রবিবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১২

ভারতীয় সেনাদের অনুপ্রবেশের আশঙ্কা রোধ করতে হবে

ঢাকাভিত্তিক একটি ইংরেজি সাপ্তাহিকী ৭ এপ্রিল প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের দূত সাতিন্দর কে লাম্বা ৫ এপ্রিল ‘অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন’ নামক একটি ভারতীয় সংস্থা কর্তৃক আয়োজিত ভারত-বাংলাদেশ নিরাপত্তা বিষয়ক মতবিনিময় সভায় বলেছেন, সন্ত্রাসী ও বিদ্রোহীদের দমনে বাংলাদেশ সরকারের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তারা বাংলাদেশ থেকে অভিযান (ভারতে) অব্যাহত রেখেছে। তিনি বলেন, আমাদের ভূখণ্ড থেকে বিদ্রোহ, সন্ত্রাসবাদ এবং উগ্রবাদিতার আপদ যৌথভাবে নির্মূল করার জন্য চলমান সহযোগিতার ধারা অব্যাহত রাখা একান্তভাবে অপরিহার্য।
লাম্বা’র এমন দুর্ভাগ্যজনক ও ভীতিকর বক্তব্যের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ কিংবা ভারতের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিবাদ করা হয়নি। সংশ্লিষ্ট পক্ষদ্বয়ের নীরবতা এ ইঙ্গিতই দেয় যে, লাম্বার বার্তায় অন্তর্নিহিত সত্যতা বা বাস্তবতা রয়েছে।
সাপ্তাহিকীটির অভিযোগ, “After successfully extracting series of one-sided benefit from the current ruling party in Bangladesh, policymakers in New Delhi has now stepped into its next phase of plan of putting pressure on the government of Sheikh Hasina in allowing Indian troops to enter Bangladesh territory for starting joint operations against terrorists, insurgents, militants and criminal elements.” (চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাদেশের শাসকদলের কাছ থেকে দফায় দফায় একপাক্ষিক সুবিধা আদায়ে সফল হওয়ার পর নয়াদিল্লি এখন সন্ত্রাসী, বিদ্রোহী, উগ্রবাদী ও অপরাধী চক্রের বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান চালানোর উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্য প্রবেশের অনুমতি প্রদানের জন্য শেখ হাসিনা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির পরবর্তী পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে।)
লাম্বা যে অজুহাত দাঁড় করিয়েছেন তা অযৌক্তিক ও অগ্রহণীয় হলেও এটা একাধারে ভীতিজনক ও উপদ্রবকর। এমন দায়িত্বহীন ও ভিত্তিহীন অভিযোগ ভারত এই প্রথমবারের মতো করেনি। কিন্তু আগে তারা এমন নগ্নভাবে বলতে সাহস করেনি যে, ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশে মোতায়েনের প্রয়োজন রয়েছে। গত কয়েক দশক ধরে ভারত কথিত সন্ত্রাসীদের শিবিরের অবস্থান-সংক্রান্ত ঠিকানা ও মানচিত্রসহ এমন ভিত্তিহীন অভিযোগ করে আসছে। বাংলাদেশ অভিযোগপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে তদন্ত ও অনুসন্ধান চালিয়ে ভারতের দেয়া ঠিকানায় হয়তো ধানক্ষেত কিংবা স্টেডিয়াম, বিদ্যালয়, দীঘি, কিংবা বাজার অথবা অন্যকিছু দেখতে পেয়েছে। বাংলাদেশ এমনকি এমন প্রস্তাবও দিয়েছিল যে, ভারত যেন তার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বাংলাদেশে প্রেরণ করে, যারা স্বচক্ষে দেখে যেতে পারেন তাদের পাঠানো ঠিকানায় আসলে কী রয়েছে। ভারত বাংলাদেশের এমন প্রস্তাবে কখনোই সাড়া দেয়নি।
তর্কের খাতিরে আমরা ধরে নিলাম যে ভারতীয় অভিযোগ যথার্থ। তা সত্ত্বেও ভারতীয় সৈন্য পাঠানোর প্রস্তাব মোটেই যথার্থ নয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কথা না হয় বাদই দিলাম, বাংলাদেশের জনগণ কি ভারতীয় সৈন্যদের আগমন মেনে নেবে? বাংলাদেশে যদি কোনো সন্ত্রাসী থেকে থাকে তাহলে তাদের বাংলাদেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়ার জন্য ভারত বাংলাদেশকে অনুরোধ করতে পারে। অথবা বিষয়টি সার্ক কিংবা জাতিসংঘেও উত্থাপন করতে পারে। এমনকি ভারত উভয় দেশের সীমান্তে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মোতায়েনের জন্য জাতিসংঘকে অনুরোধ করতে পারে। কিন্তু ভারত বিতর্কিত ও গোপন চুক্তি বা প্রতিশ্রুতিকে ব্যবহার করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তার সেনাবাহিনীকে ঢুকিয়ে দিতে পারে না। কেননা এ ধরনের চুক্তি বা প্রতিশ্রুতি বাংলাদেশের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বন্ধুত্বের আবরণে বাংলাদেশের মানুষ তাদের স্বদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব কোনো শক্তির কাছে বিকিয়ে দেবে না।
এটা সবার জানা, ভারত নিজেই তার প্রতিবেশী দেশগুলোর সমাজবিরোধী, সন্ত্রাসী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিরাপদ আস্তানা—বিশেষ করে যারা ভারতে অবস্থান করে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, বার্মা (মিয়ানমার), নেপাল, তিব্বত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, মালদ্বীপে হামলা চালায়। ভারত তাদেরক খাদ্য, অস্ত্র, গোলাবারুদ, প্রশিক্ষণ, আশ্রয় ও প্রশিক্ষণ এবং কৌশলগত সমর্থন দেয়। এসব দেশের কোনোটিই এমন প্রস্তাব দেয়নি—সমাজবিরোধী, সন্ত্রাসী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের তাড়ানোর জন্য ভারতে তাদের সৈন্য মোতায়েন করতে হবে।
একথা উল্লেখের দাবি রাখে যে যদি বাংলাদেশে কোনো সন্ত্রাসী চক্র থেকেই থাকে, তবে তারা নিশ্চিতভাবে ভারতীয় উদ্যোগে ভারতের অর্থে ও স্বার্থে সৃষ্ট এবং ভারতীয় নির্দেশে পরিচালিত। বাংলাদেশে বিদ্যমান সব ধরনের অস্ত্র, গোলাবারুদের উত্স হলো ভারত। প্রতিবেশী দেশে গোলমাল ও অশান্তি সৃষ্টি করার ভারতীয় ভূমিকা নতুন কিছু নয়। ভারতের প্রতিবেশী প্রতিটি দেশে অশান্তি সৃষ্টির নেপথ্য নায়ক হলো ভারত। ভারতই সিকিমে সিকিম কংগ্রেস সৃষ্টি করে এবং সর্বশেষ সেখানে অশান্তি সৃষ্টি করে দেশটিকে গ্রাস করে। শ্রীলঙ্কায় গৃহযুদ্ধের সূচনা করে। বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, পাকিস্তান, নেপাল, মিয়ানমারকে অস্থিতিশীল ও দুর্বল করতে ভারত বিবিধভাবে চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে। এমনকি দালাইলামা ও তার অনুসারীদের আশ্রয় দিয়ে ভারত চীনের বিরুদ্ধেও অঘোষিত যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।
উল্লেখ করা প্রয়োজন, বাংলাদেশে যদি কোনো ভারতীয় সন্ত্রাসী চক্র থেকেই থাকে, তবে তারা কীভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং আবার অভিযান চালানোর জন্য ভারতে যায়। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতীয় সীমান্তের প্রায় পুরোটাতেই বেড়া দেয়া হয়েছে। সীমান্ত অঞ্চলে ভারত হাজার হাজার বিএসএফ ও সৈন্য মোতায়েন করেছে। এরা প্রায় প্রতিদিনই নিরীহ বাংলাদেশীদের সীমান্তাঞ্চলে হত্যা করছে। কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো সন্ত্রাসীকে আটক কিংবা হত্যা করার কোনো রেকর্ড নেই। তবে কি সন্ত্রাসীরা ভারতের হয়েই বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং আবার ভারতে যায়? তারা কীভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে, যদি তাদের প্রতি ভারতীয় বাহিনীর সমর্থন না থাকে? তাদের আমাদের দেশে পাঠানো হয় কেন তার জবাব লাম্বাই দিয়েছেন—ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে মোতায়েন করার অজুহাত ও পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য।
স্মরণাতীতকাল থেকে বাংলাদেশের অংশ হিসেবে থাকা এক-দশমাংশ ভূমি পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করে গ্রাস করার জন্য ভারত তার ভূখণ্ডে চাকমা সন্ত্রাসীদের জন্য ২৫টি প্রশিক্ষণ শিবির খুলেছিল। অভিযোগ আছে যে, এগুলোর অধিকাংশই বন্ধ করা হয়নি। বঙ্গভূমি আন্দোলনের নামে বাংলাদেশের ২১টি জেলাকে বাংলাদেশ থেকে পৃথক করার একটি চক্রকে ভারত মাঠে নামিয়েছে। বর্তমানে উভয়কে নিষ্ক্রিয় রাখা হয়েছে। ভবিষ্যতে হয়ত তাদের ব্যবহার করা হবে, যখনই বাংলাদেশ সরকার ভারতীয় খপ্পর থেকে বেরিয়ে আসতে সচেষ্ট হবে। ভারত আজ পর্যন্ত এদের কাউকে আমাদের হাতে তুলে দিয়েছে এমন নজির নেই।
অথচ বাংলাদেশ এমন সব স্বাধীনতাকামীকে (ভারতের ভাষায় সন্ত্রাসী) ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে, যারা তাদের জন্মভূমিকে ভারতের হাত থেকে মুক্ত করার সংগ্রামে লিপ্ত। তাদের দাবি এবং ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, তাদের অঞ্চল অর্থাত্ আমাদের প্রতিবেশী মেঘালয়, আসাম, ত্রিপুরা, মিজোরাম, মণিপুর, নাগাল্যান্ড ও অরুণাচল প্রদেশ ১৮২৬ সালে ব্রিটিশ সরকার চক্রান্তমূলকভাবে দখল করে নেয়ার আগ পর্যন্ত একদিনের জন্যও নয়াদিল্লির অধীনে ছিল না। এমনকি মৌর্য কিংবা গুপ্ত আমলেও নয়। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ অনুপ চেটিয়াসহ বহু স্বাধীনতাকামী যোদ্ধাকে আটক করেছে, জেলে রেখেছে এবং অধিকাংশকেই ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্য মোতায়েনের প্রস্তাব দেয়ার কোনো অধিকার সেদেশের কথিত বিশেষজ্ঞের নেই।
ভারত যেভাবে প্রকাশ্যে ও গোপনে চাকমা সন্ত্রাসীদের সার্বিক সহযোগিতা করেছে এবং করছে, আসামসহ অন্যান্য অঞ্চলের স্বাধীনতাকামীদের পক্ষে বাংলাদেশ তা কখনোই করেনি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের আবির্ভাব হওয়ার বহু আগে থেকেই আমাদের প্রতিবেশী অঞ্চলগুলো স্বাধীন হওয়ার জন্য যুদ্ধ করে আসছে। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট নাগাল্যান্ড প্রকাশ্যে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। সে ঘোষণা বাস্তবায়নের যুদ্ধ আজও অব্যাহত রয়েছে। আমাদের প্রতিবেশী সাতটি রাজ্য অঞ্চলে পুলিশ, আধা-সামরিক বাহিনী ছাড়াও চার লাখের বেশি ভারতীয় নিয়মিত সৈন্য মোতায়েন রয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় ১২ লাখ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রয়েছে। যারা মূল জায়গায় অবস্থান করে গত ৬৫ বছরে স্বাধীনতাকামীদের পরাজিত করতে পারেনি, তাদের বাংলাদেশে মোতায়েন করে যৌথ অভিযান চালিয়ে নির্মূল করা যাবে, এমন যুক্তি বেকুবদের কাছেই রাখা যায়। সবচেয়ে বড় কথা হলো, বাংলাদেশে আদৌ কথিত সন্ত্রাসীরা আছে তেমন প্রমাণও ভারত দাঁড় করাতে পারেনি। সন্ত্রাসীদের দেশ ভারত। সুতরাং তাদের সেখানেই নির্মূল করতে হবে। এটা আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। মূলত এটা হলো বাংলাদেশকে ভারতের পায়ের নিচে রাখার একটা বাহানা।
আর বাংলাদেশে যদি ভারতীয় সন্ত্রাসীরা থেকেই থাকে, তবে তাদের পাকড়াও করতে বাংলাদেশের পুলিশই যথেষ্ট, ভারতীয় সৈন্য দরকার নেই। আমাদের সেনাবাহিনী জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের অধীনে সন্ত্রাসকবলিত অঞ্চলে শান্তি স্থাপনে তাদের বীরত্বপূর্ণ দক্ষতার জন্য এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অনন্য সুনাম কুড়িয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সন্ত্রাসীদের প্রতিহত করতে তারা একই পন্থা অবলম্বন করে। এজন্য পোটা (POTA - Prevention of Terrorism Act), টাডা (TADA - Terrorist and Disruptive Activities Prevention Act), উইপা (UAPA - Unlawful Activities Prevention Act) কিংবা সেনাবাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন-১৯৫৮ (AFSPA - Armed Forces Special Powers Act 1958) অথবা অন্য কোনো কালাকানুন তৈরি করতে হয়নি, যেগুলো ভারত কাশ্মীরে, পাঞ্জাবে, আমাদের প্রতিবেশী অঞ্চলে প্রয়োগ করছে। পার্বত্য চট্টগ্রামকে কখনোই উপদ্রুত এলাকা ঘোষণা করা হয়নি, সেখানে ভিন্নভাবে জরুরি অবস্থা কিংবা সামরিক শাসন জারি করা হয়নি। অথচ আমরা সাফল্যের সঙ্গে সন্ত্রাসীদের কম রক্তপাতে দমাতে সক্ষম হয়েছি।
ভারতীয় সন্ত্রাসীরা যাতে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব ভারতের। নিন্দুকেরা মনে করেন, বাংলাদেশে ভারতীয় জবরদখল প্রতিষ্ঠিত করে বশংবদ অনুগত সরকার ঢাকায় টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনী মোতায়েনের এবং কথিত যৌথ অভিযানের কথা বলছে, যার মুখ্য উদ্দেশ্য হলো চূড়ান্ত পর্যায়ে বাংলাদেশকে ভারতের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলার সংস্কৃতি, মনস্তাত্ত্বিক, রাজনৈতিক পরিবেশ ও মানসিকতা তৈরি করা।
ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের ভাষ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে এখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন একান্ত বিশ্বস্ত সরকার ক্ষমতায় রয়েছে, যার কাছ থেকে বাংলাদেশকে কিছু না দিয়েই ভারত একপাক্ষিক সর্বাধিক সুযোগ-সুবিধা আদায় করে নিয়েছে। এর পরও ভারত সন্তুষ্ট হয়নি। ভারত যথার্থই অনুভব করে যে, ঢাকার ক্ষমতার মোড়লরা ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয়ার পর পরবর্তী শাসক শ্রেণী বর্তমান সরকারের আমলে স্বাক্ষরিত বিতর্কিত প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সমঝোতা বা চুক্তিগুলো হয়তো মেনে নেবে না, যা ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতের জন্য চরম পরাজয় ও ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, বারবার ভারতের ‘রাডার’ থেকে বেরিয়ে-আসা বাংলাদেশকে আর ভারতীয় রাডার থেকে বের হতে দেয়া হবে না। তাই ভারতীয় প্রভাব ও কর্তৃত্ব অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্যেই ভারত মূলত এ সরকারের আমলে বাংলাদেশে তার সেনাবাহিনী ঢুকিয়ে দিতে চায়। অন্যদিকে ক্ষমতাসীনরাও যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় ফিরে আসতে একেবারে মরিয়া। পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য হয়তো ভারতীয় বাহিনীকে আমন্ত্রণ জানাবে, যারা জাতীয়তাবাদী শক্তিকে সন্ত্রাসী, মৌলবাদী, জঙ্গি বা স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করে নির্মূল করবে।
উল্লেখ্য, ভারতীয় সেনাবাহিনী ২০০৩ সালে উলফা (ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম) যোদ্ধাদের ভূটানের শিবির থেকে বিতাড়িত করার জন্য ভুটানে প্রবেশ করে। ২০০৪ সালের পর থেকে ভুটানের কোথাও উলফা’র কোনো অস্তিত্ব না থাকলেও ভারতীয় সৈন্যরা আজও ভুটানে অবস্থান করছে। ভারত বাংলাদেশ এবং ভারতের অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের ক্ষেত্রে একই নাটক পুনঃমঞ্চস্থ করতে চায়।
এ পরিস্থিতিতে প্রতিবেশী দেশকে বিব্রত করতে ভারতকে আর কোনো সুযোগ দেয়া উচিত হবে না। এ আধিপত্য স্পৃহা প্রতিহত করতে এ অঞ্চলের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে অবিশ্বাস্য ধরনের রক্তারক্তি বন্ধের পন্থা হিসেবে ভারতীয় সৈন্যদের বাংলাদেশে প্রবেশের যে কোনো চক্রান্তমূলক প্রস্তাব ব্যর্থ করতে এখনই সচেতন ও সচেষ্ট হওয়া দরকার।
আমি যতখানি আমার দেশবাসীকে বুঝেছি, তাতে মনে হয় বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ কখনোই আমাদের মাটিতে ভারতীয় সৈন্যদের অনুপ্রবেশ মেনে নেবেন না। আমাদের বীর জনগণ তাদের দখলদার শত্রুবাহিনী হিসেবে বিবেচনা করেই প্রতিহত করবেন। আমাদের গৌরবময় অতীত ও ঐতিহ্য বলে দেয়, আমাদের পূর্বপুরুষরা কখনোই বিদেশি জবরদখল মেনে নেননি। বিদেশি শোষকরা তাদের স্থানীয় কিছু চরের সহযোগিতায় সাময়িকভাবে তাদের পদানত করতে সক্ষম হলেও চূড়ান্ত পর্যায়ে বিদেশি শক্তিকে মার খেয়ে পিছুটান দিতে হয়েছে। সুদূর অতীতে না গিয়ে নিকট অতীতে পলাশী-পরবর্তী উপমহাদেশে বাঙালি মুসলমানরাই প্রথম ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলে। শহীদ তিতুমীর, ফকির মজনু শাহ, হাজী শরিয়ত উল্লাহ তাদের মধ্যে অন্যতম। আর হিন্দুরা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন শুরু করেছিল ১৯০৫ সালের ব্রিটিশ বাংলার বিভক্তির মাধ্যমে ঢাকাকে রাজধানী করে পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশ গঠন করার পর থেকে। হিন্দুরা নতুন এ প্রদেশকে মুসলমানদের স্বার্থের অনুকূলে গিয়েছিল বলেই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সূচনা করে।
এ বাস্তবতা সবাই স্বীকার করবেন যে, ভারতের নানাবিধ স্বার্থান্বেষী ও আগ্রাসী আচরণের জন্য বাংলাদেশীরা ভারতের ওপর পাকিস্তান আমলের চেয়েও অধিকতর রুষ্ট ও বিরক্ত। ভারত যে আমাদের বন্ধু, ’৭১ সালের পর তেমন একটি নজিরও স্থাপন করতে পারেনি। ভারতীয় নীতি-নির্ধারকদের উচিত আমাদের ইতিহাস পুনঃঅধ্যয়ন করে আমাদের মনস্তত্ত্ব, চেতনাবোধ এবং স্বাধীনতার জন্য আমাদের আত্মত্যাগ অনুধাবন করা। বাংলাদেশ লেন্দুপ দর্জিদের দেশ নয় যে, ভারতের হাতে কেউ বাংলাদেশ তুলে দিতে চাইলে সিকিমের জনগণের মতো বাংলাদেশীরাও তা মেনে নেবে। ভারত-বান্ধবরা বাংলাদেশকে শাসন করলেও এদেশের জনগণ ভারতীয় উপস্থিতি কিছুতেই মেনে নেবে না। ভারত তার সুহৃদদের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে অন্যায়ভাবে যা কিছু অর্জন করেছে, তাও তাকে হারাতে হবে।
ভারত কেন বাংলাদেশে তার সেনাবাহিনী পাঠাতে চায়, তার ঐতিহাসিক দিকটাও তুলে ধরতে চাই। ১৯৪৭ সালে ভারত বাধ্য হয়েই মুসলমানদের জন্য পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি মেনে নিয়েছিল। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট উপমহাদেশ বিভক্তির ৮ দিন আগে তত্কালীন কংগ্রেসের বাহ্যত ধর্মনিরপেক্ষ কিন্তু বাস্তবে কট্টর সাম্প্রদায়িক নেহরুরা বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেয়, তারা সাময়িকভাবে উপমহাদেশ বিভক্তি মেনে নিয়েছে। তারপরও নেহরু লিখিতভাবে বলেছেন, উপমহাদেশকে খণ্ডিত করা হলে বাংলা ও পাঞ্জাবকেও ভাগ করতে হবে । কেননা তাহলেই ওই দুই প্রদেশের যে অংশগুলো পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হবে সেগুলো অচিরেই ভারতে ফিরে আসবে।
১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতাকে ভারতীয় নেতারা নেহরুর সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন হিসেবে বিবেচনা করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে তাদের কাছে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছিল এবং ১৬ ডিসেম্বরকে ভারত এখনও তাদের বিজয় দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। ভারত ভাবতেই পারেনি, ভারতীয় সেনাবাহিনীকে আর কখনও বাংলাদেশ ভূখণ্ড ছাড়তে হবে। এমনকি ভারতীয় আমলাদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে বাংলাদেশের প্রশাসন চালানোর চেষ্টাও ভারত চালিয়েছিল। এ উদ্দেশ্য সামনে রেখে মুক্ত বাংলাদেশে ঢাকায় বেসামরিক কর্মকর্তাদের প্রথম বৈঠক ভারতীয় আমলার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। ভারত কল্পনাও করতে পারেনি যে, শেখ মুজিব বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের দাবি তুলবেন। কিন্তু শেখ মুজিব সবার আগে সে দাবিটিই করেছিলেন, যা উপেক্ষা করা ভারতের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এ প্রসঙ্গে ভারতের সাবেক প্রেসিডেন্টে জৈল সিংয়ের স্বীকারোক্তিটি বিশেষভাবে উল্লেখ্যযোগ্য। কলকাতা থেকে প্রকাশিত তত্কালীন ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘সানডে’র (২৫ জুলাই, ১৯৮৭) সঙ্গে প্রেসিডেন্ট হিসেবে সর্বশেষ সাক্ষাত্কারে জৈলসিং বলেছিলেন : ‘১৯৭২ সালে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার সুবিবেচনাপ্রসূত ছিল না। এতে ভারতের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দ্রুত সৈন্য প্রত্যাহার করে আমরা দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে পারিনি।’
১৯৭২ সালের পর থেকেই ভারত ভারতীয় সৈন্যদের বাংলাদেশে প্রবেশের নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেনকে অপহরণ করতে ভারতীয় দূতাবাসে হামলা, বিডিআর সদর দফতরে সেনাকর্মকর্তাদের হত্যা, ভুয়া সেনা অভ্যুত্থানের প্রচারণা প্রভৃতি বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্য মোতায়েন করার পরিবেশ তৈরি করেও বাংলাদেশ থেকে তেমন আমন্ত্রণ পায়নি। এখন তারা বলছে, শেখ হাসিনাকে উদ্ধার করার জন্য ভারতীয় বিমান বাহিনী প্রস্তুত ছিল। এমনকি এমনও বলছে যে, শেখ হাসিনাকে বিব্রত করা হলে ভারত চুপ হয়ে বসে থাকবে না। আর এখন আবার অজুহাত দাঁড় করাচ্ছে, সন্ত্রাসী নির্মূল করতে যৌথ অভিযানের নামে ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশে আসা দরকার।
এ অবস্থায় সারাবিশ্বের প্রবাসী বাংলাদেশীদের কাছে বিনীত অনুরোধ, আসুন বাংলাদেশকে এ আগ্রাসী মনোভাব থেকে মুক্ত রাখতে বিশ্বব্যাপী জনমত গড়ে তুলি। আমরা যে যে দেশে বসবাস করছি, সেখান থেকেই দেশরক্ষার আন্দোলনে সোচ্চার হই। চরম বিপর্যয় থেকে আমরা আমাদের প্রিয় স্বদেশ এবং এর জনগণকে রক্ষা করি।
লেখক : আমেরিকা প্রবাসী সাংবাদিক ও গবেষক
noa@agni.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন