রবিবার, ৮ এপ্রিল, ২০১২

ইতিহাস রচনায় সমকাল ও আমাদের চলমান পথ ইতিহাস রচনায় সমকাল ও আমাদের চলমান পথ ইতিহাস রচনায় সমকাল ও আমাদের চলমান পথ রাসৱা থেকে বলছি


সংবাদপত্রের রিপোর্টকে বলা হয় চলমান সাহিত্য। দৌড়াতে দৌড়াতে লেখা আর লিখতে লিখতে দৌড়ানো। দীর্ঘ ৫০ বছর সংবাদপত্র জগতের সাথে জড়িয়ে আছি। এখনো না লিখে থাকতে পারি না। লেখা ও বলা আমার তরুণকাল থেকেই চলছে। তাই এখন এটা একধরনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আমি যা লিখছি, তা কতটুকু সত্য জানি না। নিয়মিত কলামে যা লিখি, তা হচ্ছে আমার মতামত ও ধ্যানধারণার প্রতিফলন। ভিন্ন মত বা দ্বিমত পোষণ করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। ভিন্ন মতকে আমি যথেষ্ট সম্মান করি। সমাজে ভিন্ন মত থাকা খুবই স্বাভাবিক। ভিন্ন মতই গণতন্ত্র বিকাশের প্রধানতম মাধ্যম। গণতন্ত্র হচ্ছে একটি ফুলের বাগান। যেখানে বহু রকম ফুল ফোটে। সবাই এক ফুলের ভক্ত নন। শুধু স্বেচ্ছাচারী ডিক্টেটরেরাই ভিন্ন মত সহ্য করতে পারেন না। আমরা সিভিল ও মিলিটারি ডিক্টেটর দেখেছি। সারা জীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে জেল খেটে শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু কী কারণে যে একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাকশাল চালু করেছিলেন, তা আজো আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। জীবনে তিনি অনেক ভুলভ্রান্তি করেছেন। তবুও আমরা তাকে এ দেশের একজন মহান নেতা মনে করি। সব মতকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যই হয়তো তিনি একদলীয় শাসনব্যবস্থা চালু করেছিলেন। সে সময়ে তিনি সব কাগজ বা সংবাদপত্র বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সব দল ও মতের নেতাকর্মীদের একদলে যোগ দিতে বাধ্য করেছিলেন। সরকারি কর্মচারীদেরও রাজনৈতিক কর্মীতে পরিণত করেছিলেন। সাংবাদিক নেতারাও দলবেঁধে বুকে পোস্টার লাগিয়ে বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন। একদলীয় শাসন ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন ও জেনারেল ওসমানী সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। সাংবাদিকেরা কেউই এই ব্যবস্থার প্রতিবাদ করেননি। কেন করেননি প্রশ্ন করলে সবাই উত্তর দেবেন ভয়ে। সেই সময়ের কাগজ দেখলে মনে হবে সবাই খোশদিলে, হাসিমুখে বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন। সবার বুকে পোস্টার ছিল- আমরা বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কলমসৈনিক। বঙ্গবন্ধুর মর্মান্তিক পতনের পর তার অতি ভক্তরা সবাই পালিয়ে গেলেন। প্রতিবাদে রাস্তায় কোনো মিছিল বের হয়নি। মতা আর মতাবানের অনুগত থাকা সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক জীবনে নতুন কিছু নয়। প্রতিবাদ বা বিদ্রোহ করে ক’জন? প্রতিবাদীরাই জালেমের হাত থেকে মজলুমকে রা করেন। প্রতিবাদীরাই মানুষের জন্য প্রাণ দেন। মজলুমের প েঅবস্থান নিতে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল সাঃ আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন। মজলুমের মুক্তির জন্য লড়াই করা যেকোনো মানুষের জন্য অবশ্য কর্তব্য। জগতের সব নবীই মানুষের মুক্তির বাণী নিয়ে এসেছেন। কিতাবগুলো সেই মুক্তিরই সনদ।
এর আগে আমি রাষ্ট্র নিয়ে লিখেছি। মানুষ বড় না রাষ্ট্র বড়? আমার কাছে মানুষই বড়। জগতে মানুষের ওপর কিছুই নেই। মানুষের স্রষ্টা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা। আর মানুষ নিজেদের কল্যাণেই রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্ম দিয়েছে। কিন্তু চলমান রাষ্ট্রব্যবস্থা মানুষকে মুক্তি দিতে পারেনি, বরং রাষ্ট্রব্যবস্থা জুলুমবাজ ও অত্যাচারী হয়ে পড়েছে। তাই মানুষ রাষ্ট্রব্যবস্থার দাসে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্র শোষকে পরিণত হয়ে পড়েছে। তাই আমি বিশ্বাস করি, নির্যাতিত মজলুম মানুষ একদিন এই পুরনো ঘুণে ধরা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ত্যাগ করবে এবং নতুন ব্যবস্থা গড়ে তুলবে। সেদিন আর বেশি দূরে নয়। বাংলাদেশ একটি মুসলিমপ্রধান দেশ। এ দেশের ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান। রাষ্ট্র না চাইলেও সমাজজীবনে ধর্মের বিশাল প্রভাব রয়েছে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক এলাকার মানুষ হাজার বছর আগেই মুক্তির জন্য ইসলাম গ্রহণ করেছে। ইসলামই এ অঞ্চলের মানুষের ভেতর সাম্য প্রতিষ্ঠা করেছে। ইসলামই মানুষকে মানুষের মর্যাদার আসনে বসিয়েছে। কিন্তু এখানে সরকার রাষ্ট্রব্যবস্থা, রাজনীতি ও ইসলামবিরোধী। এখানে শোষণ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। এখানে ইসলামবিরোধী রাজনৈতিক দল আছে। আমেরিকার সাথে সুর মিলিয়ে এখানে সরকার ইসলামবিরোধী ব্যবস্থা চালু করেছে। এখানে ইসলামে বিশ্বাস না করা গৌরবের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এখানে ইসলামের প েকথা বললেই মৌলবাদী আর জঙ্গি-সন্ত্রাসী বলে হেনসৱা করা হয়। ধর্মীয় পুস্তক হাতে থাকলেই জঙ্গি বা সন্ত্রাসী। শুধু ধর্মীয় কারণে ভারতে ৩০ কোটি শূদ্র বা হরিজন রয়েছেন, যাদেরকে সনাতন ধর্ম মানুষ হিসেবে স্বীকার করে না। ভারতে আরো রয়েছে ৫০ কোটি মানুষ, যারা দারিদ্র্যের কারণে মানবেতর জীবন যাপন করেন। বাংলাদেশেও কোটি কোটি মানুষের জীবনে রয়েছে চরম দারিদ্র্য। পাকিস্তানের ২৩ বছর আর বাংলাদেশের ৪১ বছর মিলিয়ে ৬৪ বছরেও দারিদ্র্য অশিা শোষণ জুলুম থেকে মানুষ মুক্তি পায়নি। কারণ রাষ্ট্র ও রাষ্ট্র পরিচালকেরা শোষণ ও জুলুমের প।ে চলমান অত্যাচারী আইনগুলো সেভাবেই বহাল আছে। শোষণের আইনগুলো তৈরি হয়েছে ব্রিটিশ আমলে। রাষ্ট্র যত দিন নিজেকে প্রভু মনে করবে তত দিন এই অবস্থা অব্যাহত থাকবে। এই প্রভুর পরিচালক যারা তারাও জালেম। তারাও আধুনিক ফেরাউন, নমরুদ ও সাদ্দাদ। শোষণ ও অত্যাচারের আরেক হাতিয়ার হচ্ছে চলমান নির্বাচনব্যবস্থা ও গণতন্ত্র। শতকরা ১০ ভাগ লোক এ দেশে সরকার, গণতন্ত্র ও নির্বাচন পরিচালনা করে। বাকি ৯০ ভাগ মানুষ এই ১০ ভাগের শোষণের শিকার। যারা মতায় যান বা মতায় থাকেন তাদের কাছে সেনাবাহিনী, বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ, আনসার ও দলীয় লাঠিয়াল বাহিনী আছে। জনতার হাতে কী আছে?
আমেরিকা ও ইউরোপের মতো দেশগুলোতে এখন অকুপাই আন্দোলন চলছে। মহান গণতান্ত্রিক দেশের সরকার ও নেতারা অকুপাই আন্দোলনকারীদের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে। অত্যাচারিতরা সেস্নাগান দিচ্ছে- আমরাই ৯৯ ভাগ, আর তোমরা মাত্র এক ভাগ। এ পৃথিবীতে ৭০০ কোটি লোক আছে। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা, জাতিসঙ্ঘ, প্রচলিত ধ্যানধারণা ৯৯ ভাগ মানুষকে শোষণ করে। সমাজতন্ত্র এসেছিল মানুষের মুক্তির কথা বলে, কিন্তু পারেনি। মাত্র এক শ’ বছরের মধ্যেই সমাজতন্ত্রের ধারণা ভেঙে পড়েছে। হাজার বছরের পুঁজিবাদ ও শত বছরের গণতন্ত্র এখনো টিকে আছে। কারণ এর চেয়ে ভালো কিছু মানবজাতি আবিষ্কার করতে পারেনি। তাই ল্যাংড়া-লুলা গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদ টিকে আছে। বিশ্ব অর্থনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছে। অকুপাই আন্দোলন তারই পূর্বাভাস। বিশ্বের মানুষ বুঝতে পেরেছে জগৎটা এভাবে চলতে পারে না। আমাদের দেশের অবস্থাও ওই একই রকম। পাকিস্তান আর বাংলাদেশ মিলিয়ে ৬৪ বছর পার হতে চলেছে। এই ৬৪ বছরেও সাধারণ মানুষের ভাগ্যের তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। এখন অশিা, দারিদ্র্য, অজ্ঞানতা প্রবলভাবে বিরাজ করছে আমাদের দেশে। যে কারণে পাকিস্তান থেকে আমরা মুক্তি লাভ করেছি সে কারণগুলো এখনো দূরীভূত হয়নি। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী আর বাংলাদেশের শাসক গোষ্ঠীর মাঝে তেমন কোনো ফারাক আমি দেখতে পাচ্ছি না। শুধু পতাকা আর জাতীয় সঙ্গীতের পরিবর্তন হয়েছে। ৪০ বছর পরও আমরা স্বাধীনতার ঘোষণা, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা, একুশের চেতনা, স্বাধীনতার চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে ব্যস্ত আছি। আর কত দিন এ অবস্থা চলবে তা শুধু আল্লাহ তায়ালাই জানেন। আওয়ামী লীগের নেতারা নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের সোল এজেন্ট মনে করেন। দেশের স্বাধীনতার জন্য আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কেউ কিছু করেনি। দেশের মানুষের সুখশান্তি বাড়ানো আওয়ামী লীগের এজেন্ডা নয়। এই দলের প্রধান অ্যাজেন্ডা হলো মামলা আর হামলা। ক’দিন আদালত বলেছেন, অমুককে দেশ থেকে বের করে দাও। এখন আওয়ামী নেতারা বলছেন, অমুককে যুদ্ধ করে দেশ থেকে বের করে দেয়া হবে।
সংবাদপত্রের রিপোর্ট দেখিয়ে আদালত চলছে। যা ছাপা হলো তা নিয়েই মামলা হচ্ছে। আদালত তা আমলে নিচ্ছেন। মুখের কথায় ইতিহাস রচনা হচ্ছে। রাস্তাঘাটের ভাষণ ইতিহাস হয়ে যাচ্ছে। এমনি করে ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে শত শত বই প্রকাশিত হচ্ছে। শুনে শুনেও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচিত হচ্ছে। এমন মুক্তিযোদ্ধার সাথেও মাঝে মাঝে দেখা হয়, যিনি মুক্তিযুদ্ধের কথা দাদার কাছে শুনেছেন। তখন আপনার বয়স কত ছিল? উত্তর চার-পাঁচ বছর। তাহলে? তাহলে আর কিছু নয়। আমি দাদার কাছে শুনে শুনেই মুক্তিযোদ্ধা হয়েছি। এভাবেই ইতিহাস রচিত হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের কোনো তথ্য-উপাত্তের প্রয়োজন নেই। শুধু চাই চেতনা ও আবেগ। তাই কেউ বলেন ৩০ লাখ, আর কেউ বলেন তিন লাখ। কেউ বলেন, বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ ঘোষণা দিয়েছেন। আবার কেউ বলেন, মেজর জিয়া ঘোষণা দিয়েছেন। আদালত রায় দিয়েছেন, বঙ্গবন্ধুই ঘোষণা দিয়েছেন। শুধু রাজনীতির কারণেই সংবিধানে ধর্মনিরপেতাও আছে আবার রাষ্ট্রীয় ধর্ম ইসলামও আছে। সমাজতন্ত্রও আছে, আবার মুক্ত অর্থনীতিও আছে। আওয়ামী লীগ বলে, আমরা ভাষাভিত্তিক জাতি ও রাষ্ট্র। আর আরেক দল বলে, আমরা একটি ভৌগোলিক রাষ্ট্র।
শুধু ভাষার কারণেই আমরা স্বাধীন হইনি। শুধু ভাষার কারণে পশ্চিম বাংলা একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠন করতে পারেনি। পশ্চিম বাংলার বাঙালিরা ধর্মীয় কারণে দিল্লির অধীনে রয়ে গেছে। আর মুসলমান হয়েও পাকিস্তানের সাথে থাকতে পারিনি। শুধু ভাষার কারণে হলে অখণ্ড বঙ্গদেশ একটি আলাদা রাষ্ট্র হতে পারত। আবার হায়দরাবাদ মুসলমান হয়েও স্বাধীন রাষ্ট্র হতে পারেনি। কাশ্মির স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে। মেজরিটি মুসলমানের কথা বলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলেও শাসকেরা শোষকে পরিণত হয়েছিল। প্রমাণিত হয়েছে, শুধু ভাই বলে ডাকলেই চলবে না, ভাইয়ের স্বার্থ রা করতে হবে। বাঙালি মুসলমানেরা নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্যই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছে। বাঙালি মুসলমানদের ল্য ও আশা ছিল সিঙ্গাপুর বা মালয়েশিয়ার মতো একটি দেশ প্রতিষ্ঠা করার। কিন্তু দেশের মানুষের সে আশা ও ল্য পূরণ হয়নি। এখন যারা রাষ্ট্র চালান তাদের সাথে পাকিস্তানি বা বিশ্বের কোনো শোষকের ফারাক নেই। দেশের মানুষ বিশ্বাস করে এ দেশটি বিশ্বের একটি উন্নত দেশ হতে পারত। সততা এই দেশ থেকে বিদায় নিয়েছে। দুর্নীতিতে দেশটা ভরে গেছে। সব রাজনৈতিক নেতাই দুর্নীতিতে অংশ নেন, এটা দেশের সাধারণ মানুষের বিশ্বাস। দুই প্রধান রাজনৈতিক দল বা জোট একে অপরের বিরুদ্ধে লেগে আছে। তাদের খিস্তিখেউরের কথা এখন নিয়মিত খবরের কাগজে ছাপা হচ্ছে আর টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হচ্ছে। সত্য কথাও দেশ থেকে দ্রুত বিদায় নিচ্ছে। সত্যকথা এখন কেউ প্রচার করে না। সত্য কথা এখন কেউ লিখতে চান না। দেশের লেখক বুদ্ধিজীবী সাংবাদিকেরা দুই ভাগে বিভক্ত। এমন অবস্থা এই উপমহাদেশে কোথাও নেই। বহু পত্রিকা, ম্যাগাজিন ও টিভি চ্যানেল রয়েছে যারা দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে লিখছেন বা বলছেন।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, মুক্তিযোদ্ধাসহ সব কিছুই বিভক্ত। কোনটা সত্য বা তথ্য এখন আর বোঝার উপায় নেই। আমরা যারা পুরো সত্তর-একাত্তর সাল দেখেছি নিজের চোখে দেখেছি, এখন চার দিকের কথা শুনে মনে হয় কিছুই দেখিনি। অথবা যা দেখেছি তা ভুল দেখেছি। তিরিশ বছর আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ভিয়েতনাম আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছে। দেশের উন্নতি বা উন্নয়নের ব্যাপারে সেখানে সব দল ও মত একাট্টা। বুদ্ধিজীবীরা একবার ভিয়েতনাম ঘুরে দেখে আসতে পারেন। ভিয়েতনামের একসময়ের প্রধান শত্রম্ন আমেরিকা এখন ভিয়েতনামে বিনিয়োগ করছে। দেশবাসীকেও আমি আহ্বান জানাব গভীরভাবে ভাবুন, আমাদের সমস্যা কোথায়। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেমন যেন গৌরবের সাথে বললেন, মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী বিদেশীদের তালিকায় কোনো পাকিস্তানি নেই। আমার বিশ্বাস, তিনি নিশ্চয়ই জানেন ১৯৭১ সালে বহু পাকিস্তানি রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবী বাঙালিদের সমর্থন করে জেলে গেছেন। অনেকেই কলমের মাধ্যমে বিশ্বজনমত সৃষ্টি করেছেন। এমন হীনম্মন্যতা আর কোথাও দেখিনি। ৫০ ও ৬০ দশকে আমরা গণচীন ও আমেরিকার সম্পর্ক দেখেছি। আজ আমেরিকার প্রধানতম বাণিজ্য বন্ধু। বড়ই বেদনার বিষয় আমরা দীর্ঘ ৪০ বছরেও পাকিস্তানের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে পারিনি। এর কারণ আমরা দেশের স্বার্থ রা করতে চাই না। একশ্রেণীর রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবী আছেন, যারা বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী বিদেশীদের ইশারায় চলেন, বলেন ও লেখেন। এরা একধরনের বিদেশী স্বার্থের দালাল এবং নিজ দেশের শত্রম্ন।
আমরা সংবাদপত্রের রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে ইতিহাস রচনা করতে চাই। আমরা শুধু বিজয়ীর কথা শুনতে চাই। আগেই বলেছি পত্রিকার রিপোর্টের ওপর নির্ভর করে আমাদের দেশের বিচার শুরু হয়েছে। ১৯৭১ সালে সব সংবাদপত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের দুষ্কৃতকারী বলা হতো। কারণ ওটাই ছিল সরকারি ভাষা। শুনেছি সমকালে নাকি ইতিহাস সৃষ্টি করা যায় না। কারণ সময় বা কাল নাকি ইতিহাসকে প্রভাবান্বিত করে। বিটিভিতে একটি ফিচার প্রচার করা হয়েছিল ফতুল্লা জায়গা বা শব্দটার ওপর। টিভি রিপোর্টার বলেছিলেন, শাহ ফতেহ উল্লাহ সিরাজীর নামে জায়গার নাম ফতুল্লা হয়েছে। বিষয়টা জানার জন্য আমি উপমহাদেশের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ড. আবদুল করিমের দ্বারস্থ হয়েছিলাম। তিনি উত্তর দিলেন, ওসব পত্রিকা বা টিভির কথা। ওসব কথা দিয়ে ইতিহাস রচনা হয় না। ওসব কথা ইতিহাসবিদদের প্রভাবান্বিত করে না। তিনি জানালেন, শাহ ফতে উল্লাহ শিরাজী কখনোই ঢাকা আসেননি। যেমন ধরুন, রাম-রাবণের কথা। এটা ইতিহাস না মহাকাব্য, তা আজো নির্ধারিত হয়নি। যদি ইতিহাস হয়, তাহলে রাম ও রাবণ রক্ত-মাংসের মানুষ ছিলেন। কিন্তু আমরা তা শুনতে রাজি নই। তাই রাম আজ দেবতা ও পূজনীয়। রাবণ একজন রাস। রাম বিদেশী আর্য রাজা। আর রাবণ এ দেশেরই সন্তান ও রাজা। কিন্তু যুদ্ধে পরাজিত হয়ে রাস হয়ে গেছেন।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আবেগে ভরা বহু বই প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশে গবেষণামূলক কোনো বই বের হয়নি। সত্য তথ্য নিয়ে কেউ এখনো কাজ করেননি। আর আমরা সত্য ঘটনা জানতেও চাই না। আমরা একবার বলি বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। আবার বলি তার ৭ মার্চের ভাষণই স্বাধীনতার ঘোষণা। রাজনৈতিক কারণে আমরা নানা ধরনের গল্প বানিয়ে চলেছি। আমি নিজেও ১৯৭০-৭১ সালের ঘটনাবলির একজন প্রত্যদর্শী। কিন্তু একজন শুধু দর্শীর দেখা ঘটনাবলি ইতিহাস রচনার জন্য যথেষ্ট? না, যথেষ্ট নয়। যিনি যেমন দেখেছেন তেমন করে লেখা অনেক বইতে বেরিয়েছে। কিন্তু সঠিক ইতিহাস কি তৈরি হয়েছে? মুক্তিযুদ্ধের দলিলে আমরা যা পড়েছি আর রাজনীতিকদের মুখে যা শুনি তাতে কোনো মিল নেই। মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর তৈরি হয়েছে। কিন্তু কোনো ইতিহাসঘর তৈরি হয়নি। নিজের ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনার বিশ্লেষণ করেন। যেমন ধরুন, মেনন আর মতিয়া রাজনৈতিক কারণে আলাদা ছিলেন, এখন আবার রাজনৈতিক কারণে এক হয়েছেন। এবার পাঠক নিজেই ব্যাখ্যা করুন কেন তারা আলাদা ছিলেন, আর কেনই বা তারা এক হলেন। যেমন ধরুন, আলবেরুনি রচিত ভারত তত্ত্ব এক হাজার বছর আগে আরবি ভাষায় লিখিত একটি ইতিহাসের আকর গ্রন্থ। সব ইতিহাসবিদই এই
পুস্তককে মানেন ও গুরুত্ব দেন। কেউ বলেন না তিনি মুসলমান ছিলেন বা আরবীয় ছিলেন। ভারত তত্ত্ব নিয়ে কেউ কখনো দ্বিমত করেননি।
প্রখ্যাত বাঙালি নেতা সুভাষ বসুর বংশীয় মেয়ে শর্মিলা বসু আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি গবেষণা পুস্তক রচনা করেছেন। এই বইটি ইতোমধ্যে বহুল আলোচিত হয়েছে। বিদেশে বাঙালিরা তাকে ধাওয়া করেছে। ইতোমধ্যে বইটির বাংলা অনুবাদও বেরিয়েছে। শর্মিলা বসুর এই বইটি মূলত একটি গবেষণাধর্মী বই। তিনি ১৯৭১ সালের ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট সব মহলের সাথে কথা বলেছেন। তিনি বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান সফর করেছেন তথ্যউপাত্ত সংগ্রহ করার জন্য। মুক্তিযুদ্ধের সোল এজেন্ট বলে বহুল পরিচিত প্রধান প্রধান চরিত্রের সাথেও তিনি কথা বলেছেন। তাদের কথা বইতে প্রকাশ করেছেন। শর্মিলা বলেছেন, বাংলাদেশে তিনি সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা পেয়েছেন। স্বপ্রণোদিত হয়ে অনেকেই তথ্য দিতে এগিয়ে এসেছেন। সবাই সব সময় নিজের ঢোল পেটাতে চেয়েছেন। একসময় তিনি তথ্যের ভারে কান্ত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু তিনি দলিল ও প্রমাণ সহকারে তেমন বেশি তথ্য পাননি। সবার কথায় আবেগ রয়েছে। প্রতিপরে ব্যাপারে ঘৃণা ও ােভ রয়েছে। পুরো বই নিয়ে এটা আলোচনার জায়গা নয়। সময় ও সুযোগ মতো অন্য কোথাও আলোচনা করা যাবে। শর্মিলার বই পড়ে বোঝা গেল ৩০ লাখ বিষয়টা একটা আবেগের প্রকাশ। ৩০ লাখ অঙ্কটি কেউই সমর্থন করেননি। বাংলাদেশেও সরকারিভাবে মুক্তিযুদ্ধে বা ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে শুরু করে ১৯৭২ সালের মার্চ পর্যন্ত উভয় পরে কত লোক নিহত বা শহীদ হয়েছে তার কোনো তথ্য বা সংখ্যা প্রকাশ করা হয়নি। কেন কোনো সরকারই এ কাজটি করেনি তা একেবারেই বোধগম্য নয়।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক
ershadmz40@yahoo.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন