আমি বললাম অবশ্যই বেশি। কারণ এখনো আপনি আমাকে স্যালুট দেবেন। আমাকে যতই নিগৃহীত করেন আপনার অন্তরাত্মা আপনাকে বলবে আমাকে স্যালুট দিতে। এ ছাড়া নেত্রী সম্পর্কেও অনেক কথা আমার কাছে জানতে চেয়েছে। আমি বললাম আমাকে জানার আগে আপনারা খোঁজখবর নেন। আপনারা যে অভিযোগগুলো নিয়ে এসেছেন সেই অভিযোগগুলো একটাও সত্য নয় বলে আমি বিশ্বাস করি।
Ñআচ্ছা আপনি যে মাপের নেতা, বাংলাদেশে তো রাজনৈতিক নেতা অনেকেই থাকবে তো আপনার মানের নেতা খুব বেশি হবে না। আপনার মতো নেতাকে যদি এভাবে নিগৃহীত করতে পারে আর পরে যদি তার জন্য আইনানুগ কোনো প্রতিকার না হয় তাহলে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক নেতাদের অবস্থা কি হবে?
জলিল : কোনো গ্যারান্টি নেই।
প্রশ্ন : আপনার মনে আছে বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি অনেকের কাছেই নিন্দিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠন করেছিলেন। যার নাম দেয়া হয়েছিল বাকশাল। সেই সময় তিনি গভর্নর পদ্ধতি চালু করেছিলেন। যদি বঙ্গবন্ধু আরো দু-চার বছর বাঁচতেন এর সুফল যদি মানুষের কাছে পৌঁছত তা হলে এক রকমের চিন্তা হতো। আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধুর কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর জন্ম দেয়া আওয়ামী লীগ। যার মাধ্যমে এই আওয়ামী লীগকে বঙ্গবন্ধু কবর দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনেছে। আওয়ামী লীগ দিয়ে যা করা সম্ভব ছিল তা করা হয়েছে এবং আওয়ামী লীগ আজকে সেকেলে হয়ে গেছে এ জন্য আমি বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের জন্ম দিলাম। সেই সময় আপনি গভর্নর হয়েছিলেন। আমিও সৌভাগ্যক্রমে টাঙ্গাইলের গভর্নর হয়েছিলাম। সেই পদ্ধতি সম্পর্কে যদি আপনি কিছু বলতে চান।
Ñআমি মনেপ্রাণে বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব কর্মসূচির একজন সমর্থক। বঙ্গবন্ধু বাকশাল নামে যে দ্বিতীয় বিপ্লব কর্মসূচি করেছিলেন তার লক্ষ্য ছিল এ দেশের কৃষক শ্রমিকের অর্থনৈতিক মুক্তি। দেশটাকে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু আনফরচুনেটলি যে শিশু জন্মই নিলো না সেই শিশু সম্বন্ধে গোটা দেশবাসীর মধ্যে এর বিরোধী শক্তি, যারা জনগণের ক্ষমতা বাস্তবায়িত হোক, জনগণের কল্যাণ হোক, জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি আসুক বিশ্বাস করে না তারা এর বিরুদ্ধে এবং এর পাশাপাশি যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল এই শক্তিগুলো বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের স্বপ্নগুলোকে নস্যাৎ করল। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে। শুধু তাই নয় এই পরিকল্পনাকে জাতির কাছে উপস্থাপন করল বিকৃতরূপে এবং বাকশালকে একটি গালি হিসেবে উপস্থাপন করল বা পরিচিতি দিলো। আমি এখনো বিশ্বাস করি, আমরা যদি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বিশ্বাসী কর্মী হয়ে থাকি। বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচিকে জীবিত করা আমাদের দায়িত্ব। এই কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আবারো বাংলাদেশের কৃষক, শ্রমিক মেহনতী মানুষের মুক্তি আসতে পারে এটা আমি বিশ্বাস করি। প্রসঙ্গত, এখানে একটি বিষয় যোগ করে বলি, আমার বন্ধু রাজ্জাক যখন বাকশাল করল আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে গিয়ে আমি তাকে বলেছিলাম, তোমার এই বাকশাল বঙ্গবন্ধুর বাকশাল না এটা ইন্দিরার বাকশাল। তুমি এটা নিয়া এগিয়ো না। আবার ফিরে এসো, দলের সেক্রেটারি ছিলা আবার সেই দায়িত্ব নিয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পথে দলটাকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করো। আমার বন্ধু তখন আমার কথা শুনে নাই কিন্তু পরে তিনি তার ভুল বুঝতে পেরে আওয়ামী লীগে ফিরে এসেছিলেন এবং আওয়ামী লীগের আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কাজ করে গেছেন। সুতরাং এই যে দ্বিতীয় বিপ্লবের কথা বললেন, এখানে একটি শক্তি আছে যারা এর অপব্যবহার করে, যারা এ সম্পর্কে মানুষকে বিভ্রান্তি ব্যাখ্যা দিয়ে মানুষকে বিপথে নিয়ে যায়। বিষয়টি আমাদের জন্য দুঃখজনক এই কারণে, আজকে দেখেন, আমাদের গভর্নর পদ্ধতি নেই প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের মধ্যে দিয়ে জনগণের কাছে ক্ষমতা তুলে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। তখন গভর্নর ছিলাম আমি আপনি (কাদের সিদ্দিকী), আবু সায়ীদ আরো অনেকে। বাকশালের এই গভর্নর পদ্ধতি ছিল ক্ষণস্থায়ী। কারণ অল্প কয়েক মাসের মধ্যেই একটি নির্বাচন দেয়ার কথা ছিল। সেখানকার নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে আপনাকে বঙ্গবন্ধু যে দায়িত্বটা দিয়েছিল সেটা বাস্তবায়ন হলে সারা জেলার কমান্ড ও কন্ট্রোল আপনার হাতে থাকত। আপনি জনপ্রতিনিধি হিসেবে জেলার ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য সব রেস্পন্সিবিলিটি ছিল আপনার। ব্যর্থ হলে আপনার ব্যর্থতা হতো আর সফল হলে দলের এবং কর্মসূচির সফলতার মধ্য দিয়ে জনগণের সফলতা হতো। এটা আমি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি এখানো।
কাদের সিদ্দিকী : দেশে এখন খুব অস্থিতিশীল অবস্থা চলছে। এই মাত্র ক’দিন আগে একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তÑ তার বহু দিনের রাজনৈতিক জীবনÑ তিনি মন্ত্রণালয়ে ঘুষ কেলেঙ্কারির অভিযোগ মাথায় নিয়ে পদত্যাগ করেছেন। আবার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তাকে পুনরায় দায়িত্বহীন মন্ত্রী পদে রাখা হলো। তার মন্ত্রণালয়ের ঘুষ কেলেঙ্কারি সম্পর্কে এবং তাকে যে আবার রাখা হলো এ সম্পর্কে আমরা একজন প্রবীণ রাজনৈতিক, বিবেকবান রাজনৈতিক, উদার রাজনৈতিক হিসেবে যদি কিছুু মন্তব্য করতেন?
আবদুল জলিল : আমি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যে অভিযোগের ফলে পদত্যাগ করেছেন তার জন্য ধন্যবাদ জানাবো। যে ঘটনাটা ঘটেছে, উনি যেটা বলেছেন যে এই কেলেঙ্কারির সাথে তার সমৃক্ততা নেই এটা প্রমাণ করার জন্যই তিনি সরে যাচ্ছেন এবং আশা ব্যক্ত করেছেন যে আমি রাজনীতি থেকে আপাতত কিছুটা দূরে থাকব। নির্দোষ প্রমাণ হয়ে আমি আবার রাজনৈতিক মঞ্চে আসব। এই পর্যন্ত তিনি অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য। যদিও বিলম্বে তিনি পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু পরে তাকে যে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী দেয়া হলো এটাকে আমি মনে করি রাজনীতির জন্য একটি হতাশাব্যঞ্জক ব্যাপার। এটা করা ঠিক হয়নি। লেট হিম প্রুভ অর্থাৎ ঘটনা তন্তের পর যদি তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হন। তখন আবার তাকে দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। কিন্তু যেটা করা হয়েছে তা আমাদের রাজনীতির জন্য একটি হতাশা।
কাদের সিদ্দিকী : এর জন্য কি সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দায়ী নাকি প্রধানমন্ত্রী?
আবদুল জলিল : সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দায়ী নন। যিনি তাকে দায়িত্ব দিয়েছেন তিনি দায়ী। এখানে আমি বলব সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে একসেপ্ট করা ঠিক হয়নি।
কাদের সিদ্দিকী : বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বঙ্গতাজ তাজউদ্দিন আহমেদের ছেলে সোহেল তাজ বহুদিন আগে প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে বলেছেন, যেহেতু রাষ্ট্রপতির কাছে তার পদত্যাগপত্র পাঠানো হয়নি সেহেতু তিনি মন্ত্রী আছেন। তাহলে কি কাজ না করলেও সাধারণ মানুষের রক্ত ঘামের পয়সা কেউ কাউকে দিয়ে দিতে পারে?
আবদুল জলিল : তাজউদ্দিন আহমেদের ছেলে সোহেল তাজ যে কাজটা করেছে আমি মনে করি সে পলিটিক্যালি অনেক কনসাস হিসেবেই দায়িত্বটা পালন করেছে। এখানে আমার একটা প্রশ্ন সংবিধানে কী আছে সেটা আমি জানি না; একজন পদত্যাগ করার পর সেটা কত দিন ঝুলিয়ে রাখাতে পারে রাষ্ট্রপতির কাছে সেটা গেল না কেন?
কাদের সিদ্দিকী : যদি এমন হয়, যত দিন রাখতে পারে তার চেয়ে অনেক দিন বেশি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। তাহলে কি এই সরকার বা সরকারের প্রধান ব্যক্তিরা সংবিধান লঙ্ঘন করেনি?
আবদুল জলিল : না সংবিধানে যদি এমন কোনো বিধান থাকে সেটা জেনেও যদি বিলম্বিত করা হয়ে থাকে তবে অবশ্যই এটা সংবিধান লঙ্ঘন হয়েছে।
কাদের সিদ্দিকী : আরেকটা জিনিস হলো এই যে সোহেল তাজের মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগের পরও তার বেতনভাতা তার অ্যাকাউন্টে যাচ্ছে। এই দায়িত্বটা কে নেবে?
আবদুল জলিল : এখানে সোহেল তাজ কিন্তু স্পষ্ট করেই বলেছেন, কেন পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হয়নি, কেন অ্যাকাউন্টে টাকা যাচ্ছে? সেই টাকা যেন ফিরিয়ে নেয়া হয়। বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা কিন্তু এই ধরনের কথা বলেননি। এ জন্য তিনি ধন্যবাদ পেতে পারেন। ঠিক তিনি যোগ্য বাপের যোগ্য সন্তান।
কাদের সিদ্দিকী : ইলিয়াস নামে একজন নেতা, বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদকÑ তাকে আজ ক’দিন ধরে পাওয়া যাচ্ছে না। এত বড় মাপের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বা প্রতিপক্ষ যদি হারিয়ে যায় তাহলে দেশের সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কোথায়?
আবদুল জলিল : আজ সকালে একটি রাজনৈতিক আলোচনায় আমি বলেছি, এখানে একে অপরকে দোষ দিয়ে কোনো লাভ নেই। আমি যেহেতু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আছি, আমার দায়িত্ব রাষ্ট্রের সব নাগরিককে নিরাপত্তা দেয়া। সেই হিসেবে ইলিয়াস আলী একজন ক্ষুদ্র মানুষ নন। একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের দ্বিতীয় সারির নেতা এবং সিলেট জেলার তিনি নির্বাচিত সভাপতি। এই রকম মানুষ হঠাৎ করে গুম হয়ে যাবে! এটা কোনো দিনই কেউ আশা করে না। আর তিনি গুম হওয়ার পর আমি আমার দর্শক ভাইদেরকে বলব, আপনারাই বলুন আপনারা আতঙ্কে আছেন কি না। আমার স্ত্রী আমাকে বলেÑ দেখো তুমি আর বেশি কথা বোলো না যদি তোমাকে গুম করে নিয়ে যায়, আমি কোথায় দাঁড়াব? আমার ছেলেমেয়েরা কোথায় দাঁড়াবে? এই আতঙ্কটা আমার পরিবারের কাছেও চলে গেছে।
কাদের সিদ্দিকী : আপনিও সরকারের একটা পার্ট। আপনার দায়িত্ব মানুষকে নিরাপত্তা দেয়া।
আবদুল জলিল : আমি সেই কথাই তো বলেছি। গুম হওয়া ব্যক্তিকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব সরকারের। আমি আমার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বলবÑ আপনারা যে-করেই হোক তাকে খুঁজে বের করে জনগণের সামনে উপস্থাপন করুন। তার মাধ্যমে গোটা জাতি ও দেশের মানুষকে আশ্বস্ত করার ব্যবস্থা করুন। মানুুষ নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দিনাতিপাত করতে পারে না।
কাদের সিদ্দিকী : গতকাল বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কৃষক সমাবেশে বক্তৃতা করেছেন। সেখানে যেভাবে ইলিয়াস আলীর বিষয়টিকে তিনি এনেছেন, তাতে অনেকেই ব্যথা পেয়েছেন। একজন রাজনৈতিক মানুষ, তাকে পাওয়া যাচ্ছে না, ঠিক এমন সময় এমন শক্ত কথা বলা বাঙালি কৃষ্টির মধ্যে পড়ে না। যেমন ধরেন কেউ যদি তার পরিবারের কাউকে কবরস্থানে নিয়ে যায়, সেই পরিবারে যদি কোনো বিবাহযোগ্যা কন্যা থাকে, তাহলে তার বিয়ের প্রস্তাবটা সে দিন দেয় না। কিছু সময় অপেক্ষা করে শোক ভোলার সময় দেয়। এ ক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ওই ধরনের বক্তব্যটা আপনি কিভাবে দেখছেন?
আবদুল জলিল : আমি স্পষ্ট করে বলছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কালকে যেভাবে কথা বলেছেন তার যে পদমর্যাদা সেখান থেকে এই ভাষাটা মানায় না।
কাদের সিদ্দিকী : আপনি যখন দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, বিরোধী দলে ছিলেন বিএনপি ক্ষমতায় ছিলÑ তখন রাজনৈতিকভাবে খুবই কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন অথবা কথা বলেছিলেনÑ সে দিন ছিল ৩০ এপিল ২০০৬। ওই দিন সরকারের ডেডলাইন ঘোষণা করেছিলেন। এই সম্পর্কে আপনি কিছু বলুন।
আবদুল জলিল : এই সম্পর্কে আমি আজ কিছু বলব না। এই সম্পর্কে আমি লিখছি আশা করছি আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি সেটা বই আকারে প্রকাশ পাবে।
কাদের সিদ্দিকী : অনুষ্ঠানের দর্শকদের জন্য কিছুটা যদি শেয়ার করতেন?
আবদুল জলিল : ৩০ এপ্রিল আমি খামাখা কোনো কথা বলি নাই। এটা ছিল একটা পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনাটা আমি আর নেত্রী ছাড়া আর কেউই জানতেন না।
কাদের সিদ্দিকী : বর্তমান সরকার সম্পর্কে কিছু বলুন।
আবদুল জলিল : এই সরকারের অনেক অর্জন আছে। কিন্তু দুই-একটা ঘটনা সব অর্জনকে ম্লান করে দিচ্ছে। সুতরাং আমি সরকারকে বলব, সরকারপ্রধানকে বলব, যে অর্জন আছে সেটা যদি আমরা জনগণের কাছে নিয়ে যেতে পারি, তবে আশা করি জনগণ আগামীতে আমাদের ফেলবে না। কিন্তু এই অর্জনের পাশাপাশি যে দুই-একটা ঘটনা আমাদেরকে বিপদগ্রস্ত করছে, প্রশ্নবিদ্ধ করছে, আমাদের অবশ্যই তা থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করতে হবে। তা না হলে মানুষ আমাদেরকে ভুল বুঝবে এবং সেই ভুল বোঝার পরিণতি হবে করুণ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন